মূল: ড্যাভিড লজ
অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম
চরিত্র অবতারণা
কয়েক মিনিট পরে স্যালি নিজেই হাজির হলো।
“আমার কি ভয়ঙ্কর দেরী হয়েছে, ফ্রিটস সোনা?”
“মনে হয় শুধু আধা ঘন্টা,” মালিক মালিক আনন্দে দীপ্ত হয়ে ফ্রিটস টেনে টেনে বললো। “ইশেরউড সাহেবকে পরিচয় করিয়ে দেই — মিস বাওলেস? ইশেরউড সাহেব তো ক্রিস নামে সবার পরিচিত।”
“আমি নই,” আমি বললাম। “ফ্রিটস শুধু সেই লোকের ব্যাপারে থাকে যে আমাকে আমার জীবনে সব সময় ক্রিস বলে ডেকেছে।”
স্যালি হেসে উঠলো। কাঁধে ছোট একটা হাতাবিহীন কোট ঝুঁলিয়ে এবং মাথার এক পাশে আস্থার সাথে পেজ বয়ের মতো ছোট্ট একটা ক্যাপ গুঁজে দিয়ে কালো রেশমী কাপড়ে সজ্জিত ছিলো সে।
“তোমার টেলিফোনটা একটু ব্যবহার করি, লক্ষ্মীটি?”
“অবশ্যই। এখনই করো।” ফ্রিটস আমাকে চোখে ধরে ফেললো। “ক্রিস, অন্য রূমে আসো না। তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।” সে স্পষ্টতই তার নতুন অর্জন, স্যালি সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা শুনতে ব্যাকুল হচ্ছে।
“ঈশ্বরের দোহাই লাগে, এ লোকটির সাথে আমাকে একা ফেলে যেও না!” সে চিৎকার করে বললো। “না হলে সে আমাকে টেলিফোনেই ফুসলিয়ে ফেলবে। সে ভয়ঙ্কররূপে আবেগপ্রবণ।”
স্যালি যখন নাম্বারটা ডায়াল করলো, তখন লক্ষ্য করলাম যে তার আঙ্গুলের নখগুলো পান্না সবুজে অঙ্কিত ছিলো, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাছাই করা একটা রঙ, কারণ এতে তার হাতের দিকে মনোযোগ চলে গেলো, যে হাতগুলোতে সিগারেট খেতে খেতে দাগ পড়ে গেছে এবং ছোট্ট এক বালিকার হাতের মতো নোংরা হয়েছে। ফ্রিটসের বোন হওয়ার মতো সে যথেষ্ট কালো ছিলো। তার মুখ লম্বা ও চিকন, গুড়া করা মৃত সাদা। বাদামী রঙের বিস্ফারিত চোখজোড়া তার চুলের সাথে মানাতে এবং ভ্রুর জন্য ব্যবহৃত পেনসিলের সাথে মানাতে আরো কালো হওয়া উচিৎ ছিলো।
“হিলু,” উজ্জ্বল চেরি ঠোঁটদুটো গোল করে নাড়িয়ে সে দরদ দিয়ে বললো যেন সে মাউথপিসটাকে চুমু দিতে যাচ্ছে: “তুমিই নাকি, লক্ষীটি?(Ist da Du, mein Leibling?)” নির্বোধের মতো মিষ্টি হাসিতে তার মুখ খুলে গেলো। ফ্রিটস ও আমি নাট্যশালায় অভিনয়ের মতো তাকে দেখতে বসে পড়লাম।
ক্রিসটোফার ইশেরউড গুডবাই টু বার্লিন (১৯৩৯)
যুক্তি দিয়ে বলতে গেলে চরিত্র হচ্ছে উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক উপাদান। মহাকাব্যের মতো অন্যান্য কথন রীতি, এবং ছায়াছবির মতো অন্যান্য মাধ্যমেও একইভাবে গল্প বলা যায়, কিন্তু মানব প্রকৃতির চিত্রায়নে সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্য ও মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার বিচারে ইউরোপিয়ান উপন্যাসের মহান ঐতিহ্যের কাছে কোনো কিছুই সমকক্ষ হতে পারে না। তবুও পরিভাষায় চরিত্রকে আলোচনা করা কথাসাহিত্য শিল্পে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন দিক। অংশত এ কারণে যে এত ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র থাকে এবং তাদেরকে চিত্রায়ন করার এত ভিন্ন ভিন্ন উপায় থাকে: মুখ্য চরিত্র ও গৌণ চরিত্র, ফ্ল্যাট চরিত্র ও রাউন্ড চরিত্র, ভার্জিনিয়া ঊল্ফের মিসেস ডালওয়ের মতো মনের ভেতর থেকে চিত্রিত চরিত্র, আর ক্রিসটোফার ইশেরউডের স্যালি বাওলেসের মতো অন্যান্যদের দ্বারা বাইরে থেকে দেখা চরিত্র।
আসলে যে হালকা কল্পনা ও স্কেচ নিয়ে গুডবাই টু বার্লিন তৈরি হয় সে বিষয়টি হলো আমাদের সময়ে মঞ্চ নাটক ও ছবি (আই অ্যাম আ ক্যামেরা), তারপর মঞ্চ ও ছবির সঙ্গীতে (ক্যাব্যারেট) ইশেরউডের টেক্সটটি সফলভাবে উপযোগী করার বদৌলতে স্যালি বাওলেস উল্লেখযোগ্যভাবে দীর্ঘ জীবন উপভোগ করেছে । প্রথম নজরে এটা বোঝা দুরূহ কেন স্যালি প্রায় এই পৌরাণিক স্থান অর্জন করেছে। সে বিশেষ কোনো সুন্দরী নয়, বিশেষ কোনো বুদ্ধিমতী নয়, আর শিল্পী হিসেবে বিশেষ কোনো প্রতিভাবতী নয়। সে অহংকারী, হতোদ্যম এবং যৌন সম্পর্কে অর্থলোলুপ। কিন্তু সব সত্ত্বেও সে নিস্পাপতা ও নাজুকতার মোলায়েম ভাব বজায় রাখে, আর তার জীবনের ভাব ও বাস্তবতার মধ্যকার ফারাকের ব্যাপারে অপ্রতিরোধ্যরূপে কমিক কিছু একটা আছে। নাৎসিদের দখলের আগে আগে ভিমার বার্লিনে শুরু হওয়ায় তার গল্প ব্যাপক মজাদার ও তাৎপর্য্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। নোংরা লজিং হাউসে যশ ও বিত্তের অসাড় স্বপ্ন দেখে, এক ধড়িবাজ রক্ষক থেকে আরেক রক্ষকে লাফিয়ে, তোষামোদ করে, শোষণ করে এবং মিথ্যা বলে, সবচেয়ে স্বচ্ছভাবে সে সেই সর্বনাশা সমাজের আত্ম-প্রতারণা ও নির্বুদ্ধিতার প্রতীক হয়ে যায়।
অপেক্ষাকৃত প্রাচীন কথাসাহিত্যে যা সুলভ, চরিত্র অবতারণা করার সেই সরলতম উপায়টি হলো দৈহিক বর্ণনা ও জীবনীর সংক্ষিপ্ত রূপ প্রদান করা। জর্জ এলিয়টের মিডলমার্চ এর প্রথম অধ্যায়ে ডরোথিয়া ব্রুকের প্রতিকৃতি এ রীতির নিখুঁত উদাহরণ:
মিস ব্রুকের সে ধরনের সৌন্দর্য ছিলো যা গরীব পোশাকে স্বস্তি এনেছে বলে মনে হয়। তার হাত ও কব্জি এত সুচারুরূপে গড়া ছিলো যে যেসব আস্তিনে ধন্য কুমারী ইতালিয়ান চিত্রকরদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিলো, সেগুলোর চেয়ে কম স্টাইল ছাড়া সে আস্তিন পরতে পারতো; আর তার প্রোফাইল এবং উচ্চতা ও মাপ মনে হলো তার সাদামাটা কাপড়ের থেকে বেশি মর্যাদা পেলো, প্রাদেশিক ফ্যাশনের পাশে যে কাপড় তাকে বাইবেলের — অথবা আমাদের কোনো এক বড় কবির চমৎকার একটা উক্তির মুগ্ধতা প্রদান করলো আজকের পত্রিকার একটা অনুচ্ছেদে। তার সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই বলা হয়েছিলো যে সে উল্লেখযোগ্য রকমের চালাক, কিন্তু আরো একটু যোগ করা হয়েছিলো যে তার বোন সেলিয়ার কাণ্ডজ্ঞান বেশি।
ইত্যাদি, ইত্যাদি কয়েক পৃষ্ঠা ধরে। জৌলুসপূর্ণ, তবে আমাদের থেকে আরো বেশি সহিষ্ণু ও অবসরভোগী সংস্কৃতির এটি। আধুনিক ঔপন্যাসিকগণ সাধারণত চরিত্রের প্রকৃত ব্যাপারগুলোকে ঘটনা ও উক্তি দ্বারা ধীরে ধীরে, বৈচিত্র্যময়রূপে, কিংবা প্রকৃতভাবে তুলে ধরে আবির্ভূত হতে দেওয়াটাকেই বেশি পছন্দ করেন। যে কোনো ক্ষেত্রে, কথাসাহিত্যে যাবতীয় বর্ণনা উঁচু মাত্রায় বেছে বেছে প্রদান করতে হয়; এর মূল আলঙ্কারিক কৌশল হলো সিনেকডোকি, যেখানে গোটা বস্তু অংশ দ্বারা প্রতীকায়িত হয়। জর্জ এলিয়ট ও ক্রিস্টোফার ইশেরউড দুজনেই নায়িকার হাতে ও মুখে মনোযোগ নিবদ্ধ করে, পাঠককে বাকিটা কল্পনা করতে দিয়ে তাঁদের নায়িকাদের চেহারা ফুটে তোলেন। ডরোথিয়ার কিংবা স্যালি বাওলেসের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের বিশদ বিবরণ দিতে অনেক পৃষ্ঠা লাগবে, হয়তো একটা গোটা বই।
চরিত্র, শ্রেণী, জীবন-যাপন প্রণালীর সর্বদা দরকারি সূচক হচ্ছে কাপড়-চোপড়, বিশেষ করে স্যালির মতো প্রদর্শনবাদীর ক্ষেত্রে। তার কালো রেশমী সাজসজ্জা (বিকেলে এমনিতে বেড়ানোর জন্য পরিহিত) মুগ্ধ করার বাসনার সংকেত প্রদান করে তাত্ত্বিকভাবে (হাতাবিহীন কোট), এবং যৌন উস্কানির সংকেত প্রদান করে {পেজ বয়ের হ্যাটটি ট্রান্সভেসটিজমসহ (বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধানের অভ্যাস) নানা ব্যঞ্জনার মধ্যে যৌন দ্ব্যর্থকতা ও বিকৃতির ব্যঞ্জনাও লাভ করে যা পুরো বইয়ে বহমান}। তার কথা ও আচরণে এসব বৈশিষ্ট্য কার্যকর হয়ে ওঠে — তার সর্বশেষ যৌন বিজয়ে দুজন লোককে মুগ্ধ করতে টেলিফোন ব্যবহার করতে চাওয়া — এর ফলে কথক স্যালির হাত ও মুখাবয়বের বর্ণনা প্রদানের সুযোগ লাভ করে।
“দৃশ্য রীতি (scenic method)” বলতে হেনরি জেমস একেই বুঝিয়েছেন, যা অর্জন করা তাঁর লক্ষ্য ছিলো যখন তিনি “নাটকীয়তা সৃষ্টি করো! নাটকীয়তা সৃষ্টি করো!”র জন্য উদ্বুদ্ধ হলেন। জেমস মঞ্চ নাটকের কথা ভাবছিলেন, কিন্তু ইশেরউড সিনেমার সাথে বেড়ে ওঠা প্রথম প্রজন্মের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে পড়েন, আর এর প্রভাব দৃশ্যমান। গুডবাই টু বার্লিন এর কথক যখন বলে, “আমি ক্যামেরা,” তখন সে সিনেমার ক্যামেরার কথা ভাবছে। ডরোথিয়া যখন স্থির ভঙ্গি প্রদান করে, যেন শব্দ প্রতিকৃতির জন্য বসে আছে, আর প্রকৃতপক্ষে চিত্রশিল্পের কোনো এক অবয়বের সাথে তুলনা করা হয়, অন্যদিকে স্যালিকে তখন আমাদের কাছে ঘটনায় নিবদ্ধ(in action) হিসেবে দেখানো হয়। এ প্যাসেজটিকে সিনেমার শট সিকোয়েন্সে ভেঙে ফেলা সহজ: স্যালি তার কালো রেশমী পোশাকে ভঙি প্রদান করছে — দুজন লোকের মধ্যে চকিত চাহনি বিনিময় — স্যালি যখন নাম্বার ডায়াল করে, তখন তার আঙুলের সবুজ নখের ক্লোজ-আপ শট — যখন সে তার প্রেমিককে অভিনন্দন জানায়, তখন তার মেক-আপের খারাপ সমন্বয়, ভাঁড়বেশ ও প্রভাবিত অভিব্যক্তির আরেকটা ক্লোজ-আপ শট — আর স্রেফ অভিনয়ে মজা পাওয়া পুরুষ দর্শকদের একটি দ্বৈত শট।
স্যালি বাওলেসের গল্প অনায়াসে যে পর্দায় রূপান্তরিত করা যায়, নিঃসন্দেহে এতে তার খানিকটা ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু প্যাসেজে কিছু অর্থের সূক্ষ্ম তারতম্য রয়েছে যা একেবারে সাহিত্যের। যখন তার নাম উল্লেখ করা হয়, তখন নোংরা হাতের সবুজ নখগুলোর ব্যাপারে আমি প্রথম ভাবি। ছবিতে আপনি সবুজ নেইল পালিশ দেখাতে পারবেন, কিন্তু কথকের বক্রাঘাতমূলক মন্তব্য, “দুভার্গজনকভাবে বাছাই করা একটা রঙ” দেখাতে পারবেন না। “দুভার্গ্যজনকভাবে বাছাই করা” হলো স্যালি বাওলেসের জীবনের গল্প। আর আপনি সিগারেটের দাগ ও ময়লা দেখাতে পারবেন, কিন্তু একজন কথকেই শুধু মন্তব্য করতে পারে, “ছোট্ট একটা বালিকার হাতের মতো নোংরা”। উপরিভাগের সূক্ষ্মতার নিচে শিশুসুলভ গুণ যথার্থরূপে তা-ই যা স্যালি বাওলেসকে স্মরণীয় চরিত্র করে তুলেছে।
Be the first to comment