জায়ফল

গল্প




 

জায়ফল

-শাহীনুর ইসলাম


‘আমি তুই না, তুই আমি না। আবার আমার মধ্যেও হাজারটা আমি বাস করে’। খুব ভোর বেলায় বালুচরে হাঁটতে হাঁটতে দার্শনিকের মতো কথাগুলো বলেন আইজার মাস্টার তার একান্ত অনুগত জমশেদকে। জীবনের তো আর বেশিদিন বাকি নেই। কাজেই শেষ দিনগুলোতে ভোরের এই বিশুদ্ধ হিমেল হাওয়া, মেঠো পথ জুড়ে বালুমাখা, ভেজা ঘাস ও সূর্যের প্রথম কিরণমালার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত থাকতে চান না তিনি। এটা এখন তার রোজকার অভ্যাস।

দশ বছর ধরে শখানেক লোকের বসত করা, মূল ভূখণ্ড থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন এবং অন্যান্য চরের তুলনায় খানিকটা নতুন এই রায়দাসবাড়ি চর এলাকায় আইজার মাস্টারের একান্ত আপন বলতে ঐ জমশেদই। অনেকেই যখন তার চিন্তা-ভাবনাকে পাগলামি ভেবে বিরক্ত হয় সেখানে জমশেদ সব না বুঝলেও মনোযোগ দিয়ে শুনে যায়। বুড়োদের কথা তরুণরা শুনতে চায় না। অথচ এ বয়সেই যত কথা মনের গুদামে ভর্তি হয়ে থাকে। জীবনের এত কথা, অভিজ্ঞতা শোনানোর যে অন্তত একজন মানুষ পেয়েছেন তাতে আইজার মাস্টারের অনেকটাই স্বস্তি। এছাড়া জমশেদের আনুগত্যও তার ভাল লাগে। তাই ভাল লাগা, মন্দ লাগা, নানান চিন্তা-ভাবনা তার সাথেই শেয়ার করেন। তবে নিজের দুঃখের ব্যাপারে কদাচিৎ মুখ খোলেন।

জমশেদ যেন হারিয়ে যায়। চেনা ভাষার কথা অনেক অচেনা লাগে তার কাছে। কিছু না বুঝলে প্রশ্ন করতে সে ছাড়ে না। সবাই মাস্টার বললেও জমশেদ তাকে ওস্তাদ বলেই মানে। তবে কেন বলে সেটা নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের হারানো সূত্রের মতোই একটি সূত্র। আবার জমশেদ কবে কীভাবে আইজার মাস্টারের এত অনুগত হলো সেটাও কেউ স্পষ্ট করে জানে না যদিও তাদের পরিচয় এই চরের বয়সের সমান।

কেউ কেউ বলে আইজার মাস্টার তাকে নদীর ধারে অচেতন অবস্থায় পেয়েছে। কেউ বলে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে অসহায় অবস্থায় মাস্টারের কাছে সাহায্য চাইলে তিনি তাকে আশ্রয় দেন। আবার কেউ বলে আইজার মাস্টারই তাকে নিজের প্রয়োজনে এনে রেখেছেন। এ বিষয়টা নিয়ে যে এত জল্পনা তার কারণ এ ব্যাপারে তাদের কেউ-ই কাউকে কিছু বলেনি এবং বলতেও চায় না। তবে জমশেদ যে আশপাশের কোনো চর এলাকা থেকে আসেনি সেটা তার ভাষায় প্রকাশ পায়। সে কারণে তার কথা প্রথম যারা শোনে তারা কিছুটা আড় চোখে তাকায় তার দিকে।

চরের শেষ সীমানার ঘরটিতে সে তার বউ, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে থাকে। অন্য কারো সাথে খুব কমই মেশে তার পরিবার। প্রশ্ন করার অভ্যাসবশত ওস্তাদের অদ্ভূত ভাবনার প্রতিক্রিয়া জানায় সে,

-কী যে কন না ওস্তাদ! প্রথম দিকটা বুইঝবার পারছি। মুই জমশেদ, আপনে ওস্তাদ, জ্ঞানী মানুষ। মাগার মোর মইদ্দে ক্যামনে হাজারটা মুই থাকে?

-সেটা তোকে আরেক দিন বলবো। এই সাত সকালে তোর মাথাটা খারাপ করতে চাই না আমি। তুই কি জানিস আজকে একটা বিশেষ রাত আছে?

-আপনের সব বিশেষ দিন, বিশেষ রাত, (‘শেষ রাতের কথা’ এটুকু মনে মনে আওড়ায় চাপা হাসি হেসে)মুই জানি।

-এই না হলে যোগ্য শিষ্য। এর জন্য যা যা লাগবে তা আছে কিনা চেক করেছিস তো?

– সেটা মুই গতকালকেই করছি। খালি জায়ফল নাই।

-একটুও নাই?

-যেটুকুন আছে তাতে গোশতো নরম হইবে না, ওস্তাদ। নরম না হইলে আপনে তো চাবাইয়া খাইতে পাইরবেন না। আর গরুর গোশত তো কেনা লাগবই।

-ঠিক আছে। আজকে তো হাটবার। আর রাতে মাঘী পূর্ণিমা। কাঁইয়ার হাটে যেতে হবে তাহলে। জোনাবালি মাঝিকে ঘাটে আসতে বলিস বিকেলে।

নদী পারাপারের জন্য এখানে নিয়মিত বিরতিতে কোনো খেয়া নেই পর্যাপ্ত মানুষ পারাপার না হওয়ার কারণে। তাই সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় খেয়ার যে মাঝি আছে সেও মাঝে মাঝে অনিয়মিত থাকে। এ কারণে নিজের যখন খেয়া পারের দরকার হয় তখন আইজার মাস্টার জোনাবালি মাঝিকে ডেকে পাঠান। এ মাঝির নৌকাটা আইজার মাস্টারেরই দেওয়া। নৌকা করে মাছ ধরে সে। মাঝে মাঝে ব্রহ্মপুত্রের একেবারে ওপারে বাহাদুরাবাদ ঘাট কিংবা দূরবর্তী চর যেমন- মোল্লার চর, ছাতারকান্দি, খারজানি, কুন্দের পাড়া ইত্যাদি চরে ছুটা খেয়া পার করার জন্য যায়। আর আইজার মাস্টার যদি কোথাও ঘুরতে যেতে চান সেখানে নিয়ে যায়।

আইজার মাস্টারের মনে থেকে থেকে জীবনের নানা দার্শনিক ভাবনা উঁকি দেয়। সে কারণে জীবনের নিত্য প্রয়োজনকে ছাড়িয়ে বেশির ভাগ সময়ই সাধারণ ভাবনা বা দৃশ্যকে দার্শনিকভাবে প্রকাশ করেন জমশেদের কাছে। তাই প্রাতঃভ্রমণ শেষে ঘরে ফিরতে ফিরতে একটু দূরে তিনটা আবছা মানুষ দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করেন,

-ওরা কারা সাত সকালে ঘাটের দিকে যায়?

-কুঁইজা সোনাউল্লাহ, তার বউ আর হ্যাগো ছোট পোলা।

-ঠিক বললি না, জমশেদ। সোনাউল্লার পোশাকে হাহাকার হেঁটে যাচ্ছে। হাহাকারের ভারেই সে কুঁজা হয়েছে। সেটা হয়তো এখন আমাদের কাছে হাস্যরসের বিষয় হয়েছে। ওর বউটা হচ্ছে সমাজ এবং সমাজের প্রভাবে ব্যক্তিদ্বারা নিস্পেষিত প্রাণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা সে জানে না। সে শুধু জানে সব কপালের লিখন। আর ছোট ছেলেটা হচ্ছে অঙ্কুরে বিনাশিত ফল। এই সুন্দর জীবনটারে উপভোগ করার অধিকার সে জন্মের সাথে সাথেই হারিয়ে ফেলেছে। অথচ এক একটা মানব জীবন কী অমূল্য উপহার! এদের জন্য আমার খুব মায়া হয়। কিন্তু আমি এই বয়সে কী-বা করতে পারি? এরকম হাজার হাজার সোনাউল্লাহ পরিবার রয়েছে বাংলাদেশে।

-আপনের কথা মোর মাথায় ঢোকে না। তয় কানে লাইগা থাকে।

-কানে লেগে থাকলেই হবে। কোনো এক সময় ঠিকই মাথায় ঢুকবে। দেখিস না এই জীবনের সবকিছু আমরা কি একবারে শিখি? অনেক কিছুই আমাদের স্মৃতিতে জমা হয়ে থাকে, পরে কোনো এক সময় তা আমাদের বুঝ-এ আসে।

-ঠিক কইছেন, ওস্তাদ। মোর মনে পড়ে এক্কেবারে ছোটবেলায় দুষ্টামি করে মেলা পাখি গুলতি দিয়া মাইরা ফেলছি, বাসা থাইকা পাখির ছানা চুরি কইরছি। অহন নিজের যহন পোলাপাইন হইছে, তখন বুইঝবার পারি হ্যাগো লাইগা কী মায়া হয়।

এবার তারা দুজনে বাড়ি পৌঁছে যায়। জমশেদ গাভী দুটির জন্য খড় এনে দেয়, ধানের কুঁড়া ও লবণ মেখে পানি প্রস্তুত করে রাখে। দুধেল গাভীটাকে দোয়ায়। এরপর হাত-পা ধুয়ে ওস্তাদের জন্য গমের রুটি ও সুজি বানাতে কাজে লেগে যায়। অন্যদিকে এ সময়টায় আইজার মাস্টার সবজি ক্ষেত ও ফলের গাছগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন। শিম গাছের যে ডালটি মাচায় থাকবে না বলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে সে ডালটিকে বশে এনে মাচায় স্থাপন করেন। যে টমেটোগুলো বেশি পেকে গেছে এবং সে জন্য সেগুলোর জন্মদাত্রী গাছ আর তাদের ভার বহন করতে পারছে না সেগুলোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে আনেন। লাউ গাছের কিছু লোভনীয় লকলকে কচি ডালসহ পাতা ছেঁড়েন বোরেল মাছ দিয়ে শাক খাওয়ার জন্য। আর বরই গাছের বরইগুলো বেশ পোক্ত হয়েছে খেয়াল করে মনে মনে খানিকটা আনন্দ লাভ করেন। এ সময় জমশেদ ওস্তাদ বলে ডেকে সাবধান করে যে তিনি যেন আর ফলমূলের গাছ না লাগান। মানুষের জ্বালায় খেতেও পারেন না। বৃথাই শ্রম। আইজার মাস্টার তখন তাকে দূর থেকেই জানায়, গাছ লাগালে কেউ না কেউ তো খাবে। না লাগালে কেউ খেতে পারবে না, এমনকি পাখি-পোকামাকড়ও না। এটুকুই বা কম কিসে?

ঘন্টাখানেক এ রকম আরেকটু সময় ঘোরাফেরা করে তিনি ঘরে ফেরেন। ফিরে হাত-পা ধুয়ে নাস্তা করেন জমশেদসহ। এরপর দুধ-চা পান করেন। খেতে খেতে এবার সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং চরের কথা হয় তাদের মধ্যে। খাওয়া-দাওয়া শেষে জমশেদ ওস্তাদের জন্য দুপুরের খাবার তৈরি করে। বেলা তখন দশটা বাজে। এরপর উদ্বৃত্ত খাবারটুকু ব্যাগে ভরে চলে যায় তার নিজের সংসারে। আইজার মাস্টার তাকে বিকেলে আসতে বলে হাটে যাওয়ার কথা স্মরণ করে দিয়ে।

কোনো মানুষ যতই জ্ঞানী হোক কিংবা যতই আদর্শবান হোক তার মধ্যেও এমন দু’একটা অভ্যাস থাকে যা তার সাথে সাধারণ হিসেবে বেমানান। জীবনে হয়তো কিছু অসঙ্গতি থাকতে হয়। নইলে জীবন যে বড় সাদামাটা থেকে যায়। উপভোগের আনন্দটুকু থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আইজার মাস্টারেরও এমন একটা অভ্যাস আছে। ভোজন বিলাসী রোগ, বিশেষ করে পূণির্মা রাতে। এ রাতে তিনি গরুর মাংস দিয়ে পোলাও খান। গুরুপাক খাওয়ার পর যে ঝিমুনি আসে সেটা এবং চাঁদনি রাতের পরিবেশ মিলে যে নেশাগ্রস্ত অবস্থার সৃষ্টি হয় তা তিনি তার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি হিসেবে উপভোগ করেন। আগে বয়স থাকতে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই খেতে পছন্দ করতেন। এখন বয়স সেভাবে অনুমতি না দেওয়ায় প্রতিমাসে একদিন খান। তাই মাঝে মাঝে এ মসলা সে মসলা কখন যেন থাকে না। জমশেদ তা মনে করিয়ে দেয়। অশীতিপর এই লোকটির শরীর সায় দেয় না আর মুক্তভাবে চলাফেরা করার। তবু মাসে অন্তত একদিন হাটে যান। সেখানে প্রয়োজনীয় কিছু কেনার পাশাপাশি পুরাতন দু’একজন মানুষের সাথে দেখা হয়, পুরাতন স্মৃতির অলি-গলি হেঁটে হেঁটে তৃপ্তি পান।

জমশেদ চলে যাওয়ার পর তিনি শীতের শেষ দিনটার উষ্ণতা উপভোগ করেন ঘরের বাইরে সামনের টংয়ে বসে। পূব দিকের ব্রহ্মপুত্রের বিস্তীর্ণ প্রান্তর এখন কতই না সংকীর্ণ হয়ে গেছে। মৃতপ্রায়। ভরা মৌসুমে এর পানি এই টংয়ের পা ছুঁয়ে যায়। আর এখন প্রায় দেখাই যায় না। একদিন এই নদ ছিল এই ভিটা থেকে অনেক দূরে। একে দেখতে ছোটবেলায় তার বাবার সাথে যেতেন তিনি। তখন বালকের মন নিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখতেন উচ্ছল, দূরন্ত এ নদের বয়ে যাওয়া। আজ এই ভিটার পুনর্জন্মে সেই নদের বুকে তার বসবাস। তিনি এসব দেখছেন, ভাবছেন, আর চরের দু’চারজন চেনা মানুষ যাচ্ছেন তার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে। যাওয়ার সময় কুশল বিনিময় হয়। দু’চারটে কথা হয় চরের জীবনযাপন নিয়ে। তবে কেউ-ই বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। এভাবে বেলা একটার মতো বাজলে তিনি দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরের বিছানায় গা এলিয়ে দেন। হাতের কাছে থাকা দর্শন শাস্ত্রের একটা বই পড়তে পড়তে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন।

বেলা যখন প্রায় তিনটে বাজে তখন জমশেদ ফিরে আসে। ওস্তাদকে ঘুম থেকে জাগায় হাটে যাওয়ার জন্য। উঠেই জিজ্ঞেস করেন,

-জোনাবালিকে কি বলছিলি আসতে?

-হ, কইছি তো।হ্যার নাকি খারজানি চরে যাওয়ার কথা আছিল। আপনের কথা কওয়াতে কইলো, ‘সইন্ধ্যার আগেই আইসবে’।

-ভাল। এক কাজ কর। আমি তৈরী হয়ে নেই। তুই এর মধ্যে পিঁয়াজ-রসুন-মসলা বেঁটে রাখ।

-আইচ্ছা, ওস্তাদ।

জমশেদ মাংস ও পোলাও রান্নার মসলাদি কেটে-কুটে রেখে দেয়। এরপর আইজার মাস্টার যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে পর তারা দুজনে ঘর থেকে বের হয়। 

ততক্ষণে বেলা বেশ গড়িয়ে গেছে। চারিদিকে ভুট্টা ও কাউনের ক্ষেতকে ক্লান্ত সূর্যটা তার লাল দৃষ্টিতে এবার দিনের মতো শেষ দেখা দেখছে এবং সোনালি আলোর আলতো স্পর্শে ঘুম পাড়ানো চুমু দিচ্ছে। এ রকম সময় থেকে রাতের প্রথম প্রহর অবধি বাতাস নদীতে নিজেকে শীতল করে। এরপর তার ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় গ্রীষ্মের অসহ্য গরমে সবার দেহ-মন-প্রাণ শীতল করে দেয়। সে এক অনাবিল, বিশুদ্ধ শিহরণের ছোঁয়া। এ ছোঁয়া এখানকার মানুষদের পরের দিন কাজ করার শক্তি যোগায়। কিন্তু এখন মাঘ মাসের শেষ দিক। গরম নেই। দিনের বেলাতেই হিমেল হাওয়া।

ঘাটের দিকে জমশেদ যথারীতি আইজার মাস্টারের সাথে সাথে যায়। ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছালে আইজার মাস্টার এবারও সেই আবছা তিন মূর্তি খেয়াল করে। তখন তিনি প্রশ্ন ছোঁড়েন জমশেদকে,

      -কে রে ওরা?

      -কে আবার? আপনের হাহাকার, হ্যার পেঁষা বউ, আর হ্যাগো মুকুলে নষ্ট হওয়া ফল।

      আইজার মাস্টার এবার থমকে দাঁড়ান। প্রথমে বুঝতে পারেন না। কয়েক সেকেন্ড পরে বুঝতে পেরে একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলেন,

      -সব সময় কি এভাবে ভাবলে চলে?

      -আপনে না ঐভাবে কন!

      -তা ঠিক আছে। কিন্তু প্রথমে জাগতিক পরিচয়টা জানতে হয়। তারপর অন্যভাবে ভাবতে হবে। তা না হলে সব গোলমেলে হয়ে যায়।

আইজার মাস্টার মনে মনে ভাবে, দশ বছর আগের জমশেদ আর জমশেদ নাই। সে এখন অনেক কিছু শিখেছে। অন্যভাবে দেখতে শিখেছে। এটা নিজের কৃতিত্ব ভেবে এক টুকরো সুখ অনুভব করেন তিনি মনের মধ্যে।

এখন পারে নৌকা আসার সময় হয়েছে। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। কিন্তু জোনাবালি মাঝিকে দেখা যাচ্ছে না। যেদিক থেকে মাঝি সাধারণত নৌকা নিয়ে ঘাটে ভেড়ে সেদিকটায় জমশেদ ভাল করে কিছুক্ষণ তাকায়। না, দেখা যাচ্ছে না কোনো নৌকা। দেরি হচ্ছে দেখে একটু বিরক্ত হয় সে। ঘাট থেকে মুখ ফিরিয়ে রয় কিছুক্ষণ। দুজনে মিইয়ে পড়া আলোটুকুতে চরকে দেখছে। এর দশ মিনিট পর সূর্য যখন একেবারে ডোবার জন্য লাল হয়ে যায় তখন তার দিকে নজর রাখতেই হঠাৎ খেয়াল করে একটা নৌকা। তবে মাঝিকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। মাঝিই তখন হাঁক ছাড়লে তারা নিশ্চিত হয় এটা তাদেরই পারাপারের নৌকা।

মাঝি ঘাটে নৌকা ভেড়ালে তারা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারার আগেই সে নিজেই তার দেরি করার কৈফিয়ত হাজির করে যে সে খারজানি চর হয়ে এখানে এসেছে। কিছুটা অন্ধকার। চারদিকের নীরবতায় বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বিশ মিনিটের মধ্যে তারা ওপারে পৌঁছে যায়। মাঝি ঘাটে নৌকা বেঁধে রাখে। এরপর তিনজনই ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঁইয়ার হাটে দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছায়। আইজার মাস্টার জমশেদকে তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে মাংস এবং জায়ফল কেনার জন্য কিছু টাকা বের করে দেন। এরপর মাঝিকে সাথে নিয়ে হাটের চায়ের দোকানে গিয়ে বসেন। তিনি যাওয়া মাত্রই ওখানে বসে থাকা কিছু তরুণ ছোকড়া উঠে যায়। যারা বয়স্ক তারা থেকে যায়। চা-সিঙ্গারা, পুরি খেতে খেতে তাদের সাথে কিছুক্ষণ স্মৃতি রোমন্থণ চলে, চলে এপার ওপারের জীবনের টুকিটাকি সুখ-দুঃখের কথা। আলাপের মাঝখানে মাঝি উঠে যায় তার নিজের সংসারের বাজার করার জন্য। তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত আইজার মাস্টার আলাপ চালিয়ে যান উপস্থিতদের সাথে।

দু’ঘন্টা কেটে যায় হাটে। এবার ঘরে ফেরার পালা। মাঝি তাদেরকে ওপারে পৌঁছে দিয়ে নিজেও নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হয়। এ সময় চাঁদটা মোটামুটি তার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। এখনো পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। চাঁদনি রাতে বালুময় পথে জমশেদ টর্চলাইট জ্বেলে তার ওস্তাদকে সাহায্য করে ঘরে গিয়ে পৌঁছায়। তাড়াতাড়ি করে চুলা জ্বালিয়ে মাংস এবং পোলাও রান্না করা শুরু করে। আরও দু’ঘন্টা লেগে যায় সব রান্না শেষ করতে।

যদিও এখন রাত গভীর হয়নি—দশটার মতো বাজে—, তবুও গ্রামের রাত বলেই চারিদিকে জোছনার প্লাবন স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ জোছনার প্রধান শত্রু শহরের ঝলমলে আলোক বাতি এখানে নেই। শত্রু বলতে শুধু হালকা কুয়াশা যার মধ্য দিয়ে চাঁদটাকে খানিকটা আবছা দেখাচ্ছে। খড়ের ও টিনের ঘর, মাঝারি আকারের গাছপালা, সবজি ক্ষেত এবং পূর্ব দিকটা ফাঁকা থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের অল্প আবছা পানির মধ্যে দিগন্ত বিস্তৃত মায়াবি আলোয় চাঁদটাই শুধু আধিপত্য বিরাজ করছে। ফাল্গুনের আগাম হাওয়া বসন্তের অস্তিত্ত্বকে জানান দিয়ে যাচ্ছে ঠিক যেভাবে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মাকে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায়।

দুজনে এবার গরম গরম পোলাও-মাংস খেতে বসে। তবে জমশেদ শুধু এক টুকরো মাংস খায়। আইজার মাস্টার আরেকটু মাংস নিতে বললে সে ঘরে গিয়ে বউ-ছেলেমেয়েদের সাথে খাবে বলে উত্তর দেয়। খেতে খেতে জমশেদের থালা থেকে কয়েকটা পোলাও মাটিতে পড়ে যায়। এতে আইজার মাস্টার ভেতরে ভেতরে একটু বিরক্ত ও রাগান্বিত হন। জমশেদ তা বুঝতে পেরে নিজ থেকেই কৈফিয়ত দেয়,

-আপনের পাতে দিতে যায়্যা ব্যালেন্স রাইখবার পারি নাই। আইচ্ছা, তুইলা মোর পাতে নিতেছি।

একটু সংযত হয়ে এবং সৌম্যভাব বজায় রেখে আইজার মাস্টার শুধু বলেন,

-একটু সাবধানে কাজ করলেই তো হয়।

বিষয়টাকে এখানেই থামতে দিতে রাজি না কেউ। তবে দুজন দুদিক থেকে। তাই জমশেদ এবার খোঁচা প্রশ্ন দিয়ে,

-আইচ্ছা ওস্তাদ! দু’চাইরটা ভাত ওরকম মাটিত পইড়া গেলে কী এমন সব্বনাশ হয়?

-এটা সর্বনাশের কিছু না। হ্যাঁ, থালি ভরা ভাতও তুই ফেলে দিতে পারিস। তাতে কারো কিছু হবে না। কিন্তু তুই কি জানিস এই দুটা ভাত উৎপাদন করার জন্য একজন কৃষককে কত ঘাম ঝরাতে হয়েছে? সেই ঘামকে শ্রদ্ধা জানাতে শিখতে হবে আমাদের।

জমশেদ বুঝে যায় ওস্তাদকে আর বেশি খোঁচানো ঠিক হবে না। তাই এ ব্যাপারে আর কথা বাড়ায় না। এরপর খাওয়া শেষে তারা ঘরের বাইরে টংয়ে গিয়ে বসে। কিছুটা ঠাণ্ডা থাকায় জমশেদ কাঁথাও নিয়ে আসে। গা মুড়িয়ে আরাম করে বসে আইজার মাস্টার। জমশেদ একটা বেঞ্চি টেনে এনে সেখানে বসে পড়ে। এবার আইজার মাস্টার কোনো অদ্ভূত প্রশ্ন দিয়ে শুরু না করে খাওয়া সম্পর্কে প্রশংসাসূচক বাণী শোনায় জমশেদকে,

-আজকে পোলাওটা বেশ মজা হয়েছে, জমশেদ। গরুর গোশতগুলো বেশ নরম আর সুস্বাদু করে রান্না করেছিস। একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি আজকে। তুই যে আমার অবস্থা বুঝিস এটা আমি অনুভব করি।

জমশেদ তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দেয় না। একটু ভেবে বলে,

-মুই পাক করার যা যা জানি, হ্যার সবকিছু দিয়া পাক করছি। মেলা যত্তন কইরা করছি আইজকে।

কিছুটা নীরবতার পর জমশেদ নিজেই এবার অদ্ভূতভাবে শুরু করে কোনো এক সময়ে তাকে বলা একটা কথা দিয়ে,

-আইচ্ছা ওস্তাদ! আপনারে একটা কথা জিগাই?

-কী কথা?

-আপনে তো একদিন কইছিলেন জীবনের কুনো মাইনে নাই। তাইলে আমরা বাঁইচা থাকি ক্যান?

জমশেদ প্রশ্নটি করে পিঁপড়ার বাসাকেই যেন খোঁচা মারে। যেখান থেকে সারি সারি পিঁপড়া এলোমেলো পথে এদিক-সেদিক যেতে শুরু করে। আইজার মাস্টার সোৎসাহে উত্তর দেয়,

-বেঁচে থাকি কারণ মৃত্যুর অন্ধকারকে আমরা ভয় পাই। সব কষ্ট ভোগান্তি সত্ত্বেও এ জীবনকে অনেক সুন্দর লাগে। তারপরও জীবন আসলে অর্থহীন। এই যে আমাদের জীবন অর্থহীন এই বোধটাই আমাদের কষ্ট দেয়। অন্যান্য প্রাণীর সেই বোধটা হয়তো নেই। সেজন্য তাদের সেই কষ্টটাও নেই। তবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে করুণ দিকটা কী জানিস?

-ঐ যে কইলেন এই সুন্দর জীবনের কুনো মাইনে নাই।

-না, সেটাও না। সবচেয়ে অর্থহীন হলো এই সুন্দর জীবনকে নিজের ইচ্ছেমতো সুন্দর করে যাপন করতে না পারা। আমরা কেউ-ই একদিন ছিলাম না। সেটা তখন আমাদের কষ্ট দেয়নি। আবার একদিন থাকবো না। সেটাও তখনো কষ্ট দেবে না। কিন্তু যেটুকু সময় আছি, সেটুকু সময়ে নিজেদের চাওয়া পাওয়া অনুযায়ী বেঁচে থাকতে না পারাটাই চরম অর্থহীনতা। আর যে মানুষকে সঙ্গে করে এ জীবন ধন্য করতে চাই সেই মানুষের সাথে এই জীবন যখন না মেলে, যে প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যায় তাদেরকে যখন চাইলেও আর কাছে পাওয়া যায় না, যে ফুলের সুরভিতে প্রাণ ভরাতে চাই সেই ফুল যখন কাঁটা বেঁধে, যে নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী দেখে মনটা পুলকিত হয়ে ওঠে সেই দৃশ্যাবলী যখন দেখার সামর্থ্য হয় না তখনই এই জীবন চরম অর্থহীন হয়ে ওঠে।

কথাগুলো তিনি বলেন জীবনকে দার্শনিকতায় চিন্তা করতে ও প্রকাশ করতে পছন্দ করেন বলে, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি যেন হারিয়ে যাচ্ছেন স্বাভাবিক চেতনার জগৎ থেকে। কোনো এক দানবীয় শক্তি তাকে নিয়ে যাচ্ছে গভীর থেকে গভীরতর গহবরের দিকে। তিনি চেষ্টা করছেন ফিরতে সর্বশক্তি দিয়ে, কিন্তু কোনোভাবেই পারছেন না। বসা অবস্থা থেকে টংয়ের উপর শুয়ে পড়েন। নিজেকে প্রশ্ন করছেন, আজকে কি খুব বেশি খেয়ে ফেলেছেন? নাকি এসব শরীর আর সইতে পারছে না? পেটটাও যেন কেমন মোচড়াচেছ। তবুও এতদিনের অভ্যাস জীবনকে অন্যভাবে দেখার। এই ব্যথা বা অবশ অবস্থা কি তাকে থামাতে পারে? তিনি ছেড়ে ছেড়ে একটু বিড়বিড় করে প্রশ্ন করেন জমশেদকে,

-তোর কাছে এই জীবনটাকে কী মনে হয়?

জমশেদ এবার ওস্তাদের কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে কিছুটা অসংলগ্নতা খেয়াল করে। আর যখন তিনি শুয়ে যান তখন সে ভাবে জায়ফলের মাত্রাটা কাজে দিয়েছে তাহলে। সে তা উপেক্ষা করে মনে মনে সাফল্যের হাসি হাসে এবং উত্তর দেয়,

-আগে মনে হইতো জীবন মাইনে খাওয়া-দাওয়া, কাম-কাজ, ঘুম, বিয়ে-থা কইরা সংসার করা, আর পোলাপাইন মানুষ করা। আপনের লগে থাইকতে থাইকতে অহন মনে হয় জীবন মাইনে আরও অইন্য কিছু। জীবন হইলো চান্দের আলোর লাহান সুন্দর, সেই আলোতে শেওড়া গাছের লাহান রহস্যময়।

জমশেদের উপলব্ধিজাত এই বাক্যগুলো নিজের ব্যথা ও অবসন্নতার মধ্যেও আইজার মাস্টারকে চমকে দেয়। গরুর মাংস এবং পোলাও খেয়ে এতক্ষণ পর তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন এবং মুখে যথাসম্ভব আনন্দের ভাঁজ তুলে উচ্ছ্বাসভরে বলেন,

-এতদিন পরে তোর মুখ থেকে একটা সুন্দর কথা শুনলাম।

কিন্তু কুকুরছানা যখন মাতৃদুগ্ধ পান করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে, তৃপ্তির সে ডাক যে রাতের পিনপতন নীরবতায় শিয়ালের কানেই আগে পৌঁছায়।

জমশেদ এবার মনে মনে আওড়ায়, ‘আসল সুন্দরটা এট্টু আগেই দিয়েছি। অহন টের পাইবেন। কারণ আপনের কাছ থাইকা শোনা কথা এখন মোর কান থাইকা মাথায় আইছে। আপনের কথাই হাঁচা হইলো। মোর মইদ্দেও অহন হাজারটা মুই টের পাম। হাজারও মুইয়ের মইদ্দে যে মুইটাকে আপনে এ্যাদ্দিন দেহেন নাই সেইটা অহন দেহেন। জায়ফলের কুদরতি এইবার বুইঝবেন’।

জমশেদ ওস্তাদকে শুনিয়ে বলে,

– মুই এখন অন্য মুই যে, ওস্তাদ!

জমশেদের এ কথাটি প্রথমে আইজার মাস্টারের মনে অন্যের মধ্যে বোধ সঞ্চার করার সাফল্যস্বরূপ এক ধরণের আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু পরক্ষণে তা বটিতে মাছ কাটতে গিয়ে ঘচ করে আঙ্গুল কাটার মতো আঘাত হানে তার কলিজার মধ্যে। শুধু সন্দেহজাত চিন্তা আসে, কিন্তু উচ্চারণ করার শক্তিটুকু পান না, ‘এ জায়ফল বেশি দিয়েছে মাংসে। দেহ-মন যে পুরোপুরি অবশ হচ্ছে এ তো তারই প্রভাব। এ শুয়োরের নামের মধেই যে আমার যম লুকিয়ে ছিল এটা আমার আগেই ভাবা উচিৎ ছিল। আহ! পূর্ণিমা রাতেই অমাবস্যা। বটগাছের কোটরেই গোখরে সাপ।’

 অবসন্নতা আরও চেপে বসে। চোখদুটো খুলে রাখার শক্তিটুকু যেন থাকে না আর তার। শরীর একেবারে হিম হয়ে আসে।

প্রচণ্ড ব্যথায় এবং অবশ অবসন্নতায় অস্ফুট স্বরে শুধু উচ্চারণ করেন, ‘যম-ছেদ!’


*জায়ফল*




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*