দেশ নিয়ে স্বপ্ন ও অনুভূতি
–শাহীনুর ইসলাম
মা, মাটি ও দেশ মানুষের অস্তিত্বের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তিনটি জিনিস। এক সময় মায়ের তেমন প্রয়োজন থাকে না। কিন্তু মাটি ও দেশের প্রয়োজন কখনো ফুরায় না। মায়ের বৈষয়িক প্রয়োজন শেষ হলেও মায়ের মমতা ও আশীর্বাদ লাভের আকুতি আজীবন থাকে। বয়স হওয়ার সাথে সাথে সেই মমতা স্থানান্তরিত হয় মাটি ও দেশের প্রতি। বিশেষ করে যারা বিদেশে থাকেন, এই স্থানান্তরিকরণ তাদের বেশি ঘটে। মাটি ও দেশের বৈষয়িক প্রয়োজন প্রবাসীদের জীবনে সেভাবে না থাকলেও মায়া-মমতার কাঙাল থেকে যান আজীবন। জন্মদাত্রী মায়ের অনুপস্থিতি বোধে যেমন বুক মোচড়ায়, হাহাকার হু হু করে বেজে ওঠে, দেশের শারীরিক অনুপস্থিতিও তেমনই বোধ জাগায়। হাজার হলেও জীবনের প্রথম গন্ধ, দর্শন, শ্রবণ, বচন ও স্পর্শ তো মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। এরপর প্রত্যক্ষণের এই অভিজ্ঞতা দেশের জল-হাওয়া, উদ্ভিদ ও প্রাণী এবং সবোর্পরি মাটি ও মানুষের মমতা রসে ঋদ্ধ হয় যা অস্তিত্বের গভীর স্তরে লেপটে থাকে সুপার গ্লুর মতো। কখনো মোছা যায় না, কখনো ভোলাও যায় না। বার বার ফুটে ওঠে কথার টানে, চোখের চাহনিতে, হাতের অঙ্গভঙ্গিতে, পায়ের সঞ্চালনে ও ওঠা-বসার ভঙ্গিসহ সকল আচরণ বৈশিষ্ট্যে। দেশ-কাল-পাত্র সেখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। বরং যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়ে সেই অভিজ্ঞতার সাথে সবকিছু মেলানো ও তুলনা করার প্রয়াস প্রতীয়মান হয়।
দেশের সাথে নাড়ীর এই অচ্ছেদ্য কিন্তু আপাত অদৃশ্য বন্ধনের দরুন দেশের ভাল কোনো খবর যেমন হাজার হাজার মাইল দূরের প্রবাসী হৃদয়কে বিমোহিত ও গর্বিত করে, খারাপ কোনো খবরও তেমনই লজ্জিত ও বিমর্ষ করে। এক কথায় প্রতিটি ঘটনা নাড়া দিয়ে যায় খবরের ধরণ অনুযায়ী। তাই যে কোনো অবস্থায় দেশ ও দেশের মানুষ ভাল থাকুক, উত্তরোত্তর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে দেশ অগ্রসর হোক— সর্বদা এটাই প্রত্যাশা করি একজন প্রবাসী হিসেবে।
এখন বাংলাদেশে যখন গ্রীষ্মের দাবদাহে মধুমাসকে সামনে রেখে নববর্ষের আগমন ঘটছে, সুদূর এই কানাডায় তখনো বসন্ত বিরাজ করছে। কিন্তু বৃক্ষের দিকে তাকালে মনে হয় ক্ষোভে-দুঃখে তারা বরফের খাদি চাদর সবেমাত্র সরিয়ে এখনো অসহ্য নীরবতায় ও নিথর অভিমানে সোনালী দিনের অপেক্ষা করছে। পত্রপল্লব সবেমাত্র মুকুলিত হচ্ছে। পাখিরাও রাগে-অভিমানে প্রাণ ভরে গান গাচ্ছে না, বাজছে না কোনো স্বাগত সঙ্গীত। বাংলাদেশে বসন্তে যে হৃদয় উদাস করা পাগলা হাওয়া দেখি তা এখানে কই? এখনো বাতাসে হু হু করে বেজে ওঠে শীতের হাহাকার। মাঝে মাঝে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে দেখি। কিন্তু দেশের সেই ঝমঝম ভরা ভাদর এখানে কখনো দেখি না। প্রকৃতি কত কী না আমাদের দিয়েছিলো! কত কিছুই না জন্মে সোনার বাংলাদেশে! এরা যদি পাথরে ফুল ফোটাতে পারে, আমরা কেন ফুলকে পাথর করে রাখবো? তাই আমি স্বপ্ন দেখি সেই সোনার বাংলার যেখানে প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণী অবাধে ও নির্ভয়ে জীবন-যাপন করবে। সারি সারি বৃক্ষ ফুলে ও ফলে নুয়ে পড়বে। বসন্ত বাতাসসহ কোনো ঋতুর বাতাসই জীবাণুদের অভয়ারণ্য হবে না। সবাই বিশুদ্ধ পানি ও নির্ভেজাল খাবার খেতে পারবে। আরো স্বপ্ন দেখি সবাই সুস্থ ও সুন্দর জীবন-যাপনের অধিকার ভোগ করবে। এছাড়া সবাই শ্রম-মর্যাদা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, নারী-স্বাধীনতা, যে কোনো বয়সে শিক্ষালাভের সুযোগ-সুবিধা, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ, যা-ইচ্ছে-তাই (ভাল অর্থে) হওয়ার সুযোগ, বয়স্ক-সুবিধা এবং শিশু-সুবিধা লাভ করবে। যদি কিছুই না হয়, অন্তত সবার সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক অধিকারগুলো যেন আপাতত নিশ্চিত হয়। সবশেষে বলি আমাদের ফুল ফোটানোর যথেষ্ট সামর্থ্য রয়েছে। শুধু সেই ফুল নির্ভয়ে ও নিরাপদে ফোটার জন্য আমরা যেন উপযুক্ত পরিবেশ রেখে যেতে পারি— কায়মনোবাক্যে এই কামনা করি।
Be the first to comment