জীবন-যাপনের প্যারাডক্স
–শাহীনুর ইসলাম
জীবন অসীম— হোক সে ব্যক্তি জীবন বা সামষ্টিক জীবন। অসীম এই অর্থে যে, একে সীমায়িত করা যায় না, সংজ্ঞায়িতও করা যায় না। তবুও সমাজের স্বার্থে কিংবা গোষ্ঠী স্বার্থে তা সব সময়ই সব জায়গায় সীমায়িত এবং সংজ্ঞায়িত। পার্থিব জীবন-যাপনের সুবিধার্থে যেমন আমরা অসীম ও অখণ্ড সময়কে সীমায়িত, খণ্ডায়িত ও সংজ্ঞায়িত করে নিয়েছি, তেমনই করে নিয়েছি জীবন-যাপনের অন্যান্য প্রপঞ্চকেও। আর তা করতে গিয়ে জীবনকে আমরা খর্ব ও ঊন করে তুলেছি। আনন্দ লাভের, সুখ ভোগের অসীম ভাণ্ডারকে সীমারেখায় আবদ্ধ করে রেখেছি। খাল কেটে পানি এনেছি ঠিকই, সাথে কুমিরও এনেছি। বিশেষ করে যখন সুবিধার নিমিত্তে সৃষ্ট খণ্ডাংশকে নিয়েই আমরা ব্যতিব্যস্ত থাকি অখণ্ড ব্যতিরেকে, আর যখন তার অপপ্রয়োগটাই সুপ্রয়োগের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে কিংবা প্রাধিকার লাভ করে। এমনই অপপ্রয়োগ দেখা যায় সামন্ত যুগে যখন ব্যক্তি জীবন অত্যন্ত সীমায়িত, নিয়ন্ত্রিত ও নির্দিষ্ট ছিলো যা পরবর্তীতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের স্বীকৃতির ফলে ততটা থাকে নি।
যা হোক, এই সংজ্ঞায়ন বা সীমায়নের যেমন সুবিধা রয়েছে, তেমনই অসুবিধাও প্রতুল। অসুবিধা এই যে, এতে একেক ব্যক্তিকে একেক সংজ্ঞায় বা সীমায় বেঁধে ফেলা হয়, সব ব্যক্তির প্রতি সমান আচরণ করা হয় না। যেমন— দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জীবনের সাথে ধনিক শ্রেণির জীবন। সুবিধা এই যে এতে অংশকে বিশদ জানার ও প্রয়োগ করার অবকাশ থাকে; অনেক ব্যক্তিকে শ্রেণিবদ্ধ বা কাঠামোবদ্ধ করা যায়; সহজে শাসন করা যায়; এক ধরনের ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করা যায় যা এক সাথে বসবাসের জন্য অপরিহার্য; যে কোনো ধরনের উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু এ সীমায়ন বা সংজ্ঞায়ন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে— ব্যক্তির নয়, অন্য গোষ্ঠীর তো নয়ই। বিশেষত, ব্যক্তি যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শের অধিকারী হন। এমন ব্যক্তিকেও গোষ্ঠীর সাথে আপোস করে চলতে হয়। কারণ সে গোষ্ঠীরই অংশবিশেষ। ফলে এমন ব্যক্তির স্বপ্ন, চাহিদা, আকাঙ্খা গোষ্ঠীর জাঁতাকলে পড়ে বিশেষ যে রূপ পায় তাই তার চাহিদা হয়ে দাঁড়ায়। তবে বিশেষ এক রূপ পেলেও সেসব স্বপ্ন, আকাঙ্খা কখনো মরে যায় না। বরং সযতনে মনের এক কোণে থেকে যায়। ফলে দেখা যায় অনিবার্য দ্বন্দ, সংঘাত। এ দ্বন্দ বা সংঘাত ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর কিংবা এক গোষ্ঠীর সাথে অন্য গোষ্ঠীর বা এক জাতির সাথে অন্য জাতির।
বিভিন্ন গোষ্ঠী বা শ্রেণী মনে করে যে, তারা অর্থাৎ তাদের আদর্শ, জীবনাচার, দেশাচারসমেত তারা নিজেরাই শ্রেষ্ঠ; অন্যরা হীন, নীচ, ইতর শ্রেণীর। অতএব ওদের জীবনাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করো কিংবা ঘৃণা করো। এ ধারণা-উদ্ভূত উদগ্র বাসনা আজো পৃথিবীকে সমান তালে শাসন করে যাচ্ছে। যারা এ বাসনাকে পরিত্যাগ করেছে, তারাই সভ্য হয়েছে; তারা মেনে নিয়েছে বৈচিত্র্য মানে পারস্পরিক সংঘাত নয়, বরং তা মেনে নিয়ে নিজ নিজ কাজে নিয়োজিত থেকে সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ বলে যে একটা মতবাদ রয়েছে তার মূল কথা এই যে, নির্দিষ্ট কোনো সংস্কৃতির যে আচার, মূল্যবোধ বা রীতি-নীতি থাকে তা-ই সে সংস্কৃতির অন্যান্য প্রপঞ্চকে নিয়ন্ত্রিত করে; অন্য জাতি বা গোষ্ঠীর সেখানে কিছু করার নেই।
এটা অনেকটা ভাল শোনালেও এ মতবাদেরও বিপদ রয়েছে। যেমন— ভারতীয় উপমহাদেশে তৎকালীন সমাজে সতীদাহ প্রথা কিংবা বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধকরণ। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে প্রথা দুটি প্রায় সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু নিষিদ্ধ হওয়ার বেশ পরে আমরা উপলব্ধি করি যে, প্রথা দুটি মোটেও ভালো কিছু ছিল না।
বহুসাংস্কৃতিক দেশ বা জাতিসমূহ সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ প্রয়োগে স্বভাবতই এগিয়ে থাকে এবং সহিষ্ণু হয়ে থাকে, যদিও এতে তাদের উন্নয়ন গতি শ্লথ হয়ে যায়, বিশেষত যদি বহুসাংস্কৃতিক দ্বন্দ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তবে এক্ষেত্রে শুধু সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অবশ্যই একমাত্র কিংবা অনন্য কোনো মাপকাঠি নয়। তারও উৎকৃষ্ট উদাহরণ ঐ তৎকালীণ ভারতীয় উপমহাদেশ।
প্রকৃতপক্ষে, জীবন-যাপনের জন্য সর্বজনীন কোনো নিয়ম, মূল্যবোধ বা রীতিনীতি এখনো আবিস্কার হয় নি। তার কারণও ঐ যে, জীবনকে নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে যাপনের রীতি। একেক নিয়ম, মূল্যবোধ কিংবা আচার একেক ভূখণ্ডে সত্য, স্বীকৃত ও আচরিত। অন্য ভূখণ্ডে সেসব বেমানান, অশোভন এবং সে কারণে অনাচরনীয়। তবুও কোনো কোনো গোষ্ঠী এখনো গোঁয়ারের মতো এ ধারণা পোষণ করে যে তাদের আচরিত মূল্যবোধ ও রীতিনীতি (তা যতই পুরাতন হোক)সর্বজনীন ও সর্বকালীন। আর সেসব নিয়ে তাদের দম্ভেরও শেষ নেই, হানাহানি করতেও দ্বিধা নেই। কিন্তু সব মূল্যবোধ ও রীতিনীতি সর্বজনীন না হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কেননা প্রথমেই বলেছি জীবন অসীম। আর অসীম বলেই নির্দিষ্ট সীমানায় তাকে বেঁধে রাখা যায় না, নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আটকানো যায় না। এছাড়া দীর্ঘদিনের চর্চিত রীতি-নীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ুগত ব্যাপার তো রয়েছেই। অসীম ও অনির্দিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও জীবনকে বারবার স্থানীয়ভাবে সীমায়িত ও সংজ্ঞায়িত করা হয়। এটাই জীবন-যাপনের প্যারাডক্স।
তবে বিজ্ঞানকে যদি সাংস্কৃতিক জীবন-যাপনের মানদণ্ড হিসেবে রাখা হয়, তাহলে তা সর্বজনীন ও সর্বকালীন হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। আর তা ষোল আনা না হলেও বার আনার বেশি তো বটেই যা কোনো স্থানীয় সংস্কৃতি দিতে অপারগ। এক কালের বিজ্ঞান যে অন্য কালে এসে অচল হয়ে যেতে পারে, সেটাও ঘটে বৈজ্ঞানিক নিয়মেই। কিন্তু সংস্কৃতির পরিবর্তন সব সময় বৈজ্ঞানিক নিয়মে ঘটে না। কাজেই নানান ধরনের সংস্কৃতির মধ্যে যদি সর্বকালীন ও সর্বজনীন বলে কোনো রীতি-নীতিকে মেনে নিতে হয়, তবে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতিকে মেনে নেয়াই উত্তম।
অবশ্য সারা বিশ্বে প্রচলিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অনেক উপাদানই রয়েছে যা স্বতঃসিদ্ধ। এসব উপাদানকে গ্রহণ বা বর্জন করতে আপাত কোনো সমস্যা নেই। তবুও গভীরে একটা সমস্যা থেকেই যায়— কাকে বা কী দিয়ে এসব উপাদানকে স্বতঃসিদ্ধ ঘোষণা করা যায়? কারণ এসব নিয়ে যথেষ্ট রাজনৈতিক খেলা খেলার অবকাশ রয়েছে, রয়েছে আধিপত্য বিস্তারের প্রচ্ছন্ন মনোভাব ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের কোশলগত আস্ফালন। তবুও সব সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে এর উত্তর দেয়া যায়— বিজ্ঞান ছাড়া আর কাউকে দিয়ে নয়।
*জীবন-যাপনের প্যারাডক্স*
*ইমেজ সোর্স: ইন্টারনেট
Be the first to comment