কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: চমক

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


চমক


“আবার বলছি, আমি তোমাকে চাই,” স্যার পিট টেবিল চাপড়ে বললো। “তোমাকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারবো না। তুমি চলে না  যাওয়া পর্যন্ত এটা কী ছিলো আমি দেখিনি। বাড়ির সবকিছু কেমন যেন হয়েছে। সেই জায়গা নেই এটা। আমার সব হিসাব আবার গোলমেলে হয়ে গেছে। তোমাকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে। ফিরে আসো না। প্রিয় বেকি, আসো না।”

            “আসবো– কী হিসেবে, স্যার?” রেবেকা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো।

            “তুমি চাইলে লেডি ক্রোলি হিসেবে আসো,” ক্রেপ হ্যাটটি ধরে ব্যারোনেট বললো। “কী! ওতে কি তুমি সুখী হবে? ফিরে আসো, আমার বউ হও। তোমার ভিট ভর্ট। জন্মের ফাঁসি হোক। তুমি আমার এ যাবৎকালের দেখা ভাল মেয়ে। কাউন্টিতে যে কোনো ব্যারোনেটের বউয়ের চেয়ে তোমার ছোট্ট ভিঞ্জারে বেশি ব্রেইন আছে। আসবে তো? হ্যাঁ নাকি না?”

            “ওহ্, স্যার পিট!” অনেক বিচলিত হয়ে রেবেকা বললো।

            “হ্যাঁ বলো, বেকি,” স্যার পিট বলেই চললো। “আমি বুড়ো মানুষ, তবে ভাল মানুষ। বিশ বছর ধরে ভাল। তোমাকে সুখী করবো, যদি না করি তবে দেখো। তুমি যা চাও তা-ই করো; যা খুশি খরচ করো; আর নিজের মতো চলো। তোমার সাথে চুক্তি করে নেবো। আমি সব কিছু ঠিকঠাকমতো করবো। তুমি দেখে নিও!” আর বৃদ্ধ লোকটি  হাঁটুতে উপুড় হয়ে থাকলো এবং স্যাটারের(গ্রীক দেবতা) মতো তার দিকে কামনা ভরে তাকালো।

            রেবেকা আবার ভয়ের ছবি শুরু করলো। এ ইতিহাস চলাকালে তাকে অন্যমনস্ক হতে আমরা কখনো দেখি নি; কিন্তু এখন সে তা হলো, আর তার চোখ থেকে ঝরা সবচেয়ে অকৃত্তিম অশ্রুর  কিছুটা সে মুছে ফেললো।

            “ওহ্, স্যার পিট!” সে বললো। “ওহ্, স্যার — আমার — আমার তো ইতোমধ্যেই বিয়ে হয়ে গেছে।”

উইলিয়াম মেকারপিস থ্যাকারে ভ্যানিটি ফেয়ার  (১৮৪৮)



বেশিরভাগ কথনেই চমকের উপাদান থাকে। প্লটের প্রতিটি প্যাঁচ আগেভাগে জানতে পারলে তখন এতে আমাদের আগ্রহ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। কিন্তু প্যাঁচগুলোকে অবশ্যই প্রত্যয় উদ্দীপক ও অপ্রত্যাশিত হতে হবে। এরিস্টোটল এ প্রভাবকে বলেছিলেন পেরিপেটিয়া, বা বিপর্যাস (reversal), কোনো বিষয় থেকে এর বিপরীত দিকে আকস্মিক চলে যাওয়া, প্রায়শই যার সাথে যুক্ত থাকে “আবিস্কার”, চরিত্রের না জানা থেকে জানার দিকে রূপান্তর। এরিস্টোটলের উদাহরণটা ছিলো ঈডিপাস রেক্স  এর সেই দৃশ্য যেখানে দূত নায়কের বংশ পরিচয় সম্পর্কে আশ্বস্ত করতে এসে প্রকৃতপক্ষে প্রকাশ করে ফেলে যে নায়ক তার বাবাকে হত্যা করেছে ও মাকে বিয়ে করেছে।

            ঈডিপাস গল্পের মতো সুপরিচিত কোনো গল্পকে পুনরায় বলে  পাঠক/শ্রোতার চেয়ে বরং চরিত্রগুলোই চমকের অভিজ্ঞতা বেশি লাভ করে; পাঠক/শ্রোতাদের জন্য প্রাথমিক প্রভাব হচ্ছে বক্রাঘাত প্রভাব (সেকশন ৩৯ দেখুন)। সম্পূর্ণ নতুন গল্প বলার দায় নিয়ে (বা ভান করে) আগের সব কথন রীতি থেকে উপন্যাস অবশ্য আলাদা। কাজেই প্রথম পঠনে বেশিরভাগ উপন্যাসের সম্ভাবনা থাকে চমক প্রদানের, যদিও কিছু কিছুতে অন্যগুলোর চেয়ে বেশি থাকে।

            থ্যাকারে ভ্যানিটি ফেয়ার এর এ দৃশ্যে কয়েকটি পুরে দিতে সমর্থ হয়েছেন। একজন ব্যারোনেট, কপর্দকশূন্য ও এতিম পরিচারিকা, বেকি শার্পকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে চমকে ওঠে; স্যার পিট ক্রোলি ও পাঠক চমকিত হয় এটা আবিষ্কার করে যে ইতোমধ্যেই তার বিয়ে হয়ে গেছে। পরিস্থিতিটি থেকে থ্যাকারে আরো বেশি সুযোগ লাভ করেন। যেমনটা ক্যাথলিন টিলোস্টন তাঁর নভেলজ অব দী ১৮৪০জ  বইয়ে লক্ষ্য করেন,  উপন্যাসটির চৌদ্দতম অধ্যায়ের এ প্যাসেজটি দিয়েই উপন্যাসটি শেষ হয়েছে, আর আসল ধারাবাহিক প্রকাশনার চতুর্থ নাম্বারের শেষেও এটি এসেছিলো। কাজেই বেকির স্বামীর পরিচয় সম্পর্কে প্রথম বারের পাঠকেরা কিছু সময় (আধুনিক টিভি সোপের দর্শকদের মতো বরং) উৎকণ্ঠায় থেকে থাকবেন। থ্যাকারের সমসাময়িকদের সাথে যে সাদৃশ্যমূলক তুলনা হয়েছে, তা নাটকের অঙ্কের সমাপ্তি হবে। সুন্দরী ও উদ্বেলিত যুবতী নারীটির সহজাতভাবে নাটকীয় হওয়ার আগে বৃদ্ধ লম্পটের হাঁটুতে উপুড় হয়ে থাকার দৃশ্যটি এবং বেকির “ওহ্, স্যার — আমার — আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে” ধ্রুপদী পর্দারেখা, যা বিরতির মধ্য দিয়ে দর্শককে গুঞ্জনরত রাখার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

            পরের অধ্যায়ে তাৎক্ষণিক উত্তর না দিলেও বেকি কাকে বিয়ে করেছে সে বিষয়টি রয়েছে। বেকির আগে স্যার পিটের সৎ বোন, মিস ক্রোলি ধড়াস করে রূমে ঢুকে পড়ে তার ভাইকে হাঁটুতে উপুড় হয়ে থাকতে দেখে, আর চমকে ওঠে, বিশেষ করে এটা জেনে যে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। অধ্যায়টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত থ্যাকারে উন্মোচন করেন না যে বেকি মিস ক্রোলির ভাগিনা, অমিতব্যয়ী ক্যাভালরি অফিসার, রোডন ক্রোলিকে গোপনে বিয়ে করে।

            এ রকম প্রভাব সৃষ্টি করতে সতর্ক প্রয়াসের প্রয়োজন হয়। আতসবাজির সেট-পিসে যেমনটা ধীরে ধীরে দহনকারী ফিউজ পরপর বিরাট বিস্ফোরণকে প্রজ্জ্বলিত করে। উন্মোচনের সময় এলে পাঠকের কাছে তা প্রত্যয় উদ্দীপক করে তুলতে যথেষ্ট তথ্য অবশ্যই সরবরাহ করতে হবে, তবে এত তথ্য নয় যে পাঠক আগেভাগেই অনায়াসে বুঝে ফেলবে। থ্যাকারে তথ্য চেপে রাখেন, কিন্তু প্রতারণা করেন না। কথক হিসেবে তাঁর স্বভাবদুর্লভ স্বল্পভাষীতাকে আরো বেশি স্বাভাবিক প্রতীয়মান করতে তাঁর কথনের এ অংশে তিনি পত্রের প্রচুর ব্যবহার করেন ।

            গল্পের আগের দিকটায় বন্ধু অ্যামেলিয়ার ভাইকে স্বামী বানানোর প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কপর্দকশূন্য বেকি স্যার পিটের অসুস্থ দ্বিতীয় স্ত্রীর দুই কন্যার জন্য পরিচারিকার পদ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কুইন’স ক্রোলিতে তার দেশের আসন কৃপণ ও দেখতে বিশ্রী বৃদ্ধ ব্যারোনেটের কাছে ও তার ধনী কুমারী সৎ বোনের কাছে নিজেকে অমুল্য করে তুলতে সে উঠে পড়ে লেগে যায়। মিস ক্রোলি বেকিকে এত পছন্দ করতে শুরু করে যে তার লন্ডনের বাসায় অসুস্থ হলে তার সেবা-শুশ্রুষা নেয়ার জন্য  পীড়াপীড়ি করে। বেকিকে ছাড়িয়ে আনতে স্যার পিট অনিচ্ছায় রাজী হয়, কারণ স্যার পিট মিস ক্রোলির কাছ থেকে  তার মেয়েদের উইলকৃত সম্পত্তির আশায় গুঁড়ে বালি দিতে চান না; কিন্তু তার স্ত্রী মারা গেলে (যে ঘটনায় সব চরিত্র স্থুলভাবে উদাসীন থাকে) বেকিকে কুইন’স ক্রোলিতে যে কোনো মূল্যে ফিরিয়ে আনতে এমনকি বিয়ের জন্য বাধ্য হয় সে। মিস ক্রোলি ইতোমধ্যেই এ বিপদ টের পেয়েছে — যতই সে বেকির সঙ্গ উপভোগ করুক, পরিবারে বরণ করে নেয়ার মতো কোনো ইচ্ছা তার নেই — আর তার ভাগিনা যেন বেকিকে প্ররোচিত করে, তাকে তৃতীয় লেডি ক্রোলি হিসেবে অযোগ্য করে তোলে, সে ব্যাপারে ভাগিনাকে নীরবে উৎসাহিত করেছে। এর পরির্বতে তাকে বিয়ে করা হঠকারী হলে রোডন অন্তত সম্মানজনক কাজ করে। সম্পদ ও মর্যাদার সন্ধানে প্রেম ও মৃত্যু কেবল তাদের প্রতিদ্বন্দী হওয়ায় বাকি চরিত্রগুলো সম্পূর্ণরূপে হিসাব-নিকাশ ও নিজের স্বার্থ থেকে কাজ করে।



            থ্যাকারের বক্রাঘাত অনুশোচনাহীন। বেকি “অনেক বিচলিত” হয়, তার অশ্রু একবারের জন্য অকৃত্রিম — কিন্তু কেন? সে নির্বোধ রোডনকে বিয়ে করেছে এই আশায় যে রোডন তার আন্টির সহায়-সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে শুধু এটা দেখার জন্য যে সে আরো বড় ও আরো নিশ্চিত এক পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছে: ব্যারোনেটের স্ত্রী হওয়া এবং ঘটনা প্রবাহে শীঘ্রই ধনী সম্ভ্রান্ত এক মহিলা হওয়া (ব্যারোনেটের যে দাবি সে “বিশ বছর ধরে ভাল” তা অতি আশাবাদী, আর নিশ্চয়ই বেকির প্রতি তার আকর্ষণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম আকর্ষণ)। দৃশ্যটি স্যার পিটের চরিত্রায়ন থেকে ব্যাপক কিছু লাভ করে, যার সম্পর্কে কথক আগেই বলে, “ইংল্যান্ডের ব্যারোনেটমণ্ডলী, অভিজাতমণ্ডলী, জনগণ বেশি চতুর, বেশি হীন, বেশি স্বার্থপর, বেশি বোকা, বেশি কুখ্যাত বৃদ্ধ মানুষ ধারণ করে না।” বেকির দিকে ব্যারোনেটের স্যাটারের মতো কামনা ভরে তাকানোর চিত্রকল্পে থ্যাকারে ভিক্টোরিয়ান স্বল্পভাষীতার ততদূর যান যতদূর তা তাকে অনুমতি দেয় এ ইঙ্গিত করতে যে স্যার পিট বেকির প্রতি স্থুল যৌনতায় আগ্রহ থাকার বাইরে নয়। এমন একজন স্বামীকে হারিয়ে সে যে কাঁদবে তা শুধু তার নিজের উপরই নয়, ভ্যানিটি ফেয়ার  এর গোটা আবহের উপরও বিধ্বংসী মন্তব্য।


আগের পর্ব                                                                                                                          পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*