দেশে-বিদেশে বাঙ্গালি সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা




দেশে-বিদেশে বাঙ্গালি সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা

-শাহীনুর ইসলাম


মানুষ অনির্দিষ্ট এবং বিশ্বজনীন হয়ে জন্ম নেয় না। অপার সম্ভাবনার মধ্যেও তাকে সুনির্দিষ্ট ও বিশেষ হয়েই জন্মলাভ করতে হয়। সে প্রথমে জন্মায় মানুষের অবয়ব নিয়ে, তাও ছেলে বা মেয়ে হিসেবে। তাকে আরো সুনির্দিষ্ট করা হয় সংস্কৃতিজাত একটি নাম দিয়ে। সে হয়ে যায় ‘রাম’, ‘খাজা’ ‘হ্যারি’, ‘ক্রিস্টিনা’ কিংবা ‘জরিনা’। এই নাম তার উপস্থিতিতে কিংবা অনুপুস্থিতিতে অন্যের কাছে তার সমগ্র সত্ত্বার প্রতীকে পরিণত হয়। এরপর যোগাযোগ ও ভাব প্রকাশের জন্য একটি ভাষা এবং জীবনযাপনের জন্য একটি সংস্কৃতি সে পায়। যতই সে বড় হয় ততই সে আরো সুনির্দিষ্ট এবং বিশেষ হয়ে ওঠে। এক সময় কেউ কেউ বিশেষ থেকে বিশেষ হয়েও নির্বিশেষে পৌঁছে যায়। তবে বেশিরভাগই বিশেষ থেকে যায়। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে তার সুনির্দিষ্ট সে পরিচয়ই  আমাদের স্বস্তি দেয় এবং কাজকে সহজ করে, আনন্দ-বেদনা ও ভাব প্রকাশে সহায়তা করে। এ জন্যই এত এত জাতি-গোষ্ঠী এ পৃথিবীতে।

এই জন্মলাভ শুধু তার পিতৃপুরুষের অবয়বগত কাঠামো থেকেই নয়, মানসিক চিন্তাজাত দীর্ঘদিনের আচরিত আচরণ-বৈশিষ্ট্য থেকেও। আর এই সুনির্দিষ্টতা প্রদান করে সে যে পরিমণ্ডলে জন্ম গ্রহণ করে সেই পরিমণ্ডলে ইতিমধ্যে বিরাজমান সংস্কার-কুসংস্কার-অপসংস্কারসহ সংস্কৃতি। ভাষা সেই সংস্কৃতির প্রধানতম ধারক ও বাহক। আর কোনো কারণে সে ভাষা যদি হারিয়ে যায়, তবুও সেই সংস্কৃতিজাত সংস্কার বা অপসংস্কার তার চিহ্ন রেখেই যায় ব্যক্তির চিন্তা-চেতনায়।



এই যে সংস্কৃতি যা মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে তার সমৃদ্ধি নির্ভর করে— কোনো জাতিগোষ্ঠী কতটুকু অবদান রাখছে এতে, কতটুকু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের চর্চা করছে, অন্য সব সমৃদ্ধ সংস্কৃতি থেকে কোন কোন উপাদান কতটুকু সে নিজের করে নিচ্ছে— এসবের উপর। সব গোষ্ঠীর সংস্কৃতি সবার কাছে সমৃদ্ধ মনে হয় না। আবার অনেকের সংস্কৃতি যে সমৃদ্ধ সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তো লিখিত ভাষাই নেই। তাদের কথা আলাদা। কিন্তু কোনো জাতির যখন অহংকার করার মতো একটি সমৃ্দ্ধ সংস্কৃতি ও ভাষা থাকে তখন তাকে অবহেলা করে ভিন্ন এক সংস্কৃতিকে নিজের করে নেওয়ার প্রয়াস আত্মবিনাশের নামান্তর মাত্র। এতে গৌরবের কিছু নেই। আত্মাকে বিসর্জন দিয়ে বৈষয়িক বৃদ্ধি হয়তো হতে পারে। স্থান-কালের প্রেক্ষাপটে অন্য সংস্কৃতিকে আয়ত্ত্বে এনে সে বৃদ্ধি করা যেতে পারে, কিন্তু তা কোনোভাবেই চিরতরে নিজের সংস্কৃতির বিনিময়ে নয়।

বস্তুত মানুষ তা পারেও না অস্বীকার করতে, যতই সে ভান করুক। এই কৃত্রিম ভান তাকে নিজ সংস্কৃতির অন্য মানুষদের কাছ থেকে বিজাতীয় করে তোলে; আর অন্য জাতি তো তাকে গ্রহণই করে না। ফলে এ-কূল, ও-কূল দুকূলই হারায়, যদিও বহু-সাংস্কৃতিক সমাজে এর কিছুটা আপোস, সংমিশ্রণ ও বিনিময় চলে।

অবশ্য তার অস্বীকার করার বাস্তব কিছু কারণ আছে, যা আসলে অমূলক। যেমন- অন্যান্য প্রবাসীদের মতো বাঙ্গালিরা ভিনদেশে এসে প্রথম থেকে দীর্ঘদিন প্রতিনিয়ত যে সমস্যার মুখোমুখি হয় তা হলো যোগাযোগের দক্ষতার কমতি। আর তা মূলত ভাষাকেন্দ্রিক। যেমন- কানাডার ইংরেজভাষীরা যে টানে এবং যে শব্দগুলো নির্দিষ্ট কলোক্যুয়াল ও কনটেক্সে ব্যবহার করে তার সাথে সে তেমন পরিচিত নয় আগে থেকে। আর বয়স হলে প্রযুক্তির মতো ভাষাও আয়ত্ত্ব আনা খুবই কঠিন। এর থেকে তাদের অনেকে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে তারা নিজের ছেলেমেয়েদের সামনে কখনো বাংলা বলবে না। তাহলে তারাও এই সমস্যার মুখোমুখি হবে।

সেজন্য নিজের ছেলেমেয়ে অন্য বাঙ্গালির সাথে কথোপকথনে যদি বাংলা না বলে সেটাকে সে গর্বের বিষয় হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু এখানে জন্ম নেওয়া ছেলেমেয়েদের কাছে ইংরেজি হচ্ছে ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ। বরং বাংলাটা যদি বাসায় চর্চা না হয় বা তাদেরকে কোথাও শেখানো না হয়, তবে এটা একটা ঘাটতি হিসেবে থেকে যাবে তাদের জীবনে। বাবা-মায়ের সুখ-দুঃখ লাভের সাংস্কৃতিক উপাদানের সাথে তাদের সুখ-দুঃখের বিস্তর ব্যবধান রয়ে যাবে। এছাড়া সহানুভব, সহানুমর্মিতা এবং পরস্পর উপলব্ধিও সম্যকরূপে সফল হবে না, যেটা রক্তীয় কিংবা আত্মীয়দের কাছ থেকে মানুষ প্রত্যাশা করে ব্যাপকভাবে, বিশেষ করে বিপন্ন কিংবা অসহায় অবস্থায়। যদিও এসবের জন্য সাংস্কৃতিক মিলই একমাত্র বিষয় নয়। এছাড়া যে অনিবার্য ঘাটতির শিকার পূর্ব প্রজন্ম নতুন পরিবেশে, ঠিক একইভাবে নিবার্য ঘাটতির শিকার হবে উত্তর প্রজন্ম যখন সে বাংলাদেশের সংস্কৃতির মানুষদের সাথে মিশতে যাবে। তারা বুঝবে না শেকড়ের সাথে সম্পৃক্ত আত্মীয়-স্বজন ও অন্য মানুষদের ভাব ও ভাষা। হ্যাঁ, না মিশলেও হবে; তাদের দিন ভালই যাবে। কিন্তু ঐ যে নিজের বলে অহংকার করার মতো, বলার মতো তাদের কিছু থাকবে না। কানাডার সাথে অন্য দেশের তুলনায় নির্দ্বিধায় তাদের কিছু থাকবে, কিন্তু কানাডার ভেতর অন্য জাতির তুলনায় কিছুই থাকবে না।

প্রবাসের মতো ভিন্ন পরিবেশে পূর্ব প্রজন্মের চর্চিত ও মানসিক পুষ্টির যোগানদাতা সংস্কৃতিকে উত্তর প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া কার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে তাহলে? অবশ্যই তা পূর্ব প্রজন্মের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সে জন্য উত্তর প্রজন্মকে আমাদের যেমন যথেষ্ট সময় দিতে হবে তেমনই নানাভাবে অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাদেরকে আগ্রহী করে তুলতে হবে শেকড়ের সংস্কৃতির প্রতি। নইলে তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে যে শূন্যতার সৃষ্টি করবে তা আর কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না। আত্মিক ও মানসিক দূরত্বের একটা চাপা বেদনা রয়েই যাবে। আমরা যেহেতু বাঙ্গালি প্রতিবেশে জন্মগ্রহণ করেছি, আমাদের দায়িত্ব আমাদের ঋদ্ধ সংস্কৃতিকে প্রবাসের উত্তর প্রজন্মের কাছে প্রবাহিত করা। তার প্রয়োজন হতো না যদি বিশ্বের সব মানুষ শুধু এক জাতি, এক সংস্কৃতির চর্চাকারী হিসেবে গড়ে উঠতো । কিন্তু সে ধারণা তো শুধু মাত্রই আদর্শিক। বাস্তবে তা কোথাও দেখা যায় নি, হয়তো দেখা যাবেও না। এই যে সুনির্দিষ্ট ও বিশেষ হয়ে কোনো কোনো জাতি গর্ব করে তাতে দোষের কিছু নেই। আমাদেরও সেটা করতে দোষের কিছু নেই। আমরা পৃথিবীর যেখানেই বসবাস করি না কেন, আমাদেরকে তাই প্রথমে বাঙ্গালি হতে হবে। অন্য সংস্কৃতির ভাল দিকগুলোও আমরা গ্রহণ করবো, কিন্তু তাও বাঙ্গালিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেভাবে পানিকে পুকুরে রাখলে পুকুরের রং, নদীতে রাখলে নদীর বৈশিষ্ট্য পায়, সে রকমভাবে। আর এর মধ্য দিয়েই আমাদের বিশ্বমানব-মানবী হতে হবে। উল্টোটা কখনো হয় না, তা বাস্তবসম্মত নয়ও।



কিন্তু কেন আমরা বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালি সংস্কৃতিকে লালন করবো এই সুদূর প্রবাসে যেখানে তার কোনো বৈষয়িক মূল্য নেই। করবো এই কারণে যে বৈষয়িক চাহিদা পূরণের পরও আমাদের একটা নিজস্ব পরিচয় লাগে যা গর্বের সাথে বলা যায় এবং যা অন্যান্য জাতির মতো আমাদেরও আছে, আর তা ভালভাবেই আছে। মানুষ হিসেবে আমরা গর্ব করতে পছন্দ করি। ব্যক্তিগতভাবে আমরা বলি বা আচরণে দেখাই যে আমি ‘গান পারি’, ‘ছবি আঁকতে পারি’, ‘কবিতা আবৃত্তি করতে পারি’, ‘নাচ জানি’, তাহলে জাতিগতভাবে নয় কেন? আমরা চেষ্টা করলে কানাডার পাসপোর্ট পেতে পারি, জাতীয়তা কানাডিয়ানও হতে পারে, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষা ভালভাবেই রপ্ত করতে পারি, এদের সঙ্গীত-সংস্কৃতিকে কাজ চালানোর মতো করে দখলে নিতে পারি, কিন্তু বাঙ্গালি জাতিসত্ত্বার যে ছাপরেখা আমাদের মুখায়বে এবং শরীরের কাঠামোতে মুদ্রিত হয়ে আছে তাকে বদলাবো কী করে? হ্যাঁ, বদলানোও যাবে, কিন্তু তাতে বেশ কয়েক হাজার বছর লাগবে। ততদিনে অনেকগুলো প্রজন্ম শিকড় হারানোর প্রচ্ছন্ন বেদনায় ভুগবে নানা পরিস্থিতিতে।

কানাডার পাসপোর্ট পাওয়ার পরও কিংবা কানাডায় জন্ম নিয়েও এবং সেই সূত্রে এখানকার সংস্কৃতি দ্বারা পরিপুষ্ট হলেও যদি মধ্যপ্রাচ্যের এক কানাডিয়ানের সাথে আলাপ-আলোচনায় কথা ওঠে যে তোমাদের কী আছে তুমি তো দেখতে আমার মতো নও কিন্তু আমার মতোই ইংরেজি বলো, তখন মাথা হেঁট করে রাখতে হবে যদি নিজের সংস্কৃতির গর্বিত অধ্যায়টি আমরা বা উত্তর প্রজন্ম নিজের করে না নেই। যখন অন্য কোনো জাতি জানবে যে আমাদের পূর্বপুরুষদের অনুকরণীয় ও গর্বময় একটা অধ্যায় ছিল তখন তারা আমাদের সে ঐতিহ্যকে সম্মানই করবে। হয়তো মনে মনে বলবে, ‘ব্যাটা যে সে জিনিসের ঔরসজাত সন্তান নয়’। উদাহরণ দিয়ে বলি, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বিহার, ভাসু বিহার, ময়নামতি বিহারসহ অনেক স্থাপনারই এখন তেমন মূল্য নেই। এমনকি সেগুলো মুসলমানপ্রধান দেশ হিসেবে বরং বাজে জিনিসের মধ্যে পড়ে। কিন্তু তারপরও সেগুলোকে তো আমরা ধ্বংস করিনি। কারণ ধর্মগতভাবে বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান হলেও  জাতিসত্ত্বাগতভাবে আমরা প্রধানত ঐসবের উত্তরাধিকার বহন করি কিংবা এগুলোরই ঔরসজাত সন্তান।

এই অতীত আমাদের স্বর্ণালী দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয় যাকে লালন করে আমরা জাতিসত্তা হিসেবে গর্ব করতে পারি। আর কারো যদি মনে হয় যে না, বাঙ্গালি সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করার মতো কিছু নেই। তবে তার পবিত্র নৈতিক দায়িত্ব এ সংস্কৃতির যে শাখাগুলি দুর্বল তা নিয়ে কাজ করে একে গর্ব করার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। যদি দেশের মধ্যে বলি তবে বলতে হয়ে সিলেটের মানুষ যেমন তাদের হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম কুষ্টিয়ার মানুষ যেমন লালন ফকির, রংপুর অঞ্চলের মানুষ যেমন ভাওয়াইয়া নিয়ে গর্ব করে। সেটা তো তাদের নিজ নিজ স্থানীয় সংস্কৃতিরই গৌরব। বাংলার মতো ছোট্ট একটা ভূখণ্ডে সঙ্গীতের যে মাধুর্যময় বৈচিত্র্য ও বিস্তৃতি তা বিশ্বের কয়টি সংস্কৃতিতে আছে? যে একে অস্বীকার করবে, এর পুষ্টি নিবে না সে নিজেই অপুষ্টি রোগে ভুগবে। নিজের গর্ভধারিণী মাতার দুধ দ্বারা পরিপুষ্ট না হয়ে ধাত্রী মাতার দুধ খেয়ে পুষ্ট হতে হবে। নিজেদের গর্ব করার মতো কিছু থাকবে না। তাতে অন্যরা শুধু উপহাসই করবে, বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত করে তাকাবে না।

একটা সংস্কৃতির সবকিছু যে ভাল বা সবার কাছে ভাল লাগবে তা কেউ স্বীকার করবেন না নিশ্চয়ই। এর মধ্যে কুসংস্কার-অপসংস্কারও থাকে দেদার। তবু বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই যেখানে সেগুলো নিয়ে পড়ে থাকে সেখানে কিছু করতে পারলে ভাল, না করতে পারলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সেই কুসংস্কারকে যখন রাজনীতিকরা, শাসকরা ব্যবহার করেন। তখন সেই কুসংস্কার দূর করতে কিছু মানুষ অবশ্যই এগিয়ে আসেন তাদের যুক্তিশীল তরবারি নিয়ে। তার প্রয়োজনও তখন দেখা যায়।

তবে সংস্কার-অপসংস্কার-কুসংস্কার সমন্বয়ে যে সংস্কৃতি তার মধ্যে আমাদের যুক্তি, মুক্তবুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের নিরিখে কুসংস্কার এবং অপসংস্কারকে বর্জন করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজন্ম লালিত কুসংস্কার থেকে বেশিরভাগ মানুষই মুক্ত হতে পারে না। তথাকথিত মাস্টার্স কিংবা পি. এইচ. ডি. ডিগ্রীও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে মুক্ত করতে পারে না। সাহিত্যও না, দর্শনও না, বিজ্ঞান তো নয়ই। যদি তা-ই হতো তবে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে এসব শাস্ত্র অধ্যয়ন করে পাশ করা মানুষগুলো অন্তত কূপমণ্ডুক হতো না। আবার এর কোনোটাই লাগে না যদি একটি খোলা ও সহিষ্ণু মন থাকে, মুক্ত ও যুক্তিশীল চিন্তাশক্তি থাকে। সেক্ষেত্রে অধীত এ বিষয়গুলো বড় ধরনের সহায়ক হিসেবে কাজ করে সন্দেহ নেই। তবে মুক্ত মন তো এমনই এমনই তৈরি হয় না। কখনো অধীত বিষয়গুলো ধাক্কা দিতে দিতে মনের বদ্ধ দ্বার খোলে, কখনো পরিবার কিংবা প্রতিবেশ তাকে মুক্তমনা হিসেবে তৈরি করে। যা হোক এ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলো যে কুসংস্কার দ্বারা চালিত, পরিচালিত এবং সে কারণে তাদের সকল মুক্তির পথ অবরুদ্ধ তাও তারা মানতে নারাজ। শুধু ব্যক্তি জীবনে তারা এর প্রতিফলন দেখতে চান না, দেখতে চান সামাজিক জীবনে এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনেও। এতে করে তাদের ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন কিংবা জাতীয় জীবনে যেমন মুক্তি ঘটে না তেমনই যারা এর বাইরে তাদেরকেও এরা মুক্ত জীবন-যাপন করতে দিতে চান না। মাঝখান থেকে ভণ্ডরা যারা মুখে কুসংস্কারের গুণগান করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোকে মুগ্ধ করার লক্ষ্যে, কিন্তু কাজের বেলায় ঠিকই স্বার্থ হাসিল করে তারা লাভবান হয় এবং প্রায় সব কিছুরই কর্ণধার হয়ে ওঠে। আর এরাই নিয়ন্ত্রণ করে সবার জীবন এবং সে অধিকার ও ক্ষমতাও প্রদান করে সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোই। তখন নিজেদের দুঃখ-কষ্ট-হতাশার কারণকে আরোপ করে এবং সমাধান খোঁজে কোনো এক দৈব শক্তির উপর।



কুসংস্কারের দরুন যা কিছু স্বাভাবিক, যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত তাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলো অস্বাভাবিক, অযোক্তিক এবং সে কারণে সবার জন্য কষ্টকর ও ভোগান্তিকর করে তোলে। কুসংস্কার রক্ষার্থে এরা যতটা অতন্দ্র প্রহরী সংস্কার ঠেকাতে এরা ঠিক ততটাই ব্যতিব্যস্ত। এমনকি নিজেদের জান কোরবান করতেও দ্বিধাবোধ নেই এদের। নইলে কীভাবে এরা নিজের জাতিসত্ত্বাকে অস্বীকার করে যায় তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে? নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও সঙ্গীতকে অচ্ছুৎ মনে করে নিজেদের সন্তানদের এসব থেকে দূরে রাখে?

ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশসহ প্রায় গোটা বিশ্ব দখল করে শাসন করেছিলো অস্ত্রের জোরে, কিন্তু শাসন কায়েম করেছিল নিজেদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে স্থানীয় মানুষদের অন্তরে প্রোথিত করে যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব এখনো এসব অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে প্রতীয়মান। তাই তো এখনো আমাদের কাছে সুন্দর সেটাই যেটা পাশ্চাত্য। এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলো দেশজ সেই সাংস্কৃতিক শূন্যতা ও সঙ্কট তৈরি করে নিজেদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ভৌগোলিকভাবে বেখাপ্পা বেশ-ভূষণ, সেকেলে আচার-আচরণ এখন যেভাবে পারছে সেভাবেই প্রোথিত করে চলছে। এভাবে চললে ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে বেশি দেরি থাকবে না প্রবাসীসহ স্বদেশী বাঙ্গালি জাতির!




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*