হেয়ারবল

অনুবাদ গল্প




হেয়ারবল মার্গারেট এটউড

হেয়ারবল


মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


অপারেশনের জন্য টরন্টো জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছিল ক্যাট। দিনটা ছিল দুর্ভাগ্যের, মাসটা ছিল মৃতদের, আর তারিখটা ছিল নভেম্বরের তেরো।

অপারেশনটা ছিল জরায়ুর সিস্টের, বড় একটা সিস্ট। ডাক্তার বলেছিল, বহু মহিলারই সিস্ট ছিল। কেউ জানত না কেন। জিনিসটা অনিষ্টকর ছিল কি না, তাতে ইতোমধ্যে মৃত্যুর কোনও বীজগুটি ছিল কি না, তা বের করার কোনও উপায় ছিল না। ভেতরে ঢোকার আগে না। ডাক্তার ‘ভেতরে ঢোকা’ তেমনভাবেই বলেছিল যেমনভাবে শত্রুর এলাকায় আক্রমনের কথা টিভি প্রামাণ্য চিত্রে বয়স্ক বিশেষজ্ঞদের বলতে শুনেছিল ক্যাট। চোঁয়ালের একই উত্তেজনা, দাঁতের একই কিড়মিড়ানি, একই ভয়ানক উপভোগ ছিল। শুধু এটুকু ছাড়া যে, ডাক্তার যার মধ্যে যাবে তা ছিল ক্যাটের শরীর। অ্যানাস্থেটিকের অপেক্ষা করে ও উল্টো দিকে সময় গুনে, ক্যাটও তার দাঁত কিড়মিড় করেছিল। আতঙ্কিত হয়েছিল। কিন্তু কৌতূহলীও হয়ে উঠেছিল। কৌতূহল অনেক ছিল তার।

সিস্টটা যাই হোক না কেন, রেখে দেওয়ার জন্য ডাক্তারকে সে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল যাতে করে এক নজর দেখতে পারে। নিজের শরীরের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিল তার। আগ্রহ ছিল শরীর যা কিছু করতে বা জন্ম দিতে বেছে নেয় তার প্রতি। অদ্ভূৎ ড্যানিয়া, যে ম্যাগাজিনের ডিজাইন করেছিল, সে যদিও তাকে বলেছিল যে, অস্বাভাবিক এই বৃদ্ধিটা তার জন্য শরীরের পাঠানো একটা বার্তা। কম্পন কমানোর জন্য বালিশের নিচে নীলকান্তমণি রেখে তার ঘুমানো উচিৎ। ক্যাট তাকে বলেছিল বালিশের মধ্যে গুঁজে রাখার কথা।

সিস্টটাকে নির্দোষ হিসেবে দেখা গেল। নির্দোষ এর এই ব্যবহার ক্যাটের পছন্দ হল। যেন জিনিসটার একটা আত্মা ছিল। সেটাকে শুভেচ্ছাও জানাল। ডাক্তার বলল, আঙ্গুর ফলের মতো বড় সেটা। ক্যাট বলল, ‘নারকেলের মতো বড়’। অন্য মানুষের আঙ্গুর ফলের মতো ছিল। সে তুলনায় ‘নারকেল’ ভালো। এতে নারকেলের রুক্ষ্মতা আছে। লোমশতাও আছে।

এর ভেতরের লোমটা ছিল লাল রঙের। লম্বা এবং পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ভেতরে চলে গেছে। যেন উম্মত্ত হয়ে যাওয়া ভেজা রেশম বল কিংবা জমাটবদ্ধ বাথরুম-বেসিনের নালা থেকে টেনে বের করে আনা আবর্জনা। এর মধ্যে ছোট ছোট হাড্ডিও ছিল। অথবা হাড্ডির টুকরো। পাখির হাড্ডি, গাড়ির চাপে পিষ্ট চড়ু্ই পাখির হাড্ডি। হাত-পায়ের নখ, আঙুলও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ছিল নিখুঁতভাবে গড়া পাঁচটি দাঁত।

হাস্যজ্জ্বোল ডাক্তারকে ক্যাট জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি অস্বাভাবিক?’ ভিতরে গিয়ে এখন যেহেতু অক্ষত অবস্থায় আবার বের হয়ে এসেছে ডাক্তার, সেহেতু সে কম দৃঢ় ছিল।

‘অস্বাভাবিক? না।‘ ডাক্তার সতর্কভাবে বলল। যেন নবজাতকের অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার কথা মাকে জানান দিচ্ছিল। আরও বলল, ‘শুধু এটুকুই বলা যাক যে, এটা মোটামুটি অনেকেরই হয়।‘ ক্যাট একটু হতাশ হল। অনন্যতাকে বেশি পছন্দ করত সে।

এক বোতল ফর্মালডিহাইড চেয়ে নিয়ে খোলা টিউমারটি এর মধ্যে রেখে দিল সে। তারই এটা। নির্দোষ। এটা ফেলে দেওয়া ঠিক না। অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গিয়ে সে ম্যান্টেলের ওপর রেখে দিল। নাম দিল হেয়ারবল। ভালুকের পুরে দেওয়া মাথা কিংবা সংরক্ষিত সাবেক পোষা প্রাণী অথবা জ্বালানোর জায়গাটার ওপরে (ম্যান্টেলে) আবির্ভূত লোম ও দাঁতবিশিষ্ট যে কোনও কিছু থাকার চেয়ে এতে খুব বেশি তফাৎ নেই। কিংবা সে ভান করে যে, নেই। যা হোক, এতে মুগ্ধতার ছাপ আছে অবশ্যই।

জের এটা পছন্দ করে না। যা কিছু নতুন ও অদ্ভূৎ তার প্রতি কথিত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও রক্ত দেখে ভয় পাওয়ার মতো মানুষ সে। অপারেশনের পর প্রথমবার যখন সে কাছে আসে (সন্তর্পণে আসে, চুপি চুপি আসে), তখন সে ক্যাটকে হেয়ারবলটা ছুড়ে ফেলে দিতে বলে। এটাকে বলে ‘বিতৃষ্ণাজনক’। ক্যাট সোজা প্রত্যাখান করে বলে আবেগে গদগদ হয়ে তার জন্য যে মরা ফুলগুলো জের এনেছে সেগুলো না রেখে সে বরং ম্যান্টেলের ওপর বোতলে করে হেয়ারবলই রেখে দেবে। আর ফুলগুলো তো হেয়ারবলের অনেক আগেই পচে যাবে। ম্যান্টেলের অলঙ্কার হিসেবে হেয়ারবল অনেক বেশি ভালো। জের বলে, আহত করার কিশোরিসুলভ আকাঙ্খা থেকে কোনও কিছুকে চরমে নিয়ে যাওয়ার, প্রান্তে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা ক্যাটের আছে। এটা বুদ্ধিদীপ্তির বিকল্প হয় না তেমন। এই তো সেদিন সে বলে ক্যাট অনেক বেশি দূর যাবে। সে বোঝাতে চাচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি দূরে।

ক্যাট বলে, ‘সে জন্য আমাকে নিয়োগ দিয়েছিলে, তাই না? কারণ আমি অনেক বেশি দূরে যাই।‘ কিন্তু জের বিশ্লেষণাত্মক মেজাজে আছে। সে বলে যে, ক্যাটের এসব প্রবণতা ম্যাগাজিনের কাজে প্রতিফলিত হিসেবে সে দেখতে পাচ্ছে। ঐসব চামড়া এবং কিম্ভূতকিমাকার ও নির্যাতিত-চেহারার ভঙ্গিগুলোর নিচে চলে যাওয়ার পথ অনুসরণ করতে থাকা উচিৎ কি না, সেটার ব্যাপারে সে ও অন্যরা মোটেও নিশ্চিত না। সে যা বোঝাতে চায় ক্যাট কি তা দেখতে পায়? মূল বিষয়টা বোঝে? বিষয়টা আগেই উত্থাপিত হয়েছে। কিছু না বলে মাথা মৃদু ঝাঁকায় ক্যাট। এর তর্জমা যা দাঁড়ায় তা সে জানে: বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে অভিযোগ এসেছে। অতিমাত্রায় অদ্ভূৎ, অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক। কঠিন।

ক্যাট বলে, ‘ক্ষতটা দেখতে চাও? এটা ফাটালেও আমাকে হাসাবে না কিন্তু।‘ এ ধরণের জিনিসে জেরের মাথা ঘোরে। যেমন—রক্তের চিহ্নমাত্র আছে এমন কোনও কিছু, ধাত্রীবিদ্যার কোনও কিছু। প্রসব কক্ষে সে তো বমিই করেছিল প্রায় দু’বছর আগে যখন তার স্ত্রীর বাচ্চা হচ্ছিল। ক্যাটকে সে কথা গর্বের সাথে বলেছিল। ক্যাট চিন্তা করছে চল্লিশের দশকের সাদা-কালো ছবির মতো করে মুখের এক পাশে সিগারেট পুরে দেওয়ার কথা। চিন্তা করছে ধোঁয়াটাকে জেরের মুখে ছেড়ে দেওয়ার কথা।

বাদানুবাদের সময় ক্যাটের ঔদ্ধত্য জেরকে উত্তেজিত করে তুলত। তারপর ক্যাটের ওপর-বাহু ধরত, চোখে আবেগের চাপা আগুন থাকত, উম্মত্ত চুমা হত। জের তাকে এমনভাবে চুমু দেয় যেন কেউ তাকে দেখছে, এক সঙ্গে তাদের যে ভাবমূর্তিটা তৈরি হয় যেন তা বিচার করছে। সবচেয়ে নতুন জিনিসটাকে চুমু দেওয়া যা শক্ত ও চকচকে, গোলাপি-মুখী, কাটা-মাথাওয়ালা। বালিকাকে চুমু দেওয়া, মহিলাকে চুমু দেওয়া, কটিদেশ জড়িয়ে থাকা ছোট্ট স্কার্ট ও আঁটসাঁট প্যান্ট পরিহিত বালিকাকে চুমু দেওয়া। জের আয়না পছন্দ করে।

কিন্তু সে এখন উত্তেজিত না। আর বিছানায় নিয়ে যেতে ক্যাট তাকে প্রলুব্ধ করতে পারছে না। সেও এটার জন্য তৈরি না। সে তো আরোগ্যই লাভ করেনি। কাছে থাকা মদটা জের শেষ করে না। পরবর্তী ভাবনায় ক্যাটের হাত ধরে। সাদাটে মাপে বড় অ্যালপ্যাকা রেশমি কাপড়ে ঢাকা ক্যাটের কাঁধে চাচাসুলভ কয়েকটা চাপড় বুলায় জের। তারপর দ্রুত চলে যায়।

ক্যাট বলে, ‘বিদায়, জেরাল্ড।‘ মস্করা করে নামটি উচ্চারণ করে সে। এটা তাকে এক ধরণের অস্বীকার, এক ধরণের নাকচ, ঠিক যেন জেরের বুক থেকে পদক ছিড়ে ফেলে দেওয়ার মতো। এটা এক রকমের সতর্কতা।

প্রথম যখন তাদের দেখা হয়, তখন সে ছিল জেরাল্ড। ক্যাটই তাকে পরিবর্তন করে প্রথমে জেরি, তারপর জেরে রূপ দিয়েছে। (ফ্লেয়ার, ডেয়ার এর সাথে ছন্দ মিলিয়ে)। তাকে গাল ফুলানো থেকে মুক্ত করেছে, কোন জুতা পরতে হবে তা তাকে বলে দিয়েছে, ঢিলেঢালা ইতালিয়ান স্যূট তাকে দিয়ে কিনিয়েছে, তার চুলগুলো নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছে। খাবার-দাবার, পানীয়, বিনোদনের ঔষধ, মহিলাদের বিনোদন আন্ডারওয়্যারের প্রতি জেরের বর্তমান রুচির অনেকটাই এক সময় ক্যাটের রুচি ছিল। জেরের এখনকার নতুন, কঠিন, সংক্ষিপ্ত নাম যা ইংরেজি আর এর তীক্ষ্ম স্বর দিয়ে শেষ হয়েছে, তা ক্যাটেরই সৃষ্টি।

ক্যাট যেন নিজেরই। ছেলেবেলায় সে ছিল রোমান্টিসাইজড ক্যাথারিন। ঝাপসা চোখের খুঁতখুঁতে মা তাকে সাজাত এমনভাবে যাতে তাকে দেখাত বালিশের এলোমেলো কাভারের মতো। হাই স্কুলেই সে জামার পাড়গুলো বাদ দিয়ে প্রাণবন্ত, গোল-মুখো ক্যাথি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ধোয়া চুলের তাজা দীপ্তি ছিল। ছিল ঈর্ষা করার মতো দাঁত। যেন সন্তুষ্ট করতে আগ্রহী এবং স্বাস্থকর খাবারের বিজ্ঞাপনের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ছিল ক্যাথ। টেক-ব্যাক-দ্য-নাইট জিন্সে ও চেক শার্টে এবং ইট-শ্রমিকের স্টাইলে নীল সূতি কাপড়ের ডোরাকাটা হ্যাটে তাকে সোজাসাপ্টা লাগত, বাজে লাগত না। ইংল্যান্ডে গিয়ে নিজের নাম সঙ্কুচিত করে রাখে ক্যাট। সঙ্কোচনটা সাশ্রয়ী, পথের বিড়াল সদৃশ এবং পেরেকের মতো তীক্ষ্ম। অস্বাভাবিক ব্যাপারও ছিল এটা। ইংল্যান্ডে মনোযোগ পেতে হলে আপনার কিছু একটা করতে হবে, বিশেষ করে আপনি যদি ইংরেজ না হন। এ অবতারে নিরাপদ থেকে সে আশির দশকের র্যাম্বো হয়ে ওঠে।

এখনও এ নামের কথা সে ভাবে, যে নাম দিয়ে সে চাকুরির সাক্ষাৎকারের ডাক পেয়েছিল এবং চাকুরিটা পেয়েছিলও। চাকুরিটা ছিল অ্যাভঁ গার্ড ম্যাগাজিনে। অধিক আলোক-সম্পাতে নারীদের সাদা-কালো ক্লোজ-আপ ছবি ম্যাট পেপারে ছাপাতে হত। ছবিতে নারীর চুলগুলো চোখের ওপরে এসে উড়ত, আর একটা নাসারন্ধ্র প্রাধান্য লাভ করত। একে বলা হত দ্য রেজর’জ এজ। শিল্প হিসেবে চুলের ছাঁট, কোনও বাস্তবিক শিল্প, ছবি পর্যালোচনা, একটু তারকা-ধূলি, সাজ-সজ্জা কক্ষের ধারণা যা ছিল পোশাক-আশাক এবং পোশাক-আশাক যা ছিল ধারণা—শরীরের বাইরে কাঁধে রাখা গদি। ক্যাট তার কাজটা হাতে হাতে ভালোই শিখেছিল। সত্যিই জেনেছিল কিসে কাজ হত।

অঙ্কন থেকে নকশা, তারপর পুরোটার তত্ত্বাবধান, এবং তারপর পুরো বিষয়গুলোর কাজ দেখত সে। কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু এর মূল্য ছিল। সে সৃষ্টিশীল একজন হয়ে উঠেছিল। সার্বিক চেহারাটা সে-ই সৃষ্টি করত। কিছুক্ষণ পর সোহোর রাস্তায় সে হাঁটত অথবা লবির খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের হস্তকর্মকে আবির্ভূত হতে দেখত। সে যে সজ্জায় সাজিয়েছে তাতে পায়চারি করে দেখত। দেখত তার উষ্ণ উচ্চারণের উদগীরণ। যেন ঈশ্বরের মতো হওয়া। ঈশ্বরই কেবল আদর্শ মাপরেখা তৈরি করেনি।

সেই সময়ের মধ্যে ক্যাট তার মুখের গোলগাল ভাবটা হারিয়ে ফেলেছিল। দাঁতগুলো যদিও তেমনই ছিল অবশ্যই। উত্তর আমেরিকার দন্ত-বিদ্যা সম্পর্কে কিছু একটা বলার ছিল। তার বেশিরভাগ চুলই সে কামিয়েছিল, আকর্ষণীয় চাহনির ওপর কাজ করেছিল, কর্তৃত্ব বহনকারী ঘাড়ের নির্জন অন্তঃস্থ বাঁকটা ঠিক করেছিল। এগুলো বিশ্বাস করাতে যা করতে হয়েছিল তা হলো এই যে, আপনি কিছু না কিছু জানতেন যা তারা তখনও জানত না। বিশ্বাস করাতে আরও যা করতে হয়েছিল তা হলো তারাও এ বিষয়টা জানতে পারত যা তাদেরকে ক্ষমতা, যশ ও যৌন-প্রলোভন দিতে পারত, যা আবার তাদের জন্য বিনামূল্যে ঈর্ষার আকর্ষণ হত। ম্যাগাজিনের মূল্য। মাথা খাটিয়ে তারা যা বের করতে পারত না, তা ক্যামেরা দিয়ে পুরোপুরি করা হত। স্থির আলোক, স্থির সময়। কোণ প্রয়োগ করে যে কোনও নারীকে ক্যাট কুৎসিৎ বানাত। যে কোনও পুরুষকেও বানাত। যে কাউকে সে সুন্দর বানাতে পারত, কিংবা নিদেনপক্ষে মজার। সবটাই ছিল ফটোগ্রাফি, সবটাই ছিল আইকোনোগ্রাফি। সবটাই ছিল নির্বাচনকারী দৃষ্টিতে। এ জিনিসটাই কখনও কিনতে পাওয়া যেত না। তাতে সাপের চামড়ার ওপর আপনার অল্প মাসিক পারিশ্রমিকের যতই ঢালা হোক না কেন।

এ অবস্থান থাকা সত্ত্বেও দ্য রেজর’জ এজ  মোটামুটিভাবে কম বেতন দিত। অনেক কিছু যা ক্যাট এত ভালোভাবে প্রেক্ষিতে স্থাপন করত সেসব কিছুতে তার নিজেরই সামর্থ্য ছিল না। লন্ডনের দুর্বল মান ও ব্যয় তাকে আক্রান্ত করতে লাগল। খাদ্যদ্রব্যে মিতব্যয়ী হতে সাহিত্য ভোজে দু’একটা রুটি-বিস্কুট খেতে খেতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ক্লান্ত হয়েছিল পাবের লাল-মেরুন কার্পেটিংয়ে প্রোথিত সিগারেটের ধোঁয়াশা গন্ধে। ক্লান্ত হয়েছিল শীতে জমে যাওয়া পাইপের প্রতিবার বিস্ফোরণে। ক্লান্ত হয়েছিল ম্যাগাজিনের ক্লারিসা, মেলিসা ও পেনিলোপিরা কীভাবে একেবারে, সম্পূর্ণরূপে, পুরোপুরি ঠাণ্ডায় জমে গিয়েছিল রাতের বেলা তাদের সেই বকবকানিতে। আর কীভাবে একেবারে, সম্পূর্ণরূপে, পুরোপুরি, সাধারণভাবে কখনও তত ঠাণ্ডা বোধ করেনি তাতে। পাইপগুলো সব সময় বিস্ফোরিত হত। কেউ-ই আসল পাইপ লাগানোর কথা ভাবেনি। ভাবেনি যে পাইপগুলো পরের বার আর বিস্ফোরিত হবে না সে কথা। অন্যান্য ঐতিহ্যের মতো বিস্ফোরিত পাইপ ছিল ইংরেজদের ঐতিহ্য।

যেমন ধরেন ইংরেজ পুরুষদের কথা। শ্রুতিমধুর স্বরধ্বনি ও শব্দবাহুল্যে মুগ্ধ করে আপনার প্যান্টি খুলে ফেলে। তারপর একবার খুলে ফেললে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দৌড় দেয়। নতুবা থেকে গিয়ে প্যান প্যান করে। ইংরেজরা এটাকে ঘ্যান ঘ্যান  না বলে প্যান প্যান বলে। আসলে এটাই ভালো শোনায়। কব্জির আওয়াজের মতো। শব্দটা ছিল ইংরেজদের দ্বারা প্যান-প্যানগ্রস্ত হওয়ার প্রথাগত প্রশংসার শব্দ। এটা বলা মানে ইংরেজরা আপনাকে বিশ্বাস করেছিল, তাদের প্রকৃত সত্ত্বাকে জানতে পারার সুবিধা আপনাকে অর্পণ করেছিল। ভেতরকার, প্যান প্যান করা ইংরেজটা। এভাবেই তারা নারীদের সম্পর্কে গোপনে ভাবত: প্যানপ্যানানির আধার। ক্যাট এটা করতে পারত, কিন্তু তার মানে এই না যে, এটা তার পছন্দ ছিল।

ক্যাটের যদিও ইংরেজ নারীদের চেয়ে একটা বেশি সুবিধা ছিল: সে কোনও শ্রেণির ছিল না। তার কোনও শ্রেণি ছিল না। সে তার নিজের শ্রেণিতেই ছিল। বিভিন্ন ধরণের ইংরেজ পুরুষদের মাঝে তার আনাগোনা ছিল। এ পুরুষদের এই জ্ঞান ছিল যে, শ্রেণির মাপকাঠি ও ভাষার টান যা তারা তাদের পিছনের পকেটে বয়ে নিয়ে বেড়াত, তা দিয়ে ক্যাটকে মাপা হচ্ছিল না। যে ক্ষুদ্র উন্নাসিকতা ও বিরাগ তাদের অভ্যন্তরীণ জীবনে সমৃদ্ধি প্রদান করত, তার অধীন ছিল না সে। এ রকম স্বাধীনতার উল্টো দিকটা ছিল যে, সে ছিল স্বাভাবিক আওতার বাইরে। সে ছিল ঔপনিবেশিক—কত সজীব, কত প্রাণবন্ত, কত নামহীন, পরিশেষে কত পরিণামবিহীন! দেয়ালের ফুটোর মতো তাকে সব গোপন কথা বলা যেত। আর তারপর অপরাধবোধ ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া যেত।

ক্যাট অবশ্যই অতিমাত্রায় চটপটে ছিল। ইংরেজ পুরুষরা ছিল খুবই প্রতিযোগিতা-ভাবাপন্ন। তারা জিততে পছন্দ করত। এ বিষয়টা কয়েকবার তাকে আহত করেছিল। দু’বার সে গর্ভপাত ঘটিয়েছিল। কারণ প্রশ্নবিদ্ধ পুরুষগুলো বিকল্প হিসেবে বিবেচনাযোগ্য ছিল না। সে বলতে শিখেছিল যে, আর যাই হোক সন্তান চায় না সে। শিখেছিল যে, যদি বাচ্চাই কামনা করত, তাহলে সে কিনত জার্বিল (মরুভূমির এক ধরণের ইঁদুর)। জীবনটাকে তার অনেক দীর্ঘ মনে হতে শুরু করত। তার অ্যাড্রেন্যালিন শেষ হয়ে যাচ্ছিল। শীঘ্রই তার বয়স ত্রিশ হবে। আর সামনে যা কিছু সে দেখতে পাচ্ছিল তা ছিল একই জিনিসের আরও বেশি কিছু।

জেরাল্ড না আসা পর্যন্ত সব কিছু এভাবেই ছিল। ক্যাটকে সে বলেছিল, ‘তুমি টেরিফিক।‘ আর ক্যাট তার মুখ থেকেও এটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল। যদিও টেরিফিক শব্দটা পঞ্চাশের দশকের ক্রু-কাটের সাথে সম্ভবত উধাও হয়ে গিয়েছিল। সে সময় নাগাদও জেরাল্ডের কণ্ঠস্বরের জন্য প্রস্তুত ছিল সে। গ্রেট লেকের একরৈখিক, ধাতব নাকি স্বর যার মধ্যে স্পষ্ট কঠিন আর ধ্বনি ও নাটকীয়তায় এর অনুপস্থিতি। একঘেঁয়ে স্বাভাবিক। ক্যাটের লোকজনের উক্তি। তার হঠাৎ মনে হয়েছিল সে একজন নির্বাসিত ব্যক্তি।

জেরাল্ড খুঁজছিল। জেরাল্ড নিয়োগ দিচ্ছিল। ক্যাটের সম্পর্কে সে শুনেছিল। তার কাজ দেখেছিল এবং খুঁজেও পেয়েছিল। টরন্টোর বড় একটা কোম্পানি ফ্যাশন নির্ভর ম্যাগাজিন চালু করতে যাচ্ছিল। জেরাল্ড বলেছিল, কাভারেজের দিক দিয়ে অবশ্যই আন্তর্জাতিক এবং উচ্চ শ্রেণির। কিন্তু এতে কিছু কানাডিয়ান ফ্যাশনও থাকবে। আরও থাকবে দোকানের তালিকা যেখানে ম্যাগাজিনগুলো কিনতে পাওয়া যাবে। সে দিক দিয়ে সেগুলোকে মনে হয়েছিল যে, প্রতিযোগিতায় সেগুলো সর্বত্র জায়গা করে নেবে। বিশেষ করে আমেরিকান ম্যাগাজিনের চেয়ে। এ ম্যাগাজিনগুলোর ব্যাপারে ধরেই নেওয়া হয় যে, নিউ ইয়র্ক বা লস এঞ্জেলসেই কেবল গুচির পণ্য পাওয়া যায়। কিন্তু হায়! সময় বদলে গেছে। এডমন্টনেও এগুলো পাওয়া যায়! উইনিপেগেও পাওয়া যায়!

অনেক দিন ধরে দূরে ছিল ক্যাট। তখন কানাডিয়ান ফ্যাশনের চল ছিল। বুদ্ধিদীপ্তভাবে বলতে গেলে বলতে হবে ‘কানাডিয়ান ফ্যাশন’ ছিল এক ধরণের বিরোধাভাস। ক্যাট এটা করা থেকে বিরত ছিল। সায়ানাইড-সবুজ কাভেন্ট গার্ডেন-বুটিকের চামড়া আবৃত লাইটার (যেমনটা দ্য রেজর’জ এজ এর সংখ্যায় থাকত) দিয়ে সিগারেট ধরাত। জেরাল্ডের চোখে চোখ রাখত, আর স্থিরচিত্তে বলত, ‘ছেড়ে দেওয়ার মতো লন্ডন অনেক কিছু।‘ সি-মি-হিয়ার মেফেয়ার রেস্টোরেন্টটির দিকে এক নজর তাকাত। এখানেই তারা মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করছিল। এই রেস্টোরেন্টটি ক্যাট বেছে নিয়েছিল, কারণ সে জানত যে, জেরাল্ড বিল পরিশোধ করবে। খাওয়ার জন্য ক্যাট কখনও সে ধরণের অর্থ ব্যয় করেনি। ‘কোথায় খাব আমি?’

জেরাল্ড তাকে আশ্বস্ত করত যে, এখন টরন্টো হচ্ছে কানাডার রেস্টোরেন্ট রাজধানী। ক্যাটের গাইড হতে পেরে সে নিজেকে সুখি মনে করত। বড় একটা চায়নাটাউন ছিল। ছিল বিশ্বমানের ইটালিয়ান রেস্টোরেন্ট। তারপর সে কিছুক্ষণ থেমে একটা দম নিত। বলত, ‘নামটার বিষয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি। ক্রেজিতে যেমন, ক্যাট কি তেমন?’ সে ভাবত এটা ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল। ক্যাট আগে তা শুনেছে।

ক্যাট বলত, ‘না, কিটক্যাটে যেমন ক্যাট তেমন। এটা হচ্ছে চকোলেট। তোমার মুখে এলে গলে যায়।‘ জেরাল্ডের দিকে সে তাকাত, মুখটা বাঁকাত, একবার বাঁকাত।

জেরাল্ড ভ্যাবাচ্যাকা খেত। কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যেত। তাদের দরকার ছিল ক্যাটকে। তারা ক্যাটকে চাইত। তারা ক্যাটকে ভালোবাসত। সারমর্মটা এভাবেই বলত সে। আপেক্ষিকভাবে বলতে গেলে, ক্যাটের মতো সজীব, উদ্ভাবনকুশল মনোভঙ্গি ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কেউ একজন তাদের কাছে অনেক অর্থমূল্যের হবে। তবে অর্থের চেয়েও অন্য পুরষ্কার ছিল। ক্যাট প্রাথমিক ধারণায় থাকবে। থাকবে তার গঠনমূলক প্রভাব। আরও থাকবে তার মুক্ত হাত। জেরাল্ড এমন একটা অঙ্কের কথা উল্লেখ করেছিল যা শুনে ক্যাট হাঁপাচ্ছিল। আর তা অশ্রুতভাবে অবশ্যই। তখন নাগাদ আকাঙ্খা প্রদর্শন করা সে আরও ভালোভাবেই জানত।

ক্যাট তাই পিছন দিকে যাত্রা করেছিল। তিন মাসের সাংস্কৃতিক অভিঘাত কাটিয়ে উঠেছিল। বিশ্ব-মানের ইতালিয়ান ও চমৎকার চাইনিজ খাবার খেয়ে দেখেছিল। আর জুনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্টের অফিসে প্রথম সুযোগেই জেরাল্ডকে প্ররোচিত করেছিল। এমন একটা জায়গায় জেরাল্ড এই প্রথম প্ররোচিত হয়েছিল। যদিও সময়টা ছিল কর্মব্যস্ত সময়ের বাইরে, বিপদটা তবু তাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল। ধারণাটাই এমন ছিল। দুঃসাহসী। প্রশস্থ কার্পেটে হাঁটু গেড়ে বসা ক্যাটের প্রতিমূর্তি, শুধু রবিবারের নিউ ইয়র্ক টাইমজ এর অন্তর্বাস বিজ্ঞাপনে তখন পর্যন্ত দেখা কিংবদন্তীতুল্য ব্রাতে ক্যাটের প্রতিমূর্তি জেরাল্ডের স্ত্রীর রূপালী ফ্রেমে বাঁধা আকদের প্রতিকৃতিকে পূর্ণ অবয়বে তুলে ধরেছিল। প্রতিকৃতিটা টেবিলে থাকা অসম্ভব বল-পয়েন্ট কলম সেটের পরিপূরক ছিল। তো দেখার সময় জেরাল্ড এতটা সোজাসাপ্টা ছিল যে বিয়ের প্রথমে রিংটা খুলে ছাইদানিতে রেখে দিতে বাধ্য অনুভব করেছিল। পরের দিন ক্যাটের জন্য এক বাক্স ড্যাভিড উড ফুড শপ চকোলেট এনেছিল। ক্যাটকে বলেছিল যে, ওগুলো সবচেয়ে ভালো। আরও বলেছিল যে, ক্যাট সেগুলোর গুণগত মান সনাক্ত করতে পারে কি না সে ব্যাপারে সে উদ্বিগ্ন। ক্যাটের কাছে জেরাল্ডের অঙ্গভঙ্গিটা মামুলি কিন্তু মধুরও মনে হয়েছিল। মামুলিপনা, মধুরতা, মুগ্ধ করার ক্ষুধা—এ নিয়েই ছিল জেরাল্ড।

জেরাল্ড এমন ধরণের লোক ছিল যাকে নিয়ে লন্ডনে ক্যাটকে বিরক্ত হতে হত না। জেরাল্ড মজার ছিল না, জ্ঞানবান ছিল না। কথা বলায় মুগ্ধতাও তেমন ছিল না। কিন্তু সে উৎসাহী ছিল, বশ্য ছিল, ছিল সাদা কাগজ। ক্যাটের চেয়ে আট বছর বড় হলেও তার বয়স অনেক কম লাগত। নিজের দুষ্টামিতে গোপন, বালখিল্যসুলভ আনন্দ থেকে সে মজা পেত। আর খুব কৃতজ্ঞ ছিল। সাধারণত বিছানায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঘন ঘন বলত, ‘আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, এটা হতে যাচ্ছে।‘

তার স্ত্রী যার সাথে কোম্পানির নানা একঘেঁয়ে উৎসবে ক্যাটের সাক্ষাৎ হয়েছিল (এখনও সাক্ষাৎ হয়), সে জেরাল্ডের কৃতজ্ঞতাবোধের ব্যাখ্যা প্রদান করতে সহায়তা করত। স্ত্রীটি ছিল খুঁতখুঁতে। নাম ছিল শেরিল। তার চুল এমন দেখাত যেন তখনও সে বড় বড় রোলার এবং ‘আপনার-চুলে-সুগন্ধি-মাখুন’ স্প্রে ব্যবহার করত। তার মনের প্রতিটা ঘরে ছিল লরা অ্যাশলি ওয়ালপেপার: সোজা সারিতে সাজানো ছোট, ঢাকা প্যাস্টেল বাড। প্রেম করতে সে সম্ভবত রাবার মোজা পরত। আর পরে তালিকায় টিক চিহ্ন দিত। আরেকটি এলোমেলো গৃহস্থালি কাজ। ক্যাটের দিকে সে এমনভাবে তাকাত যেন বাতাস বিশোধক দিয়ে সে তার মুখে স্প্রে করতে চায়। শেরিলের বাথরুমের ছবি কল্পনা করে ক্যাট এর প্রতিশোধ নিত। বাথরুমের তোয়ালেগুলো শাপলাখচিত ছিল, টয়লেটের সিটের কাভারে চুল পড়ে থাকত।

ম্যাগাজিনটা শুরু করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। শুরু করার জন্য ক্যাটকে যদিও প্রচুর অর্থ যোগান দেওয়া হয়েছিল, যদিও রঙিন কাজ করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তবু জেরাল্ড তাকে যে মুক্ত হস্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা তার ছিল না। কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলীকে তার মোকাবেলা করতে হয়েছিল, যাদের সবাই ছিল পুরুষ, যাদের সবাই ছিল হিসাবরক্ষক অথবা আলাদা করে চেনা যেত না, যারা ছিল সতর্ক ও খচ্চরের মতো ধীরগতির।

ক্যাট তাদের বলেছিল, ‘এটা তো সহজ। যেমনটা হওয়া উচিৎ তেমন ছবি দিয়ে তাদের পরিপূর্ণ করবে। আর যে অবস্থায় ছবিগুলো আছে সেটাতে তাদের দুর্বল মানের বোধ করাবে। বাস্তবতা এবং প্রত্যক্ষণের মাঝামাঝি ফাঁকা জায়গাটি নিয়ে আপনি কাজ করছেন। সে জন্য তাদের নতুন কিছু দিয়ে আঘাত হানতে হবে, এমন কিছু যা তারা আগে কখনই দেখেনি, এমন কিছু যা তারা নয়। উদ্বেগের মতো আর কিছুই তেমন বিক্রি হয় না।‘

অন্যদিকে পরিচালকমণ্ডলী ভেবেছিল যে, রিডারশিপে ইতোমধ্যে যা ছিল তারও বেশি কিছু তো প্রদান করতে হবে। আরও পশম, আরও জাঁকালো চামড়া, আরও কাশ্মিরি। আরও প্রতিষ্ঠিত নাম। পরিচালকমণ্ডলীর উপস্থিত কিছু করার বোধটা ছিল না। ছিল না ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা। যুক্তিসঙ্গত কোনও প্রবৃত্তিও ছিল না। শুধু মজা করে হলেও রিডারের ওপর একটা কিছু ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছাও ছিল না। যদি তাদের পুরুষালি হরমোন বলে কিছু থাকে, সেটাকে আকর্ষণ করার আশা নিয়ে ক্যাট তাদের বলেছিল, ‘ফ্যাশন হচ্ছে শিকারের মতো। এটা ক্রীড়া-কৌতূকময়, এটা তীব্র, এটা শিকারি। এটাই রক্ত ও নাড়িভুঁড়ি। এটা যৌন।‘ কিন্তু তাদের কাছে এটা ছিল সুরুচির ব্যাপার। তারা চেয়েছিল পোশাকেই সাফল্য আনে পদ্ধতি (ড্রেস ফর সাকসেস)। ক্যাট চেয়েছিল আঁততায়ী আক্রমণের শটগান পদ্ধতি(বিভিন্ন সম্ভাবনাকে বিবেচনা করার পদ্ধতি)।

সবকিছুই একটা আপোসের বিষয় হয়ে গিয়েছিল। অল দ্য রেজ ম্যাগাজিনের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল ক্যাট। কিন্তু ‘রেজ’ শব্দটির উষ্মা-কম্পনে পরিচালকমণ্ডলী সরে এসেছিল। তাদের মতে সবকিছুর মধ্যে এ শব্দটা অতিমাত্রায় নারীবাদী। ক্যাট বলেছিল, ‘এ শব্দটা তো চল্লিশের দশক এর ধ্বনি। চল্লিশের দশক ফিরে এসেছে। বোঝেন নি?’ তবে তারা বোঝেনি। তারা এটাকে বলতে চেয়েছিল ওর। ফরাসি ভাষায় যার অর্থ সোনা। আর মূল্যের দিক দিয়ে যথেষ্ট স্থুল, তবে কোনও ভিত্তি মূল্য নেই। ক্যাট তাদের এমনই বলেছিল। ফেলিস এ এসে তারা কেটে দিয়েছিল। প্রত্যেকটা দিক চাইলে এর মধ্যে গুণগত মান বজায় ছিল। ফেলিস শব্দটা অস্পষ্টভাবে ফরাসির মতো শোনায়, যার মানে ‘সুখি’(রেজ-এর চেয়ে এতটা কম হুমকিজনক)। আর অন্যদের লক্ষ্য করার মতো প্রত্যাশা না করলেও ক্যাটের কাছে এর বিড়ালসুলভ একটা গন্ধ ছিল। গন্ধটা জুতার ফিতার দুর্গন্ধকে কমিয়ে এনেছিল। আবেদনময়ী-গোলাপি অক্ষরচিত্রে সে শব্দটা লিখিয়ে নিয়েছিল। এতে কিছুটা কাজ হয়েছিল। এটা দিয়েই সে জীবন-ধারণ করতে পারত। কিন্তু এটা তার প্রথম প্রেম ছিল না।

ডিজাইনের প্রত্যেকটা উদ্ভাবনে, ক্যাট যে দৃষ্টিকোণ বেছে নিয়েছে তার প্রত্যেকটা নতুন নির্বাচনে, প্রত্যেকটা নির্দোষ বাঁকে এ তুঘলকি কাণ্ডটা ঘটেছে, বার বার ঘটেছে। অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপনটা যে অপর পৃষ্ঠায় গিয়ে ঠেকেছিল তা নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়েছিল। বিজ্ঞাপনের ছবিটা ছিল অর্ধেক গুটানো। আর মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ভাঙ্গা কাচের সুগন্ধি বোতল। তা নিয়েও হৈ চৈ হয়েছিল। দুটো নতুন মোজা পরা পা নিয়েও গোলমাল বেঁধেছিল। একটা পা তৃতীয়, ভিন্ন রঙের একটা মোজাসহ চেয়ারে বাঁধা ছিল। তারা বোঝেইনি যে, পুরুষটির তিনশ ডলারের চামড়ার দস্তানাগুলো দ্ব্যর্থবোধকভাবে ঘাড়ের চারদিকে রাখা হয়েছিল।

আর এভাবেই চলেছে পাঁচটি বছর।

জেরাল্ড চলে যাওয়ার পর ক্যাট তার থাকার ঘরে পায়চারি করে। পায়চারি, পায়চারি। তার সেলাইগুলোতে টান খায়। মাইক্রোওয়েভের উচ্ছিষ্ট খাবার দিয়ে নৈশভোজনের জন্য সে অপেক্ষা করে আছে। কেন সে এখানে অভ্যন্তরীণ দূষিত সাগরের পার্শ্ববর্তী এই সমতল শহরে এসেছিল সে ব্যাপারে এখন নিশ্চিত না। তাহলে কি জের? হাস্যকর ভাবনা কিন্তু প্রশ্নাতীত নয় আর। জেরের সাথে ক্রমবর্ধমান অধৈর্য সত্ত্বেও সে-ই কি তার থাকার কারণ?

জের তো আর পুরোপুরি লাভজনক না। পরস্পরকে তারা খুব ভালোভাবে জেনেছেও। এখন তারা সংক্ষিপ্ত রাস্তা গ্রহণ করে। অখণ্ড, হারানো, গড়ানো ও ইন্দ্রিয়সুখকর বিকেল থেকে তাদের এক সাথে কাটানো সময়গুলো কমে গিয়ে কাজ ও ভোজনের মধ্যে ঘন্টা কয়েকে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্যাট এখন আর জানেও না জেরের কাছ থেকে সে কী চায়। শুধু মনে মনে বলে যে, সে আরও বেশি কিছুর যোগ্য। আরও নতুন কিছু করা উচিৎ তার। কিন্তু সে অন্য পুরুষদের কোনওভাবেই দেখে না, দেখতে পারে না। একবার কি দু’বার চেষ্টা করে দেখেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। কখনও কখনও নৈশভোজনে বের হয়েছে কিংবা সমকামী ডিজাইনারদের একজনের সাথে সিনেমায় গেছে। গল্পগুজব তার পছন্দ।

হয়ত লন্ডনের কথা তার মনে পড়ে। এ দেশে, এ শহরে, এ রুমে নিজেকে বন্দী বন্দী লাগে। রুমটা দিয়েই সে শুরু করতে পারত, জানালা খুলে দিতে পারত। এখানটায় এত দম বন্ধ হয়ে আসে। হেয়ারবলের বোতল থেকে ফরমালডিহাইডের গন্ধ ভাসে। অপারেশনের জন্য যে ফুলগুলো পেয়েছিল সেগুলো অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে। শুধু জেরাল্ডের কাছ থেকে আজকে পাওয়া ফুলগুলো ছাড়া। ভাবতে লাগে জেরাল্ড কেন হাসপাতালে তাকে কোনও ফুল পাঠায়নি। ভুলে গিয়েছিল কি? নাকি এটা এক ধরণের বার্তা ছিল?

বলে ওঠে, ‘হেয়ারবল, তুমি যদি কথা বলতে পারতে! এ তুর্কি ফার্মে হেরে যাওয়া অধিকাংশ লোকের চেয়ে তোমার সাথে আরও বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা যদি হত!’ হেয়ারবলের শিশু দাঁতগুলো আলোতে ঝকমক করে ওঠে। এমনভাবে ঝকমক করে যেন কথা বলছে প্রায়।

নিজের কপালটা ছোঁয় ক্যাট। ভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে কি না। পিছন পিছন অশুভ কিছু একটা হতে যাচ্ছে। ম্যাগাজিনটা থেকে যথেষ্ট ফোনও আসেনি। তাকে ছাড়া তারা সব কিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। এটা খারাপ সংবাদ। রাজ্য শাসনকারী রাণীদের কখনই ছুটিতে যাওয়া ঠিক না। অপারেশনেও না। শাসকের মাথা অস্বস্থিতে ভরা থাকে। এসব ব্যাপারে ক্যাটের ষষ্টেন্দ্রিয় কাজ করে। লক্ষণগুলো জানার জন্য রাজপ্রাসাদের যথেষ্ট ক্যূতে সে জড়িত ছিল। আসন্ন বিশ্বাসঘাতকতার পদধ্বনি বোঝার জন্য তার সংবেদনশীল এন্টিনা আছে।

পরের দিন সকালে সে গুটিসুটি মেরে বসে তার ছোট মেশিন থেকে এসপ্রেসো পান করে। বর্ম-ধূসর রঙের আগ্রাসী ‘সাহস থাকলে আমাকে ছুঁয়ে দেখো’ মখমল কাপড় বেছে নেয়। আর অফিসে যায়, যদিও পরের সপ্তাহ না আসা পর্যন্ত তার যাওয়ার কথা না। বিস্ময়, বিস্ময়। করিডোরের ফিসফিস করা বাঁধনগুলো খুলে যায় এবং তাকে মিথ্যে অভ্যর্থনা জানায় যখন সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেগুলো অতিক্রম করে। তার শিল্পী টেবিলে গিয়ে বসে মেইল চেক করে। মাথাটা ধক ধক করছে। সেলাইগুলো লাগছে। তার আগমনের বাতাস পায় জের। সে ক্যাটের সাথে যত দ্রুত সম্ভব দেখা করতে চায়। আর তা মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য না।

নতুনভাবে সাজানো হুইট-অন-হোয়াইট অফিসে ক্যাটের জন্য অপেক্ষা করে সে। যে টেবিলটি তারা এক সঙ্গে বাছাই করেছিল সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর টেবিলে বসে অপেক্ষা করে। সেখানে ভিক্টোরিয়ান দোয়াত, ম্যাগাজিন থেকে ফ্রেমে বাঁধা বড় ছবি আছে। মডেলের হাতদুটো মেরুন রঙের চামড়ায় আবৃত। কব্জিদুটো মুক্তোয় বাঁধা। হারমিজ স্কার্ফটি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চোখদুটো ঢেকে ফেলেছে। মডেলের মুখখানি এর নিচে প্রস্ফুটিত হয়ে আছে। এগুলোর কিছু কিছু ক্যাটের সবচেয়ে ভালো জিনিস। ‘আমার ঘাড় চাটো’ রেশমি শার্টটি গলার দিকে খুলে রেখে, ‘তোমার হৃদয় কুড়ে কুড়ে খাও’ ইতালিয়ান রেশমি ও পশমি ঢিলেঢালা সোয়েটারে জের সুন্দরভাবে সেজেছে। ওহ, চমৎকার ঔদাসিন্য। ওহ, ভ্রুর ভাষা। সে তো অর্থের মানুষ যে ছিল শিল্প-লিপ্সু। আর এখন তার কিছু হয়েছে। এখন সে একটা কিছু। দেহশিল্প। ক্যাটের শিল্প। ক্যাট তো তার কাজটি ভালোভাবে করেছে। সবশেষে জের যৌন-আবেদনময়ী।

জের তো চকচকে তরলের মতো মসৃণ। সে বলে, ‘পরের সপ্তাহ পর্যন্ত তোমাকে এটা বলে দিতে চাই না আমি।‘ সে ক্যাটকে বলে দেয়। পরিচালকমণ্ডলীই ভাবে যে, ক্যাট অতিমাত্রায় খেয়ালী। ভাবে যে, সে খুব বেশি দূর চলে যায়। এ ব্যাপারে জের কিছু করতে পারত না। যদিও স্বভাবতই চেষ্টা করেছিল সে।

স্বভাবতই। বিশ্বাসঘাতকতা। দানবটি নিজের পাগল বিজ্ঞানীকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। ক্যাট তাকে চিৎকার করে বলতে চায়, ‘আমি তোমাকে জীবন দান করেছি!’

ক্যাট ভাল অবস্তায় নেই। দাঁড়াতেই পারছে না প্রায়। ক্যাটকে সে বসার চেয়ার এগিয়ে দিলেও ক্যাট দাঁড়ায়। দেখে কী চেয়েছে সে, কী বাদ পড়ে গেছে। জেরাল্ডই বাদ গেছে। স্থির, ফ্যাশনহীন, প্রাক্তন, কিপ্টে জেরাল্ড। জের না। তাকেও না যাকে সে নিজের প্রতিমূর্তিতে তৈরি করেছে। নষ্ট হওয়ার আগের অন্য জন। টেবিলের ওপর রূপালি ফ্রেমে স্ত্রীর ছবি, ছোট্ট একটা সন্তান ও বাড়িসমেত জেরাল্ড। ক্যাট সেই রূপালি ফ্রেমে থাকতে চায়। সন্তানটিকে চায়। তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

ক্যাট বলে, ‘আর কে সেই ভাগ্যবতী যে আমার জায়গাটা নিয়েছে?’ তার সিগারেট দরকার। কিন্তু কাঁপা হাতদুটো সে বের করতে চায় না।

বিনয়ের চেষ্টা করে জেরাল্ড বলে, ‘আসলে আমিই।‘

অতিমাত্রায় গাঁজাখুড়ি। জেরাল্ড ফোন বই সম্পাদন করতে পারত না। মৃদু স্বরে ক্যাট বলে, ‘তুমি?’ না হাসার মতো ক্যাটের সুবোধ আছে।

জেরাল্ড বলে, ‘আমি সব সময় চেয়েছি অর্থকে সৃষ্টিশীল ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে। জানতাম তুমি সেটা বুঝবে যেহেতু তুমি যে কোনও মূল্যে তুমি হতে পার না। জানতাম তোমার ভিত্তির ওপর যে এক ধরণের নির্মাণ করতে পারে তাকেই তুমি অগ্রাধিকার দেবে।‘ জাঁকালো শুয়োর। ক্যাট তার ঘাড়ের দিকে তাকায়। তাকে কামনা করে, এজন্য নিজেকে ঘৃণা করে, আর ক্ষমতাহীন হয়।

রুমটি নড়বড়ে হয়। গম-রঙা প্রশস্থ কার্পেট জুড়ে জেরাল্ড ক্যাটের দিকে নিজেকে চাপিয়ে নিয়ে যায়। তার ধূসর মখমলে আবৃত ওপরের বাহুদুটো ধরে। বলে, ‘তোমার জন্য ভালো রেফারেন্স লিখে দেব। ও নিয়ে চিন্তা করো না। আর অবশ্যই আমরা এখনও দেখা করতে পারি। আমাদের বিকেলগুলোর কথা খুব মনে পড়বে।‘

ক্যাট বলে, ‘অবশ্যই।‘ জেরাল্ড তাকে চুমু দেয়, যৌন-কাতর চুমু। অথবা তৃতীয় কোনও পক্ষের কাছে তেমন চুমুই মনে হবে। আর ক্যাট তাকে দিতে দেয়। শুকরের কানে।

ট্যাক্সিতে করে ক্যাট বাসা চলে যায়। চালক তার প্রতি রূঢ় আচরণ করে পার পেয়ে যায়। কারণ ক্যাটের আর শক্তি নেই। মেইলবক্সে এসেছে খোদিত এক নিমন্ত্রণ: জের ও শেরিল আগামীকাল সন্ধ্যায় পানাহার পার্টি করতে যাচ্ছে। পাঁচদিন আগের পোস্টমার্ক করা। শেরিল সময়ের পিছনে পড়ে আছে।

ক্যাট নগ্ন হয়ে হালকা গোসল করে। এখানটায় পান করার মতো খুব বেশি কিছু নেই। গন্ধ শোঁকার বা ধুমপান করার মতোও কিছু নেই। কী যে একটা ভুল। নিজের কাছেই আটকা পড়ে গেছে। অন্য কাজ আছে। অন্য পুরুষ আছে। অথবা সেটাই তত্ত্বকথা। তবু তার কাছ থেকে কিছু একটা ছিড়ে নেওয়া হয়েছে। কীভাবে তার ক্ষেত্রে হতে পেরেছিল এটা? ছুরিগুলোর পিছনে যখন স্লেট বসানো হয়েছিল, সে তখন সব সময় ছুরি চালাত। কেউ তার পথে এসে দাঁড়ালে তাকে সময়মতো আসতে ও উদ্দেশ্য নস্যাৎ করতে দেখা যেত। হয়ত তার ধার কমে যাচ্ছে।

বাথরুমের আয়নার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকায় সে। ঝাপসা কাচে নিজের মুখাবয়ব যাচাই করে দেখে। আশির দশকের মুখাবয়ব, মুখোস পরা মুখাবয়ব, বটম-লাইন মুখাবয়ব। দুর্বলকে দেয়ালে ঠেলে দিয়ে যা পাওয়া যায় তা-ই নেওয়া। কিন্তু সময়টা এখন নব্বইয়ের দশক। সে কি তাহলে সেকেলে হয়ে গেছে এত তাড়াতাড়ি? তার বয়স তো কেবল পঁয়ত্রিশ। আর তার চেয়ে দশ বছরের ছোট লোকজন যা ভাবছে সে ইতোমধ্যেই তার খেই হারিয়ে ফেলছে। এটা খুবই মারাত্মক হতে পারে। সময় যতই যাবে, ততই তাকে তাল মেলাতে আরও দ্রুত এবং দ্রুত দৌড়াতে হবে। আর তা কী জন্য? জীবনের যে অংশটা তার যাপন করা উচিৎ ছিল সে অংশটা শুধুই ফাঁকা পড়ে আছে। সেটা সেখানে নেই। কিছুই নেই। এর থেকে আর কী উদ্ধার করা যায়? কী করা যায় আবার? আদৌ কী করা যায়?

স্পঞ্জ দিয়ে গোসল করার পর সে যখন টাব থেকে উঠে আসে, তখন সে তো পড়েই যায় প্রায়। তার যে জ্বর আছে সে ব্যাপারে তো কোনও সন্দেহ নেই। তার ভেতরে কী যেন ফুটা হয়ে ঝরছে, অথবা অন্য কিছু জ্বালাতন করছে। ফোটায় ফোটায় পানি পড়া ট্যাপের মতো সে তা শুনতে পায়। চলমান ক্ষত একটা, এত কঠিনভাবে চলা থেকে ক্ষত। কোনও হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে এন্টিবায়োটিক নেওয়া উচিৎ তার। তা না করে সে থাকার ঘরে পায়চারি করে। বোতলের ম্যান্টল থেকে হেয়ারবলটি নামিয়ে এনে কফির টেবিলে রাখে। দু’পা আড়াআড়ি রেখে বসে, শোনে। বিদ্যুৎ বাতির ফিলামেন্ট কেঁপে ওঠে। কর্মরত মৌমাছিদের মতো এক ধরণের গুঞ্জন শুনতে পায় সে।

ডাক্তারকে সে জিজ্ঞেস করেছিল যে, এটা বাচ্চা হিসেবে শুরু হতে পারত কি না, কোনওভাবে রক্ষা পেয়ে ভুল জায়ায় ঢুকে পড়া উর্বর ডিম হিসেবে শুরু হতে পারত কি না। ডাক্তার বলেছিল, না। কেউ কেউ ভাবত এ ধরণের টিউমার জন্ম থেকে কিংবা তারও আগে থেকেই বীজাকারে উপস্থিত থাকে। এটা হতে পারে নারীর অবিকশিত জমজ। সেগুলো যে আসলেই কী সেটা অজানা। যদিও সেগুলোর নানা ধরণের টিস্যু আছে। এমনকি ব্রেন টিস্যু। যদিও অবশ্যই এসব টিস্যুর গঠনে কমতি থাকে।

এখনও কার্পেটে বসে সে এটার দিকে তাকিয়ে আছে। এর শিশুকালটা কল্পনা করছে। হাজার হলেও এটা তো তার ভেতর থেকে এসেছে। তার মাংসের মাংস এটা। জেরাল্ডের সাথে তার বাচ্চা, তার ব্যর্থ বাচ্চা যাকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেওয়া হয়নি। তার বিকৃত বাচ্চা প্রতিশোধ নিচ্ছে।

সে বলে ওঠে, ‘হেয়ারবল, তুমি এত কুৎসিৎ। একজন মায়েই শুধু তোমাকে ভালোবাসতে পারে।‘ এজন্য তার দুঃখবোধ হয়। হারানোর অনুভূতি জাগে। মুখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কান্নাকাটি সাধারণত তার জন্য না, স্বাভাবিকভাবে না, সাম্প্রতিকালে না।

হেয়ারবলটি তার সাথে কথা বলে নিঃশব্দে। একে আর ক্ষুদ্র করা যায় না। বাস্তবতার বুনন আছে এর মধ্যে। এটা কোনও ছবি না। ক্যাট নিজের ব্যাপারে যা যা কখনও শুনতে চায়নি তার সব কিছু এটা তাকে বলে। এ হচ্ছে নতুন জ্ঞান। অন্ধকারাচ্ছন্ন, মূল্যবান ও প্রয়োজনীয়। এটা কাটে।

মাথা নাড়ায় সে। ক্যাট মনে মনে বলে, মেঝেতে বসে হেয়ারবলের সাথে কথা বলে তুমি কী করছ? তুমি তো অসুস্থ। টাইলেনল খাও, আর ঘুমাতে যাও।

পরের দিন একটু ভালো বোধ করে সে। লে-আউট থেকে ড্যানিয়া তাকে ফোন করে কবুতরের মতো, সহানুভূতিশীল কু কু আলাপ করে। আর তার আভাকে এক নজর দেখতে মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় আসতে চায়। ক্যাট বাদ দিতে বলে। ড্যানিয়ার মন খারাপ হয়। আর বলে, ক্যাট যে তার চাকুরিটা হারাচ্ছে তা তার পূর্ব জনমের অনৈতিক আচরণের মূল্য হিসেবে হারাচ্ছে। ক্যাট তাকে বলে সে যেভাবেই হোক নিজেকে বদলে নিয়েছে। পুরো ব্যাপারটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে এ জীবনে সে যথেষ্ট অনৈতিক আচরণ করেছে। ড্যানিয়া জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার মধ্যে এত ঘৃণা কেন?’ যে ব্যাপারটা সে বোঝাতে চাচ্ছে সেটা বলতে চায় না সে। সত্যিই তাকে বিভ্রান্ত লাগছে।

ক্যাট বলে, ‘জানি না।‘ উত্তরটা সোজা।

ফোন কেটে দেওয়ার পর ক্যাট মেঝেতে পায়চারি করে। ব্রয়লারে গরম চর্বির মতো ভেতরে ভেতরে সে ফুটছে। শেরিলকে নিয়ে ভাবছে। তার আরামদায়ক ঘরখানায় সে যেন ঘোরাফেরা করছে। পার্টির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শেরিল তার জমাট চুলগুলো নিয়ে খেলে, উপচে পড়া ফুলদানিটি ঠিক করে রাখে, মালামাল যোগাদাতাদের নিয়ে খুঁতখুঁত করে। জেরাল্ড ভেতরে ঢুকে ক্যাটের গালে হালকা চুমু খায়। দাম্পত্য দৃশ্য। জেরাল্ডের বিবেক সুন্দরভাবে ধুয়ে যায়। ডাইনিটা মারা গেছে। জেরাল্ডের পা শরীরের ওপর, ট্রফির ওপর। সে তার নোংরা উপভোগের সময়টা কাটিয়েছে। এখন বাকি জীবনের জন্য প্রস্তুত।

ড্যাভিড উড ফুড শপে ট্যাক্সি করে যায় ক্যাট। গিয়ে দু’ডজন চকোলেট কেনে। তুলনায় বড় একটা বাক্সে ভরায়। তারপর বাক্সটা তুলনামূলক বড় একটা ব্যাগে ভরায়। ব্যাগটির গায়ে দোকানের লোগো আঁকা আছে। তারপর বাসা গিয়ে হেয়ারবলটি বোতল থেকে বের করে। রান্নাঘরের ছাকুনি দিয়ে এর থেকে তরলটুকু নিংড়ে ফেলে এবং পেপার তোয়ালে দিয়ে আলতো করে মোছে। গুড়া কোকোয়া ছিটিয়ে দেয়। এতে তা বাদামি প্যাস্টি আস্তরণে রূপ নেয়। ফরমালডিহাইডের মতো গন্ধটা এখনও আছে। তাই সে স্যারান মোড়কে আবৃত করে। তারপর টিনফয়েল দিয়ে ঢাকে। আর তারপর ধনুকে বাঁধা গোলাপি টিস্যু পেপারে ঢাকে। চকোলেটগুলো যুৎসইভাবে হেয়ারবলের চারদিকে বসিয়ে টুকরো টুকরো টিস্যু দিয়ে বিছানা বানিয়ে ড্যাভিড উড বাক্সে রেখে দেয়। বাক্সটি বন্ধ করে দিয়ে সে টেপ মারে। তারপর ব্যাগে রাখে, ওপরে কয়েকটা গোলাপি কাগজ দেয়। এটা তার উপহার। মূল্যবান ও বিপদজনক। এটা তার দূত, তবে দূত হিসেবে যে বার্তাটা দেবে সেটা দূতের নিজের। যে-ই কিছু জিজ্ঞেস করবে তাকে এটা সত্যি কথা বলবে। এটা ঠিক যে, জেরাল্ডের অধিকারেই থাকা উচিৎ এটা। হাজার হলেও এটা তারও সন্তান।

ক্যাট কার্ডের ওপর ছাপায়, ‘জেরাল্ড, দুঃখিত, আমি তোমার সাথে থাকতে পারিনি। এটুকুই উষ্মা (রেজ)। ভালোবাসা নিও, ক।‘

সন্ধ্যা নেমে এলে পার্টিটা অবশ্যই পুরোদমে শুরু হবে। উপহারটি পাঠানোর জন্য ক্যাট একটা ট্যাক্সি ডাকে। এমন দামী ব্যাগে যা কিছুই পৌঁছাক, তাকে শেরিল অবিশ্বাস করবে না। জনসম্মুখে, সবার সামনে সে এটা খুলবে। বিপদ হবে, প্রশ্ন হবে। গোপন কথা প্রকাশ পেয়ে যাবে। ব্যথা হবে। তারপর সব কিছু অনেক দূর চলে যাবে।

ক্যাটের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। তার হৃৎপিণ্ড ধুক ধুক করছে। ফাঁকা জায়গাটি কেঁপে উঠছে আবারও। কিন্তু জানালার বাইরে তুষারপাত হচ্ছে, তার ছেলেবেলার নরম, ভেজা, বাতাসহীন ফলকগুচ্ছ। কোটটা পরে বোকার মতো বাইরে যায় সে। শুধু মোড়ে যেতে মন চায়। কিন্তু মোড়টিতে পৌঁছামাত্র সেটাকেও ছাড়িয়ে যায়। তুষার গলে তার মুখমণ্ডলে পড়ছে। যেন ছোট ছোট কিছু আঙুল তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ভয়ানক একটা কাজ করেছে সে। কিন্তু অপরাধ বোধ নেই তার মধ্যে। নিজেকে হালকা ও শান্তিময় লাগে। বদান্যতায় ভরপুর লাগে। আর সাময়িকভাবে অনামিকা লাগে।


#হেয়ারবল#




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*