কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: কমিক উপন্যাস

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


কমিক উপন্যাস


“চলো এখন দেখি; এর কী সঠিক শিরোনাম তুমি দিয়েছো?” সিক্ত এপ্রিল মাসের শেষে উজ্জ্বল সবুজ মাঠে জানালা দিয়ে তাকালো ডিক্সন। তাকে হতবিহ্বল করা শেষ অর্ধ-মিনিটের কথাবার্তার দ্বৈত-উন্মোচন ছিলো না এটি, কারণ এমন ঘটনাগুলো ওয়েলচের আনুষ্ঠানিক আলোচনার প্রধান উপাদান ছিলো; সে যে নিবন্ধটি লিখেছিলো, তার শিরোনাম আওড়ানোর সম্ভাবনা ছিলো এটি। একেবারে নিখুঁত শিরোনাম ছিলো, যেহেতু নিবন্ধটির অস্বস্তিকর মূঢ়তা, সত্য ঘটনার বিশাল ফারাক-কার্যকারী শেষকৃত্যের যাত্রা, সমস্যাহীনতার উপর মেকি আলোকপাত স্বচ্ছ করে তোলে এটি। ডিক্সন এটা পড়েছে, অথবা পড়তে শুরু করেছে এটার মতো আর দশটা, কিন্তু তার নিজেরটাকে এটার নিজের কার্যকারিতা ও তাৎপর্য্যে নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারে বেশিরভাগগুলোর চেয়ে নিকৃষ্ট মনে হলো। “অদ্ভূতভাবে অবহেলিত এ বিষয়টি বিবেচনা করতে গিয়ে,” এভাবে শুরু হয়। এটা কোন অবহেলিত বিষয়? অদ্ভূতভাবে এ কোন বিষয়? অদ্ভূতভাবে অবহেলিত এ কোন বিষয়? টাইপস্ক্রিপ্ট নষ্ট না করে ও আগুন না ধরিয়ে দিয়ে তার এসব চিন্তা তাকে শুধু নিজের কাছে ভণ্ড ও বোকা হিসেবে প্রতিভাত করে। “চলো দেখি,” স্মৃতির মেকি প্রয়াসে সে ওয়েলচের প্রতিধ্বনি করলো: “ওহ্ হ্যাঁ; জাহাজ নির্মাণ কৌশলে উন্নয়নের অর্থনৈতিক প্রভাব, ১৪৫০ থেকে ১৪৮৫। মোট কথা, সেটা এটাই যা…”

বাক্যটি শেষ করতে না পেরে সে আবার বামে তাকালো প্রায় নয় ইঞ্চি দূরে থেকে তার নিজের মুখে তাকিয়ে থাকা কোনো মানুষের মুখ খুঁজতে । সে তাকিয়ে থেকে দেখলো আতঙ্কে ভরা মুখটি ভ্যান চালকের ছিলো, যে ভ্যানটি ওয়েলচ নির্বাচন করেছিলো দুটো পাথরের দেয়ালের মধ্যে আচমকা এক মোড় অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য। এখন বড় একটা বাস মোড়টি ঘিরে দূর থেকে দুলতে দুলতে দৃশ্যপটে এলো। ওয়েলচ হালকা ধীরে চালালো, এভাবে নিশ্চিত করে যে যখন বাসটি তাদের কাছে পৌঁছালো, তারা তখনো ভ্যানটির কাছাকাছি আসবে, আর সিদ্ধান্ত নিয়ে বললো: “বেশ, সুন্দর হয়েছে, বলবো।”

কিংজলি অ্যামিজ লাকি জিম (১৯৫৪)

কমিক উপন্যাস অনেকটাই ইংরেজি কিংবা অন্ততপক্ষে ব্রিটিশ এবং আইরিশ ধরনের কথাসাহিত্য , যা অনেক দূরে নিয়ে গেলে সব সময় ভাল হয় না। কিংজলি অ্যামিজের পরের দিককার উপন্যাসগুলোর একটি, জেইক থিং, পর্যালোচনা করে জন আপডাইক বেশ দয়াপরবশ হয়ে বলেছেন, “তাঁর আকাঙ্খা ও যশ উভয়ই ‘কমিক উপন্যাস’ এ মুগ্ধ হয়ে পড়ে আছে,” আরো বলেছেন: “জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তব ঘটনাকে পাশাপাশি পরিবেশন করলে তাতেই যখন যথেষ্ঠ হাস্যরস পাওয়া যায়, তখন ‘কৌতুককর উপন্যাস’ লেখার প্রয়োজন নেই।” কাউকে বলতেই হয়, তাঁর জন্য যথেষ্ঠ। আঠার শতকের ফিল্ডিং, এবং স্টার্ন ও স্মোলেটের কাজ থেকে শুরু করে ঊনিশ শতকের জেইন অস্টিন ও ডিকেন্স এবং বিশ শতকের ইভলিন ওয়ো পর্যন্ত ইংরেজি উপন্যাসের ঐতিহ্যে নিশ্চয়ই ইংরেজি ধ্রুপদী উপন্যাসগুলোর মধ্যে কমিক উপন্যাসের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এমনকি জর্জ এলিয়ট, টমাস হার্ডি এবং ই. এম. ফরস্টারে মতো ঔপন্যাসিকেরা যাঁদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য কৌতুককর উপন্যাস না লেখা, তাঁরাও তাঁদের কথাসাহিত্যে সেইসব দৃশ্যাবলী রেখেছেন যেগুলো আমাদেরকে উচ্চস্বরে হাসায়, এমনকি বারবার পড়লেও।

কথাসাহিত্যে কমেডি থাকার দুটো প্রাথমিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে প্রতিভাত হয়, যদিও সে উদ্দেশ্য দুটো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত: পরিস্থিতি (যাতে চরিত্র জড়িয়ে থাকে — যে পরিস্থিতি একটি চরিত্রের জন্য কমিক, অন্য চরিত্রের জন্য তা প্রয়োজনীয়ভাবে তেমন হবে না) এবং প্রকরণ। উভয়ই যুৎসই সময়-নির্ধারণের(timing) উপর গুরুত্বপূর্ণভাবে নির্ভর করে, অর্থাৎ, যে বিন্যাস অনুযায়ী শব্দসমূহ এবং তাতে যে তথ্য থাকে, সেগুলোকে সাজানো হয়। এ নীতিটিকে উদাহরণ দিয়ে দেখানো যেতে পারে ইভলিন ওয়োর ডিক্লাইন এন্ড ফল  থেকে একটি বাক্য দিয়ে। উপন্যাসটির শুরুতে লাজুক, শান্ত-শিষ্ট নায়ক, পল পেনিফেদার যে অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েট, তার ট্রাউজারটি খুলে ফেলে একদল মাতাল অভিজাত লোক, আর অশোভন আচরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৈশাচিক অবিচার প্রদান করে তাকে বের করে দেওয়া হয়। প্রথম অধ্যায়টি শেষ হয়:

“ঈশ্বর তাদের সবাইকে নরকে জ্বালিয়ে মারুক,” স্টেশনের দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে পল পেনিফেদার নীরবে মনে মনে বললো, আর তখন সে বেশ লজ্জিত বোধ করলো, কারণ এরকম গালিগালাজ সে কদাচিৎ করেছে।”

এতে যদি আমরা হাসি, আর আমার মতে বেশিরভাগ পাঠকই তাই করে, তবে হাসি “নীরবে” শব্দটির বিলম্বিত আবির্ভাবের কারণে: বাক্যটি যখন শুরু হয়, তখন উপদ্রুত নায়কের ন্যায্য ক্রোধের দীর্ঘ বিলম্বিত বিস্ফোরণ বলে যা মনে হয়, তা শেষে সে রকম কিছু হিসেবে দেখা যায় না, বরং তার ভীরুতা ও নিস্ক্রিয়তার আরো দৃষ্টান্ত মেলে। এ প্রভাবটি ধ্বংস হয়ে যেতো যদি বাক্যটি এভাবে হতো: “স্টেশনের দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে পল পেনিফেদার নীরবে মনে মনে বললো, ‘ঈশ্বর তাদের সবাইকে নরকে জ্বালিয়ে মারুক… ’ ” কথাসাহিত্যে কমেডির আরেক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত দেয় এটি: চমক (পল   অন্তত তার অনুভূতি প্রকাশ করছে) এবং বিন্যাস মেনে চলার (না মোট কথা সে নয়) সম্বনয় সাধন।

হাস্যরস কুখ্যাতভাবে ব্যক্তিনির্ভর বিষয়, কিন্তু সেই পাঠক খুবই পাষাণ হৃদয়ের হবে যে পাঠক লাকি জিম এর প্যাসেজটিতে এক চিলতেও হাসে নি, যেখানে কমিক কথাসাহিত্যের এ গুণাবলী ব্যাপক পরিমার্জিত রূপে প্রদর্শন করা আছে। প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী সহকারী প্রভাষক হিসেবে জিম ডিক্সন তার চাকুরী চলমান রাখার জন্য উদাসী অধ্যাপকের পৃষ্ঠপোষকতার উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল, যে পৃষ্ঠপোষকতায় প্রয়োজন হয় যে পাণ্ডিত্যপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশ করে জিম পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শন করুক। জিম তার অধ্যাপক ও শিক্ষাগত পাণ্ডিত্য- উভয়কেই অবজ্ঞা করে, কিন্তু সেটা বলতে পারে না। কাজেই তার রাগ মাঝে মাঝে সহিংসতার অবাধ কল্পনার ভেতরেই থেকে যায়, (যেমন–চেয়ারে ওয়েলচকে বেঁধে রাখা ও বোতল দিয়ে তার মাথায় ও কাঁধে মারতে থাকা যে পর্যন্ত না সে ফাঁস করে যে নিজে ফরাসি না হয়েও কেন সে তাঁর ছেলেদের ফরাসি নাম রাখলো) এবং এখানকার মতো অন্য সময়ে চরিত্র, ডিসকোর্স ও প্রাতিষ্ঠানিক বিধি যা তাকে নির্যাতন করে, সেগুলো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক মানসিক ভাষ্যে থেকে যায়।

লাকি জিম এর রচনাশৈলী ইংরেজি কথাসাহিত্যে নতুন একটা কণ্ঠস্বরের সূচনা করে। এ স্বর শিক্ষিত তবে শ্রেণীহীন, বাগ্মী তবে প্রথাগতভাবে মার্জিত নয়। এর সাধু, সংশয়মুলক যথার্থতায় এটি “সাধারণ ভাষা” দর্শনের কাছে কিছুটা পেয়েছে, অ্যামিজের ছাত্রাবস্থায় যা অক্সফোর্ডে আধিপত্য বিস্তার করে (“সমস্যাহীনতার উপর মেকি আলোকপাত”এ বিশেষভাবে স্পষ্ট প্রভাব)। এতে ছোট-খাট চমক, যোগ্যতা ও বিপরীত ক্রিয়ায় ভরা, যা ব্যবহারজীর্ণ রূপকল্প বা চিন্তাকে এবং গৎবাধা জবাবকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বিনির্মাণ করে।

নিবন্ধের শিরোনাম সম্পর্কে ওয়েলচের প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব দেয় না ডিক্সন, যদিও “তাকে হতবিহ্বল করা শেষ অর্ধ-মিনিটের কথাবার্তার দ্বৈত-উন্মোচন ছিলো না এটি।” যদি তা না-ই হয়, তবে আমাদের বলছে কেন? দুটো কারণ আছে: ১) ওয়েলচের বিরক্তিকর কথা বলার অভ্যাস, যেন সে এইমাত্র এটা নিয়ে ভেবেছে যা জিম নিজেই এইমাত্র বলেছে– এর উপর মজাদার রূপকগত মন্তব্য করে এটি, এবং ২) এটি বিলম্ব  সৃষ্টি করে, কমিক উৎকণ্ঠার ক্ষুদ্র মুহূর্ত সৃষ্টি করে, যা জিমের নীরবতার আসল কারণ উদঘাটনকে জোরালো করে: তার নিবন্ধের শিরোনাম আওড়াতে হবে তাতে তার বিব্রত হওয়া। বক্রাঘাতমুলক অর্থে শুধু এটি একটি “নিখুঁত” শিরোনাম যে জিম অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্সের যা যা বৈশিষ্ট্য অবজ্ঞা করে, তার প্রতিটি এটি অপছন্দ করে। “ডিক্সন এটা পড়েছে, অথবা পড়তে শুরু করেছে এটার মতো আর দশটা…  । বাঁকা অক্ষরের বাক্যাংশ জিমের বিরক্ত ও অধৈর্য্য হয়ে অ্যাকাডেমিক জার্নালগুলো পড়া সম্পর্কে আমাদের জানান দেয়। নিবন্ধটির সূচনা বাক্যে তার অত্যুৎকৃষ্টভাবে ধ্বংসাত্মক বিশ্লেষণ, যার মধ্যে প্রথাগত পাণ্ডিত্যপূর্ণ সূত্রের প্রতিটি শব্দ পালাক্রমে বিদ্রুপাত্মক জেরার অধীন করা হয়েছে, তাতে আর কোনো মন্তব্যের প্রয়োজন নেই। এরপর জিমের নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক অপবিশ্বাস থেকে আসে চরিত্রসুলভ দোষারোপ, আসে এমন এক অবস্থা যা থেকে মেরি ইংল্যান্ডের উপর মাতাল বক্তৃতা দিয়ে পরিণামে অনিচ্ছায় নিজেকে মুক্ত করে। তারপর অবশেষে ধূলিশুষ্ক পাণ্ডিত্যের প্রতীক, নিবন্ধটির শিরোনাম আমরা পেয়ে যাই, যা আমার চেনা অনেক অ্যাকাডেমিক পাঠক মুখস্থ করেছে। কথন আসঞ্জনের কোনো ক্ষতি না করেই ওয়েলচের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে এ উচ্চারণ আসতে পারতো, কিন্তু তাতে কমিক প্রভাবময়তার বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতো।

ওয়েলচের গাড়িতে যাত্রী হয়ে এবং তার ভয়ঙ্কর গাড়ি চালনার অসহায় শিকার হয়ে জিমের ক্ষমতাহীনতা শারীরিকভাবে প্রতীকায়িত হয়। সবুজ মাঠগুলোর দিকে গাড়ি থেকে ডিক্সনের বাইরে তাকানো মামুলি ও আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় বাক্যটির কাজ আছে বলে এখন প্রমাণিত হয়। কিছুক্ষণ পরে একই জানালা দিয়ে তাকিয়ে জিম অবাক হয় “প্রায় নয় ইঞ্চি দূরে থেকে তার নিজের মুখে তাকিয়ে থাকা কোনো মানুষের মুখ” খুঁজে পেয়ে। চমকের সমন্বয় ঘটে বিন্যাস মানার সাথে (ওয়েলচের অযোগ্যতা)। ভাষার শ্লথগতির যথার্থতা দিয়ে ধীর গতির প্রভাব সৃষ্টি করা হয় (“প্রায় নয় ইঞ্চি দূরে”, “আতঙ্কে ভরা”, “নির্বাচন করেছিলো…অতিক্রম করার জন্য”), আর হাস্যরসাত্মকভাবে গতির সাথে বৈসাদৃশ্য তুলনা করা হয়, যে গতিতে আসন্ন সংঘর্ষ ঘনিয়ে আসে। কী ঘটছে তা পাঠককে সঙ্গে সঙ্গে বলা হয় না, কিন্তু চরিত্রের চমক ও আতঙ্ক পুনরায় কার্যকর করে অনুমান করতে দেয়া হয়। সবটাই  যুৎসই সময়ে।


আগের পর্ব                                                                                                               পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*