কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: ভিন্ন কণ্ঠে বলা

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


ভিন্ন কণ্ঠে বলা


ক্রিস্টি সে বর্ষের ব্যাচেলর ক্যাচ। শীতের তুষার যখন মাসের পর মাস সংঘাত করে পড়ে আছে, আর ইউরোপের অর্ধেকটা যখন উপবাস করছে, আর বোমার পরিবর্তে মাথার উপরের বোমারু বিমানগুলো যখন জার্মানির জন্য খাদ্য বহন করছে, আর গ্যাস কমে যখন ক্ষীণ হয়ে আসছে এবং বিদ্যুৎ বাতিগুলো দুলছে, আর আগন্তুকেরা আরামের জন্য পরস্পরের কাছে যখন ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে — তখন গ্রেসের সামনে আশা ও প্রতিশ্রুতির সঙ্কেতের ন্যায় ক্রিস্টি জ্বলজ্বল করছে। সে পুরোপুরি সুস্পষ্ট, সুপুরুষ(তবে শুধু বিয়ের ক্ষেত্রে)। ক্রিস্টি গ্রেসের আকাঙ্খা। কোনো ডিপ্লোমা নয়, কোনো পেশা জীবন নয়, জগতের স্বীকৃতিও নয়, অন্য কিছুও নয়। শুধু ক্রিস্টি।

গ্রেস তাকে ভালবাসে। ওহ্, আসলেই সে ভালবাসে। তাকে দেখলে তার হৃৎপিণ্ডের ধুক ধুক বেড়ে যায়, কামনায় তার নাড়ীভূড়ি গলে যায়। কিন্তু তার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হবে না, হতে পারে না সে। ক্রিস্টি তাকে তার নৌকায় তুলে নেয়, সুরক্ষিতভাবে সাথে করে নেয় (হ্যাঁ, সে নৌকা চালায়) এবং পর্বতের উপরের দিকে বেশ কম সুরক্ষিতভাবে সাথে করে নেয় (হ্যাঁ, সে আরোহণ করে)। তাকে একটা ফ্ল্যাট কিনে দেয়ার প্রস্তাব করে (হ্যাঁ, তার কেনার সামর্থ্য আছে) কিন্তু না গ্রেস নেবে না। ধন্যবাদ, কোনো হীরা নয়, ক্রিস্টি। কোনো হাত ঘড়ি নয়। কোনো উপহার নয়, কোনো ঘুষ নয়, প্রিয়তম। চকলেট, হ্যাঁ, ওহ্, তোমাকে ধন্যবাদ! আর অর্কিড, এবং নৈশভোজের দাওয়াত আর ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, আর হ্যাঁ, একটা চুম্বন, আর হ্যাঁ, তুমি আমার বুক স্পর্শ করতে পারো (আমরা কতই না দুষ্ট!) আর তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি করে শুভরাত্রি, ক্রিস্টি। আমার নিজের, আমার ভালবাসা, আমার প্রিয়তম প্রিয়। তোমার জন্য আমি মরবো, কিন্তু তোমার সাথে শুয়ে থাকতে পারবো না।

বাসা যাওয়ার পথে সোহোতে ক্রিস্টি বিরতি নেয় এবং এক পতিতার সাথে এক ঘন্টা সময় কাটায়। আর কীভাবে সে বাঁচবে?

গ্রেস তাকে ভালবাসে। সে তাকে বিয়ে করতে চায়। আর কীভাবে সে বাঁচবে?

ফে ওয়েল্ডন ফিমেল ফ্রেন্ডস (১৯৭৫)

পূর্ববর্তী সেকশনে হেনরি ফিল্ডিংয়ের জোসেফ অ্যান্ড্রুজ  এ প্রদর্শন ও কথনের ভারসাম্যকৃত পর্যায়ক্রম আলোচনা করে আমি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে পুরোপুরি সারাংশ আকারে লিখিত কোনো উপন্যাস প্রায় পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে না। কিন্তু কিছু সংখ্যক সমসাময়িককালের ঔপন্যাসিক এমন বেশি মূল্য প্রদান না করেই ইচ্ছাকৃতভাবে সেদিকে অনেকটা অগ্রসর হয়েছেন। বক্রাঘাত, গতি, সারোৎসারের জন্য আমাদের আধুনিক রুচির সাথে সারাংশ কথন রীতি খাপ খায় বলে মনে হয়।  নানা চরিত্র ও যে গল্প ধ্রুপদী উপন্যাসের ধীর লয়ের ছন্দ ও সুগভীর অনুপঙ্খে আটকে না থেকে দীর্ঘ সময় ধরে বিস্তৃতি লাভ করে তা সামাল দেয়ার বিশেষ কার্যকরী উপায় এটি। (এসব কারণে হাউ ফার ক্যান ইউ গৌ ? উপন্যাসে আমি নিজেই তা ব্যবহার করেছি) এটা নিশ্চিত করতে সতর্ক থাকতে হবে যেন শব্দভাণ্ডার ও বাক্য বিন্যাসে সারাংশ রীতি একঘেয়েরূপে সমরূপী না হয়। ফে ওয়েল্ডনের উপন্যাসগুলো যে ব্যাপকভাবে সারাংশ ব্যবহার করে, তা সেগুলোর কর্মব্যস্ত কথন লয় ও শৈলীগত প্রাণবন্ততা– উভয়ের জন্যই উল্লেখযোগ্য।

দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক রীতিনীতির পটভূমিতে উনিশ শত চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের তিনজন নারীর যৌন ও বৈবাহিক অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে তাদের ভাগ্যকে বিধৃত করে ফিমেল ফ্রেন্ডস । এতে নারীরা চিত্রায়িত হয় সামগ্রিকভাবে তাদের জরায়ু ও হৃদয়ের অসহায় শিকার হিসেবে, যারা স্বামী ও প্রেমিকদের দ্বারা অপব্যবহার ও বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়েও তাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে। পুরুষরা চিত্রায়িত হয় তাদের নিজেদের অহংবাদ ও যৌন ক্ষুধার সমান অসহায় শিকার হিসেবে; কিন্তু স্বভাবজাতভাবে বাছবিচারহীন হওয়ায় তারা নারী চরিত্রগুলোর চেয়ে অনুমোদনশীল সমাজের আগমনে বেশি মজা করে। এখানে উদ্ধৃত প্যাসেজটিতে অবশ্য আগের সময়টা উপজীব্য হিসেবে আছে, উনিশ শত চল্লিশের দশক, ‘নাইস গার্লস ডিডন্ট’ সময়ে, আর নারী-পুরুষের যুদ্ধে দর কষাকষির কাউন্টার হিসেবে এ ধারণা ব্যবহৃত হতে পারে। গ্রেস আসলে কুমারী নয়, কিন্তু ভান করে যে সে কুমারী এটা জেনে যে ক্রিস্টি “যে নারীকে ভালবাসে, তার কৌমার্যকে সে প্রয়োজনীয় মনে করে, যদিও তা নস্যাৎ করতে যারপর নাই চেষ্টা করে সে।” এভাবে স্ববিরোধীতা ও ভণ্ডামি দ্বারা হাস্যরসাত্মকভাবে উভয় চরিত্রের আপোস রফা করা হয়।

প্রথম অনুচ্ছেদটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষিত– কৃচ্ছতাসাধন, অভাব, ঠাণ্ডা যুদ্ধ — কে  চিত্রকল্পের ক্রমিক তৎপরতায় সিনেমার মন্তাজের ন্যায় মনে করিয়ে দেয়, তারপর এসব জন দুর্ভোগ ও উদ্বেগের সাথে গ্রেসের ব্যক্তিগত আবেগপ্রবণ ঘোরকে বক্রাঘাতমূলকভাবে পাশাপাশি বিধৃত করে। ইউরোপের অর্ধেকটা যখন উপবাস করে, তখন গ্রেস শুধু ভাবে তাকে বিয়ে করার জন্য কীভাবে ক্রিস্টিকে সে প্ররোচিত করবে। তার চিত্রশিল্পী হওয়ার আকাঙ্খা (গল্পে এ পর্যায়ে সে স্লেডের ছাত্রী থাকে) বিস্মৃত হয়। “ক্রিস্টি গ্রেসের আকাঙ্খা। কোনো ডিপ্লোমা নয়, কোনো পেশা জীবন নয়, জগতের স্বীকৃতিও নয়, অন্য কিছুও নয়। শুধু ক্রিস্টি।” ডিসকোর্সটি এখানে ঘটনার সারমর্ম থেকে গ্রেসের চিন্তা-ভাবনার সারমর্মে রদবদল হতে শুরু করে, এমন এক প্রভাব যা পরবর্তী অনুচ্ছেদের শেষ নাগাদ আরো বেশি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।

বস্তুত এখানে আমাদের যা আছে তা জোসেফ অ্যান্ড্রুজ  এর প্যাসেজটিতে ফিল্ডিংয়ের লেখকীয় কণ্ঠের ন্যায় একক কোনো সমরূপী শৈলী নয়, কিন্তু শৈলী বা কণ্ঠের পলিফোনিক মিশ্রণ, যার মধ্য দিয়ে গ্রেস ও ক্রিস্টির কোর্টশিপের গুরুগম্ভীর ও কৌতুকময় (seriocomic) বাদানুবাদ প্রাণবন্তভাবে, তবে সংক্ষিপ্ত ও যথাযথভাবে জাগিয়ে তোলে। “সে তাকে ভালবাসে। ওহ্, আসলেই সে ভালবাসে। তাকে দেখলে তার হৃৎপিণ্ডের ধুক ধুক বেড়ে যায়, কামনায় তার নাড়ীভূড়ি গলে যায়।” এখানে কথক মনে হয় — প্রেমপত্র, প্রেমের কবিতা, প্রেমের গল্প –“প্রেম” বিষয়ক প্রথাগত সাহিত্যের ডিসকোর্স ধার করে। “তার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতে পারে না সে” মিলস এন্ড বুন রোমান্স থেকে সরাসরি নেওয়া ব্যবহারজীর্ণ চিত্র — এর প্যারডিক বৈশিষ্ট্য গ্রেসের আচরণের মেকিভাবকে জোরালো করে। পরবর্তী বাক্যের প্রথম বন্ধনী, (“হ্যাঁ, সে নৌকা চালায়…  হ্যাঁ, সে আরোহণ করে…  হ্যাঁ, তার কেনার সামর্থ্য আছে”) পাঠকের প্রশ্নের আগাম জবাব প্রদানকারী কথক হতে পারে, যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে, কিন্তু এ তথ্যের বিলম্বের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে না। কিংবা গ্রেসের বান্ধবীর ব্যাপারে ক্রিস্টকে নিয়ে তার গর্ববোধের প্রতিধ্বনি হতে পারে। (আরো একটা জটিলতা হলো যে কথক আসলে সেইসব বান্ধবীদের একজন, ক্লো যে নাম পুরুষে নিজের সম্পর্কে লেখে এবং অন্যান্য চরিত্রের গোপন চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে ঔপন্যাসিকের জ্ঞান দাবি করে।)

“ধন্যবাদ, কোনো হীরা নয়, ক্রিস্টি। কোনো হাত ঘড়ি নয়। কোনো উপহার নয়, কোনো ঘুষ নয়, প্রিয়তম। চকলেট, হ্যাঁ, ওহ্, তোমাকে ধন্যবাদ!” ব্যাকরণগতভাবে এটি এবং অনুচ্ছেদটির বাকি অংশটি গ্রেসের প্রত্যক্ষ উক্তি, কিন্তু একে ঘিরে টেক্সটে কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই, আর স্পষ্টতই এটি একক উক্তির রেকর্ড নয়। এ উক্তি সারাংশ হিসেবে কাজ করছে, কয়েকটা বিভিন্ন উপলক্ষে গ্রেস যা বলেছিলো — কিংবা ভেবেছিলো, অথবা ইঙ্গিত প্রদান করেছিলো, তার ঘনীভূত রূপ। সে বলেছিলো “শুভরাত্রি” এবং সম্ভাব্যভাবে “আমার নিজের, আমার ভালবাসা, আমার প্রিয়তম প্রিয়,” কিন্তু প্রায় নিশ্চিতভাবে বলে নি, “তোমার জন্য আমি মরবো, কিন্তু তোমার সাথে শুয়ে থাকতে পারবো না,” আরেকটি লাইন যা আধো-স্মরণীয় সাহিত্য উৎস থেকে উদ্ভুত হয়েছে বলে মনে হয়। দুটো সংক্ষিপ্ত, প্রতিসম অনুচ্ছেদ কথন কণ্ঠে যৌন অচলাবস্থাকে সংক্ষেপে বলে যা প্রতিটি চরিত্রের কাকুতি-মিনতিরই প্রতিধ্বনি।

এ প্যাসেজটি উপন্যাসগত গদ্য যাকে রাশিয়ান সমালোচক মিখাইল বখতিন বলেছিলেন “পলিফোনি” কিংবা বিকল্পভাবে “সংলাপবাদ”, তার চারিত্র্যের উদাহরণ তুলে ধরে চমৎকারভাবে, তবে কোনোভাবেই অপ্রতিনিধিত্বশীলভাবে নয়। (সাহিত্য তত্ত্বের প্রতি বিরাগভাজন পাঠকেরা এ সেকশনের বাকিটা এড়িয়ে যেতে চাইতে পারেন; যদিও বিষয়টি তাত্ত্বিক আগ্রহের চেয়েও বেশি — উপন্যাসটিতে জীবনের রূপায়নের একেবারে কেন্দ্রে এটি।) বখতিনের মতে প্রথাগত মহাকাব্য ও গীতিময় কবিতার ভাষা, কিংবা ব্যাখ্যামূলক গদ্যের ভাষা “স্বগতোক্তি নির্ভর”, যা একক সমরূপীয় রীতির মাধ্যমে জগতের উপর একক দৃশ্যকল্প কিংবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আরোপ করার প্রয়াস চালায়। অন্যদিকে উপন্যাস “সংলাপ নির্ভর”, যা নানান রীতি কিংবা কণ্ঠ যা মনে হয় যেন পরস্পরের সাথে কথা বলছে সেসব, টেক্সটের বাইরে অন্যান্য কণ্ঠ এবং সাধারণভাবে সংস্কৃতি ও সমাজের ডিসকোর্সকে অন্তর্ভূক্ত করে। উপন্যাস এ কাজটি করে বিভিন্ন উপায়ে। সরলতম পর্যায়ে কথকের কণ্ঠের সাথে চরিত্রসমূহের কণ্ঠ পর্যায়ক্রমে থাকে, যার মধ্যে তাদের নিজেদের সুনির্দিষ্ট কথার টান ও শ্রেণীগত বাগধারা, অঞ্চল, পেশা, লিঙ্গ ইত্যাদি পরিবেশিত হয়। উপন্যাসে আমরা তা মেনে নেই, তবে রেনেসাঁর আগে কথন সাহিত্যে এটি আপেক্ষিকভাবে দুর্লভ ব্যাপার ছিলো। চার্লস ডিকেন্সের আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড এ স্লপি নামে এক কুড়িয়ে পাওয়া শিশু থাকে, যাকে বেটি হিগডেন নামে এক বৃদ্ধা মহিলা দত্তক নেয়; তার চোখে শিশুটি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। “তুমি তা নাও ভাবতে পারো, কিন্তু স্লপি সংবাদপত্রের চমৎকার একজন পাঠক,” সে বলে। “বিভিন্ন কণ্ঠে সে  পুলিশী কাজ করে।” ঔপন্যাসিকেরা বিভিন্ন কণ্ঠে পুলিশী কাজ করে।

“গদ্য শিল্পীর জন্য জগতটা অন্য লোকদের কথায় ভরপুর,” বখতিন লিখেছিলেন, “যার মধ্যে তাঁর নিজেকে পরিচিত  করাতে হবে এবং যার উক্তি বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত তীক্ষ্ম কান দিয়ে তাকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। সেগুলো তাঁর নিজের ডিসকোর্স পর্যায়ে অবশ্যই চালু করতে হবে, কিন্তু এমনভাবে করতে হবে যেন পর্যায়টি ধ্বংস হয়ে না যায়।” এ কাজটি ঔপন্যাসিকেরা নানাভাবে করেন। মুক্ত পরোক্ষ রীতি কৌশল (সেকশন ৯ দেখুন) দ্বারা চিন্তা-ভাবনা ও আবেগ-অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলতে তাঁরা তাদের নিজেদের কণ্ঠকে তাদের চরিত্রসমূহের কণ্ঠের সাথে মেশাতে পারেন। কিংবা তাদের নিজেদের কথন কণ্ঠকে ভিন্ন এক রং প্রদান করতে পারেন, যে রঙের চরিত্রের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন– হেনরি ফিল্ডিং অশ্লীল ঝগড়া-ঝাটি ও প্রণয়ঘটিত অভিজ্ঞতায় ধ্রুপদী এবং অধ্রুপদী মহাকাব্যিক কবিতার ভাষা প্রয়োগ করে মক-হিরোয়িক রীতিতে প্রায়ই কথন বর্ণনা করেন। এভাবেই তিনি নৈশভোজের টেবিলে মিসেস ওয়াটারসের প্রয়াস বর্ণনা করেন টম জোনস এর একই নামের নায়ককে প্ররোচিত করতে:

প্রথমে, দুটো সুন্দর নীল চোখ থেকে, যেগুলোর উজ্জ্বল গোলকদুটো জ্বলে উঠলে আলো ঠিকরে পড়লো, দোধারা কামনার দৃষ্টি হয়ে সামনে উড়ে গেলো। কিন্তু আমাদের নায়কের জন্য খুশীর ব্যাপার হলো সে তখন কেবল একটি বিশাল গরুর মাংসের টুকরোয় আঘাত হানলো, যে মাংসটি তখন সে তার থালায় নিচ্ছিলো, আর নির্দোষভাবে তাদের শক্তিকে খরচ করলো।

ইত্যাদি। এ ধরনের লেখাকে বখতিন বলেছেন, “দ্বিমুখী ডিসকোর্স” (doubly-oriented discourse): ভাষাটা একই সাথে ঘটনাকে বর্ণনা করে এবং উক্তি বা লেখার নির্দিষ্ট একটা রীতিকে অনুকরণ করে। এ ক্ষেত্রে  প্যারডির প্রভাব সঞ্চারিত হয়, কেননা বিষয়বস্তুর সাথে রীতিটি অসঙ্গতিপূর্ণ, আর এভাবে এর আচরণবৈশিষ্ট্যকে মনে হয় উদ্ভট ও কৃত্রিম। বিষয়বস্তু ও রীতির মধ্যকার ব্যবধান ফে ওয়েল্ডনের উপন্যাসটির প্যাসেজে কমই লক্ষণীয়, কেননা রোমান্টিক কথাসাহিত্য  ও চকচকে নারী ম্যাগাজিন থেকে যে ভাষা এটি ধার করেছে, তা বিষয়বস্তুর সাথে অনুপযুক্ত নয়, শুধু অতিরঞ্জিত ও ব্যবহারজীর্ণ জিনিস-পীড়িত। এ ধরনের লেখাকে  হয়তো প্যারডির চেয়ে বরং “প্যাসটিশ” কিংবা বখতিনের ভাষায়, “শৈলীকরণ” হিসেবে বর্ণনা করা উচিৎ। উপন্যাসের ডিসকোর্সে উক্তির বিভিন্ন পর্যায়ের তাঁর শ্রেণীকরণটা জটিল, তবে রীতি ও কণ্ঠের সমাহার, আর এটাই একে সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক, সমগ্রতাবাদ-বিরোধী(anti-totalitarian) সাহিত্য আঙ্গিকে পরিণত করেছে, যার মধ্যে কোনো আদর্শতাত্ত্বিক কিংবা নৈতিক অবস্থানই চ্যালেঞ্জ ও স্ববিরোধীতা থেকে মুক্ত নয়।


আগের পর্ব                                                                         পরের পর্ব




1 Trackback / Pingback

  1. কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: প্রদর্শন ও কথন || অনুবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*