গোলকে বাঁধা গোলক-ধাঁধা
-শাহীনুর ইসলাম
দেয়াশলাইয়ের কাঠি বাতাসে জ্বালানোর মতোই লোহানের ব্যাপারটা। সহজে জ্বলে না, কিন্তু একবার জ্বললে দাউ দাউ করে জ্বলতে ও জ্বালাতে ছাড়ে না।
বাইরে থেকে তাদের এক বেডরূমবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের বসার ঘরে ঢুকেই তার স্ত্রীকে কিছু না বলে এক এক করে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় লোহান। যেন অনেক দিনের পরিকল্পনা। শুরু করে দরজার বাম পাশের দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবিটি দিয়ে। ভাংচুরের আওয়াজটা নিবেদিতার কানে প্রলয় ঘন্টার পাগলা স্বর হয়ে যথাসময়েই পৌঁছায়। রান্না ঘর থেকে প্রতিপক্ষের বন্দুকের গুলির মতো ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে আসে সে । লোহানের মতিগতি বেগতিক দেখে তেমন কিছু বলে না। মনে মনে ঠাহর করে খুব রাগান্বিত কোনো কারণে। কাছে এসে ভাংচুরের প্রথম শিকার হওয়া ফ্রেমটা দেখে সহজেই অনুমান করে কার উপর কোপানল। তবুও এ অবস্থায় সে অনাকাঙ্খিত সুনামির শিকার হওয়া এক নিরীহ প্রাণী মাত্র— কিছু বলে না। যদিও কিছুটা বিস্ময়াহত হয়। সে বিস্ময়াঘাত লোহানের ক্রোধের কাছে যেন আগুনের ছোঁয়ায় মোমের মতোই গলে যায়।
লোহানের চোখ তার শরীরের সবটুকু রক্ত নিংড়ে এনে লাল হয়ে আছে। ভেতরকার শিরা-উপশিরাগুলি স্পষ্ট অবয়বে ও সদর্পে নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করছে। চুলগুলি স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি এলোমেলো হয়ে আছে। আর মনে মনে বিড়বিড় করে অস্ফুট গালির মতো বেরোচ্ছে যেন কিছুটা দূর হতে দেখা গর্ত থেকে বের হওয়া সারি সারি কীট।
নিবেদিতা আবার রান্নাঘরের দিকে যেতে না যেতেই গ্লাস ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পায়। তবে এবার ফেরে না। এরপর ডায়েরিটা একবারে ছিঁড়তে না পেরে কয়েকটা পাতা এক সঙ্গে নিয়ে এক এক করে ছিঁড়ে ফেলে লোহান। দুটো বইও ছুঁড়ে ফেলে দেয়। লোহানের ভাঙ্গা, ছেঁড়া, অস্ফূট বিড়বিড়ানি এবং নিবেদিতার দেখেও-না-দেখার ও বুঝেও-না-বোঝার নীরবতার মধ্য দিয়ে কাটে ঘন্টা খানেক। ততক্ষণে রান্না শেষ করে নিবেদিতা।
এভাবে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এবং ছিঁড়তে ছিঁড়তে এক সময় লোহান যখন আলমিরাটা খোলে, নিবেদিতার আত্মাটার পর্বত সমান শক্তিশালী অঞ্চলটাও তখনই কেবল রিখটার স্কেলের দশ মাত্রায় ওঠার যোগাড় হয়। লোহানও কিঞ্চিত থেমে যায়। না, সে এক ঘন্টার লাগাতার ধ্বংসাভিযানে ক্লান্ত বলে বিরতি দেয় না। এ রকম অভিযানে ক্লান্তি কখনো সম্মুখে আসে না। অনেকটা শরীরে লুকিয়ে থাকা রোগের মতো, কোনো একটি প্রতঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়লে তবে সে জেঁকে বসবে। তার মনে এখন আধিপত্য করছে অন্য এক অনুভব—যাকে ক্ষোভ, ক্রোধ ও অপমান মিশ্রিত এক অনুভূতির সমন্বয় বলা যেতে পারে। আর এর পরিণতি হিসেবেই এতক্ষণের ঘটে যাওয়া দৃশ্যপট। যদিও এ অনুভবের সাথে এক ধরণের মায়া কাজ করছে, যেজন্য হয়ত সে একটু থমকে দাঁড়ায়।
আলমিরা থেকে জিনিসটা লোহান হাতে নেয়। অন্যান্য জিনিসগুলো ভাঙ্গতে কিংবা ছিঁড়তে তার একটুও বাঁধেনি। কিন্তু এখন তার মনে নতুন এক অনুভব খেলে যায় যা তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে রাখে, স্মৃতিকাতর হতে বাধ্য করে। মুহূর্তেই চোখের কোণে ভেসে ওঠে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চিত্রটি। এখনো তা বিশ্বস্ত বন্ধুর ন্যায় জীবন্ত, ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বলে ও স্থির।
জিনিসটা ক্রিকেট বলের ন্যায় গোলাকার হওয়ায় সহজেই তার হাতের মুঠোয় ঢোকে। কিন্তু কৃষ্ণবিবরে পরিণত হওয়া নক্ষত্রের মতোই ভারী লাগে। সে ভার তাকে দশ বছর সমান আলোকবর্ষ দূরত্বের গহীনে নিমিষে নিক্ষেপ করে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে—এখনো এতটা দূরত্বে সেই আগেকার কাচের স্বচ্ছতা। যে স্বচ্ছতা ভেদ করে খোদাইকৃত ছবিযুগল অনেক কিছু বলে। এর মধ্যে প্রথমে চোখ যায় তার নিজের ছবির উপর, যা রাজ্য বিজয়ের হাস্যোজ্জ্বল যুবরাজের মতো দেখতে। আর বাম হাতটি রয়েছে পিছন থেকে জড়িয়ে নিবেদিতার বাম পাঁজর পর্যন্ত আদরে আগলে রাখা অর্গল হয়ে। সেখান থেকে লোহানের চোখ নিবেদিতার প্রজাপতির মতো দুই ডানায় পরিভ্রমণ করে এসে ঠেকে চোখে। তার স্ত্রীর চাহনিতে বরাবরের মতো এবারও এক ধরণের মহাবৈশ্বিক রহস্যময়তা আবিস্কার করে সে। কিন্তু এ চাহনির অর্থ সে আজো বোঝে না। তাই খোদাইকৃত ছবিদুটো বস্তুর অবয়ব ছেড়ে দুর্বোধ্য এক অধিবস্তুতে পরিণত হয়ে আছে তার কাছে।
দুর্বোধ্যতার একটা প্রভাব বিস্তারকারী স্বভাব আছে—হয় তা অচ্ছুৎ হয়ে ওঠে নয় মূল্যবান হয়ে ওঠে। আর তা নির্ভর করে ব্যক্তিটির স্বভাবজাত প্রকৃতির উপর। লোহানের কাছে তা মূল্যবানই হয়ে ওঠে। শুধু দুর্বোধ্যতার কারণেই নয়, খোদাইকৃত এমন অনুভবের রূপায়নমূলক ছবি বা অন্য কোনো স্মৃতিচিহ্ন তার কাছে নেই—সে কারণেও দুর্লভ এবং মূল্যবান।
কাচে খোদাইকৃত বলটা তারা পেয়েছিল হানিমুনের সময়ে উপহার হিসেবে। লোহানের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু আদনান অনাহুতের মতো সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আচমকা হাজির হয়ে তাদেরকে যতটা না চমকে দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি চমকে দিয়েছিল এ উপহারটি। আদনান তাদের বিয়েতে বিদেশে থাকায় উপস্থিত হতে পারেনি। বন্ধুর মন রক্ষার্থে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছিল তার এমন চমকপ্রদ উপহার। চমকে দেওয়ার মতোই ছিল ব্যাপারটা। কারণ এ জুটি যে সাতদিনে একে অপরের হতে পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে জোছনাবিধৌত সাগরবেলায় এসেছিল যেখানে ঢেউয়ের সাথে খেলে খেলে, প্রবাল দ্বীপের বিস্ময় মেখে একে অপরের গহীন সাগরে ডুববে, ভাসবে, সাঁতার কাঁটবে, পরস্পরকে বুঝবে ও পরিশেষে বন্ধনকে প্রবাল পাথরের ন্যায় কঠিন করবে— তার কথা তো আদনানের জানার কথা ছিল না। আর জানলেও সে তাদের এক সাথের ছবিই বা পেয়েছিল কী করে? আরো এক বিস্ময় ছিল যা অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল—খোদাইকৃত ছবিটাতে দুজনের গোপন অনুভবের মূর্ত রূপ। লোহান একে ব্যাখ্যা করেছিল—দুটি আত্মা যখন এক হয়ে যায়, তখনই কেবল তারা একে অপরের অনুভব ধরতে পারে। এই না হলে সত্যিকারের বন্ধু!
কিন্তু লোহানের সাম্প্রতিক স্মৃতির প্রভাব এত বেশি যে পর মুহূর্তেই তা সুদূর অতীতের সুমুধুর স্মৃতিকে চাপা দিয়ে রাখে। সে গোলকটি ভাঙতে উদ্যত হলে নিবেদিতা প্রলয়যজ্ঞের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকতে পারে না আর। কারণ তার কাছেও এটি মূল্যবান। মনে সাহস সঞ্চার করে শুধু এটুকুই মিনতি করে,
-এটা না ভাঙলে হয় না!
লোহান কী ভেবে যেন থেমে যায়। স্ত্রীর মুখের দিকে এই প্রথম তাকায়। স্বামীর চোখে অস্ফুট কাতরতা ও উঁচু থেকে মাথার উপর পাথর পড়া আঘাতের প্রতিফলন দেখতে পায় নিবেদিতা। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে স্বামীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনাই এখন তার লক্ষ। তাই কথা না বাড়িয়ে তোয়ালে ও লুঙ্গিটা তার হাতে দিয়ে শুধু বলে,
-গোসল সেরে ডাইনিং টেবিলে আসো। আমি লাঞ্চ রেডি করছি। বেলা অনেক হল।
লোহান তখনো নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর ধপাস করে সোফায় বসে। ভাবতে থাকে আপন মনে। নিবেদিতা সব খেয়াল করে। আবার মনে করিয়ে দেয়,
-কী হল? যাও, আমার ক্ষুধা পেয়েছে।
লোহান তোয়ালে ও লুঙ্গি ছাড়াই যেতে উদ্যত হলে নিবেদিতা সেগুলো নিজের হাতে নিয়ে তাকে বাথরুম পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। এরপর ডাইনিং টেবিলটি গোমাংস, সবজি, সালাদ, ডাল ও ভাত দিয়ে ভরিয়ে রাখে।
লোহান গোসল শেষে বেরিয়ে এলে তার স্ত্রী তাকে দ্রুত খেতে আসতে বলে। উত্তরে সে জানায়,
-আমার ক্ষুধা নেই। তুমি খেয়ে নাও।
-তুমি না খেলে আমিও খাব না।
লোহান ডাইনিং টেবিলে না গিয়ে পারে না। নিবেদিতা নিজেই তার জন্য থালায় করে খাবার পরিবেশন করে। এক লোকমা ভাত মুখে দিতেই তা কিছুতেই ভেতরে যায় না লোহানের। তবু মুখে দেওয়া ভাতটুকু নষ্ট করতে মন চাইল না তার। অনেকটা জোর করেই ভেতরে ঢুকিয়ে বলে,
-আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
নিবেদিতা জোর করে না। সে জানে এখন জোর করে কোনো লাভ নেই। স্বামীর খাওয়ার অনিচ্ছাটা তাকেও ছোঁয়াচে রোগের মতো কিছুটা আক্রান্ত করে। তাই সেও কয়েকটা গ্রাস মুখে দিয়ে টেবিল থেকে উঠে পড়ে। তার আগে শুধু বলে,
-ঠিক আছে। এখন খেতে ইচ্ছে না হয় পরে খেয়ে নিও। আমি ঢেকে রাখছি।
দুজনে উঠে গিয়ে সোফায় বসে এক এক করে। নিবেদিতা চা খাওয়ার প্রস্তাব করে। লোহান তা মঞ্জুর করে। রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতে নিবেদিতা ভাবে এখন কথাটা তোলা দরকার। আর লোহান টাটকা ক্ষতের নিরাময়ে এখনো আচ্ছন্ন।
তার স্বামী যেহেতু কিছু খায়নি নিবেদিতা তাই চায়ের সাথে কিছু বিস্কুট আনে। লোহানকে চায়ের কাপটা হাতে এগিয়ে দিয়ে বিষয়টা খুলে বলার জন্য অনুরোধ করে,
-কী হয়েছে খুলে বল না! নিজের ভেতর ক্ষোভ, কষ্ট যত পুষে রাখবে ব্যথা তত বাড়বে। আমাকে বলে একটু হালকা হওয়ার চেষ্টা করো। দেখো কিছুটা ভাল লাগবে।
-এমন জায়গায় বিষফোঁড়া উঠেছে, নিবু, যে তা না যায় কাউকে দেখানো, না যায় নিজে সওয়া।
এমন প্রতিক্রিয়া শুনে নিবেদিতা থমকে যায়। আর কী বলবে ভেবে পায় না। কিন্তু এমন অবস্থায় চুপ করে থাকাটাও অসহ্য এবং অনুচিত। আবার জোর করে ব্যাপারটা খোলাসা করতে। লোহান তবু নীরবে ভাবতেই থাকে। এবার নিবু শেষ চেষ্টা করে বাইরে কোথাও থেকে এক সঙ্গে ঘুরে আসার জন্য। তাতেও লোহানের ‘না’। যেন কোনো কিছুতেই ক্ষান্ত হচ্ছে না সে। তার বিষফোঁড়ার যন্ত্রণা উপশমে কিছুই কাজে দিচ্ছে না। কাজে দেবেই বা কীভাবে? নিবুর বাতলে দেওয়া উপশমের কোনো পথেই তো পা মাড়াচ্ছে না সে। এমন তো নয় যে, সে স্ত্রীর কথা কখনো শোনে না। যৌক্তিক হলে সে সবার কথাই শোনে। কিন্তু আচ্ছন্নতা, বেদনার ঘোর তাকে সবকিছুতেই ‘না’ বলিয়ে নিচ্ছে। সে এখন কারও নয়, নিজেরও নয়, শুধু এক আচ্ছন্নতার।
নিবু টিভি চালু করে। এ চ্যানেল ও চ্যানেল ঘুরে গানের চ্যানেলে এসে থামে। আর খেয়াল করে আচ্ছন্নতা থেকে লোহানের মাঝে মাঝে চ্যানেলের দিকে একটু করে চাহনি। তার সবটুকু আচ্ছন্নতার মধ্যে চ্যানেলের গানগুলোকে মনে হচ্ছে থেকে থেকে তবলার বিরাম।
এক সময় নিবেদিতা টিভিতে কোনো একটা সিরিয়ালের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। লোহান চুপ করে কখন যে সেখান থেকে উঠে বেডরূমে চলে যায় সে সজ্ঞানে তা জানে না। ঘোর ভাঙলে সে দেখে চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। পাশের রূমে যায়। গিয়ে দেখে কম্পিউটার স্ক্রীনটাকে পটভূমি করে লোহান এখনো আত্মমগ্ন তার ভাবনায়। কখনো গালে হাত দিচ্ছে, কখনো মাথায়, কখনো-বা এক দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকছে। দু’চারটে কথা ছাড়া ঘুমানোর সময় পর্যন্ত প্রায় নীরবতাই কাটে তাদের।
নিবুর জোরাজুরি স্বত্ত্বেও রাতেও কিছু খায় না লোহান। কিছুতেই তার মন লাগছে না। সব ভাবনাকে ছাড়িয়ে সকালের ঘটে যাওয়া ঘটনাটারই চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ, চর্বিত চর্বণ। একই ভাবনা বিভিন্ন কোণ থেকে তাকে আঘাত করছে অনবরত। রাত দুটো বাজে। নিবু ঘুম থেকে এক ফাঁকে চোখ মেলে দেখে দৃশ্যের কোনো হেরফের নেই। ভাবনাও এক সময় ক্লান্তি আনে। তাই ভোরের দিকে লোহান কখন যেন বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
প্রতিদিনের মতো আজো সকাল হয়। তবু আজকের সকালটায় বাতাসে বিশুদ্ধতা নেই যেন, নেই মনের উপর রোদের কোনো খোশমেজাজী প্রভাব। প্রতিদিন সকালে ওঠা লোকটা এখনো ঘুমের ভেতর ডুবে আছে। নিবু তার ঘুম ভাঙাতে চায় না। তাই খুবই সাবধানে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। ঘরের কাজকর্ম সারে প্রায় বিনা আওয়াজে।
ঘুম থেকে উঠতে উঠতে লোহানের সকাল দশটা বেজে যায়। চোখ খুলতেই আবার মনে পড়ে জীবনের ভীষণ ব্যথাদায়ক দিনটার কথা। ভোরে ঘুমের ঘোরে সে নীরবে কেঁদেছে। তা বুঝতে পারে নোনতা, আঁঠালো গোছের চোখের নিচটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে। এবার বিছানা থেকে উঠে বাথরূমে না গিয়ে প্রথম যে ভাবনাটা তার মাথায় আসে তা হল ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিটির কোনো স্মৃতিচিহ্নই রাখবে না আর সে। তাই আলমিরাটা আবার খোলে। সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন গোলকটি হাতে নেয়। কিন্তু নিবু একটু আওয়াজ পায়। মনে সন্দেহ জাগে যেন সে এই আওয়াজের জন্য কান পেতে ছিল। লোহান এবার ছুঁড়ে মারতে প্রস্তুত। ছুঁড়তে গিয়ে তার হাত থরথর করে কাঁপছে। কী এক অজানা মায়া তাকে যেন বাঁধা দিচ্ছে। এমন সময় নিবু দৌড়ে এসে তার স্বামীকে থামায়। শরীরে কোথাও মশা কামড়ালে যেমন না দেখেই আমরা নির্দিষ্ট জায়গাটাতে থাপ্পড় মারি, নিবুর এ প্রতিরোধও যেন তেমনই। বলেই ফেলে,
-এটাও ভাঙতে চাও? ভাঙ্গো! তুমি না বললেও আমি ঠিকই বুঝেছি কার সাথে তোমার এত রাগ। আচ্ছা, তার সাথে তোমার যা স্মৃতিচিহ্ন ছিল সবই তো হয় আছড়ে নয় ছিঁড়ে মুছে দিয়েছ। বুঝলাম তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ। কিন্তু সব স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেললেও তার এতদিনের স্মৃতিগুলো মন থেকে মুছবে কী করে?
লোহান তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শোনে। কিছুটা ক্ষান্ত হয়। ভেতর থেকে গড় গড় করে বের হয়ে আসে মনোঃকষ্টের কথা,
-বুঝলে নিবু! এ জগতে কেউ কারও নয়। যাকেই আপন ভাবি সে-ই শেষে লাথি মারে। বন্ধু হিসেবে আদুকে কতটা ভালবাসতাম আমি! এই নামে শুধু আমিই ওকে ডাকতাম। আর সে কিনা…। আমাকে এতটা ছোট না করলেই পারত।
-কেন কী করেছে সে?
-সে আমি তোমাকে বলতে পারব না।
এই বলে লোহান আবার ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যত রাগ যেন ঐ গোলকটার উপর। এটা ভাঙলেই যেন সব ব্য়থার উপশম হবে— নিমিষেই এমন ভাবনাই তাকে পেয়ে বসেছে। নিবু তখনো একই তারে অনুরোধের সুর বাজিয়ে বলে,
-ঠিক আছে বলতে না চাও বলো না। গোলকটা ভেঙ্গো না প্লিজ!
ততক্ষণে লোহান আর সচেতন জগতে নেই। ডাইনোসরের মতোই লুপ্ত তার বোধ। তখনো হাতে রাখা গোলকটি সে আছড়ে ছুঁড়ে মারে মেঝেতে। প্রচন্ড শব্দে নিবেদিতার কান তালা লেগে যায়। মুহূর্তেই বিশ্বজগতের সঙ্গীত তার তাল হারিয়ে ফেলে। কাচের টুকরোগুলি একেকটা শূল হয়ে বেঁধে নিবেদিতার বুকে, পাঁজরে এবং হৃদয়ে-হৃদয়ে।
ব্যথার ঘোরে নিবেদিতা দেখে টুকরোগুলো আপনা থেকেই একটু একটু করে জোড়া লেগে একটা আকার ধারণ করছে। সে আকারটা ঠিক আগের মতো গোল নয়। আবার আগের খোদিত ছবিদুটো আছে, তবে আগের মতো স্বচ্ছ ও স্পষ্ট নয়। যেন হারানো স্মৃতির মতো অস্পষ্ট ও ঘোলাটে।
Be the first to comment