বর্ণবিষে বর্ণালী

গল্প




বর্ণবিষে বর্ণালী

-শাহীনুর ইসলাম


গত দু’মাসে বর্ণালী কোথাও বের হতে পারেনি। একে তো কাজের ব্যস্ততা ছিল, তার উপর ছিল খারাপ আবহাওয়া। তাছাড়া এবারের বড়দিন ও নববর্ষের দীর্ঘ ছুটিটাও কেটেছে তার অসুস্থ মায়ের দিকে নজর রেখে। বরাবরের মতো গত দু’মাস তার ছেলেবন্ধু এন্ড্রুর জন্য তীব্র ব্যাকুলতায় অপেক্ষা করছিল সে। কিন্তু যখন সে দেখল এন্ড্রু কিছুতেই এলো না, তখন অবশেষে নিজেই সিদ্ধান্ত নিল যে, পূর্ব উপকূলীয় অঙ্গরাজ্য নোভা স্কশিয়া থেকে একাই অটোয়া যাবে। এভাবে একই উদ্দেশ্যে দু’মাস আগে সে গিয়েছিল ভ্যাঙ্কুভারে। তারও দু’মাস আগে কুইবেক সিটিতে।

অটোয়ায় যাওয়ার জন্য সে জানুয়ারির শেষ দিনটাকে বেছে নেয়। কারণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী এ মাসের এ দিনটা অন্তত তুলনামূলক ঝরঝরে থাকবে। কোনো তুষার ঝড় কিংবা বরফি বৃষ্টি হবে না। যদিও এ মাসের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে থেকে থেকে তৃষারপাত দৃশ্যমান ছিল সর্বত্র। প্রতিটা মাঠ-ঘাট, খোলা প্রান্তর ছিল যেন বিশাল একেকটা সমাধি, যেগুলোর প্রত্যেকটি আবার একখানা ধবধবে শাদা কাফনের কাপড়ে মোড়া পড়ে ছিল এবং কখনো-সখনো সেগুলোর উপরে তুষার তর্পিত হচ্ছিল। সেই তর্পণে এমনভাবে জেগে উঠছিল যেন-বা ডাঙ্গায় হিমশীতল তুষার চর। আর ঈশ্বর এর পটভূমি হিসেবে নিজ হাতে কিছু চিরসবুজ বৃক্ষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রোপণ করে রেখেছিলেন। এই প্রান্তরগুলো এখনো এতটাই শাদা যে রাতের বেলা অন্ধকার তার নিকষ কালো অস্তিত্ব হারিয়ে মনে হয় সফেদ জোছনার মেদুর প্রলেপ মেখে কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। একে শাদাটে অন্ধকার বললেই হয়ত যুতসই হয়।

বর্ণালীর যাত্রার আগের রাতেও তুষারপাত হয়েছে প্রায় চল্লিশ সেন্টিমিটার। ভোরের দিকে কমতে শুরু করে সকালে এসে মিইয়ে গেছে। তবু যতকিছুই ঘটুক না কেন, খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ব্যালকোনিতে গিয়ে বাইরের প্রকৃতিকে দেখার ও বাতাসের সজীবতার প্রলেপ গায়ে মাখার বহুদিনের অভ্যাস তার। তার মতে এতে নাকি সারাটা দিন ফুরফুরে থাকা যায়।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ব্যালকোনিতে যায়। গিয়ে দেখে সারা রাতের তুষারপাতে সবকিছু শুধু শাদা দেখাচ্ছে। তাপমাত্রা এখনো হিমাঙ্কের বেশ নিচে। চিরসবুজ দেবদারুর গোলগাল চেহারায় যেন গুচ্ছ গুচ্ছ শাদা তুষার ফুল ফুটে আছে। ম্যাপল, পপলার, সিডার, ওক ইত্যাদি পত্রঝরা গাছগুলোকে নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। এদের নিঃসঙ্গতা এতটাই প্রকট যে রাগে-ক্ষোভে এরা তুষারকে গা ঝাড়া দিয়ে নিমিষে ফেলে দিয়েছে যেন। অথবা তুষার এদের গায়ে সুবিধাজনকভাবে জেঁকে বসতে পারেনি। ফলে যত তুষারই ঝরুক, সে শাদা পটভূমিতে গাছগুলো সব সময় একটা কালচে ও বাদামী প্রভা তুলে ধরে আছে। দৃশ্যটাকে তুলনা করা যেতে পারে চাঁদের কলঙ্কের সাথে। কিংবা রাতের কালো আকাশে তারা হিসেবে। কেননা চাঁদের দাগ যেমন জোছনার একঘেয়েমি অথবা তারা যেমন অন্ধকার রাতের ক্লান্তি দূর করে এ গাছগুলোও ঠিক তেমনটাই করেছে।

বর্ণালীর দশতলা অ্যাপার্টমেন্টটির ব্যালকোনি থেকে নিচের ভূমিকে পুরোটাই শাদা মনে হচ্ছে। এমনকি পার্কিং লটে থাকা নানান রঙের গাড়িগুলোকেও তুষার-শুভ্র উত্তোলিত কফিনের মতো লাগছে। আর রাস্তায় চলাচল করা প্রতিটা গাড়ির হেডলাইটগুলোকে মনে হচ্ছে নদীতে পানির উপরিতলে ঝাঁক বেধে বেড়ানো ইন্দে মাছের একেক জোড়া চোখ। দু’একটা যে বসার বেঞ্চি দেখা যাচ্ছে সেগুলোতে তুষার সবাইকে ভাগিয়ে শাদা শাদা গদিতে আরাম করে বসে আছে যেন। এই শীতের মধ্যেও কালো কালো কাককে একের পর এক দল বেঁধে তাদের বিল্ডিংয়ের উপর দিয়ে উড়তে দেখা যাচ্ছে। তবে অন্য কোনো পাখি বা প্রাণীকে বের হতে দেখা যাচ্ছে না। সূর্য পূর্বাকাশে উঠি উঠি করছে এবং আকাশটাকে পরিস্কার ঝকঝকে দেখা যাচ্ছে। তবে স্পষ্টতই মনে হচ্ছে সূর্যটা শুক্ল গহ্বরের দশায় পড়বে। কৃষ্ণ গহ্বর যেমন তার চারপাশের সব কিছু— এমনকি আলোকেও শুষে নেয়, এ শুক্ল গহ্বরও তেমনই। অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠের তুষারাবরণ এবং মেঘমুক্ত স্বচ্ছ আকাশ মিলে সূর্যের সবটুকু তেজ আত্মসাৎ করে। সূর্যকে তখন পানিতে প্রতিফলিত পূর্ণিমার মতোই মেকি মনে হয়।

ব্যালকোনি থেকে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে বর্ণালীর মনে হয়, তুষার এবং বরফ আচ্ছাদিত শীতকালেরও নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে। এ সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে হলে অনেকটা উইন্টার-প্রুফ দেহ-মন লাগে। এখানকার অভিবাসী প্রথম প্রজন্ম সেটা পারে না। কয়েক প্রজন্ম পরে অনেকটা পারে। আর এর পুরোটা উপভোগ করতে পারে তারাই যারা এখানকার আসল অধিবাসী অর্থাৎ ইনুইট, মেতিস ও ফার্সট নেশনস। তার প্রমাণ তুষার ও বরফের বিভিন্ন রূপ বোঝাতে এদের নিজস্ব ভাষায় নাকি এরা হাজার খানেকেরও বেশি শব্দ ব্যবহার করে। এটা প্রয়োজনে যেমন করে, সৌন্দর্য বোঝাতেও নিশ্চয়ই তেমন করে।

সকালবেলার এমন প্রকৃতিভোজন ও প্রকৃতিপাঠ শেষে বর্ণালী ঘরে ফিরে আসে। নাশতা সারে ও কফি পান করেই ছয়টায় রওয়ানা দেয় অটোয়ার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে সূর্যটাকে আকাশে দেখতে পায় সে। আর দিনটাকে দেখে তার মনে হচ্ছে রোদে খানিকটা ঝকঝক করে উঠছে যেন দীর্ঘ সময়ের কড়া শাসন থেকে মুক্ত হওয়া দূরন্ত কিশোরীর উদ্ভিন্ন যৌবন। এ সময় সে নিজের ছাইরঙা এসইউভি গাড়িটিতে উঠে বসে ইঞ্জিন গরম করার জন্য গাড়ি দশ মিনিট চালু অবস্থায় রাখে। গাড়ি চালিয়ে অটোয়ায় যেতে এক নাগাড়ে পনের-ষোল ঘন্টা লাগবে তার। ইচ্ছে করলে সে বিমানে যেতে পারত। এতে সময়ও কম লাগত। কিন্তু এখন তার কাছে যথেষ্ট টাকা নেই। তাছাড়া সে অনেকটাই দুঃসাহসিকভাবে প্রকৃতি-প্রেমী। ভূ-প্রাকৃতিক দৃশ্যরস উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হতে চায় না সে কোনোভাবে।

গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তার দু’পাশে অদূরে জনমানবহীন শাদা ভূমিতে পত্রপল্লবশূন্য ছোট ছোট বন দেখতে পায় বর্ণালী। কোনো কোনো বনে তুষারপাত এমনভাবে হয়েছে যে, বনের বড় বড় গাছগুলো থেকে তা নিচে ঝরে ছোট ছোট গাছগুলোতে গিয়ে জমা হয়েছে। ফলে উপরে কালচে, কিন্তু নিচে শাদাটে দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো সৌখিন বুড়ো তার মাথার পাকা চুলে কালো কলপ লাগিয়েছে। কিন্তু কলপ লাগানোর উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে চুলের উপরের অংশ কালচে দেখাচ্ছে, আর নিচের অংশ শাদা দেখাচ্ছে।

সবখানেই বরফ কম-বেশি প্রাধান্য বিস্তার করছে। এমনকি মহাসড়কের দু’পাশেও স্তুপীকৃত করে রাখা আছে তুষার। নগরের ভ্যানচালক এখনো লবণ ছিটাচ্ছে যাতে বরফ গলে যায় এবং রাস্তা পিচ্ছিল না হয়। আবার কিছু দূরে দেখা যাচ্ছে অন্য কোনো ভ্যানচালক ভ্যানের মেশিনের তাপে জমাটকৃত বরফ নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে পানিতে পরিণত করছে। হিমশীতল হাওয়া ঠেকাতে প্রতিটা গাড়ির মতো তার গাড়িতেও তাপ ছাড়া আছে। প্রতি শীতে তুষার-সৃষ্ট বিপর্যয়কে সামাল দিতে এখানকার সরকারকে এভাবে অতিরিক্ত কিছু টাকা গুণতে হয়। আর মানুষকে স্বীকার করতে হয় বাড়তি কষ্ট।

কম-বেশি একই রকম দৃশ্য দেখতে দেখতে কয়েকটি শহর অতিক্রম করে সে। শহরগুলোর মহাসড়কের দুপাশে কোনো গাছ-গাছালি নেই। এখন তার একটু বিরতি দরকার। সিদ্ধান্ত নেয় সামনের কোনো কফি শপে চলে যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা টিম হর্টনস-এর বিরাট সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। দেখামাত্রই মহাসড়কের সামনের এক্সিট ধরে বের হয়ে আসে। কফি শপ পর্যন্ত পথটা কিছুটা ‘ত’ আকৃতির মতো। এ পথ ধরে যেতে যেতে পাঁচ থেকে পনের হাত লম্বা বিভিন্ন আকারের সারি সারি অল্পবয়স্ক দেবদারু গাছ দেখতে পায় সে। তুষার পড়ে পড়ে গাছগুলোর যেন মানব সদৃশ শাদা হাত গজিয়েছে বলে মনে হয়। অবশ্য হাতগুলোকে শিশুর বিকলাঙ্গ হাতের মতোই মনে হচ্ছে—পরিশীলিত নখাগ্র ছাড়া আঙ্গুল। তুষারের ভারে যদিও কিছুটা নিম্নগামী দেখাচ্ছে প্রায় প্রতিটি হাতকে, তবু গাছগুলোর শির যেন তীরের ফলার মতোই তীক্ষ্ম ও ঊর্দ্ধমুখী। গাছগুলোর রঙ দূরত্ব কমার সাথে সাথে বদলে যায় বর্ণালীর চোখে। দূরের গুলোকে সে দেখে কালো সবুজে নীলাভ শাদা। এরপর সবুজের বিভিন্ন বর্ণমাত্রা হয়ে একদম কাছের গুলোকে সবুজ ও শাদার সমাহারে দণ্ডায়মান দেবদারু ছাড়া অন্য কিছু লাগে না।

তবে দুটো রঙের বিভিন্ন বর্ণমাত্রা কিছুক্ষণের জন্য তার অতীতের নানা স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে। শৈশবের এক স্মৃতি থেকে আরেক স্মৃতিতে চটজলদি ভ্রমণ। সেই স্মৃতির কোষাগারের কোষাধ্যক্ষ মূলত এন্ড্রু। যদিও বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে আকৃতি এ কাজটা করে অথবা আকৃতির সাথে রঙ সেখানে সহায়ক হিসেবে কাজ করে মাত্র, বর্ণালীর মধ্যে এক্ষেত্রে রঙটাই কাজ করে বেশি। রঙকে সে অন্য দশজনের চেয়ে মনে রাখতেও পারে অনেক বেশি।

কমলা, হলুদ, লাল তাকে চাঙ্গা রাখে; ম্যাজেন্টাও তা-ই করত। কিন্তু এ রঙের সাথে তার বাবার মৃত্যুর একটা করুণ সম্পৃক্তি সে খুঁজে পায়। নীল রঙের প্রতি তার অনেকটা এ্যালার্জি আছে। কারণ এ রঙ তাকে প্রচণ্ড বেদনায় আচ্ছন্ন করে রাখে। এমনকি এ কারণে দিনের বেলা সে পরিস্কার আকাশের দিকে তাকায় না; সাগরও দেখতে যায় না। নীল রং দেখলে জীবনের সব ব্যথা-বেদনা যেন ঘণীভূত হয়ে তার বুকে হাতুড়ি ঠুকতে থাকে। তবে ময়ুরকণ্ঠী নীলে সে মখমল-মেদুর রোমান্টিক অনুভবে জারিত হয়, এন্ড্রুর কথা মনে হলে যেমনটা তার মনে ভেসে ওঠে। অথচ বেগুণি রঙ আবার তাকে অবশ করে তোলে।

যখন বরফ-জমিনে ঠাণ্ডা অনুভূত হয়, তখন সে বরফকে অনেকটাই নীলচে শাদা দেখে। ঠাণ্ডা যতই কমে, ততই তা তার কাছে ক্রমান্বয়ে শাদা হয়ে যায়। এতে সে নিরপেক্ষ অনুভব করে। আনন্দ-বিষাদ কিছুই যেন ছোঁয় না তখন তাকে। মনে হয় আনন্দ-বিষাদ রেখার মধ্য বিন্দুতে অবস্থান করে সে এ সময়।

অবশ্য নানান ধরণের উজ্জ্বল রঙের সমাহার তার মনকে সবার আগে প্রফুল্ল রাখে। এ জন্য গ্রীষ্মের চেয়েও এখানকার শরৎ কালটা তার কাছে প্রিয় ঋতু; এ জন্য সে শরতের কমলা, হলুদ, লাল রঙের বেশ কিছু নৈসর্গিক চিত্র তার থাকার ঘরে আয়নায় সহজে দেখা যায় এমন জায়গায় টাঙিয়ে রাখে। এমনকি এ রকম একটা অণুচিত্র তার হাত ব্যাগে সব সময় রাখে। শীতের সময় কিংবা নির্জীব পরিবেশে কোনো কারণে মন খারাপ থাকলে বা বিষাদগ্রস্ত হলে সে চিত্রটি বের করে এক দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থেকে প্রফুল্লতা আহরণ করে, ঠিক যেমন সোলার প্যানেল সূর্যের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শক্তি সঞ্চয় করে।

উজ্জ্বল রঙের দিকে তাকিয়ে থেকে অনুভূতিকে চাঙ্গা করার এ অভ্যাস তার আজকের নয়। পনের বছর বয়সে এক বসন্তে যখন তার বিশ বছর বয়সী প্রথম ছেলেবন্ধু লন্ডনে ফিরে যায়, আর যখন তার সাথে যাওয়ার জন্য নিজের বাবা-মা বাধ সাধে, তখন এক মাস ধরে সে প্রচণ্ড বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার জীবনে এই সময়টা ছিল প্রথম বিষিয়ে ওঠা সময়।  প্রায় আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল সেই বার। বাড়ির ছাদ থেকে নিচে লাফ মারার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ তার চোখ পড়ে তাদের বাড়ির পিছনের বাগানে এক গুচ্ছ ফুটন্ত গোলাপের উপর। সঙ্গে সঙ্গে মনে জাগে উষ্ণ অনুভব। গোলাপী রং তার মনে প্রফুল্লতা জাগিয়ে তাকে পুনর্জন্ম দান করে যেন। তখনই সে প্রথম আবিস্কার করে তার মন-মেজাজের উপর রঙের কার্যকরী প্রভাব।

আজো তাই গাড়িতে ঝুলন্ত বাতাস-বিশোধকের পাশাপাশি একটা উষ্ণ রঙের অণুচিত্র ঝুলে আছে। এটা না রাখলে সে নীলচে বেদনায় দুর্ঘটনাবিহীন গাড়ি চালাতে পারত না। রঙের প্রতি এমন আসক্তি থাকলেও কখনোই সে উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরে না। ঠোঁটে লিপস্টিকও মাখে না। যার মনে হামেশাই রঙের মেলা বসে, রঙবৈভব এত অনুভবে সিক্ত করে, তার বাহিরটা কেন জানি রঙে তত ঝলমল করে না। ঠিক পানি যেমন অন্যের তৃষ্ণা মেটায়, কিন্তু নিজে কখনো তৃষ্ণার্ত হয় না।

কফিশপে পৌঁছে গাড়ি থেকে না নেমেই ড্রাইভ থ্রু থেকে সে প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে পারত। কিন্তু এক টানা ছয় ঘন্টা চালানোর পর একটু বিরতির প্রয়োজন তার। সে জন্যই গাড়ি থামিয়ে সে কফি শপের ভেতরে চলে যায়। এখানে সে এর আগে কখনো আসেনি। কাউন্টারে গিয়ে একটা গ্রিল্ড চিকেন পানিনি, স্টেক গ্রিল্ড র‌্যাপ, পেপসি এবং মিডিয়াম ট্রিপল-ট্রিপল কফির জন্য বলে। এসব নিয়ে এক কোণায় মুখোমুখি দুই দিকে থাকা দুটো সোফার মধ্যে যেটি থেকে ভেতরের দৃশ্য দেখা যায় সেটিতে গিয়ে বসে। এ আসনটির বাম পাশে দেয়ালে সেঁটে দেয়া আছে কাচ দিয়ে ঘেরা কৃত্রিম আলোর জ্বলন্ত ছোট ছোট শিখা। দেখতে হুবহু আগুনের শিখার মতো লাগছে, কিন্তু বিন্দুমাত্র তাপ নেই। অনেকটা এখানকার শীতের জ্বলন্ত সূর্যের মতো। শিখার অগ্রভাগের নীলচে ভাব তাকে কিছুটা শীতল অনুভব দিচ্ছে, আর বাকি অংশের হলদেটে দ্যূতি উষ্ণ অনুভব সঞ্চার করছে।

খেতে খেতে এন্ড্রুর সাথে মৃদু স্বরে ফোনে কথা বলে নিজের অবস্থান জানায় এবং তার জন্য দুশ্চিন্তা না করতে বলে।

কফিশপ থেকে মহাসড়কে উঠে কিছুদূর যাওয়ার পর এক কিলোমিটার খানেক দৈর্ঘ্যের একটা নদী দেখতে পায় বর্ণালী। এ দেশ নদী-নালার দেশ নয়। এ রকম বড় নদীও খুব একটা নেই, যদিও বড় বড় অনেক জলাশয় বা হ্রদ দেখতে পাওয়া যায়। আয়তনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। অথচ সেই তুলনায় নদীর সংখ্যা হাতে গোণা। বর্ণালী যে নদীটা পার হচ্ছে এখন তার উপরিতলেও বরফ জমে আছে। ঠিক যেন গাভীর দুধ ঘন করার পর উপরিতলের ঘিয়ে রঙের ঘন সর এবং নিচে তরল। কোনো নড়চড় নেই। অথচ এ নদীতে দু’মাস আগেও পানি বলকে বলকে ঘূর্ণি তৈরি করছিল। এ নদীকে এখনকার অবস্থায় দেখে মনেই হয় না যে, এর মধ্যে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী এখনো বাস করে। তবে এ সময় এদের জীবন খুবই ধীরগতির হয়। প্রকৃতিতে হাজার হাজার বছর ধরে এরা হয়ত নিজেদেরকে এভাবেই অভিযোজিত করেছে বংশ পরম্পরায় টিকে থাকার জন্য।

অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করে বর্ণালী। একটু একটু করে ভাঁজ ফেলে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু শেষ নিকষ ভাঁজটি তুষারের শুভ্রতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। তবু আকাশ এখন স্বচ্ছ থাকায় কাছের ও দূরের বিদ্যুৎ বাতিগুলো অনেকটাই স্পষ্ট দেখাচ্ছে। সপ্তর্ষির মতো মিটিমিটি জ্বলা দূরবর্তী সারিবদ্ধ বাতিগুলো জীবনযাত্রার মুখপাত্র হিসেবে যেন শহরের পুঞ্জিভূত হিম সংগ্রামের কথা বলে যাচ্ছে। এ আলোগুলোকে বর্ণালীর ভালই লাগে। আরো ভাল লাগে যখন যেতে যেতে দেখে রাস্তার পাশেই একটা হালকা বনের ওপাশে কিছুটা উঁচুতে কিছু ল্যামপোস্টের শাদা আলো নিচে বিকিরিত হয়ে যেন এক মায়াবী আবহ সৃষ্টি করেছে। এ দৃশ্যটি হয়ত সে দেখার সুযোগ পেত না। কিন্তু এর ঠিক সামনেই রাস্তার লাল বাতি জ্বলার কারণে সে দেখতে পায়। নেতিবাচক দিক কখনো কখনো জীবনে এভাবেই বুঝি অন্য কিছু দেখার বা করার সুযোগ নিয়ে আসে।

দুপুরের হালকা খাবারে অর্জিত শক্তি অনেকটাই ফুরিয়ে গেছে বর্ণালীর। চূড়ান্ত ক্ষুধা লাগার আগেই সে সাধারণত খেয়ে নেয়। এর ব্যতিক্রম তাকে ভোগায়। কারণ চরম ক্ষুধায় সে সব কিছুকে নীল দেখে। স্থির করে কাছাকাছি যে রেস্টোরেন্ট নজরে পড়বে সেখানে সে রাতের পানীয় ও খাবার খেয়ে নেবে। কিছুদূর যেতেই রেস্টোরেন্টের সাইন দেখতে পায় সে। গাড়ি নামায় মহাসড়ক থেকে। গাড়ি থামিয়ে ভেতর থেকেই এক নজর চোখ বোলায় রেস্টোরেন্টের চত্বরে। কিছু মানুষ নিজের মতো করে প্রয়োজন সারছে—কেউ কফি হাতে হাঁটছে, কেউ নিজেদের গাড়িতে উঠছে, কেউ-বা ট্যাক্সিতে চড়ছে। এখানে সব শেষে তার নজর যায় ইংরেজি বড় হাতের উত্তোলিত অক্ষরে লেখা ‘মান্তোবানি’-এর দিকে। তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে এন্ড্রুর সাথে কয়েক বার এখানে খেতে এসেছিল।

নীলাভ মায়াবী অন্ধকার ঠেলে বর্ণালী ইটালিয়ান রেস্টোরেন্টটিতে ঢোকে। ঢুকেই দেখে অনুজ্জ্বল আলো—খুব বেশি উজ্জ্বল না, আবার খুব বেশি নিভু নিভুও না। কানে ভেসে আসছে ইতালিয়ান ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত। সার্বিক পরিবেশটাকে অনেকটা উষ্ণ ও মন জুড়ানো করে রাখা হয়েছে।

আগোগোড়া কালো পোশাক পরিহিত ওয়েটার এগিয়ে এসে তাকে স্বাগতম জানায়।  জিজ্ঞেস করে, ‘ক’জন’? ‘দু’জন’ উত্তর এলে রেস্টোরেন্টের এক নিরিবিলি কোণায় দুই সিটবিশিষ্ট টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসায় এবং মেন্যু দেয়।

অনুজ্জ্বল হলুদাভ আলোয় বসে বর্ণালী খাদ্য ও পাণীয় তালিকা উল্টে-পাল্টে দেখা শুরু করে। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতটা তাকে উষ্ণ হলুদ ভাবরসে সিক্ত করছে। করুণ সঙ্গীতে সে যেমন নীল বর্ণকে দেখে, এ রকম সঙ্গীতে তেমনই হলুদ কিংবা কখনো কখনো ম্যাজেন্টা বর্ণ দেখে। দ্রুত লয় ও তালের গান শুনলে সে বরাবরই লাল রঙা স্মৃতিতে পরিভ্রমণ করে।  হাতের মেন্যুটার রঙ বাদামী। সব মিলিয়ে ভদ্র, মিষ্ট ও উষ্ণ আবহে সে নিমজ্জিত এখন।

কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করে—কী ধরণের ড্রিঙ্কস খেতে ইচ্ছে তার? লাল মদ, শাদা মদ, বিয়ার নাকি ককটেল? বর্ণালী জানায়—আপাতত এক গ্লাস শাদা মদই যথেষ্ট। সে লাল মদ খেতে যে অপছন্দ করে তা নয়। বরং পছন্দই করে। এক ধরণের কষ কষ স্বাদ আছে। হৃদযন্ত্রের জন্যও উপকারী। কিন্তু গ্লাসে ঢালার পর এর রঙটা রেস্টোরেন্টের পরিবেশে অনেকটাই গাঢ় বেগুনি লাগে, যা তার হৃদয়তন্ত্রীতে বিরহ-বিচ্ছেদের রাগিনী বাজিয়েই চলে। বেদনাকে অনায়াসে এড়ানোর সুযোগ থাকলে কে আর মাড়ায় সে পথ? কিছু ভাল লাগা না হয় এ জন্য অপূর্ণই থাক।

ওয়েটার বর্ণালীর সাথের অন্য জনের জন্য অপেক্ষা করে। বেশ কিছুক্ষণ সময় চলে যায়। পুরো সময়টা বর্ণালী বার বার দরজার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এক সময় সে হাতের ঈশারায় ওয়েটারকে ডাকে। পাঁচ বছর আগে ঠিক এই চেয়ারটাতে সে এন্ড্রুর সাথে মুখোমুখি বসেছিল। আগের সেই চেয়ারগুলো নেই, তবে চেয়ার বিন্যাস একই আছে। ওয়েটার কাছে এলে তাকে এ্যাপিটাইজার হিসেবে নিজের জন্য সিজার সালাদ এবং এন্ড্রুর জন্য ব্রুশেটা দিতে বলে। প্রধান খাবার হিসেবে নিজের জন্য ফেতুচিনি এবং এন্ড্রুর জন্য ক্যানোলিনিও অর্ডার করে। এন্ড্রু এখনো আসেনি দেখে ওয়েটার জিজ্ঞেস করে অন্য জনের খাবারও কি একসাথে দেবে নাকি তিনি এলে দেবেন। বর্ণালী হলদে অনুভব করে এবং মৃদু হাসি দিয়ে একসাথে দিতে বলে।

খাবার তৈরির ফাঁকে সে ফোন করে এন্ড্রুকে। মদের গ্লাসে ফাঁকে ফাঁকে চুমুক দেয়। মৃদুস্বরে জানতে চায় আর কতক্ষণ লাগবে তার। কথা বলতে বলতে মুখের নানান ভঙ্গি করে। কখনো মৃদু হাসে, কখনো মুখখানি একটু টান টান করে রাখে।

ওয়েটার দুটো এ্যাপিটাইজার এক সাথে এনে বর্ণালীকে সিজার সালাদ এবং এন্ড্রুর দিকে ব্রুশেটা পরিবেশন করে চলে যায়। পাঁচ মিনিট পর সে বর্ণালীর টেবিলে চোখ রাখে। দেখে দুটো এ্যাপিটাইজারই শেষ। কিছুটা অবাক হয় সে। যে এখনো আসেই নি, সে কী করে ব্রুশেটা খায়? রহস্যের গন্ধ পায় সে। কিন্তু কাস্টোমার বলে কথা। ব্যবসার লক্ষ্মী। এমন কিছু বলা বা করা যাবে না যাতে সহজে সে বিরক্ত হয়। ব্যাপারটা নিজের কাছে স্পষ্ট করার জন্য সে এবার থেকে কড়া নজর রাখে টেবিলটিতে।

প্রধান খাবার প্রস্তুত হলে ওয়েটার তা যথারীতি টেবিলটাতে দিয়ে আসে এবং বারের কাউন্টারে গিয়ে থেকে থেকে চোরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। বেশ কিছু সময় পর সে দেখে অন্য পাশের খাবারটি অবিকল সে রকমই আছে, কিন্তু উপস্থিত কাস্টোমারটি একটু একটু করে খেয়ে যাচ্ছে। ক্যানোলিনি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখে সে একবার ভাবে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে কিনা। না, আরেকটু সময় যাক। খাবার কেমন হয়েছে—এটা জিজ্ঞাসা করার ছলে বিষয়টা বলা যাবে।

আরো কয়েক জন কাস্টোমার এসে গেছে। তাদেরকে বসানোর পর ওয়েটার বর্ণালীর টেবিলটায় এসে মুখে মৃদু হাসি ফুটে তুলে জিজ্ঞেস করে,

-খাবার ভাল হয়েছে তো? সব ঠিক আছে?

-সুস্বাদু হয়েছে।

বর্ণালীর মুখ থেকে শোনার পর অন্য পাশের ক্যানোলিনির দিকে ইঙ্গিত করে ওয়েটার আবার জিজ্ঞেস করে,

-ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আপনার অতিথি কি আসবেন এখন?

বর্ণালী মাথা নেড়ে এবং জাফরানি হাসি হেসে উত্তর করে,

-হ্যাঁ, আসছে। আর কিছুক্ষণ। আপনি বরং এই ফাঁকে একটু গরম করে নিয়ে আসুন।

ক্যানোলিনি ওভেনে গরম করে তা আবার বর্ণালীর টেবিলে দিয়ে আসে ওয়েটার। এরপর সদ্য আসা কাস্টোমারদের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয় সে। তাদের পানীয়ের অর্ডার এনে যখন বারে সেগুলো প্রস্তুত করতে থাকে তখন এক ফাঁকে আবার দৃষ্টি দেয় বর্ণালীর টেবিলটার দিকে। কী আশ্চর্য! ক্যানোলিনির প্লেট একেবারে ফাঁকা। নিজেকে প্রশ্ন করে—আমি কি গরম করে তাকে দিয়েছি নাকি এখনো ওভেনে আছে? বাবুর্চিকে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর করে—ওটা তো আপনি দিয়ে এসেছেন টেবিলে।

রহস্য উদঘাটনে চিন্তিত ওয়েটার একবার চকিত চাহনি ফেলে বর্ণালীর দিকে। বর্ণালীর চোখে তা ধরা পড়তেই কিছুক্ষণের জন্য দুজনের দৃষ্টি জমাটবদ্ধ হয়ে যায়। পর মুহূর্তে বর্ণালী দৃষ্টির জমাট ভাব তরল করে লাল মদরঙা হাসি দিয়ে। ওয়েটার দ্রুত নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কিছুটা ইতস্তত বোধ করে। আর ভাবে দরকার নেই এ রহস্যমানবীকে ঘেঁটে দেখার।

বর্ণালী খাওয়া শেষ করে বিলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুটা ভীত ওয়েটার এদিকে আর দেখতেই চাইছে না যেন। ফলে কিছুটা দেরি হয় বর্ণালীর। তার হাতঘড়িতে এখন আটটার মতো বাজে। এক পর্যায়ে ওয়েটারের দৃষ্টি হঠাৎ করে বর্ণালীর চোখে পড়তেই সে হাতদুটো উপরে তুলে এবং কাগজে লেখার ভঙ্গি করে বিল চায়। বকশিশসহ বিল পরিশোধ করার সময় ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে— এখান থেকে উইন্টারলুড উৎসবে যেতে আর কতক্ষণ লাগবে। বিদায় দিতে পারলেই যেন বাঁচে এমন ভঙ্গিতে ওয়েটার সঙ্গে সঙ্গে বলে— আধা ঘন্টার মতো। এরপর বর্ণালী দরজার দিকে যায়। ওয়েটার তখন একখানা কাষ্টহাসি হেসে ধন্যবাদ ও শুভরাত্রি জানায়। উত্তরে সে কমলা রঙের উষ্ণ হাসি হেসে তাকেও শুভরাত্রি জানায়।

বাইরে বের হয়ে সরাসরি নিজের গাড়িতে বসে বর্ণালী। পাঁচ মিনিট গাড়ি গরম করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে আবার যাত্রা করে। এখন বাইরের শাদা শাদা ভাবটা ততটা দৃশ্যমান নয়। রাস্তার দু’পাশের বাতি ও অন্যান্য গাড়ির আলো মিলে হলদে আবহের সৃষ্টি করেছে। এতে তার মনে উষ্ণ অনুভব জাগে। দুই ঘন্টা যাওয়ার পর তার ডান পাশেই “ক্রিস্টাল গার্ডেন” লেখা বড় একটা গেট দেখতে পায় সে। একটু সামনে গিয়ে গাড়ি পার্ক করে এন্ড্রুকে আবার ফোন দেয়। নিজের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে তাকে হালনাগাদ করে।

গেটে ঢুকতেই দূরের মঞ্চ থেকে নাচ-গানের আওয়াজ শুনতে পায় সে। প্রায় দু’সপ্তাহব্যাপী উইন্টারলুড উপলক্ষে প্রতি সন্ধ্যায় এমন সরগরম অনুষ্ঠান হয়। বাইরের ঠাণ্ডা দেখে বোঝার উপায় নেই এতেও কী করে গরম গরম অনুষ্ঠান হতে পারে।

কানের মধ্যে প্রথমে নাচ-গানের আওয়াজ ভেসে এলেও সে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয় না। ঝলমলে আলোও তাকে টানে না। বরং গেটের নিকট থেকে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করে। উপভোগ করে বরফ উৎসব। খুঁটে খুঁটে দেখে বিদ্যুৎবাতির আলোয় সমুজ্জ্বল বরফের তৈরী নানান ভাস্কর্য—বিড়াল, মহিষের মতো স্থানীয় মূস, ডলফিন, তীক্ষ্ম দৃষ্টির পেঁচা, উত্তোলিত লেজের আদুরে কাঠবিড়ালি, শান্ত-শিষ্ট খরগোস, নৃত্যরত নারীমূর্তি, তেজি ঘোড়া এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর টোটেম পোল ও তাদের ঘরবাড়ি।

বরফ ভাস্কর্যের সবগুলো দেখে বেশ উপভোগ করে বর্ণালী।  তবে সবকিছুর মধ্যে টোটেম পোলটির দিকে তার মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে বেশিক্ষণ। পোলটি দেখতে শুরবিহীন হাতির সামনের অংশের মতো। উপরে তোলা মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটোকে মনে হচ্ছে কান। দুটো কানের মধ্যবর্তী জায়গায় তার চোখ আটকে যায়। টোটেমের চোখ বরারব উপরে এবং কানদুটোর মাঝের জায়গায় কাস্তের মতো দুটো বর্মের মধ্যে আচ্ছাদিত আছে এক দণ্ডিত রাজপুরুষ। এ রাজপুরুষকে কেন তার চেনা লাগছে? শুধু এই কারণে চেনা নয় যে, এর আকার মানুষের মতো কিংবা বাস্তবের অন্যান্য প্রাণীমূর্তিগুলোর মতো। এর চেয়েও বড় কারণ বিদ্ধ করে তাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, আর ভাবে। কিছুতেই উত্তর মেলে না। শুধু তার সকাতর দৃষ্টি ও দেহভঙ্গিমা বর্ণালীর হৃদয়বীণায় মহাকালের এক অব্যক্ত, অস্ফুট বেদনার সুরকে বাজিয়ে যাচ্ছে যেন।

এতক্ষণ বরফ উৎসবের ভাস্কর্যগুলোকে এতটাই মুগ্ধ হয়ে দেখেছে বর্ণালী যে, এর পিছনের নীল কাপড়ও তাকে তৎক্ষণাৎ বেদনায় আচ্ছন্ন করতে পারেনি। কিন্তু এখন মনে হয় নীল রঙের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। নইলে তাকে বিষন্ন লাগছে কেন? একটু একটু করে নীল বিষ তাকে পুরোটা ছেঁয়ে ফেলেছে। মুগ্ধতার ঘোর তাকে তখন তা বুঝতে দেয়নি। এখন যখন সে রাজপুরুষকে দেখছে তখন তার ঘোরের মধ্যে এন্ড্রু এসে ভিড় করছে। পুরো অবয়বটি শাদা থেকে নীল হয়ে যায় তার নিস্পলক দৃষ্টিতে। বরফ মূর্তির মতো বেদনায় ঘণীভূত হয়ে কঠিন হয়ে যায় বর্ণালী। সব সময়ের জন্য হাত ব্যাগে রাখা অণুচিত্রটিও বের করে দেখার মতো চেতনাশক্তি থাকে না তার। এরপরের ঘটনা উৎসবে উপস্থিত সবাই ঘটা করে জানে। কিন্তু সে আর কিছুই জানে না।


*বর্ণবিষে বর্ণালী*




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*