কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: উপরিতলে অবস্থান

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


উপরিতলে অবস্থান


আর অনেক কথা বলার আছে। “তার কী ভয় করো তুমি?” তার ভারী ওজন হাওয়ার্ডের উপরে দিয়ে, স্তনদুটো তার মুখাবয়বের সামনে রেখে ফ্লোরা জিজ্ঞেস করে। “আমার মনে হয়,” হাওয়ার্ড বলে, “একই জায়গায় এত নিবিড়ভাবে আমরা পাল্লা দেই। এর মানে আছে। তার ভূমিকা আমার ভূমিকাকে তবুও এত শক্ত করে বেঁধে রেখেছে; সেটা তার বিকাশকে ফাঁদে ফেলে দেয়, তাই আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে সে বাধ্য অনুভব করে। ভেতর থেকে আমাকে ধ্বংস করে।” “ওখানে আরাম লাগছে তো তোমার?” ফ্লোরা বলে, “আমি কিন্তু তোমাকে ঠেলছি না।” “না,” হাওয়ার্ড বলে। “তোমাকে ধ্বংস করছে কীভাবে?” ফ্লোরা জিজ্ঞেস করে। “আমার মধ্যে একটা মূল দুর্বল জায়গা খুঁজে পেতে হবে তার,” হাওয়ার্ড বলে। “সে নিজেকে বোঝাতে চায় যে আমি মিথ্যে ও মেকি।” “তোমার বুকটা খুবই চমৎকার, হাওয়ার্ড,” ফ্লোরা বলে। “তোমারও, ফ্লোরা,” হাওয়ার্ড বলে। “তুমি কি মিথ্যে ও মেকি?” ফ্লোরা জিজ্ঞেস করে। “আমার তা মনে হয় না,” হাওয়ার্ড বলে, “অন্য কারো চেয়ে বেশি নয়। আমার তো চরম আবেগ আছে ঘটনা ঘটানোর। কোনো শৃঙ্খলাকে বিশৃঙ্খলায় পরিণত করার। সে যেটাকে দেখে নতুন ধারায় প্রভাবিত প্রগতিবাদ হিসেবে।” “ওহ্, হাওয়ার্ড,” ফ্লোরা বলে, “আমি যা ভেবেছিলাম সে তার চেয়েও বেশি চালাক। তার কি সম্পর্ক চলছে?” “মনে হয় তাই,” হাওয়ার্ড বলে। “একটু সরো না, আমার লাগছে তো।” ফ্লোরা তার কাছ থেকে পড়ে যায় এবং তার পাশে গিয়ে থাকে; তারা ওখানে বিশ্রাম নেয়, ফ্লোরার সাদা অ্যাপার্টমেন্টের ছাদের দিকে মুখ করে থাকে। “জানো না?” ফ্লোরা জিজ্ঞেস করে। “খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবে না?” “না,” হাওয়ার্ড বলে। “তোমার যথাযথ কৌতুহল নেই,” ফ্লোরা বলে। “ওখানে জীবন্ত মনস্তত্ত্ব আছে, আর তোমার কি না আগ্রহ নেই। এতে কোনো বিস্ময় নেই যে সে তোমাকে ধ্বংস করতে চায়।” “আমাদের নিজের মতো করে চলায় আমরা বিশ্বাস করি,” হাওয়ার্ড বলে। “চাদরটা দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলো,” ফ্লোরা বলে, “ঘামছো কিনা। এভাবেই তো মানুষের ঠাণ্ডা লাগে। যা হোক, তোমরা তো একসাথে থাকো।” “হ্যাঁ, আমরা একসাথেই থাকি, কিন্তু পরস্পরকে আমরা অবিশ্বাস করি।” “আহ্, হ্যাঁ,” হাওয়ার্ডের দিকে তাকাতে পাশ ফিরে ফ্লোরা বলে, যাতে করে তার বড় ডান স্তনটা হাওয়ার্ডের শরীরে চাপ খায়, আর মুখে হতবুদ্ধির অভিব্যক্তি নিয়ে বলে, “কিন্তু এটাই কি বিয়ের সংজ্ঞা নয়?”

ম্যালকোল্ম ব্র্যাডবেরি দ্য হিসট্রি ম্যান (১৯৭৫)



আগের দিকটায় (সেকশন ৯) ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে সাবজেক্টিভিটি পরিবেশন করার ক্ষেত্রে কথন সাহিত্য আাঙ্গিকের মধ্যে উপন্যাস সর্বোচ্চ জায়গায় আছে। আগেকার ইংরেজি উপন্যাসগুলো –ডিফোর রবিনসন ক্রুসো, রিচার্ডসনের পামেলা — নজিরবিহীন বাস্তববাদ দিয়ে তাদের চরিত্রগুলোর মনোজগতের ভাবনা চিত্রায়িত করতে পত্র ও পত্রিকা ব্যবহার করতো; আর অন্ততপক্ষে জয়েস ও প্রাউস্ট অবধি এ শাখার পরবর্তী বিকাশ অগ্রগতিশীলভাবে চৈতন্যের গভীরতর ও সূক্ষ্নতর অনুসন্ধানের ভিত্তিতে দেখা যেতে পারে। তাই কোনো ঔপন্যাসিক যখন মানব আচরণের উপরিতলে থাকাটাকে বেছে নেয়, তখন চমকিত মনোযোগ এবং হয়তো অস্বস্তি দিয়ে আমরা মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার অনুপস্থিতি খেয়াল করি, যদিও সঙ্গে সঙ্গে আমরা সে কারণের প্রতি আমাদের আঙ্গুল নির্দেশ করতে পারি না।

 ম্যালকোল্ম ব্র্যাডবেরির দ্য হিসট্রি ম্যান  এ রকমই একটি উপন্যাস। এতে আছে এক সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক যে দ্য ডিফীট অব পাইরেসি  নামে সবেমাত্র একটি বই লিখে এই প্রস্তাবে উৎসর্গ করে যে “আর কোনো ব্যক্তিগত অহং নেই।” হাওয়ার্ড কিং বিশ্বাস করে যে অহং হচ্ছে সেকেলে বুর্জোয়া ধারণা, বিশ্বাস করে যে ব্যক্তিক মানুষেরা শুধু কন্ডিশনড রিফ্লেক্সের পোঁটলা; আর নিস্কৃতি পাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে ইতিহাসের প্লটকে শনাক্ত করা (মার্ক্সিস্ট সমাজবিজ্ঞানের সাহায্যে) এবং তাতে সহযোগিতা করা। আচরণ ও পরিবেশের উপরিতলে থেকে উপন্যাসের ডিসকোর্সটি জীবনের এই নৈরাশ্যজনক, মানবতাবিরোধী দর্শনের অনুকরণ করে এমনভাবে যা একে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছে বলে মনে হয়, তবুও পাঠককে সুবিধাজনক কোনো অবস্থান প্রদান করে না যেখান থেকে একে সমালোচনা কিংবা বাতিল করা যায়। গল্পটি যদিও মূলত হাওয়ার্ডের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় এই অর্থে যে ঘটনার প্রায় সকল বর্ণনায় সে থাকে, তবুও তার ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনায় আমাদের প্রবেশাধিকার প্রদান করে তার উদ্দেশ্যকে বিচার করতে কথন আমাদের সহায়তা করে না। একই ব্যাপার ঘটে কির্কের শত্রুরাসহ অন্যান্য চরিত্রের ক্ষেত্রে।

 উপন্যাসটিতে বর্ণনা ও সংলাপ থাকে। বর্ণনা কেন্দ্রীভূত হয় সব কিছুর  উপরিতলকে ঘিরে — কির্কের বাড়ি সাজানো, ক্যাম্পাসের নিরানন্দ, বিমানবীকৃত স্থাপত্য, সেমিনার, কমিটি, পার্টিতে ছাত্র-ছাত্রী এবং কর্মচারীদের বাইরের আচরণ। চরিত্রদের দ্বারা অন্তদর্শনমূলক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই, লেখকীয় ভাষ্য ছাড়াই, সরল, ক্রিয়া-বিশেষণহীন উক্তির জুড়ে দেওয়া অংশ সে বলে/জিজ্ঞেস করে  ইত্যাদির উপর কোনো তারতম্য ছাড়াই, এমনকি উক্তির লাইনের মধ্যে বিরতি ছাড়াই সংলাপকে সমতলভাবে, বস্তুনিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করা হয়। ডিসকোর্সের “গভীরতাহীনতা” আরো জোরালো হয় বর্তমান কালকে প্রাধিকার প্রদান করে। প্রথাগত কথনের অতীত কালে নিহিত থাকে যে গল্পটি কথকের জানা এবং কথক কর্তৃক আগাগোড়া মূল্যায়ন করা হয়েছে। এ উপন্যাসে কথন ডিসকোর্স চরিত্রগুলোকে নিস্ক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে যখন তারা অজানা ভবিষ্যতের দিকে মুহূর্তে মুহূর্তে চলাফেরা করে।

এ কৌশলের তাৎক্ষণিক কমিক ও হিমশীতল প্রভাব বিশেষভাবে আঘাত হানে যৌন মিলনের দৃশ্যগুলোতে, যেখানে কেউ স্বাভাবিকভাবে অন্তত একজন অংশগ্রহণকারীর আবেগ ও সংবেদনের উপলব্ধিজাত বিবরণ পাওয়ার প্রত্যাশা করবে । এখানে উদ্ধৃত প্যাসেজটিতে হাওয়ার্ড কির্ক তার সহকর্মী ফ্লোরা বেনিডর্মের সাথে বিছানায় থাকে, “সে সেসব পুরুষদের সাথে বিছানায় যেতে পছন্দ করে যাদের বিয়েটা সমস্যাপীড়িত; তাদের এত কিছু বলার থাকে, তারা গরম থাকে যেহেতু তারা পরিবারের জটিল রাজনীতি থেকে এসেছে, যা ফ্লোরার বিশেষজ্ঞ গবেষণার ক্ষেত্র,” আর তারা হাওয়ার্ডের স্ত্রী বার্বারার সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে কথাবার্তা বলছে।

বিশেষ করে প্রেমিক বা প্রেমিকার বিয়ে সম্পর্কে কথা বলতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার ধারণায় নিহিত কমেডি অবশ্যই রয়েছে, আর রয়েছে দম্পতির ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্ক এবং তাদের কথাবার্তার বিমূর্ত বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে টানা বৈসাদৃশ্যে। কিন্তু শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকের মধ্যে, তুচ্ছ ও গাম্ভীর্যপূর্ণের মধ্যে যেভাবে সংলাপ এঁকেবেঁকে চলে, তাতে কমিক অসঙ্গতির চেয়ে বেশি কিছু থাকে। হাওয়ার্ড যখন বলে যে তার স্ত্রী নিজেকে বোঝাতে চায় যে সে মিথ্যা ও মেকি, তখন সে উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় বিষয় উচ্চারণ করে। কামনার প্রতি অঙ্গভঙ্গি দিয়ে ফ্লোরা প্রথম প্রথম এটা এড়িয়ে যেতে চায় বলে মনে হয়: “তোমার বুকটা খুবই চমৎকার, হাওয়ার্ড,”। তার প্রতুৎত্তর, “তোমারও, ফ্লোরা,” মজাদায়ক, কিন্তু কৌতুকটা কাকে নিয়ে? আমাদের মনস্থির করতে হবে ঠিক যেমনটা আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা করি। হাওয়ার্ড কি মিথ্যে ও মেকি? নাকি তার “ঘটনা ঘটানোর চরম আবেগ” নৈতিক স্খলনের জগতে এক ধরনের সাধুতা, উদ্যমের বহিঃপ্রকাশ? হীনমন্ম্যতার অনুপস্থিতি, যা এমন প্রশ্নের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভার পাঠকের উপর প্রক্ষিপ্ত হয়।



চরিত্রগুলো কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিৎ, সে ব্যাপারে দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা প্রদান করতে, মন্তব্য করতে টেক্সটের অস্বীকৃতিকে অনেকের কাছেই ব্যাঘাতমূলক লেগেছে, কিন্তু নিঃসন্দেহে এটি এর ক্ষমতা  ও মুগ্ধতার উৎস। এ সম্পর্কে বিবিসি টেলিভিশনে উপন্যাসটির অভিযোজনা মজার। ক্রিসটোফার হ্যাম্পটনের স্ক্রিপ্টটি মূল উপন্যাসের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলো, আর চরম ভালভাবে কাস্ট করা হয়েছিলো, পরিচালনা করা হয়েছিলো এবং অভিনয় করা হয়েছিলো। অ্যান্থনি শের হাওয়ার্ড কির্কের ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেছিলেন — কিন্তু অভিনেতা হিসেবে ভূমিকাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে হয়েছিলো তাঁর, আর নিজের সন্তুষ্টির জন্য অন্য লোকের নিন্দনীয় শোষক ও কারসাজিবাজ হিসেবে সম্ভবত অপরিহার্যভাবে বেছে নিয়েছিলেন তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে চিত্রায়িত করতে। এভাবে টেলিভিশন সংস্করণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অনেকটা ভার নিয়ে নেয়, যা উপন্যাসটি পাঠকের কোলে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করেছিলো, আর ব্যাপক উপভোগ্য হলেও সেই মাত্রায় এটি কম চ্যালেঞ্জের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। (এও বলতে হবে যে এখানে উদ্ধৃত দৃশ্যটি পরিবেশন করতে গিয়ে ফ্লোরা বেনিডর্মের সুন্দর বক্ষের দৃশ্যমান প্রমাণ দ্বারা বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ থেকে সবার মনোযোগ কতকটা বিচ্যূত হয়েছিলো।)


আগের পর্ব                                                                                                                                পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*