মূল: ড্যাভিড লজ
অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম
সূচনা
এমা উডহাউস সুদর্শন, চালাক এবং ধনী। আরামদায়ক বাসা আছে, আর সুখেই দিনাতিপাত করে। বেঁচে থাকার সর্বোত্তম কিছু আশীর্বাদকে একীভূত করেছে বলে মনে হয়। আর সংসারে প্রায় একুশ বছর ধরে আছে তেমন কোনো ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই।
অতিশয় স্নেহপ্রবণ, মমতাময়ী পিতার দু’কন্যার মধ্যে সে ছোট। বোনের বিয়ের ফলে অনেক আগে থেকেই বাড়ির গৃহকর্ত্রী হয়েছে। মা এত আগে মারা গেছেন যে মায়ের আদরের অস্পষ্ট স্মৃতিও তার মনে নেই। মায়ের জায়গায় এসেছিলেন পরিচারিকা হিসেবে চমৎকার এক মহিলা, মায়ের স্নেহের দিক দিয়ে যার ঘাটতি খুব কমই ছিলো।
উডহাউস সাহেবের পরিবারে মিস টেইলর ষোল বছর ধরে পরিচারিকার চেয়ে বরং বন্ধু হিসেবে আছেন, দুই মেয়েকেই খুব ভালবাসেন, বিশেষ করে এমাকে। এ দুয়ের মধ্যে বোনের ঘনিষ্ঠতা বেশি। পরিচারিকার নামমাত্র পদ অধিকার করার আগেও তার মেজাজের কোমলতা তাকে কোনো কঠোরতা চাপিয়ে দিতে দেয় নি। আর কর্তৃত্বের ছায়া অনেক আগে মিলিয়ে যাওয়ায় তারা এখন বন্ধু হিসেবে, খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে একসাথে থেকে আসছে। এমা যা পছন্দ করে ঠিক তা-ই করে মিস টেইলরের বিচারবোধকে উচ্চ সম্মান জানিয়ে, কিন্তু নিজের দ্বারাই প্রধানত পরিচালিত হয়।
এমার পরিস্থিতির প্রকৃত মন্দটা আসলে তার নিজের মতো করে চলার অতিমাত্রায় ক্ষমতা থাকা, আর নিজের সম্পর্কে একটু বেশি ভালভাবে চিন্তা করার প্রবণতা; এ অসুবিধাগুলোই এ জুটিটির জন্য অনেক উপভোগ-আনন্দে হুমকির কারণ হয়েছে। অবশ্য বর্তমান বিপদটা এত অস্পষ্ট যে সেগুলো কোনোভাবেই তার দূর্ভাগ্য হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
দুঃখ হাজির হলো- হালকা দুঃখ- কিন্তু কোনো অপ্রীতিকর চেতনার আকারে নয়। – মিস টেইলর বিয়ে করেছেন।
জেইন অস্টিন এমা (১৮১৬)
আমার শোনা এ যাবৎকালের সবচেয়ে বিষাদময় গল্প এটা। চরম ঘনিষ্ঠতা নিয়ে — অথবা বরং সহজ ও আলগা অথচ আপনার হাতের ভাল দস্তানার মতো অন্তরঙ্গ ভাব নিয়ে অ্যাশবার্নহ্যাম পরিবারকে আমরা নোহেম শহরের নয় ঋতু অবধি চিনি। আমার স্ত্রী ও আমি ক্যাপ্টেন ও মিসেস অ্যাশবার্নহ্যামকে চিনি, এবং যে কাউকে জানা সম্ভব। তবুও অন্য অর্থে তাদের সমন্ধে আমরা তেমন কিছুই জানি না। আমার বিশ্বাস এটা এমন একটা অবস্থা যা শুধু ইরেজদের ক্ষেত্রে সম্ভব, যাদের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কঠোর চেষ্টা করে বের করি এ বিষাদময় সম্পর্কের ব্যাপারে আমি কী জানি। আমি তো কিছু জানি না। ছয় মাস আগে আমি ইংল্যান্ডে কখনো যাই নি, আর অবশ্যই ইংরেজ হৃদয়ের গভীরতা কখনো বাজিয়ে দেখি নি। আমি শুধু অগভীরতাকে চিনেছি।
ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড দ্য গুড সোলজার (১৯১৫)
উপন্যাস কখন শুরু হয়? প্রশ্নটা জটিল ঠিক এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো, মানব ভ্রুণ কখন ব্যক্তিতে পরিণত হয়? নিশ্চয়ই প্রথম দিককার শব্দগুলো কলম দিয়ে লিখে বা টাইপ করে উপন্যাস সৃষ্টি কদাচিৎ শুরু হয়। বেশিরভাগ লেখকই প্রারম্ভিক কিছু কাজ করে থাকেন যদি সেটা শুধু তাঁদের হাতে থাকে। প্লটের ছক এঁকে, চরিত্রের জীবন-বৃত্তান্ত সংকলন করে, ধারণা, স্থান-কাল, পরিস্থিতি, কৌতুক দিয়ে কাগজ ভরিয়ে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ অথবা মাসের পর মাস ধরে লেখার প্রক্রিয়া হিসেবে অনেকে সযত্নে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। নিজের মতো করে কাজ করার উপায় সব লেখকেরই আছে। হেনরি জেমস দ্য স্পয়লজ অব পয়নটন এর জন্য যেমন দীর্ঘ তেমন মজাদার নোট করেছিলেন যেন চূড়ান্ত উপন্যাস। বোধ হয় মুরিয়েল স্পার্ক নতুন উপন্যাসের ধারণার উপর মানসিকভাবে ভেবেছেন এবং কিছু লেখেন নি যতক্ষণ না পর্যন্ত সন্তোষজনক সূচনা বাক্য ভেবেছেন।
অবশ্য পাঠকের জন্য উপন্যাস সব সময় সূচনা বাক্য দিয়ে শুরু হয় (যা আসলে ঔপন্যাসিক যে সূচনা বাক্য লিখেছিলেন তা অবশ্য নাও হতে পারে)। আর তারপর পরবর্তী বাক্য, আর তারপর তার পরেরটা…। উপন্যাসের শুরুটা কখন শেষ হয়, উত্তর দেয়ার জন্য সেটা আরেক জটিল প্রশ্ন। প্রথম প্যারাগ্যাফ, প্রথম কিছু পৃষ্ঠা, নাকি প্রথম অধ্যায়? একজন অবশ্য বলেছেন, উপন্যাসের শুরুটা হচ্ছে দ্বারপ্রান্ত যা, আমরা যে বাস্তব জগতে বাস করি তা থেকে ঔপন্যাসিক কল্পনায় যে জগৎ সৃষ্টি করেন, তাকে পৃথক করে রাখে। অতএব যেমনটা বলা হয় উপন্যাসের শুরুটা “আমাদের টেনে নিয়ে যাবে”।
এ কাজটি সহজ নয়। লেখকের সুরের সাথে, শব্দসমূহের ব্যপ্তির সাথে, বাক্য গঠনের সাথে এখনো আমরা পরিচিত নই। আমরা তো প্রথম প্রথম ধীরে ধীরে ও ইতস্ততভাবে বই পড়ি। গ্রহণ করা ও মনে রাখার মতো দেদার তথ্য আমাদের থাকে, যেমন- চরিত্রগুলোর নাম, অনুরাগ ও সমগোত্রীয়তার ভিত্তিতে তাদের সম্পর্ক, স্থান-কালের কনটেক্সচুয়াল বিবরণ যেগুলো ব্যতিরেকে কাহিনী অনুসরণ করা যায় না। এসব প্রয়াস কি কোনো কাজের হবে? বেশিরভাগ পাঠকই দ্বারপ্রান্তের উপর থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেবার আগে অন্তত কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে লেখককে সন্দেহজাত ফায়দা প্রদান করবে। এখানে দুটো নমুনা প্রদর্শিত হলেও আমাদের দ্বিধা অবশ্য ন্যূনতম কিংবা একেবারে নাই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে একেবারে প্রথম বাক্যটি দিয়ে আংটার মতো করে আমাদের বেঁধে ফেলা হয়।
জেইন অস্টিনের শুরুটা ধ্রুপদী: প্রাঞ্জল, সুচিন্তিত, বস্তুনিরপেক্ষ। প্রকরণের পরিমার্জিত মখমল দস্তানার আড়ালে ব্যঙ্গাত্মক ব্যঞ্জনা লুকায়িত। প্রথম বাক্যটি নায়িকার পতনের জন্য বেশ সূক্ষ্মভাবে রচিত। সিনড্রেলা গল্পের স্বল্প মূল্যায়িত নায়িকার বিজয়ের উল্টো যা প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস থেকে ম্যান্সফিল্ড পার্ক পর্যন্ত জেইন অস্টিনের কল্পনাশক্তিকে আগে আর্কষণ করেছিলো। এমা এমন এক রাজকন্যা সত্যিকারের সুখ পাওয়ার আগে যাকে অবশ্যই ছোট হতে হবে। “সুদর্শন” (প্রথাগত সুন্দরী বা রূপবতী –এর চেয়ে বরং সুদর্শন–এক ধরনের পুরুষসুলভ ক্ষমতা-বাসনার ইঙ্গিত, হয়তো, সেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষ বিশেষণে), “চালাক” (বুদ্ধিমত্তার দ্ব্যর্থবোধক শব্দ মাঝে মাঝে যা নিন্দাসূচকভাবে প্রয়োগ করা হয়, যেমনটা এখানে “নিজের কল্যাণের তুলনায় অতিমাত্রায় চালাক”) এবং “ধনী”, সম্পদের নৈতিক বিপদের বাইবেলীয় ও প্রবাদমূলক অনুষঙ্গ নিয়ে: এ তিনটা বিশেষণ এত মার্জিতভাবে মেশানো হয়েছে (শ্বাসাঘাত ও বর্ণতত্ত্বের বিষয়- সেগুলো পুনরায় সাজিয়ে দেখুন) যে তাতে এমার “আপাত” সন্তুষ্টির মেকিভাব অভিব্যক্ত হয়। “সংসারে প্রায় একুশ বছর ধরে আছে তেমন কোনো ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই”, রূঢ় জাগরণের প্রতীক্ষায় সে। প্রায় একুশ বছর, যা সংখ্যাগুরুর প্রথাগত বয়স; সে বয়সে তাকে এখন অবশ্যই নিজের জীবনের দায়-দায়িত্ব নিতে হবে, আর ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবিত্ত সমাজে নারীর জন্য এর মানে ছিলো– বিয়ে করবে কিনা, করলে কাকে করতে হবে– এসব। এমা তো সে দিক দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে স্বাধীন, যেহেতু সে তার পরিবারে ইতোমধ্যেই গৃহকর্ত্রী; এমন এক পরিস্থিতি যাতে ঔদ্ধত্য জন্ম নিতে পারে, বিশেষত সে যখন পরিচারিকার হাতে লালিত পালিত হয়েছে যে মায়ের স্নেহ প্রদান করেছে ঠিকই কিন্তু মায়ের শাসন প্রদান করে নি (ব্যঞ্জনা অর্থে)।
এ ইঙ্গিত আরো জোরালোভাবে লক্ষ করা যায় তৃতীয় অনুচ্ছেদে; কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে একই সাথে এমার নিজের কণ্ঠ, এবং বিচক্ষণ, নিরপেক্ষ কথকের কণ্ঠ আমরা শুনতে শুরু করি। “এ দুয়ের মধ্যে বোনের ঘনিষ্ঠতা বেশি।” “তারা এখন বন্ধু হিসেবে, খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে একসাথে থেকে আসছে।” এ বাক্যাংশগুলোতে পরিচারিকার সাথে এমার নিজের, বেশ আত্ম-তুষ্ট সম্পর্কের বিবরণ আমরা শুনছি বোধ হয়। যে পরিচারিকা তাকে “যা পছন্দ করে” তা-ই করতে দিতো। অনুচ্ছেদের শেষে ব্যঙ্গাত্মক কাঠামো, “মিস টেইলরের বিচারবোধকে উচ্চ সম্মান জানিয়ে, কিন্তু নিজের দ্বারাই প্রধানত পরিচালিত হয়”, অযৌক্তিকভাবে বেখাপ্পা দুটো বাক্যের মধ্যে সমরূপে ভারসাম্য আনে, আর এভাবেই চতুর্থ অনুচ্ছেদে কথকের স্পষ্টরূপে বর্ণিত এমার চরিত্রের ত্রুটির ইঙ্গিত দেয়। মিস টেইলরের বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে আসল কাহিনী শুরু হয়: মিস টেইলরের সঙ্গ ও পরিণত পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে এমা হ্যারিয়েট নামে এক যুবককে বেছে নেয় যে এমার সংকীর্ণ স্বার্থপরতাকে উৎসাহিত করে, আর যার পক্ষ থেকে এমা বিপর্যস্ত ফলাফল নিয়ে ঘটকালি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে শুরু করে।
ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ডের বিখ্যাত সূচনা বাক্যটি কলার ধরে দ্বারপ্রান্তের উপরে আমাদের কার্যত টেনে নিয়ে পাঠকের মনোযোগ নিবদ্ধ করার স্পষ্ট এক কৌশল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অস্পষ্টতা ও নির্দেশহীনতা, সত্য আবিস্কারের সম্ভাবনা সম্পর্কে উদ্বেগ কথনকে আক্রান্ত করে। কে এই ব্যক্তি আমাদের সম্ভাষণ জানাচ্ছে? সে ইংরেজি ব্যবহার করে, অথচ নিজে ইংরেজ নয়। “বিষাদময় গল্প” এর বিষয় হিসেবে যাদের মনে হচ্ছে সেই ইংরেজ দম্পতিকে সে চেনে অন্তত নয় বছর ধরে, তবু দাবি করে কথনের এ মুহূর্ত পর্যন্ত ইংরেজদের সম্পর্কে “কিছুই জানি না” । প্রথম বাক্যটির “শোনা” ইঙ্গিত দেয় যে সে অন্য কারো গল্প বর্ণনা করতে যাচ্ছে, কিন্তু পরপরই প্রায় এ ব্যঞ্জনা নিহিত থাকে যে কথক, এবং সম্ভবত তার স্ত্রী, নিজেরাও এর অংশ। অ্যাশবার্নহ্যাম পরিবারকে কথক ঘনিষ্ঠভাবে চেনে- এবং আদৌ জানে না। এসব স্ববিরোধী কথা যুক্তিসঙ্গত করে তোলা হয় ইংরেজপনার, ইংরেজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আচরণের প্রকাশ ও বাস্তবতার মধ্যে অসমতার প্রভাব হিসেবে। কাজেই যদিও আগাম বোধের অন্তর্নিহিত সুরে এমা কমিক না হয়ে বরং ট্রাজিক তবুও সেটার সঙ্গে এর শুরুটা একই ধরনের বিষয়বস্তুগত সুর (thematic note) তোলে। “বিষাদময়” শব্দটি অনুচ্ছেদের শেষের দিকে বারবার এসেছে, আরেকটা প্রধান শব্দ “হৃদয়” (দুটি চরিত্রেরই কথিত হৃদয়াবস্থা আছে, এলোমেলো আবেগপূর্ণ জীবন যাপন করে) শেষের আগের বাক্যে বাদ পড়ে গেছে।
জেইন অস্টিনের প্রকরণ বর্ণনা করতে গিয়ে আমি দস্তানা রূপক ব্যবহার করেছি, যে প্রকরণ নিজেই অংশত রূপক পরিত্যজ্য করে কর্তত্ব দাবি করে (যুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞানের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে রূপক প্রয়োজনীয়ভাবে কাব্যিক অলঙ্কার হওয়ায়)। দস্তানার ঐ একই রূপক বস্তুত দ্য গুড সোলজার এর সূচনা অনুচ্ছেদে দেখা যায়, যদিও ভিন্ন অর্থে। এখানে এর তাৎপর্য্য হচ্ছে নম্র সামাজিক আচরণ, সহজ অথচ নিয়ন্ত্রিত আচরণ যা প্রাচুর্য ও বিভেদমূলক রুচির সাথে খাপ খায় (“ভাল” দস্তানা সুনির্দিষ্ট করা আছে), কিন্তু প্রতারণামূলক আড়াল বা “ঢেকে ফেলা” র ইঙ্গিত আছে। প্রথম অনুচ্ছেদের কিছু কিছু হেঁয়ালি দ্রুত ব্যাখ্যা করা হয়েছে- যেমন, কথক যে ইউরোপে বসবাসকারী আমেরিকান সে তথ্য দিয়ে। কিন্তু তার প্রমাণের নির্ভরযোগ্যতা ও অন্য চরিত্রগুলোর কালানুক্রমিক অভিষ্ঠ লক্ষ্য গোপন এতে মারাত্মক বিষয় হিসেবে বিষাদময় গল্পে পরিণত হয়েছে।
উপন্যাস শুরু করার অবশ্য আরো নানা উপায় আছে, আর পাঠকেরা এ বই পড়লে সেগুলোর কিছু কিছু বিবেচনা করার সুযোগ লাভ করবেন, কেননা কথাসাহিত্যের শিল্পরূপের অন্যান্য দিকগুলো দৃষ্টান্ত দিয়ে হাজির করতে উপন্যাস বা গল্পের সূচনা অনুচ্ছেদ আমি প্রায়শই বেছে নিয়েছি (এতে প্লট সংক্ষেপে বর্ণনা করতে হয় নি আমাকে)। কিন্তু এখানে সেটা সম্ভাবনার ব্যাপ্তির ইঙ্গিত দেয়ার মতো হয়তো। উপন্যাস শুরু হতে পারে ভূদৃশ্য বা শহরদৃশ্যের উদ্বৃত্ত রগরগে বর্ণনা দিয়ে যা গল্পটার প্রাথমিক স্থান-কাল হবে, ছবি সমালোচনার ভাষায় যাকে বলে মিজ অঁ সেন : উদাহরণস্বরূপ, টমাস হার্ডির দ্য রিটার্ন অব দ্য নেটিভ এর শুরুতে এগডন হীথের বিষাদময় বর্ণনা, কিংবা আ প্যাসেজ টূ ইন্ডিয়া এর শুরুতে মার্জিত, ভদ্র গাইড বইয়ের গদ্যে ই. এম. ফর্সটারের চন্দ্রপুরের বর্ণনা। ইভলিন ওয়োর আ হ্যান্ডফুল অব ডাস্ট এর মতো কথোপকথনের মাঝখানে উপন্যাস শুরু হতে পারে, অথবা শুরু হতে পারে আইভি কম্পটন-বার্নেটের প্রাতিস্বিক কর্মের মধ্য দিয়ে। শুরু হতে পারে কথকের মনকাড়া আত্ম-পরিচয় দিয়ে, “আমাকে ইশমাইল বলে ডাকুন” (হার্মান মেলভিলের মবি ডিক), নতুবা শুরু হতে পারে আত্মজীবনীর আক্ষরিক ঐতিহ্যে রূঢ় ভঙ্গি দিয়ে: “… আপনি হয়তো প্রথম যে বিষয়টা জানতে চাইবেন তা হচ্ছে আমার জন্ম কোথায়, আর আমার নিম্নমানের শৈশব কেমন ছিলো, আর আমার মা-বাবা কী নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং আমার জন্মের আগের সব কিছু, আর ড্যাভিড কপারফিল্ড ধরনের ফালতু সব কিছু, কিন্তু এসবের ভেতর যেতে আমার ইচ্ছে করছে না” (জে. ডী. স্যালিঞ্জারের দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই )। ঔপন্যাসিক দার্শনিক ভাবনা দিয়েও শুরু করতে পারেন – “অতীত হচ্ছে বিদেশ: সেখানে তারা সব কিছু করে ভিন্নভাবে ” (এল. পি. হার্টলি, দ্য গো–বিটউইন ), অথবা প্রথম বাক্য দিয়েই চরিত্রকে চরম বিপদে নিক্ষেপ করতে পারেন: “ব্রাইটনে তিন ঘন্টা থাকার আগে হেইল জানতো তাদের উদ্দেশ্য ছিলো তাকে হত্যা করা” (গ্রাহাম গ্রীন, ব্রাইটন রক )।
অনেক উপন্যাসই শুরু হয় “ছকে বাঁধা গল্প” দিয়ে যাতে গল্প কীভাবে বানানো হলো তার ব্যাখ্যা থাকে, কিংবা কথাসাহিত্যের পাঠকের কাছে বর্ণিত হওয়ার বিবরণ থাকে। কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস এ বেনামী কথক টেমস নদীর মোহনায় পাল তোলা নৌকার পাটাতনে বসা একদল বন্ধুকে তার কঙ্গোর যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তা বর্ণিত হওয়ার বিবরণ থাকে (“আর এটাও,” মারলো শুরু করে, “পৃথিবীর অন্ধকার জায়গাগুলোর একটি হয়েছে”)। হেনরি জেমসের দ্য টার্ন অব দ্য স্ক্রু তে এক মৃত রমণীর স্মৃতি থাকে, যা দেশের বাড়ির অতিথিদের কাছে জোরে জোরে পড়া হয় যারা ভূতের গল্পে মজা পেয়ে আসছে, আর হয়তো যা প্রত্যাশা করেছিলো তার চেয়েও বেশি পায়। কিংজ্লে অ্যামিজ তাঁর ভূতের গল্প, দ্য গ্রীন ম্যান শুরু করেন দ্য গুড ফূড গাইড এর রসদীপ্ত অনুকরণে: “কেউ লন্ডন থেকে ৪০ মাইল ও এম ওয়ান থেকে ৮ মাইলেরও কম দূরত্বে প্রকৃত ঘোড়া বদল করার সরাইখানা পেয়ে যাওয়ার বিস্ময় কাটাতে না কাটাতেই সমানভাবে ইংরেজ মেলার গুণাদর্শে বিস্মিত হচ্ছে…” । ইটালো ক্যালভিনোর ইফ অন আ উইনটার’স নাইট আ ট্রাভেলর শুরু হয়, “আপনি প্রায় শুরু করতে যাচ্ছেন ইটালো ক্যালভিনোর নতুন উপন্যাস ইফ অন আ উইনটার’স নাইট আ ট্রাভেলর ”। জেমস জয়েসের ফিনেগানজ ওয়েক বাক্যের মাঝখানে শুরু হয়: “নদী চালিত, আদম-হাওয়াকে ছাড়িয়ে, তীরের বাঁক থেকে উপসাগর পর্যন্ত পুনরায় চলার প্রশস্থ ভিকাস (প্রাচীন রোমের ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিট) আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনে হাউথ দূর্গ ও তার পরিপার্শ্বে।” বাদপড়া অংশটুকু দিয়ে বইটি শেষ হয়: “একটা পথ একটা নিঃসঙ্গ একটা অন্তিম একটা ভালবাসা পাওয়া একটা দীর্ঘ” –এভাবে আমাদের কাছে আবার শুরুতে ফিরে আসে সেই পরিবেশের নদীর পুনর্চলার মতো করে, নদী থেকে সাগরে, সাগর থেকে মেঘে, মেঘ থেকে বৃষ্টিতে, বৃষ্টি থেকে নদীতে, আর কথাসাহিত্য পঠনে অফুরন্ত অর্থ সৃষ্টির মতো করে।
Be the first to comment