অন্য আকাশ

গল্প




 অন্য আকাশ

-শাহীনুর ইসলাম


মনটা ভাল নেই। এই যে আজ সন্ধ্যার ঠিক পরেই আকাশ একটার পর একটা মেঘের ভাঁজ পেশাদার এক স্ট্রিপ ড্যানসারের মতো একটু একটু করে খুলে নিজেকে শেষ পর্যন্ত শৈল্পিকভাবে নিরাবরণ করে রেখেছে শুধু নিজের সব নক্ষত্র-গ্রহ-উপগ্রহ নামক সোন্দর্যমণ্ডিত আভরণকে প্রদর্শন করে ধরাতলের প্রাণীকূলকে বিনি পয়সায় বিনোদন দেওয়ার জন্য; আর বাতাস নতুন প্রেমিক সেজে সুদূর কোনো বন থেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সুশীতল, মেদুর স্পর্শ; তবুও মন ভাল নেই।

না, মন ভাল নেই। অথচ এমন সময় কিন্তু আমার মন কখনো খারাপ থাকে না। কিংবা এমন সৌন্দর্যের প্রতি বিবাগী থাকার মতো অতটা বেরসিকও আমি নই। আজ অবশ্য তার  গুরুতর একটা কারণ আছে। মনের এ অবস্থা আজকের নয়। কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলছে। আমি তা বলে আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না। সময় হলে ঠিকই জানতে পারবেন। তাই বাইরের এমন সৌন্দর্যকে অবহেলা করে আমি ঘরে বসে আছি ইতিমধ্যে চালু রাখা কম্পিউটারের সামনে।  

একটা গোলাপ ফুল যেন আমাকে ডাকছে। আমি কিছুটা কৌতূহলী না হয়ে পারছি না। অবশ্য একে ফুল বললে ভুল হবে। এটি ফুলের ছবি। শুধু গন্ধ নেই। তবু এ ফুল দেখলে এর পূর্ণ ঘ্রাণ পেতে কিছুই কল্পনা করতে হয় না। এ ফুল পূর্ণ ঘ্রাণের অনুষঙ্গ হিসেবে নিজেই কাজ করে। ছবিটা যে এই প্রথম দেখছি তা কিন্তু নয়। কয়েক দিন ধরেই দেখছি। আসল ফুল হলে তো এ কয়দিনে শুকিয়েই যেতো। কিন্তু এ ফুল এখনো তরতাজা। যতবার দেখছি ততবার যেন কিছুক্ষণ হলেও দৃষ্টি আটকে থাকছে। আর ঘ্রাণ নিজেই এসে ধরা দিচ্ছে কোনো এক হিপ্নোটাইজড শিকারের মতো। এ কয়দিন যে একে গ্রহণ করিনি তার কারণ কারও অপরিচিত কোনোকিছু— তা যতই সুন্দর হোক এবং সে কারণে যতই আমাকে আকর্ষণ করুক— আমি সাধারণত তা গ্রহণ করি না। তাছাড়া মনটাই তো ভাল নেই।

কম্পিউটারে মৃদুমন্দ গান বাজছে। কিন্তু কোনো কিছুই মনটাকে চাঙ্গা করতে পারছে না যেন। কামানের কাজ যেমন তরবারি দিয়ে হয় না, তেমনই যে কারণে মন খারাপ সে কারণটা না ঘুচালে যতই এটা-সেটা তাকে দেয়া হোক না কেন সেও ভাল হবে না। তা জেনেও মনটাকে কিছুটা হলেও ভাল করার শেষ চেষ্টায় অগত্যে ফুলের দিকেই মনোযোগ দেই। কারণ আপনারাও জানেন একে ভাল না রাখলে জগতের অন্য কোনো কিছুকেই সে তোয়াক্কা করে না; সবকিছুই তখন তার কাছে যেন নস্যি কিংবা উপেক্ষণীয় কিছু। আমি মনের এই বাড়াবাড়ি আর সহ্য করতে পারছি না।

ফুলটা যেন নীরবে কিছু একটা বলছে যার মানে হয়তো এ রকম, ‘আমাকে গ্রহণ করেই দেখো না, তোমার মন ভাল হয়ে যাবে’। এমন অনুনয়ের পরও একটু যাচাই করতে মন চাইছে। তাই ফুলের প্রদত্ত প্রোফাইল দেখে নেই। কিন্তু তেমন কিছুই নেই। শুধু নাম লেখা আছে ‘অন্য আকাশ’।

মনে সন্দেহ জাগে নকল নিশ্চয়ই। তবু কেন জানি সে অনুনয় আমি উপেক্ষা করতে পারছি না। তাই যখন ফুলকে গ্রহণ করবো বলে প্রস্তুত হই, ঠিক তখনই বেরসিক একটা ভিডিও কল আসে রসিক বন্ধুর কাছ থেকে। বন্ধু জানতে চায় কেমন আছি। জবাবে বলি, ‘তুষারে ঢাকা ম্যাপল গাছ যতটা ভাল থাকে আমিও বেঁচে থাকার জন্য ততটাই ভাল আছি’। কিছুক্ষণ বাতচিৎ শেষে কী যেন একটা কাজে চলে যেতে হবে বলে কলটা কেটে দেয়।

তবুও মনটা ঠিক হয় না। মনকে মেরামত করতে পারে হয়তো এর মিস্ত্রী। কিন্তু সে মিস্ত্রী তো মিলবে না। তবুও এক রকম নিরাশ হয়েই শেষ চেষ্টার কাছে সমর্পন। অবশেষে ফুলটিকে গ্রহণ করার কয়েক সেকেন্ডের মাথায় কথা বলে ওঠে, ‘কেমন আছেন?’ আমার তখন মনে হয় একে দেখতে যতই সতেজ, উদ্দীপ্ত মনে হোক না কেন এ যেন গ্রীষ্মের সেই চৌচির হয়ে ফেটে থাকা মাটি— যে মাটি অধীর আগ্রহে থাকে বৃষ্টির জন্য, যে মাটিকে ভূগর্ভের পানিও তৃষ্ণা মেটাতে পারে না। উত্তর করি,

-ভাল।

-আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি ভাল নেই।

-আসলে…..তা আপনি কী করে বুঝলেন? আর কেন আপনার মনে হচ্ছে যে আমি ভাল নেই?

-বোঝা যায়। আকাশে মেঘ করলে ধরাতলের কাছে সে খবর গোপন থাকে না।

-কিন্তু আপনি তো আমার ধরাতলের কেউ না। কোনোদিন হয়তো দেখিও নাই আপনাকে।

-গ্রহণ যখন করেছেন, তখন তো ধরাতলের কেউ না কেউ হয়েই গেছি। আর আপনাকে আমি দেখেছি।

-যাই হোক দেখেছেন ভাল কথা। কিন্তু সত্যি করে বলেন তো আপনি কীভাবে জানলেন আমার মন ভাল নেই?

-এত কিছু জানেন আর এটা জানেন না? তা কী করে হয়? আরে আপনার স্ট্যাটাস দেখে।

-আর আপনি আমার মনের খবর এত রাখেন! তো মন খারাপ থাকলে যে মাথা ঠিকমতো কাজ করে না এটা জানেন না?

-জানি। এও জানলাম যে মন খারাপ থাকলেও আপনার কথার ধার ঠিকই থাকে।

-যাই হোক। আচ্ছা, বলুন তো আপনি কে?

-আমি হচ্ছি অন্য আকাশ।

-সেটা তো আপনার আসল পরিচয় না।

-মানুষ তার আসল পরিচয় জানে নাকি কখনো?

-তা জানে না। কিন্তু জগৎ সংসারে দার্শনিকতার চেয়ে সামাজিকতার মূল্য বেশি। আপনার পারিবারিক নাম আর সামাজিক পরিচয় জানতে চেয়েছি।

-আপনার সাথে তো এখন সামাজিক কিংবা পারিবারিক আলাপ হচ্ছে না। বরং দার্শনিকতার সূত্র ধরেই আলাপটা চলছে। আর সামাজিকতা? সেও তো দার্শনিকতারই ব্যবহারজীর্ণ রূপ। আ্চ্ছা, আমি আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?

-ঠিক তা না…

-বিরক্ত হলে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন।

-সত্যি বলবো?

-জি, নির্দ্বিধায়।

-আসলে…

-হুম…

-বিরক্ত হওয়ার জন্য আমার দিক থেকে যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু কেন জানি খারাপ লাগছে না।

-নাকি বিনয় মজুমদার হয়ে গেলেন যে সবসময় বিনয়ীই থাকতে হবে?

-হা-হা-হা! হাসালেন। দুঃখের দিনেও এভাবে হাসতে হচ্ছে।

-হাসেন, হাসেন। যেভাবে পারেন হাসেন। হাসলে শরীর-মন দুটোই ভাল থাকে। আচ্ছা, এখন উঠতে হবে। মা ডাকছে। ভাল লাগলো কথা বলে। পরে আবার কথা হবে।

-ও.কে. বাই। ভাল থাকবেন।

আমার মনের জানালায় উঁকি দিয়ে কে এভাবে কথা বলে গেলো? মনে হয় অনেক চেনা, আমার সব খবরাখবর রাখে। যাই হোক, আমার মন ভাল করা নিয়ে কথা। কথা বলার সময় তো খারাপ লাগেনি। তার মানে অন্য মিস্ত্রী দিয়েও মনের স্বার্থ রক্ষা চলে। খারাপ কী!

একটা সিগারেট ধরাই। প্রথম টানের ধোঁয়া ছাড়ার পর খেয়াল করি তা সোজা পথে যাচ্ছে না। বাতাসে ভেসে ভেসে কুণ্ডলী আকারে সাপের মতো সামনের দিকে যাচ্ছে। মনে হয় ঠিক জীবনের মতো। পৃথিবীটা হলো বাতাস, আর জীবনটা হলো ধোঁয়া। কখনো সোজা পথে চলার আশ্রয় তার থাকে না। সব সময় বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে চলে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়।

সিগারেট শেষ হলে মনটা আবার ভাবনার গভীরে ডুব দেয়। যথারীতি কিছুই ভাল লাগে না। কম্পিউটার স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ সত্যি, কিন্তু মনে মনে চলছে মন খারাপের চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভাবছি মানুষের হৃদয়ানুভূতি অবুঝ বালকের মতো। সেখানে কোনো যুক্তি পাত্তা পায় না। তার আবদার রক্ষা না করলে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যুক্তি দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হয়তো বোঝানো যায়, কিন্তু দিনের শেষে সে অনুভূতিজাত কাঙ্খিত জিনিসটা তার চাই চাই; নইলে তার চলে না। কিন্তু বাস্তবতা বেশিরভাগ সময়ই সেখানে বাধ সাধে। শুরু হয় দ্বান্দিক সংলাপ। যুক্তি আপাত জয়লাভ করলেও অনুভূতি কখনো তাকে ছাড়ে না—আগুন লাগায়, পোড়ায়, ভেজে ভেজে খায়, আবার নতুন করে জন্ম নেয়, আবার শুরু হয় দ্বন্দ-পোড়ানো-ভেজে খাওয়া। এ দুষ্ট চক্র থেকে নিস্তার মেলে না বুঝি কখনো মানুষের! হায়রে হৃদয়! তোরে নিয়ে বড় ভয় হয়।

ঘন্টাখানেক ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিপ করে একটা শব্দ আমাকে ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে নিয়ে আসে। খেয়াল করি অন্য আকাশের ইনবক্স বার্তা,

-এখন কি মন ভাল হয়েছে?

-না, আগের মতই। আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

-হ্যাঁ, হয়েছে।

-আচ্ছা, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?

-করতে পারেন নির্দ্বিধায়।

-আপনি ছেলে না মেয়ে?

-হা! হা! হা! আপনার কি মনে হয়?

-আমার অনুমান আপনি মেয়ে?

-সঠিক অনুমান। আমি জানতাম আপনি ঠিক ধারণা করবেন।

-তাহলে আপনাকে একটা কথা বলি?

-জি, বলেন।

-আমি আপনাকে এসব কেন বলছি ঠিক জানি না। হয়ত মানুষ যখন খুব সঙ্কটে পড়ে তখন যে কাউকেই কাছে পেলে আপন মনে করে তা জানাতে চায়। আমিও তা-ই চাইছি। ভাবনা শেয়ার করার জন্য আমার এখানে কেউ নেই। যে দু’একজনকে জানাতে চাই তারা তাদের কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত।

-বলেন প্লিজ। আপন মনে করে বলতে পারেন।

– আচ্ছা, যে কোনো সম্পর্কে কি টানাপোড়েন, ভুল বোঝাবুঝি, রাগ কিংবা মান-অভিমান থাকতে পারে না?

-থাকা খুবই স্বাভাবিক। সম্পর্কের নিয়মই তা-ই। কখনো একরৈখিক নয়। কিন্তু আমার মনে হয় দিনের শেষে সব কিছু সত্ত্বেও ফিরে আসার আকুতি থাকা উচিৎ।

-কিন্তু যাদের শুধু রাগ আছে, ইগো আছে, ঝগড়া করার প্রবণতা আছে, অথচ এসবকে উতরিয়ে ফিরে আসার আকুতি নেই, তারা কি ভালবাসতে জানে না ভালবাসা রক্ষা করতে জানে?

-কোনোটাই জানে না।

-আমার মনে হয় এরা ভালবাসাকে শুধু বাণিজ্যিক পাল্লায় মাপে। কোনোভাবে এদের প্রেমে পড়া মানে নিজেকে আত্মাহুতি দেয়া জগৎ ও জীবনের কাছে, নিজেকে নিজের কাছে ছোট করা। তবু অবাক ব্যাপার কী জানেন? এরাই হয়তো ভালবাসা পেয়ে থাকে। আর যারা সত্যিকারে ভালবাসে তাদের ভবিতব্য হয় যন্ত্রণাদায়ক।

-বুঝেছি আপনি যাকে ভালবাসতেন সে আপনার অনুভূতি বোঝেনি। আপনি কি আপনার অনুভূতি তাকে জানিয়েছেন?

-জানানোর কিছু নেই তো। সব তো ওপেন সিক্রেটের মত।

-তবু আমার মনে হয় আপনি আপনার অনুভূতিকে ঠিকমতো জানাতে পারেননি।

-হয়তো-বা সে যেভাবে জানতে চেয়েছে সেভাবে পারিনি। কিন্তু আমার মতো করে তো জানিয়েছি।

-সেটা হয়তো সে বোঝেনি। যাকে জানাবেন তাকে জানাতে হবে তার মতো করে, নিশ্চয়ই আপনার মতো করে নয়। তাহলে না তা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।

– কিন্তু সব কিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরও এত কিসের নাটকীয়তা?

-সব ঠিকঠাক মানে কি আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন বিয়ের কথা?

-হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।

-তাহলে তো বলা মুশকিল।

-জানেন আমি জানি তার সাথে আমার অনেক কিছুই মিলতো না? কিন্তু কেন জানি খুব বেশি ভালবেসে ফেলেছিলাম তাকে। আর তার যন্ত্রণা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি।

-আমি কী বলবো! আপনার জন্য আমার সত্যি খুবই খারাপ লাগছে। নিজেকে শক্ত করুন। মানুষের জীবনে এমন সঙ্কট খুব অস্বাভাবিক নয়। এতে হতাশ হলেও একেবারে ভেঙ্গে পড়বেন না। আচ্ছা, আপনি কি ঐ মেয়েকে এখন ঘৃণা করেন?

-না, ঘৃণা করি না। যাকে একবার বুকে নেই, সব কিছু সত্ত্বেও তাকে বুকেই রাখি। আর সেজন্যই বুকে এত রক্তক্ষরণ। না পারি ঘৃণা করে ভুলে যেতে না পারি সইতে।

-বেশ! ওকে ভুলে যান। যে ভালবাসতে জানে না তাকে ওভাবে বুকে পুষে লাভ নেই। তাতে কষ্টই বাড়বে। আপনার কি মনে হয় না সে আপনার সাথে প্রতারণা করেছে?

-প্রতারকের ধর্মই তো প্রতারণা করা। সে তো এর বাইরে আসার মত মহৎ হৃদয়ের না।

অন্য আকাশের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না। খেয়াল করে দেখি সে অফ লাইনে চলে গেছে। হয়তো বিদ্যুৎও প্রতারণা করছে। মাথায় ভারী বোঝা বেশ কিছুক্ষণ বয়ে বেড়ালে তা ঘাড়ে বা পিঠে স্থানান্তর করলে যেমন কিছুটা স্বস্তি মেলে তাকে কথাগুলো বলে তেমনই লাগছে। কিন্তু পরক্ষণই দুশ্চিন্তা মনের ঘরে প্রবেশ করে। তাকে কি এত কিছু বলা ঠিক হলো? তাকে তো আমি সেভাবে জানি না। যদি কাউকে বলে দেয়, আর তারা এটা নিয়ে হাসাহাসি করে! বলুক গে! আমি তো আর অসত্য কিছু বলিনি। কারও সাথে প্রতারণাও করিনি। আমার মন ভাল করা নিয়ে কথা। পরেরটা পরে দেখা যাবে।

রাত গভীর হয়। বিছানায় আধা ঘন্টাখানেক এপাশ ওপাশ করে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠে যথারীতি কম্পিউটারে ফেসবুকে ঢুকি। দেখি সেই গোলাপ তখন জীবন্ত নেই, অর্থাৎ অনলাইনে আসেনি। এই ফাঁকে নাস্তা করি। ঘরের টুকটাক কাজ করি। নানা কাজের মাঝে ফেসবুক খোলা থাকে। মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখি সে এসেছে কিনা। কিন্তু না তাকে আর পাই না। নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। এক সময় দুপুর গড়িয়ে যায়। তবু তার দেখা মেলে না। বিরক্তি আর খারাপ লাগা চরমে ওঠে।

ভিন্নতার জন্য একটু বাইরে বেরোই। রাস্তায় হাঁটছি ঠিকই কিন্তু রাস্তার কোনো কিছুই আমাকে টানছে না। মন যেন হারিয়ে গেছে তার বিষন্ন পুরীতে।

টিম হর্টনসে ঢুকে একটা কফি হাতে নেই। কিছুক্ষণ কফি শপে বসে কফি পান করি। বেশ নিরিবিলি লাগছে জায়গাটিকে। দু’একজন বিভিন্ন কোণায় বসে গল্প করছে। কেউ কেউ একা একা বসে কফি পান করছে আর নিজস্ব ভাবনার জগতে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে আছে। এমন পরিবেশে নিজেকেও ভাবনার রাজা মনে হচ্ছে। বুঝলাম এখানে এখন বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।

সেখান থেকে বেরিয়ে আবার রাস্তায় হাঁটা শুরু করি বাসার উদ্দেশ্যে। হাঁটতে হাঁটতে বাসা বরাবর লরিয়ের স্ট্রীটে মোড় নেই। শরতের বিকেলে সূর্য ঠিক ত্রিশ ডিগ্রী কোণে রাস্তাটাকে অবলোকন করছে। ফলে এর রশ্মিগুলো আমার মুখ বরাবর পড়ে ভাবনাগুলোকে যেন ঝলসে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ অন্ধকার দেখি। অদ্ভূত আলোয় ম্যাপলের ঝরা হলুদ পাতার মাঝে ফুটপাতের একটা বেঞ্চিতে কেউ একজন বসে আছে। তার ওপাশটা হ্যালো ইফেক্টের কারণে উজ্জ্বল সোনালি আলোয় আলোকিত আর এপাশটা অস্পষ্ট আবছায়ায় নিমজ্জিত। তবে সত্যি অদ্ভূত মায়াময় ও দুর্লভ দৃশ্য বলে মনে হচ্ছে। তাকেও পাশ কাটিয়ে চলে যাই। ফিরি ঘরের একেবারে নিভৃত কোণে।

মন খারাপের মাঝেও দৃশ্যটা মনে যেন একটা ছাপ রেখো গেলো। দৃশ্যের সাথে এমন মাখামাখি কিছুক্ষণ পরেই উবে যায় যখন কম্পিউটারে তখনো খোলা ফেসবুকের ইনবক্সে অন্য আকাশের একটা বার্তা দেখি- ‘আমাকে ক্ষমা করবেন, প্লিজ!’ মনে আচমকা তড়িৎ খেলে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। কী জন্য এই ক্ষমা প্রার্থনা? আমি কি খুব বেশি বলে ফেলেছি যা তাকে কোনো না কোনোভাবে আহত করেছে? তাকে অনলাইনে পেলে জিজ্ঞেস করতাম। কিন্তু সব কিছু রহস্যময় লাগছে। আমার প্রতি তার আগ্রহ দেখে তো মনে হয় না যে সে এতক্ষণ অফলাইনে থাকার মতো মেয়ে।

রাত বারোটা বাজে। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। কালকের রাতের মতো আজকের রাতটাও অবিকল তেমনই সুন্দর আছে। আমিও অবিকল তেমনই খারাপ আছি। হঠাৎ করে তাকে আবার অনলাইনে দেখা যায়। নদীর গতিময় দৃশ্যাবলী দেখার সময় যখন কোনো এক শুশুক হঠাৎ হঠাৎ শুধু তার পৃষ্ঠদেশ দেখিয়ে মানুষকে কৌতূহলী করে তোলে আমাকেও তেমনই কৌতূহলী করে তুলছে সে। আর তার এই ‘হঠাৎ হঠাৎ’ স্বভাবটা আমাকেও হঠাৎ করে অন্য দিকে নিয়ে যায়। আমি তা-ই চাই। চাই সব ভুলতে। সে কারণেই না তার এই স্বভাবকে প্রশ্রয় দেয়া। জিজ্ঞেস করি,

-ক্ষমা প্রার্থনা কেন? আমি কি কোনোভাবে আপনাকে আহত করেছি?

-আপনি আহত করবেন কেন? ক্ষমা চেয়েছি এখানে বিদ্যুৎ বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে ছিল না। তাই আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এক ফাঁকে বন্ধুর মোবাইল থেকে শুধু ঐ বার্তাটা দেই আপনাকে। আপনি যদি ভুল বোঝেন!

-কিন্তু আপনি এমনভাবে বার্তাটা দিয়েছেন আমার মনে হয়েছিল না জানি সিরিয়াস কিছু।

-ঘুমাতে যাবেন না?

-না, পরে ঘুমাবো।

-এখনো মনটা ভাল হয়নি বুঝি? আমি যদি পারতাম আপনার মনটাকে ভাল করতে! কিন্তু আমি তো দূরে আছি। শুধু কথাই বলতে পারি, অন্য কিছু নয়।

-মিথ্যে বলবো না। আপনাকে কথাগুলো বলে কিছুটা হালকা লাগছিল। আপনাকে এজন্য ধন্যবাদ।

তার কথাগুলোর মধ্যে কেমন একটা চেনা ঘ্রাণ পাই আমি। তবে অচেনাই বেশির ভাগ। প্রশ্ন করি,

-আচ্ছা, আপনার প্রফাইল পিকচারে নিজের ছবি দেননি কেন?

-আমি দেখতে খুব ভাল না যে! হা-হা-হা!

-যার চিন্তা সুন্দর, যে ফুলকে তার প্রফাইল পিকচার হিসেবে রাখে, সে নিজে সুন্দর না হয়ে পারে না।

-ওটা আপনার বিশ্বাস। বাস্তবে তা নাও হতে পারে।

-বাস্তবের তথাকথিত ফাঁপা সুন্দর প্রথম দর্শনে মন ভোলায় সত্যি, তবে তা মনে স্থায়ী আসন পায় না।

-ঠিক আছে। কাল দিয়ে দেবো। এখন ঘুমাবেন না?

-হ্যাঁ, ঘুমাবো। ঠিক আছে ভাল থাকবেন। কাল কথা হবে।

-আপনিও ভাল থাকবেন।

এরপর আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

খুব সকালে কেন জানি ঘুমটা ভেঙে যায়। ফেসবুক চেক করার বদভ্যাসবশত যথারীতি কম্পিউটার চালু করে লগ ইন করি। খুলতেই দেখি অন্য আকাশ থেকে আমার ইনবক্সে মোটামুটি একটা দীর্ঘ বার্তা,

-আমাকে এবার সত্যি ক্ষমা করবেন। প্রথম বার যে ক্ষমা চেয়েছিলাম তাও এজন্য। কিন্তু সেবার সত্যি কথাটা বলতে পারিনি। ফেসবুকে একটা অচেনা মেয়েকে যে নিজের কথা জানিয়েছেন তাতে সেটা আপনার মনের সারল্য ও সেই মেয়ের প্রতি খানিকটা আস্থাও প্রকাশ করে। অচেনা কারও প্রতি এত বেশি আস্থা রাখা নিজের জন্য ক্ষতিকর। অনাকাঙ্খিত অনেক বিপদ হতে পারে। তবে আমার একটা লাভ হয়েছে। আমি আপনাকে আরও গভীরভাবে চিনতে পেরেছি। আপনাদের সম্পর্কের আমি একটা বিশ্লেষিত রূপ দাঁড় করিয়েছি। আপনাকে সে বোঝেনি। এর কারণ আপনার নিস্পৃহতা ও নির্লিপ্ততা। সেটা যে কারণেই হোক। নইলে এত গভীর আবেগ উপেক্ষা করার কথা নয় তার। আপনাকে বলেছিলাম যে আমার প্রফাইলে নিজের ছবিটা দিয়ে দেবো। সেটা দিতে পারছি না বলে সত্যি দুঃখিত। কারণ জানতে চাইবেন না, প্লিজ। আরেকটা কথা আমার মন বলছে আপনাকে সে ভুল বুঝলেও এখনো ভালবাসে। ভাবছেন এত কিছু কেন বলছি। মনে করেন ‘চেনা কথার অচিন সুরে শুনিয়ে গেলাম গান’।

বার্তাটি পড়ে সহজ পথকে বাঁকা মনে হচ্ছে। মেলানো যাচ্ছে না কিছু। একজন এসে হৃদয়কে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে; আরেকজন রহস্যের জালে ফাঁপর দেয়া শুরু করেছে। কিন্তু কেন বা এত লুকোচুরি? কীভাবেই-বা গভীর নদীতে ডুব দিয়ে বের করে আনলো ‘নিস্পৃহতা’ নামক তীর ভাঙ্গার কারণ। বার্তাটি পড়তে পড়তে শেষের লাইনে এসে চোখ আটকে যায়। পুরানো অনেক অনুষঙ্গকে জাগিয়ে তোলে। কবিতার এই লাইনটা শুধু একজনের মুখ থেকেই শুনতাম আমি যখন সে আমার সাথে হেঁয়ালি করতো। বুঝতে বাকি থাকে না অন্য আকাশে শ্রাবণী আজ তার রূপ মেলে ধরেছে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা হাতে নেই। ফোন থেকে মুছে দেয়া কিন্তু স্মৃতিতে জমে থাকা নাম্বারটি ডায়াল করি। রিং টোন বাজছে। ধরছে না। হতাশ হলাম। সব বিশ্লেষণ মিথ্যে মনে হলো। মোবাইলটা টেবিলে রাখতেই ওপাশ থেকে কল আসে। সঙ্গে সঙ্গে কল ধরি। এবার দুঃসাহস বুকে নিয়ে বলি,

-কপালে এলিয়ে পড়া চুলগুলো সরিয়ে ফেলো, শ্রাবণী। তোমার কপালে আমি চুমু খাবো ‘উ…ম’।

ওপাশ থেকে ভারী নিঃশ্বাস আমার ধারণাকেই শতভাগ নিশ্চিত করে। সে আবগমথিত কণ্ঠে বলে ওঠে,

-আমি তো সরিয়েই আছি। সেদিনও সরিয়ে রেখেছিলাম। তুমিই বোঝোনি!

দু’পাশের ভারী পর্দাটা নিমিষেই আপনা-আপনি সরে গেলো।




2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*