বিষম নয়না




বিষম নয়না

শাহীনুর ইসলাম


ক’দিন ধরেই লুসিয়ানাকে নাছোড়ভাবে মনে পড়ছে। বিশেষ করে ওর চোখদুটো। শরীরের বেদানার মতো রক্তিম আভাকে ছাড়িয়ে ওর সবুজ চোখদুটোকেই বেশি বেশি মনে পড়ছে। যেন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যজনকভাবে অনেক কিছু বলে যাচ্ছে এবং একই সাথে গোপন করে যাচ্ছে।

বাদামী, কালো চোখ আমি আগে অনেক দেখেছি। নীল চোখ যদিও কম দেখেছি, তবু এর সম্পর্কে আগে শুনেছি। কিন্তু সবুজ চোখের অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ব কোনো ধারণা ছিল না আমার মধ্যে। এ রঙের চোখ প্রথম আমি ওর মধ্যেই দেখি। দেখেই দুর্নিবার, ব্যাখ্যাতীত এক আকর্ষণ অনুভব করি। ওর সবুজ চোখ দেখাটা আমার কাছে মহাসাগরের বুকে চলতে চলতে কোনো এক দূর দ্বীপ আবিস্কারের মতো বিরল এক দৃশ্য ছিল। দেখামাত্রই মনে হয়েছিল পৃথিবীর সব সবুজের যে প্রাণবন্ত সমারোহ তা ওর চোখদুটো থেকে বিচ্ছুরিত ও পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। তাই ওকে দেখে জীবনে দুর্লভ কিছু দেখেছি বলে নিজেকে এদিক দিয়ে অনেকটা ধন্য মনে হয়।

অনেকেই সবুজ চোখের মানুষকে দেখলে ভয়ে আঁতকে ওঠে। কেউ আবার কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে এদের এড়িয়ে চলে। হয়তো এদের কৌতূহলপ্রবণ, রহস্যময়, ঈর্ষান্বিত, আবেগী, হঠকারী, সৃজনশীল, আত্মমগ্ন, প্রাণবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত স্বভাবের কারণে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার কাছে শুধুই বিস্ময়জনক আকর্ষণ এবং তার ফলস্বরূপ আমার নিজেকে উদ্দীপ্ত লাগাটা কাজ করেছে।

কিন্তু কী আশ্চর্য! লুসিয়ানার চোখ সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে কাকতালীয়ভাবে ওর একটা ফোন বার্তা পাই। একে হয়তো টেলিপ্যাথি বলা যেতে পারে। দৃশ্যমান কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়াই যোগাযোগ। বার্তা পেয়েই আমি চমকে উঠি। এও সম্ভব?

বার্তায় জানায় ও আমার সাথে দেখা করতে চায়। একটুও দেরি না করে আমি তৎক্ষণাৎ বিস্ময় প্রকাশ করে ফিরতি বার্তা দেই,

-তুমি কি করে জানলে যে তোমাকে আমার মনে পড়ছে এ সময়? তাছাড়া এখানে এলেই বা কবে? আগে জানাওনি কেন কিছু?



একসাথে এত প্রশ্ন করেছি বলেই হয়তো-বা সে প্রশ্নভারে জর্জরিত হয়ে গেছে। তাই দেখি আমার প্রশ্নমালার উত্তর মেসেজে না দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আমাকে ফোন করে জানায়,

-গতকাল এসেছি। ভাবলাম একটু ফ্রি হয়ে তোমাকে জানাই।

-তা তুমি যে মেক্সিকো থেকে আসবে সেটা আগে জানালে তো পারতে?

-তা হয়তো পারতাম। কিন্তু জানো কী হয়েছে? এবার এত তাড়াহুড়া করে আসতে হয়েছে যে এখানকার কাউকেই জানাতে পারিনি। দূতাবাসে একটা কাজের জন্য এসেছি। সপ্তাহখানেক আছি। তাড়াহুড়ার মধ্যে আবার ফিরতে হবে।

-শুধু এক সপ্তাহ? সেটা তো দেখতে দেখতেই চলে যাবে।

-হুম, কিছু করার নেই। এ তো প্রমোদ ভ্রমণ না। তবে আমি ঠিক করেছি এর মধ্যেই প্রমোদ খুঁজে নেবো যদি তুমি সময় দাও।

-সময় দিতে আমার আপত্তি নেই। আমি আজকে ফ্রি আছি। কালকে কাজ আছে। তোমার যদি সময় থাকে, তবে আজকেই আমরা দেখা করতে পারি।

-ঠিক আছে। কিন্তু কখন?

গেল বার ওর বিদায়ের আগের দিন আমরা এক সাথে জাপানিজ সুশি খাই। অবশ্য সে-ই নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়। বহুসাংস্কৃতিক দেশের এই একটা সুবিধা—বহু সংস্কৃতির খাবার মেলে। শুধু টাকা থাকলেই হয়। নানান দেশের খাবার চেখে চেখে শেষে যেটা সবচেয়ে সুস্বাদু বলে মনে হয় সেটাতেই থিতু হয়ে পড়া আর কি।

সেবার যদিও আমার আরেক দিন খাওয়ানোর কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সে দেশে চলে যাওয়ায় তা হয়ে ওঠেনি। তাই তাকে এবার আমিই প্রথম খাওয়াবো এবং সেটা বাংলাদেশি খাবার। কিছুক্ষণ ভেবে ওকে বলে দেই ভারতীয় একটা রেস্তোঁরায় আসার জন্য। বাইরে বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ নেওয়ার জন্য এর বিকল্প নেই। কারণ এসব রেস্তোঁরার মালিক ও বাবুর্চি মূলত বাংলাদেশিই, যদিও এখানে ব্যবসার খাতিরে ভারতের নামে চলে। আর আমি ওকে আমার বাসায় খাওয়াতে পারতাম ঠিকই। কিন্তু আমার রান্না একেবারে বাজে। জীবন ধারণের জন্য তা নিজে খাওয়া চলে। অন্যকে খাওয়ালে নিজের সম্মান খোঁয়ানোর সাথে সাথে নিজের পূর্বপুরুষদের সমৃদ্ধ খাদ্য সংস্কৃতিকেও অপমান করা হয়।

বাংলাদেশি একটা রেস্টোরেন্টের ঠিকানা ওকে মেসেজ করে বলি—এখানে দুপুর বারোটার দিকে এসো। তারপর ঘোরাঘুরি করতে করতে রাত হয়ে গেলে আমরা অন্য কোনো রেস্তোঁরায় বা অন্য কোথাও নৈশভোজ সেরে ফেলবো।

মধ্যাহ্ন ভোজের সময়টাকে বেছে নিয়েছি কারণ তাতে এক সাথে ত্রিশ থেকে চল্লিশ ধরণের কিংবা তার চেয়েও বেশি খাবারের স্বাদ মেলে। দামও সস্তা। যাকে বলে বুফে।

এখন সকাল দশটা বাজে। বসন্তের প্রথম সপ্তাহ চলছে। বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আকাশ বেশ পরিস্কার নীল। কোথাও মেঘের কোনো লেশমাত্র নেই। এ সময়টায় বাতাসে সাধারণত ধূলিকণাও থাকে না। বিশুদ্ধ বাতাস। সমস্যা একটাই—ঠাণ্ডা বাতাস। বাইরে গিয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে গেলে কাশতে কাশতে প্রাণখানি যাবার উপক্রম হয়। রোদের সাহস হয় না প্রকাশ্যে হাজির হওয়ার। সূর্য লুকিয়ে লুকিয়ে কিরণ দেয় এবং মোমবাতির চেয়েও কম তাপ দেয়। কমজোর, ঊনপাঁজুরে। ঘর থেকে বাইরে তাকালে দেখা যায় ঝকঝকে রোদ উঠেছে। মনে হয় একটা টি শার্ট-প্যান্ট পরেই বের হওয়া যাবে। কিন্তু সবাই জানে এ রোদ মায়াবী, ছলনাময়ী। দেখতে রোদের মতো, কিন্তু তাপে চাঁদের আলোর মতো।

অন্যদের মতো আমিও এখানকার জলবায়ুর ছলনাটুকু বুঝি বলে বেশ প্রস্তুতি নেই। ভেতরে ইনার, তার উপরে একটা মোটা পলো-শার্ট এবং তার পর স্নো-জ্যাকেট পরি। আমার বাসা থেকে একটুখানি হাঁটলেই গন্তব্যে যাওয়ার বাসটা পাওয়া যায়। কাজেই ভেবেছিলাম এটুকু জায়গা আসতে বেশি সময় লাগবে না। সাড়ে এগারোটায় বেরোলেই যথাসময়ের আগেই পৌঁছে যাবো রেস্টোরেন্টে।

বাস স্টপে পনের মিনিট পর পর সাধারণত নির্ধারিত বাসগুলি আসে। শুধু যেদিন তুষার ঝড়ের মতো কোনো কারণ থাকে সেদিন এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। পরিকল্পনামাফিক বাসা থেকে যথা সময়ে আমি রওয়ানা দেই। রাস্তা কিছুটা পিচ্ছিল থাকার কারণে বাস স্টপে হেঁটে যেতে দু’মিনিটের জায়গায় পাঁচ মিনিট লাগে। সেখানে গিয়ে কাঙ্খিত বাসটার জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু কী কারণে যেন বাসটা আসে বিশ মিনিট পর। আর বিলম্ব না করে আসার সাথে সাথেই উঠে পড়ি। এখান থেকে রেস্টোরেন্টে পৌঁছাতে লাগবে পনের মিনিট। একটু দেরি হয়ে যাবে। এখন সে শুধু বিরক্ত না হলেই হয়।

বাসে যেতে যেতে যথারীতি লক্ষ্য করি সবুজ বলতে তেমন কিছুই নেই চারপাশে। বিচ্ছিন্ন দু’একটা চিরহরিৎ বৃক্ষ ছাড়া। কিন্তু তাতে সবুজের তৃষ্ণা আমার কিছুতেই মেটে না। বরং তৃষ্ণা আরো বাড়িয়ে দেয় যেভাবে জিহ্বায় মিষ্টির একটু রস পড়লে আরো মিষ্টি খাওয়ার বাসনা জাগ্রত হয়।

কয়েক মাস ধরে শাদা শাদা সব তুষার চাদর দেখতে দেখতে আমার চোখদুটো বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্লান্তি দূর করার জন্য এবার আমার চারপাশে সবুজ-সমৃদ্ধ প্রকৃতি চাই। কিন্তু সেটা পুরোপুরি পেতে গেলে জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এতদিনে ক্লান্তিটা আরো বেড়ে যাবে সন্দেহ নেই। আমি ক্লান্তি আর বাড়াতে চাই না। সেজন্য লুসিয়ানাকে দেখার আগ্রহ বেশ প্রবল হয়ে উঠেছে। ওর চোখের সবুজ রঙ নিশ্চয়ই আমার তৃষ্ণা মেটাবে। ভাগ্যিস ওর সাথে দেখা হয়েছিল আগে এবং সখ্যও গড়ে উঠেছিল! নইলে এবার ছয়মাসের পুরোটা সময় ধরে এখানকার হিমগ্রস্ত শাদা ভাব আমাকে মনমরা ও বিমর্ষ করে রাখতো।

গতবার প্রথম যখন শীতকালে এদেশে আসি তখনই ওর সাথে পরিচয়। সেবার ওর সবুজ চোখ দেখে দেখে আমি অনেকটাই প্রাণবন্ত সময় কাটিয়েছিলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার উদ্দীপ্ত থাকার মতো আশপাশের প্রকৃতি তখনো প্রস্তুত নয়। চোখ নিয়ে কথা বলতে বলতে তাকে এক পর্যায়ে জানিয়েছিলামও যে তোমার চোখের মতো তুমিও ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রম আমাকে সব সময় টানে। আমার কথা শুনে সে কিছু বলেনি। শুধু মৃদু অথচ রহস্যময় একটা হাসি হেসেছিল। কিন্তু এবারের শীতে সে রকম ফুরফুরে ভাব আমার মধ্যে এখনো একটিবারের জন্যও আসেনি। সেটার কারণ খুব সম্ভবত ওর সবুজ সবুজ চোখকে এ চার মাস ধরে দেখতে না পাওয়া। আজকে আবার দেখতে পাবো ভাবতেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠছে।

বাস রেস্টোরেন্টের কাছাকাছি স্টপে এসে পৌঁছে যায়। নেমে দ্রুত পদক্ষেপে হাঁটতে শুরু করি। রেস্তোঁরায় গিয়ে দেখি সে বরাবরের মতো এবারও ঠিক সময়ানুবর্তী। আমার আগেই এসে হাজির। মনে বড় ইচ্ছে ছিল এবার ওর আগে আমি এখানে আসবো। কিন্তু বাসে চলাচলের এই একটা অসুবিধা। ঠিক সময়মতো কোথাও পৌঁছানোর নিশ্চয়তা নেই। অবশ্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে ভিন্ন কথা।

রেস্টোরেন্টে তখনো ভোজনরসিকদের ভীড় জমেনি। বলতে গেলে সে-ই প্রথম ঢুকেছে। একা এক কোণায় বসে আছে দরজার উল্টো দিকে মুখ করে। আমি ঢুকে ওর পিঠে ঝুলে পড়া লম্বা চুল ও দেহের আকার-আকৃতি দেখে ধরে নেই এটাই লুসিয়ানা।

মনের ঘরে যার নিত্য বসবাস তাকে যে কোণ থেকেই দেখা হোক না কেন চিনতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। আমি ধীর পায়ে চুপি চুপি ওর পিছনের দিকে যেতে শুরু করি। রেস্টোরেন্টের ওয়েটার দূর থেকে আমাকে এভাবে হাঁটতে দেখে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে ঈশারায় চুপ থাকতে বললে সে মনে হয় আমার মনোভাব বুঝে যায়। তাই আমার দিক থেকে মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয় যাতে করে আমার দিকে তার চোখের অবিরাম দৃষ্টিপাত লুসিয়ানার কাছে আমাকে আগেভাগেই চিহ্নিত করে না দেয়।

পিছনে গিয়েই ওর চোখদুটো আমি দু’হাত দিয়ে ঢেকে ফেলি। এতে ওর চুলের কিছুটা আমার হাতের মধ্যে এসে ঢুকে পড়ে। সামনে কিছু একটা টুপ করে পড়ার শব্দও পাই। কিন্তু সে শব্দ আমাকে মোটেও ভাবিয়ে তোলে না। সরাসরি সামনে গিয়ে হাজির না হয়ে পিছন থেকে এভাবে চোখ ধরে আমি ওকে মূলত চমকে দিতে চেয়েছিলাম। আর চমকের অছিলায় আমার ঈপ্সিত ধন ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু আমার এমন আচরণ যেন ওর মনঃপূত হয়নি। সে তো চমকে ওঠেই নি। বরং কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে এক ঝাঁকিতে পিছন ফিরে তাকায়। ওর রক্তবর্ণ চোখদুটো আমার নজরে আসে। মুহূর্তেই আমার সবুজ চোখের স্বপ্ন তিরোহিত হয়। ওর অপ্রত্যাশিত এই পাল্টা আচরণে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাই।

‘আমার আচরণের জন্য আমি দুঃখিত’। বলার সাথে সাথে ওর চোখে-মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখে এবার আমি নিজে চমকে উঠি, যদিও চোখের রক্তবর্ণটা তখনো চলে যায়নি। একই সাথে হাসি এবং রক্তবর্ণ দেখে আমার নিজেকে মনে হয় মাছ ধরার জন্য জেলেদের পানি ঘোলা করার কৌশলের শিকার হিসেবে।

আমার দৈন্য দশা বোধ হয় সে বুঝে ফেলে। তাই আমাকে স্বাভাবিক করতে সামনে থেকে আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে। এ আলিঙ্গনে আমার উচ্ছ্বাসের ঝুড়ি পুরোটা না ভরলেও তার চিকিৎসায় কাজ দিয়েছে। আচমকা ঝাটকান দিয়ে আমার দিকে ওভাবে তাকানোর ফলে আমি সহসা যে বিশ্রী অবস্থায় পড়ি তা কেটে যায়।

একটু পরেই লোকজন হয়তো হুমড়ি খেয়ে পড়বে। সে দৃশ্যের চাপে পিষ্ট হওয়ার আগে তাকে প্রস্তাব করি খাবার আনতে। তারপর খাবার নিয়ে দুজনে টেবিলটায় বসে পড়ি। এতক্ষণ আমি ওকে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখেছি। গভীরভাবে কেন জানি দেখিনি। হয়তো প্রথমেই আমার অপ্রস্তুত হওয়ার কারণে। খেতে খেতে যখন আলাপ করছি একটা বছর কেমন কাটলো দেশে, তখন সে যখন তার বর্ণনা দেয় সেটা শুনতে শুনতে আমার দৃষ্টি ওর চোখে আটকে যায়। তখন মনে মনে একটু সন্দেহ জাগে এ কি সেই লুসিয়ানা?

আমার দৃষ্টি তার চোখে আটকে আছে। এ অবস্থায় মনে হলো আমার কানের পাশ দিয়ে একটা কুকুর একটা বিড়ালকে তাড়া করলো।



গত বছর যেটুকু সময় ওর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে সেটুকু সময়ে ওর দুটো চোখই পুরোপুরি সবুজ রঙের ছিল। যেন বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের দুটো সবুজ শস্যক্ষেত। এখন শুধু উত্তরবঙ্গের শস্যক্ষেতটা আছে। দক্ষিণবঙ্গের ক্ষেতটা যেন পুরোপুরি সমুদ্রে রূপ নিয়ে নীল হয়ে গেছে। আমি গভীরভাবে তাকিয়ে থাকি, আর গভীর বিস্ময়ে বিমূঢ় হই।

হ্যাঁ, আমার স্পষ্ট মনে আছে ওর চোখ স্বচ্ছ সবুজ ছিল। ওর চোখজোড়ার জন্যই সে আমার মনে বসত করছিল। চোখে সে কী রহস্যময় মায়া! কিন্তু এরকম কীভাবে হলো? বুফে খাওয়া এবং ওর দেশের গল্প শোনার চেয়ে আমার মনোযোগ বেশি এ জটিলতার সমাধান নিরসনে। এখন ওর চোখের যে অবস্থা দেখছি তাতে বৈচিত্র্য থাকলেও আমার মন ভোলানা মায়াটায় ঘাটতি পড়ে গেছে।

ওর চোখকে এখন বিষম বর্ণে দেখা যাচ্ছে। অথচ এতক্ষণ সেটা আমার দৃষ্টিকে এড়িয়ে গিয়েছিল যেভাবে বিগত সময়টায় গেছে। কিন্তু আমি তো ওকে আগে যেভাবে দেখেছি সেভাবে মনে গেঁথে রেখেছি। কিছুতেই মেলাতে পারছি না।

ওর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর কথাগুলোর দিকে আমি পুরো মনোযোগ দিতে পারিনি। আমার অমনোযোগকে সে সহজেই বুঝতে পারে, কারণ ওর ছোট ছোট ঘটনার বর্ণনায় ‘হ্যাঁ-হু’ ছাড়া আমার কোনো প্রতিক্রিয়া পায়নি। তাই বিষয়টা পরিস্কার করতে আমাকে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি কি কোনো কারণে উদ্বিগ্ন, তাহের?

-না, ভাবছি।

-ভাবাভাবির কিছু নেই। আমাদের কারুরই এত সময় নেই যে অনেকটা সময় কাছাকাছি থাকবো? যেটুকু সময় থাকি, তা যদি ভেবেই কাটাই তবে সে সময়টুকুও বৃথা যাবে।

-তুমি ঠিক বলেছো, লুসি। আচ্ছা, একটা কথার জবাব দেবে? সঙ্কোচ না করে বলেই ফেলি। কী বলো?

-নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো।

-আ…সবুজ শস্যক্ষেতের মধ্যে তুমি সমুদ্রের নীল কোথায় পেলে?

-মানে?

-না, থাক। এমনি মনে হলো। তাই জিজ্ঞেস করলাম।

-ও…হা! হা! হা! বুঝেছি। সেটা অন্য এক কাহিনী।

-কী রকম?

-এখনই শুনবে? খাওয়াটা শেষ করি। তারপর অন্য কোনো কম ভীড়ের কফিশপে বসে বলি? বাইরে তো এখনো ঠাণ্ডা। বেশিক্ষণ হাঁটাহাঁটিও করা যাবে না।

-ঠিক আছে।

এতক্ষণে ওর মুখ থেকে চোখ উঠিয়ে দেখি লোকজন লম্বা লাইন ধরে বুফে নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে এবং শোরগোলও বেড়ে গেছে। সেদিকে আমার মনোযোগ ছিল না। আমাকে পুরোটা সময় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল ওর চোখের ভাবনা।

ওর থালার দু’একটা খাবারের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে এই প্রথম খাদ্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানায় সে,

-তন্দুরি চিকেনটা খুব মজার। প্রথমে যে ডাল স্যূপটা খেয়েছি সেটাও দারুণ ছিল।

-আরো মজার মজার খাবার আছে। সবগুলো তো এখানে নেই। তাছাড়া বাসায় রান্না করলে অন্য রকম সুস্বাদু হয়। কিন্তু আমি পারি না।

-না, না, তুমি যেমনই করো, তোমার হাতের রান্না একদিন খাবো। তোমার বাসায় আমাকে দাওয়াত দিলাম। দিন-ক্ষণ তুমি ঠিক করো। ভয় নেই। আমিও তোমাকে মেক্সিক্যান খাবার রান্না করে খাওয়াবো।

বলেই হেসে ওঠে। আমিও না হেসে পারি না। এ রকম হালকা হাস্যরসে আমাদের দুজনার মনোভূমির উঁচু-নিচু জায়গাগুলো অনেকটা সমতল হয়ে যায়।

খাওয়া শেষে অন্য কোনো নির্জন কফিশপে কফি পান করতে চেয়েছিলাম বলে এখানে চা-কফি কিছু খেলাম না। শুধু ফলাহার বলতে মিষ্টান্ন ক্ষীর খেলাম। সে এটাও বেশ পছন্দ করে।

ভীড় থেকে বের হয়ে আমরা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করি। কাছেই একটা কফিশপ পেয়ে যাই। বাইরে থেকে ভেতরে তেমন মানুষজন দেখা যাচ্ছে না বলে এখানেই যাবো মনস্থির করি। ঢুকেই দুটো মাঝারি আকারের কফি নিয়ে সরাসরি এক কোণায় গিয়ে বসে পড়ি।

লুসি আমার অজানা একটা শব্দ উচ্চারণ করে বলতে শুরু করে,

-হেটারোক্রোমিয়া সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে?

আমাদের আজকের ভাব ও বিষয়ের সাথে শব্দটাকে আপাত সম্পর্কহীন মনে হলো আমার কাছে। তাই মাথাটা নেড়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে জানাই,

-না, নেই। সেটা কী?

-বুফে খাওয়ার সময় তুমি যেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলে ডাক্তারি শাস্ত্রে তাকে বলে হেটারোক্রোমিয়া। সহজভাবে বলতে গেলে দাঁড়ায়—দুটি ভিন্ন রঙ বা বর্ণ। কারো দুটি চোখ যখন দুটি বর্ণের হয়, তখন তাকে এ নামে অভিহিত করা হয়। মানুষের মধ্যে এটা কমই দেখতে পাওয়া যায়। তবে কুকুর, বিড়াল ও ঘোড়ার মধ্যে এটা কমন। বিশেষ করে, তার্কিশ বিড়াল, সাইবেরিয়ান কুকুরের মধ্যে। এমনকি কোনো কোনো গবাদি পশুর মধ্যেও দেখা যায়।

আমি তার নতুন এই কথা শুনে শুধু বিস্মিত হই। জগৎ কী বিচিত্র! প্রকৃতিও সব জায়গায় মনে হয় তার একই নিয়ম বহাল রাখতে পারে না। কিন্তু আগে কী করে ওর দুটো চোখই একই রঙের ছিল? এ ভাবনা মনে জাগতেই ওকে প্রশ্ন করি। সে জানায়,

-আমার চোখদুটো কখনোই একই রঙের ছিল না। এখন যে অবস্থায় দেখছো সে অবস্থায় আমার জন্মের পর থেকেই ছিল। কিন্তু আমি এক রঙের করে রাখতাম। সেটাও রাখতাম একটা কারণে।

আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। ওর চোখের এত রহস্য! একটার জট খুলতে না খুলতেই আরেকটা রহস্য এসে হাজির হয়। কারণ জিজ্ঞেস করে বলি,

-কেন?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিতে লাগে,

-মানুষ যা দেখে অভ্যস্ত তার বাইরে কিছু মেনে নিতে সে নারাজ। আমি বিষম নয়না হওয়ার কারণে সমাজের মানুষজন আমাকে প্রায় একঘরে করে রাখতো। ছোটবেলায় কেউ আমার সাথে খেলতে চাইতো না, মিশতে চাই তো না, আমাকে দেখার পর কারো কোনো অঘটন ঘটলে তার কারণটা আমার উপর অযথা আরোপ করতো। মোটকথা, সব সময় অশুভের প্রতীক হিসেবে আমাকে গণ্য করতো।

-মানুষ তো আসলে এমনই কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তারা কিছুতেই বুঝতে চায় না আমরা যা দেখে অভ্যস্ত, জগৎ শুধু তার উপর ভিত্তি করেই চলে না।

-একদম ঠিক বলেছো। তারপর আমার এক ডাক্তার আঙ্কেল বুদ্ধি দিলেন যে তুমি একই রঙের কন্ট্যাক্ট লেন্স পড়ো। সামাজিক অত্যাচার থেকে বাঁচবে। হয়েছেও তাই। এখন আর কেউ সেরকম আচরণ করে না। বরং আকর্ষিত বোধ করে আমার সাথে মেশার জন্য।

শেষ কথাটা বলার সময় লুসির মুখটায় খানিকটা আনন্দবোধের দীপ্তি বিকিরিত হয়। এরপর মুহূর্তকাল নীরব থেকে আবার শুরু করে,

-রেস্টোরেন্টে তুমি যখন পিছন থেকে আমার চোখদুটো ঢেকে ফেলেছিলে, তখন আমার আচরণে তোমার খটকা লেগেছিল, তাই না?



আমার অস্বীকার করার উপায় নেই। তাছাড়া ওর কাহিনি আমার জানা ছিল না। আমি এখন শুধুই সমর্পিত এক প্রাণী। আমার দৃষ্টিটা নিচে নিক্ষেপ করে বলি,

-একটু তো হয়েছিলামই। আসলে তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম।

-কিন্তু জানো চমকে দিতে গিয়ে সামাজিক অত্যাচার থেকে বাঁচার যন্ত্রদুটো আমার চোখ থেকে তুমি ফেলে দিয়েছিলে?

ওর এ কথাটা শুনে নিজেকে বেশ অপরাধী লাগে। মনে পড়ে যায় সে সময়ের টুপ করে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার কথা, যেদিকে আমি মোটেও মনোযোগ দেয়নি।

ওর কথা যেন ফুরোয় না। আমিও পুরোটা শুনেই যাচ্ছি।

-আর লোকজনের ভীড় যতই বাড়ছিল, ততই কেউ কেউ আমার দিকে কেমনভাবে যেন তাকিয়ে ছিল। বিশেষ করে ওয়েটারটা। ওদের চোখে আমি আমার ছোটবেলার দম আটকানো অনুভূতির প্রতিফলন পেয়েছিলাম। তাই তোমাকে বলছিলাম যে অন্য কোথাও গিয়ে কাহিনিটা বলবো।

সে ওর চোখের একটা করে জট খোলে, আর আমি তাতে বাধা পড়ে যাই। এর মধ্যে এত কিছু ঘটে গেছে। অথচ আমি মগ্ন ছিলাম শুধু একটা বিষয়ে। আসলে যার কাছে যেটা কাঁটার মতো বেঁধে সে সেটা নিয়েই বেশি মগ্ন থাকে। অন্যের কাঁটাবিদ্ধ হওয়ার ব্যথা কেউ সহজে বুঝতে চায় না, যেমনটা আমি নিজেই বুঝতে পারিনি।

গত বছরের কথা ওকে মনে করিয়ে দিয়ে এবার আমি শুরু করি,

-তোমার মনে আছে? গত বছর তোমার সবুজ চোখ দেখে আমি বলেছিলাম— তুমি ব্যতিক্রম। এখন তোমার দু’চোখের একটায় সবুজ শস্যক্ষেত এবং আরেকটায় নীল সমুদ্র দেখে মনে হচ্ছে তুমি ব্যতিক্রমেরও ব্যতিক্রম।

শেষ না করতেই আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে লুসি পুনরাবৃত্তি করে,

-আর ব্যতিক্রম আমাকে সব সময় টানে।

আমার গত বছরের সেই কথাটা সে হুবহু পুনরাবৃত্তি করেছে দেখে বেশ অবাক হয়ে আমি হো হো করে হেসে উঠি। আমার সাথে সেও হাসে। এ হাসির তুফান আমাদের এতক্ষণের আড়ষ্টতা, অপরাধবোধ, বিব্রত-বোধ—সবই যেন সমূলে উপড়ে নিয়ে যায়।





Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*