প্রবন্ধ
অতীত-কথন
শাহীনুর ইসলাম
অতীত নিয়ে আমরা অতি বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করি। এর অন্যতম কারণ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। যে টুকু জানি তাও প্রায় সময় নির্দিষ্ট সমীকরণ মেনে চলে না। ফলে ভবিষ্যতের কোনো ঘটনা যখন বর্তমানে এসে ঘটে এবং তা আমাদের সমীকরণের সাথে না মেলে, তখন আমরা তাকে বলি ‘অঘটন’ কিংবা ‘দূর্ঘটন’। কিন্তু দূর্ঘটনও ঘটে কার্যকারণের নিয়ম অনুসরণ করেই; শুধু আমাদের প্রত্যাশার সাথে মেলে না, এই যা। আর যেহেতু ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়, তাই অতীত নিয়ে মেতে থাকা ছাড়া, অতীতের ঘটে যাওয়া প্রপঞ্চের নানান ধরনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে বর্তমানের সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে মিলিয়ে দেখা ছাড়া ভবিষ্যতের এই খাঁ খাঁ করা বিরান প্রান্তরে আমাদের নিজেদের বড় অসহায় ও নিরালম্ব মনে হয়। সাঁতার না জেনে সাগরে ডুবে যাওয়ার মতো ফাঁপর বলে মনে হয়। অতীতের অর্জিত জ্ঞান হচ্ছে ভবিষ্যতের অকূল পাথারে সাঁতার জানার মতোই ব্যাপার। তা কিছুটা হলেও আমাদের সাহায্য করে; কিছুক্ষণ জীবন-লীলা অবলোকন করার অবকাশ যোগায়, যদিও অত বড় সাগরে তা অতি সামান্যই অবলম্বন। তবুও তাই নিয়ে আমাদের জীবন-যাপন; কারণ গত্যন্তর নেই।
কালে কালে মানুষ মহাকালের অমোঘ সব নিয়ম উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। যেমনটা আর্কিমেডিস, কপারনিকাস, গ্যালিলিও, স্যার আইজ্যাক নিউটন, আইনস্টাইন প্রমুখ বিজ্ঞানী এবং সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টোটলসহ নানা ধরনের দার্শনিক করে গেছেন। অতীতের সেইসব অমোঘ নিয়ম ও সূত্রাবলী আমরা বর্তমানে কাজে লাগাই ও ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হই। আমাদের এ কালের কোনো মহান ব্যক্তি তাঁর সৃষ্ট অমোঘ নিয়ম আবিস্কার করে আবার আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং সেই সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জীবন-পারাবারে বাতিঘর হয়ে থাকবেন।
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকার দরুন আমরা প্রায়শই অতীতচারী হয়ে থাকি এবং অতীত স্মৃতি রোমন্থনে এক প্রকার সুখ লাভ করে থাকি। এই স্মৃতিবিহ্বলতা বা স্মৃতিকাতরতা বেশি কাজ করে বয়স যত বাড়তে থাকে। তখন আমরা বর্তমানের সাথে অতীতকে মেলাই; আর সে বর্তমান কালিক তো বটেই, স্থানিকও হতে পারে। ‘স্থানিক’ বলতে একই জায়গার বর্তমান ও অতীত না হয়ে বরং ভিন্ন ভিন্ন জায়গাকে বুঝিয়েছি। যদি স্থানিক বর্তমান কখনো কিছুটাও মেলে সেই ফেলে আসা অতীতের সাথে, তবে মরুতে এক আঁজলা জলের দেখা পাওয়ার মতো তাৎক্ষণিক আনন্দ পেলেও সেই সাধ, রূপ, রস, গন্ধ আর খুঁজে পাই না। ফলে বর্তমানের ইন্দ্রিয় বিলাসের চেয়ে অতীত প্রায়শই এত মধুর হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। এর আরেকটি কারণ বোধ হয়—বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোও ভোঁতা হয়ে যায়। ফলে শৈশব বা কৈশোর বা তারুণ্যের সেই ক্ষিপ্রতা, সজীবতা ও জোশ নিয়ে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় সেই মতো কাজ করে না। শৈশবের সেই প্রথম দেখা মানুষ-ফুল-পাখি-পরিপার্শ্ব মনে যে স্থায়ী ছাপ ফেলে তা জীবনের আর কোনো স্তরে দেখা যায় না। বয়সের এ স্তরে—জন লকের ভাষায়—মস্তিকের ‘সাদা কাগজ’ এ আমাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রথম ছাপ পড়ে। এ জীবনে বুদ্ধি হওয়ার পর যা কিছু প্রথম তা সাধারণত কখনো ভোলা যায় না। পরবর্তী জীবনে আরো বেশি অভিজ্ঞতা, রূপ-রস-গন্ধ লাভ করলেও শৈশবের প্রথম প্রত্যক্ষণের কাছে তা তুচ্ছ। তবে হ্যাঁ, জীবনের নানা অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সেই সাধ, সেই রস লাভ না করলেও এক প্রকার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় লব্ধ হই বটে, যা শুধু বয়স বাড়ার সাথেই অর্জিত হয়।
তবুও কথা থেকে যায় যারা নতুন ধারণা, চিন্তা-চেতনা, পরিপার্শ্ব, প্রজাতিকে গ্রহণ করার মানসিকতা রাখেন, তারা অবশ্য চিরদিনই সজীব ও যুবাবয়সী। নতুন সব কিছু তাদেরকে যেমন সমানভাবে পুলকিত করে, তেমনই অতীতের প্রথম প্রত্যক্ষণের অভিজ্ঞতাও তাদেরকে সমানভাবে নাড়া দেয়।
সমবয়সীদের যতই তিরোধান ঘটে কিংবা তারা যতই দূরে চলে যায়, অতীত ততই নতুন সুর-ছন্দে বেজে ওঠে। সেসব স্মৃতি তখন বর্তমান প্রজন্মকে শুনিয়ে সান্ত্বনা ও স্বস্তি লাভের চেষ্টা চালানো হয়। এ জন্য বয়সের এক পর্যায়ে বাঁচাল নামে অভিহিত হতে হয়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম প্রায়শই তাতে বাধ সাধে; সেসব কথা শোনার ধৈর্য ও স্থৈর্য তাদের হয় না। তখন নিঃসঙ্গতা আরো জেঁকে বসে। উবু হয়ে বসে একা একা অতীত রোমন্থন করা ব্যতিরেকে কিছুই করার থাকে না। এর মধ্যে যদি বা অতীতের কাউকে মেলে তখন মন খুলে কথা বলে মন ভরে তৃপ্তি পাওয়া গেলেও জীবনের নানা আয়োজনে তাকে সাধারণত সে সঙ্গ ত্যাগ করতে হয়।
তাই বলে কি অতীত অগ্রাহ্য ও বর্জনীয়? না, তা কেউ স্বীকার করবেন না নিশ্চয়ই। মাটির মমতা রসের মতোই অতীত যেমন অত্যন্ত গোপনে কাজ করে যায় যা সচেতন ও সতর্ক না হলে কখনো উপলব্ধি করা যায় না কিংবা নিয়তি নিতান্ত বাধ্য না করলে গুরুত্ব বোঝা যায় না, তেমনই অতি গোপনে ও সন্তর্পণে অতীত তার প্রাপ্য পেয়ে থাকে। অতীত থাকে বর্তমানের জড়ায়ুতে, অস্থিতে, মজ্জায়। সে কারণে তার মহিমা বোঝা আমাদের কাছে এমনিতে দায় হয়ে পড়ে। অনেক চিন্তা-ভাবনা ও সচেতন প্রয়াসের পরই মাত্র তা পরিলক্ষিত হয়। এর একটা বিপদ হলো সামগ্রিক বা সামষ্টিক চেতনার অভাব। যেহেতু সচেতনতা ও চিন্তা-ভাবনার পরই অতীত আমাদের কাছে মহিমান্বিত হয়ে ধরা দেয়, সেহেতু সবার চিন্তা-চেতনায় তা এক সাথে দেখা যায় না। অতীত ঝর্ণা ধারার মতো, ফল্গু ধারার মতো আমাদের শুধু দিয়েই যায়; কিন্তু তার প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ত না হওয়ার দরুন তা অতি গোপনেই থাকে। অতীত খুব বেশি অতীতচারী।
আমাদের যত প্রিয়জনই হোক না কেন, মৃত্যুর পর তাদেরকে আমাদের সচেতন প্রয়াসে মনে করতে হয়। নিকটবর্তী হলে যদিও তত প্রয়াসের প্রয়োজন পড়ে না, তবুও সুদূর হলে স্মরণ করিয়ে দেয়ার মতো কোনো উদ্দীপক লাগে। অতীতের অবদানও তেমনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের মনে পড়ে না; কোনো কিছু দিয়ে মনে করাতে হয়। তখন অবশ্য ক্ষণকালের দান হলেও অতীত তার প্রাপ্য পায়। আমরা যখন চেয়ারে বসে কোনো কাজ করি কিংবা কোনো অনুষ্ঠান দেখি, তখন চেয়ারের কথা আমাদের মনে থাকে না। কিন্তু চেয়ারটি কোনো কারণে নড়বড়ে হলে কিংবা কোনো ত্রুটির কারণে বসা অবস্থায় সমস্যা হলে আমাদের মনোযোগ পুরাদস্তুর চেয়ারটির দিকে চলে যায়। এই চেয়ারটিই অতীত, আর যা করছি বা দেখছি তা বর্তমান এবং এই বর্তমান যে স্বপ্ন বা চেতনা কিংবা কোনো ভাবনা জাগায় তা ভবিষ্যৎ–যার কথা আমরা প্রায়শই ভাবি। অবশ্য তাই করা উচিৎ। নইলে অগ্রগতি, সমৃদ্ধি কিংবা আমরা যাকে বলি ‘সম্মুখ যাত্রা’ তা সম্ভব হতো না। ফলে ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনাও ব্যাহত হতো। যে ব্যক্তি বা জাতির অতীত যত সমস্যাপূর্ণ সে ব্যক্তি বা জাতির অগ্রযাত্রা ততই বাধাগ্রস্ত হয়। হ্যাঁ, আমরা ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রায় অংশ নেবো, কিন্তু অতীতের অবদান ভুলে যাওয়াটা অকৃতজ্ঞতা ও আত্মবিনাশের নামান্তর। ভবিষ্যতের দিকেই অগ্রসর হবো, কিন্তু অতীতকে সাথে নিয়ে বর্তমানের হাত ধরে যাবো। এতে বর্তমানের গতি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও তাতেই সবার মঙ্গল। আর সবার মঙ্গল করতে গেলে অর্থাৎ সবাইকে নিয়ে একসাথে এগুতে হলে গতি কিছুটা শ্লথ হওয়াই স্বাভাবিক।
অতীতের প্রাপ্যকে স্বীকার করা মানে বর্তমানের হাত ধরে ভবিষ্যতের পথকে মসৃণ করে বেগবান হওয়া। তখন অতীত ততটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না যতটা আগাম ভাবা হচ্ছে। অতীত তখন থাকবে দৃঢ় ও নিরাপদ একটি চেয়ারের মতো, যার উপর বসে ভবিষ্যতের সকল কাজ আয়েসে সমাধা করা যাবে।
অতীতে থাকে জীবন নির্যাস, বর্তমানে জীবন-যাপন, আর ভবিষ্যতে থাকে জীবন-বীজ। অতীতের সেই নির্যাস বর্তমানে আমরা পান করবো ঠিকই, তবে ভবিষ্যতের নতুন জীবন-বীজকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে নয় অবশ্যই। সেই জীবন বীজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা বর্তমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বীজ খারাপ হলে যেমন ফসল ভাল হয় না, তেমনই বর্তমানের জীবন-যাপনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য যে বীজ আমরা রোপণ করবো ভবিষ্যৎ ঠিক তেমনই ফসল এনে দেবে। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কোনোটা ছেড়ে কোনোটা নয়। এদের আনুপাতিক সমন্বয় প্রয়োজন; আর তা ব্যক্তিগত জীবনেই হোক কিংবা সমষ্টিগত জীবনেই হোক।
অতীত যদি জীবনের ভিত হয়, তাহলে যে ভিত যত বেশি সুদৃঢ় সে ভিত তত বেশি সম্ভাবনাময়। আর সে সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে অতীতের চলমানতা প্রয়োজন, শুধু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখলে চলবে না। আবার কাজ না করে সোনালি অতীত নিয়ে শুধু গর্ব ও অহংকার করলেই অন্য কেউ এসে ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে না। তাতে কেবল দুঃখ ও হতাশার অথর্ব পাল্লাখানিই ভারী হবে।
Be the first to comment