আতর বাঁশি

গল্প




আতর বাঁশি

-শাহীনুর ইসলাম


জীবনে অনেক ঘুরেছে আনিলা। এটা তার দ্বিতীয় নেশা। প্রধান উদ্দেশ্য প্রকৃতির ভাল লাগার উপাদানসমূহের চলার ভঙ্গিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নতুন নতুন সুর তৈরি করা। এর মধ্য দিয়ে সে জীবনের রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শকে ধারণ করতে চায়। ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর বহু দেশের বহু জায়গা, নদী, সমুদ্রসৈকত, দ্বীপ, স্থাপনা ও স্থাপত্য তাকে আকৃষ্ট করেছে। এ জন্য সময় বের করে বার বার ছুটেও গিয়েছে ভাল লাগার জায়গাগুলোতে।

ভারত মহাসাগর থেকে শুরু করে আরব সাগর, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পারের বেশ কিছু জায়গা তার দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আন্দামান নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ থেকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেও তার পা পড়েছে। এহেক জায়গার এহেক অনুভব তাকে এহেকভাবে রোমাঞ্চিত করেছে। এছাড়া ভেনিজুয়েলার এঞ্জেল জলপ্রপাত, জিম্বাবুয়ের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত এবং কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো বিশাল বিশাল পৃথিবী বিখ্যাত জলপ্রপাতও বাদ যায়নি। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে এমন করে তার মন আটকে যাবে বাংলার পাহাড়ি এলাকার মাত্র দেড়শ ফুট উচ্চতার ও সাত ফুট প্রস্থের মাধব নামের একটা জলপ্রপাতে তা সে জীবনে কখনো কল্পনাও করেনি।

অবশ্য এখানে তার আসাটা এই প্রথম নয়। প্রথম এসেছিল অনেক আগে বাবা-মায়ের সাথে। তখন যৌবনের মুকুলিত হওয়ার সময়টায় বাবার চাকুরি সূ্ত্রে বছরখানেক ছিল। সে সময় জলপ্রপাতটা তাকে এতটা মুগ্ধ করতে পারেনি। মুগ্ধ করেছিল অন্য কিছু যা এখন বিস্মৃত প্রায়।

তবে এখনকার মতো তাকে মুগ্ধ করে পড়ন্ত বিকেলটার সূর্যের মিষ্টি তেজ, আকাশে মেঘদলের মুহূর্তে মুহূর্তে রঙ বদল এবং বিশেষ করে জলপ্রপাতটার আছড়ে পড়ার সাথে সাথে জলের উপর সৃষ্ট তাৎক্ষণিক রঙধনু। প্রপাতটির উপরের জল নিচে পড়ার সাথে সাথে রঙধনুর পাশাপাশি এক ধরণের সুরধনুও সৃষ্টি হয়। যেন জলপ্রপাত নয়, সুরপ্রপাত পড়ছে। এর পাহাড়ি রঙ ও ঢঙটাই মূলত খুব টানছে তাকে।

সুরটার মধ্যে সাপের এঁকেবেঁকে চলার একটা ভাব আছে। চেনা হয়েও যেন ঠিক চেনা নয়। এক ধরণের সুগভীর কারুণ্য আছে অথচ মাধুরিমায় ভরপুর। মনে হয় সুর-ধনু থেকে একসাথে অনেকগুলো তীর সুরের ইন্দ্রজাল তৈরী করে ছুটে বেড়াচ্ছে চারপাশে। এ অবস্থায় তার পক্ষে ঠিক পার্থক্য করা কঠিন যে, সুর জলপ্রপাতটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে নাকি জলপ্রপাত সুরটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একাকার হয়ে আছে বললেই হয়ত যুৎসই হবে।

যে বা যা কিছু মুগ্ধ করে, মানুষ সাধারণত তাকে ছুঁয়ে মুগ্ধতার পুরো স্বাদ নিতে চায়, যদি তা আয়ত্তাধীন থাকে। অন্যান্য পর্যটকদের ভিড় ঠেলে আনিলাও তার মুগ্ধতাকে খুব কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায়। এক পা দু’পা করে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। যাওয়ার সময় মাধবকে ঘিরে ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জরিত নানা জল্পনা তার কানে আসে। তবে সে মাধবকে যতটা না দেখে সুরটাকে তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে শোনে, আর উপভোগ করে, যদিও ভিড়ের কিচিরমিচির শব্দ তাতে কিছুটা বাধা দেয়। যেখানটায় জল পড়ছে সেখান থেকে চল্লিশ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত সামনের জায়গাটা জলে ভর্তি। সে এ জায়গাটার একেবারে মুখোমুখি কিনারে এসে পড়ে। এবার মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে সুরটা একটু পরিবর্তিত শোনাচ্ছে দূরবর্তী জায়গাটার চেয়ে।

কিছুটা কৌতূহল জাগে আনিলার। প্রপাতের নিচে কয়েকবার জায়গা বদল করে সে এটা পরীক্ষা করার জন্য যে, অন্যান্য স্থান থেকেও সুরটা কি আলাদা শোনায়? ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গিয়ে শোনে এহেক কোণ থেকে সুরঝঙ্কারটির এহেক রূপ কানে আসছে। এ পরিবর্তন যতটা না অবস্থানগত তার চেয়ে বেশি উৎসজাত। তবে তা এতটাই সূক্ষ্ম যে, শব্দ ও সুর বুঝতে বিশেষভাবে বোদ্ধা ও অভ্যস্ত না হলে কেউ এর পার্থক্য করতে পারবে না।  

আনিলা পেরেছে কারণ, বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই সুরের সাথে তার বসবাস। সেই সাথে ধ্যান ও জ্ঞান। সুর সৃষ্টি ও তা কণ্ঠে গেয়ে অন্তরভাবকে মধুর করে প্রকাশ করাটাই তার প্রথম নেশা। এ নেশা তাকে অনেক মানুষের কাছ থেকে যেমন দূরে ঠেলে দিয়েছে, তেমনই অনেককে কাছেও এনে দিয়েছে। সঙ্গে দিয়েছে খ্যাতি। কিন্তু  দুনিয়াজুড়ে নিজের নাম আরো ছড়িয়ে পড়ুুক—এটাই তার মনোবাঞ্ছা। তাই ছুটে ছুটে গেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রায় প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন জায়গার বিশেষ দৃশ্য, রূপ, গন্ধ তাকে সুরের চাক তৈরীতে সাহায্য করেছে। এজন্য নানা স্থানের নানা কিছুকে  আরো বেশি দেখতে চেয়েছে, শুনতে চেয়েছে, স্পর্শ করতে চেয়েছে এবং অনুভব করতে চেয়েছে। পরিশেষে সেসব অনুভবকে অবসরে রোমন্থন করে মৌমাছির মতো সুরের চাক সৃষ্টি করেছে। এহেক চাকে ধারণ করতে চেয়েছে এহেক সুরবৈশিষ্ট্য। শুদ্ধভাবে বলতে গেলে পুরাদস্তুর একজন প্রাকৃতিক সুর সংগ্রাহক, মিশ্রক ও প্রকাশক।

সুর প্রকাশে সে অবশ্য বস্তুর চেয়ে বস্তুর চল বা দোলাটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ সে বিশ্বাস করে চলের মধ্যেই বস্তুর অদৃশ্য অন্তরাত্মার বহিঃপ্রকাশ থাকে। চলটাই তার কাছে বস্তুর অদৃশ্য ঈশ্বর। তাছাড়া সুরও তো ভাব বা কথার চল। বস্তু সম্পর্কে জানতে হলে তা বই বা ইন্টারনেট পড়েই জানা যায়। কিন্তু এর দোলা বা চলটা যে অনুভব জাগায় এবং একটা বস্তু থেকে আরেক বস্তুকে সহজেই তফাৎ করে দেখায়, সেটা অনুভবে এনে সুরে প্রকাশ করতে গেলে সামনাসামনি তাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়। রাজহংসীর চলাকে সুরে রূপান্তর করতে যেমন রাজহংসীকে চলন্ত অবস্থায় বার বার দেখতে হয়, আবার একই রাজহংসী কোথায় চলছে—জলাশয়ে না নদীতে না বালুচরে নাকি সমতলে— সেটাও সুরের হেরফের ঘটায়, তেমনটা অন্য সব কিছুর ক্ষেত্রেও সত্য।

জলপ্রপাতটির বিভিন্ন জায়গায় সুরঝঙ্কারের রূপভেদ বোঝা শেষে আনিলা সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক এ সুরলালিত্যের প্রকৃত উৎস খুঁজে বের করতে হবে। তার ধারণা মাধবের জল পড়ার চলের সাথে সুরটা ঠিক পুরোপুরি যায় না। এর উৎস নিশ্চয়ই অন্য কোথাও। মনে মনে ভাবে এটা বের করতে পারলে তা হবে সঙ্গীত জীবনে তার এ যাবৎকালের সবচেয়ে সেরা আবিস্কার। এখানকার মানুষগুলো যা-ই বলুক না কেন, তা মনে হয় অনেকটা জনশ্রুতি।

অদূরেই পাহাড়ি ঢালের উপর একটা পর্যটন হোটেল আছে যেখানে সে মূলত আজকে ভোরবেলায় এসে উঠেছে । ওঠার পর সেখানকার দু’একজন কর্মচারী তাকে মাধবের রূপমাধুর্য সম্পর্কে বলার পাশাপাশি সাবধানবাণীও উচ্চারণ করেছে। বিশেষ করে, সন্ধ্যার পর মাধবের আশেপাশে যেন কোনোভাবেই না থাকেন। আনিলা যখন জানতে চেয়েছিল কেন, তখন একজন চোখে-মুখে অতি আগ্রহ নিয়ে জানায়,

-জলপ্রপাতটার উপরে বড় বড় দুটো পদ্ম গোখরা সাপ ছিল এক সময়। পুরুষ সাপটার নাম মাধব, আর স্ত্রীটার নাম ছিল মাধবী। একদিন সে মাধবের উপর অভিমান করে জলপ্রপাত বেয়ে নিচে নেমে আসে। তখন সময়টা ছিল বিকেলবেলা। তো মাধবীকে তখন একজন মানুষ কুণ্ডলী পাকানো অবস্থায় প্রপাতটার নিচে দেখে ফেলে এবং ‘সাপ’, ‘সাপ’ বলে চিৎকার করে। তখন মাধবী মানুষের আওয়াজে ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করতে শুরু করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা ছেড়ে চলে যায় না। এরপর কিছু মানুষ বড় বড় লাঠিসোঠা এনে জড়ো হয়। কিন্তু সাপটা তখনো দূরে জলপ্রপাতের নিচে থাকার ফলে লাঠি দিয়ে কেউ তাকে মারতে পারে না। এরপর সেখানে এ এলাকার মাতব্বর তার বন্দুক নিয়ে সাপটাকে গুলি করে। আহত অবস্থায় তড়পাতে তড়পাতে সাপটা আবার উপরে চলে যায়। সবাই তখন মাতব্বরকে আফসোসের ধ্বনি তুলে বলে, এটা কী করলেন উনি যে সাপটাকে পুরো মারতে পারলেন না। আহত অবস্থায় সাপকে ছেড়ে দিলে সে সাপ রাতে এসে মরণ কামড় দিয়ে যায়। এ ঘটনা ঘটার পরদিন থেকে সেই মাতব্বরকে আর কোথাও দেখা যায়নি। আর সেই দিনের পর থেকে প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেল থেকে মধ্যরাত্রি হাহাকার জড়ানো একটা কান্না শোনা যায়। সেটা হচ্ছে মাধবের কান্না। সঙ্গী হারানোর আত্মা-ফাটানো বেদনা। এ মাধবের নামেই এ জলপ্রপাতের নাম হয়েছে মাধব জলপ্রপাত। কিন্তু বাইরে থেকে যারা জলপ্রপাতটা দেখতে আসে তারা  মনে করে এটা জল পড়ার মধুর সুর।

হোটেলের কর্মচারীটির মনে হল গল্প বলে আনন্দ লাভ করার একটা স্বভাব আছে। সে আরো যোগ করে যে, এখানে আসার তার দুই বছর হল। এর মধ্যে প্রতিদিন সে কান্নাটা শুনতে পায়। মাধব এখনো সুযোগ খোঁজে প্রতিশোধ নেওয়ার। তাই প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেল থেকে নিশীথ রাত পর্যন্ত জলপ্রপাতের আশেপাশে ঘুর ঘুর করে। তখনই ঐ আর্তনাদটা শোনা যায়।

আরেক পুরানো কর্মচারীও গল্প বলায় কম যায় না। আনিলার কাছে নিজের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে দেখে সেও এই গল্পটাই স্থানীয় ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে বলেছে। শুধু জলপ্রপাতের জলকে মাধবের অশ্রুপ্রপাত বলেছে। পড়ন্ত বিকেল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত যে কান্না করে সেটাই চব্বিশ ঘণ্টা ধরে ঝরে পড়ে জলপ্রপাত হয়ে। আঁধার যত ঘনিয়ে আসে কান্নার শব্দ ততই গভীর হয়। আর মাতব্বরের জায়গায় সে এক শিকারীর উল্লেখ করেছে। সেই সাথে বলেছে মাধবীকে গুলি করার সময় তার দাদাও জনস্রোতের মধ্যে ছিল।

তার ‘দাদা’ সেখানে ছিল শুনে প্রথম কর্মচারী কটাক্ষ করে বলে,

-তোর দাদা মনে হয় আদম-হাওয়ার গন্ধব খাওয়ার সময়ও সেখানে ছিল। সব জায়গায় তো তোর দাদাকে সাক্ষী গোপাল হিসেবে থাকতে দেখা যায়। তোর দাদী ছিল না সাথে?

এটা বললে তখন সে শুধু কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায়। আর আনিলা মুখ টিপে একটু হাসি দিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।

একই জিনিস এহেক হাতে রান্নার ফলে যেমন এহেক স্বাদ আস্বাদিত হয়, তেমনই একই গল্প বা ঘটনাও ভিন্ন মুখে ভিন্ন শোনায়। কেউ গল্পটাকে অতিরঞ্জিত করে বলে, কেউ মূল গল্পের মধ্যে কৌশলে অন্য ঘটনা ঢুকায়, আবার কেউ-বা নিজেকে গল্পের একটা অংশ করতেও ছাড়ে না।

এখন বিকেলটা চলে গেছে। সন্ধ্যা নেমেছে আঁধারকে কোলে নিয়ে। পর্যটকদের সংখ্যাও অনেকটা কমে গেছে। সব সংস্কার, বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে আনিলা সুরের উৎস খুঁজতে মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভাবছে কালকে দিনের বেলায় হয়ত যাওয়া যাবে। কিন্তু তাতে জীবন থেকে একদিন পিছিয়ে পড়বে। এখনই একবার চেষ্টা করে দেখা যাক। তবে একজন নির্ভরযোগ্য গাইড নিতে পারলে ভাল হয়।

হোটেলে ফোন করে একজন গাইড পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে ওপাশ থেকে আতঙ্কভরা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সতর্কবাণীও আসে,

-ম্যাডাম, ভুল করেও ওদিকটায় যাবেন না। ওখানে কেউ যায় না। যে কয়জন গেছে এখন পর্যন্ত কেউ ফিরে আসে নাই। একবার…।

আবার কাহিনি বলা শুরু করলে আনিলা শুধু ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’ বলে ফোনটা কেটে দেয়।

***

চিন্তিত হয়ে পড়ে আনিলা। উপরে যাওয়ার উপায়টা কী? উপায় জানলে অন্ধকার, কুসংস্কার ও লোকভয়কে সে কখনো আমলে নেয়নি। আশেপাশে একটা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কেউ কোনো উপায় বাতলে দিতে পারে কিনা। কিন্তু মনে হয় তেমন কেউ নেই এ ব্যাপারে সাহায্য করার। সবাই ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। আঁধারে একা একা পথ খোঁজাও মুশকিল, গন্তব্য তো দূরের কথা। এত কিছু ভাবার পর শেষে আজকের মতো কৌতূহলকে দমন করে সে। কালকে সকালে প্রথমেই একজন সাহসী গাইড বের করতে হবে।

উপায়হীন হয়ে আনিলা সিদ্ধান্ত নেয় হোটেলে যাওয়ার বিপরীত দিকের রাস্তাটায় একটু ঘুরে আসার। কারণ এখন হোটেলে ফিরে তেমন লাভ নেই। তার চেয়ে বরং যতটুকু পারা যায় ততটুকু আশপাশটা আরো অনুসন্ধান করে দেখা যাক। তবে ওদিকটায় গাড়ি যাবে কিনা বা গেলে কতদূর পর্যন্ত যাবে সেটা কাউকে জিজ্ঞেস করে জানা যাক। সে একজনকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর পায় যে, বেশি দূর যাওয়া যাবে না গাড়ি নিয়ে। আর বোনাস হিসেবে পায় আতঙ্কের বাণী,

-ওদিকটায় এমনিতেই কেউ যায় না। আর সন্ধ্যার পর যাওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারে না।

লোকজনের ভিড় কমার সাথে সাথে সুরটা এখন আরো কিছুটা ভারী, গভীর ও মর্মভেদী হয়ে উঠেছে। যতক্ষণ সেটা শোনা যায় ততক্ষণ সে শুনতে চায়। তাই গাড়ির জানালা কিছুটা খুলে রেখে  গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়। যতই দূরে যাচ্ছে সুরটা ততই মিইয়ে আসছে। গাড়ি এবার ধীরে ধীরে চালায় সে একটা সীমাচিহ্ন বের করার জন্য যেখানটার ওপারে সুরটা আর শোনা যাবে না। যেতে যেতে এক সময় সে সুরটা আর শুনতে পায় না। গাড়িটা রাস্তার পাশে পার্ক করে পিছনে হাঁটতে শুরু করে। পোকামাকড় উৎপাত করা শুরু করে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো আরো কিছু পোকা ডাকছে। এগুলো উপেক্ষা করে সে ঠিক সুরসীমাটি খুঁজে পায়। নিশ্চিত হওয়ার জন্য এক পা এগোয়, আবার এক পা পিছায়। এভাবে একেবারে নিখুঁত অবস্থান নির্ণয় করে।

কিন্তু সামনের দিকে পা ফেললে সুরটা না শোনা যাওয়ারই কথা। সেখানে সে যখন সামনের দিকে পা দিচ্ছে, তখনো সুরটা শুনতে পাচ্ছে। আগের সুরটার মতোই সর্পিল ভঙ্গি আছে আরোহণ ও অবরোহণে। এ অবস্থানে সুরটার মেজাজ ও ভাবরস যদিও অনেকটা একই অনুভূত হচ্ছে, তবুও পুরাটা নিখুঁত লাগছে না এবং তুলনামূলক কম আয়তনের মনে হচ্ছে।  আরো মনোযোগী হয়ে ওঠে সে। ভেসে আসা সুরটার মধ্যে একটু ঊনতা কানে বাজছে।  তার মানে এখন দুটো সুর উৎসের মিলিত বিন্দুতে অবস্থান করছে সে। যেন নদী ও সাগরের মিলিত বিন্দু মোহনায়।

সাগরকে পেতে হলে নদীকে আগে জানতে হবে যেহেতু সাগর অর্থাৎ মাধবের সুরটার কাছে পৌঁছানোর সঠিক রাস্তা আপাতত তার জানা নেই। মোহনা থেকে তাই নদীর দিকে যেতে প্রস্তুতি নেয় সে। পৃথিবী গোল—এ সত্যের উপর ভিত্তি করে কলম্বাস যেমন ভারতবর্ষ যাওয়ার লক্ষে বিপরীত দিক দিয়ে যাত্রা করেছিলেন, আর আবিস্কার করেছিলেন আমেরিকা মহাদেশকে, আনিলার এ যাত্রাটাও অনেকটা সে রকমই। কিন্তু এদিকটায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট প্রশস্থ রাস্তা নেই। মনে হয় এ উৎসটা খুঁজে পেলে ভারতবর্ষ না হোক আমেরিকার মতো মহাদেশ মেলার সম্ভাবনা আছে। অথবা কে জানে মাধবের সুরভাণ্ডার রূপী ভারতবর্ষ যাওয়ারও উপায় মিলতে পারে। তাই দুই সুরের মিলিত বিন্দুতে গাড়িটা রেখে এবং হাতে টর্চলাইট ও হাত ব্যাগটা নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে।

শব্দ শুনে শুনে এর উৎস খোঁজার ক্ষেত্রে আনিলার বিশেষ দক্ষতা আছে। আর শব্দটা যদি হয় সঙ্গীতের, তবে তার জন্য তা আরো সহজ। ঠিকই গন্তব্য খুঁজে নেয়। লক্ষ্যবস্তু ভেদ করতে পটু একদম পুরাণের তীরন্দাজ একলভ্যের মতো।

কচি কচি ধানক্ষেতের মধ্যে চিকন চিকন আইল দিয়ে সর্পিল সুরের উৎস পথে হাঁটতে শুরু করে সে। শহরের আলো-হাওয়ায় বড় হলেও অনেক বেশি ভ্রমণ করার দরুন গ্রামের কোণা-কাঞ্চি ধরে হাঁটার পুরানো অভ্যাস আছে আনিলার। তাই এসব আইলে নতুনদের মতো পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তার নেই। তবু সে সাবধানে হেঁটে চলছে।

দু’একটা ব্যাঙের লম্ফঝম্প, পোকামাকড়ের চিঁ চিঁ ডাক, মাঝে মাঝে দু’একটা পেঁচা ও শিয়ালের ডাক এবং অবিরাম ভেসে আসা সুরটা ছাড়া আর কোনো কিছুর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। কোনো মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না দৃষ্টিসীমার মধ্যে। হাঁটতে হাঁটতে ভেসে আসা সুরটার আয়তন আরো একটু ভারী শুনতে পায় সে। অনুমান করে এখান থেকে দূরত্ব হবে এক কিলোমিটারের মতো।

এ দূরত্বে দেখে একটা ঝোঁপ। আর এর থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরত্বে একই জাতের কিছু গাছ একটা সারি হয়ে দাঁড়ানো। মনে হচ্ছে এ সারি থেকে সুরলালিত্য ভেসে আসছে। আর একটু এগোতেই দেখতে পায় চারটি সারি মিলে একটা আয়তক্ষেত্র তৈরী করেছে।  এর মধ্যে চারকোণা ঘরের মতো কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটা কিসের তৈরী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পূর্ণিমা রাত হলে হয়ত আঁচ করা যেতো। ঘরটা থেকে আলোর আভাও চারপাশে পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। এটা যে বিদ্যুৎ বাতির আলো নয় সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। তবে মোম বা কেরোসিন তেলে জ্বলা কূপ জাতীয় কিছু একটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর সে ঠিকই বুঝতে পারছে এ ঘরটিই ভেসে আসা সুরটির উৎস।

হাঁটতে হাঁটতে ঘরটির একেবারে কাছে এসে দাঁড়ায় সে। সারির গাছগুলো আম গাছের মতো বৃক্ষ কিংবা বট গাছের মতো মহীরূহ নয়, আবার চারাগাছও নয়, তবে বেশ লম্বা। টর্চ মেরে আঁতকে ওঠে আনিলা। গলা শুকিয়ে আসে। এ কী? গাছগুলোর সারা শরীরে দশ থেকে বারো ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এবং এক সেন্টিমিটার প্রস্থের মোটা মোটা পেরেক মারা। সারিটা তবু দুলছে বাতাসে। আনিলা এ গাছগুলোর নাম জানে না।

হাত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে কয়েক ঢোক গিলে নেয় সে। এরপর গাছগুলোর মর্মন্তুদ দৃশ্য ভুলে গিয়ে মনোযোগ দেয় ঘরটির দিকে। ঘরটাকে শণের তৈরী লাগছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছুঁয়ে দেখে আসলে শণ নয়। ইরি ধানের খড় দিয়ে তৈরী। দরজাটা  তার ঠিক সামনা বরাবর নয়। এখান থেকে বের হওয়ার মতো দুই দিক দিয়ে জোড়া আইল যা আসলে স্কীমের আবাদের সময় পানি প্রবাহের জন্য ব্যবহৃত হয়, আর যাকে ড্রেন বলাই উত্তম সেগুলো ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই।  পঞ্চাশ ফুট দূরত্বে ঝোপটাকে দোকানের টবে রাখা এক গুচ্ছ রজনীগন্ধার মতো আকারে দেখা যাচ্ছে। ছোট টর্চলাইটের আলোয় পুরোটা স্পষ্ট দেখা যায় না। বরং সে আলো নিক্ষেপের পর চোখে  কিছুক্ষণ আঁধার নেমে আসে। এক মিনিট পর চোখদুটো প্রসারিত করে দেখে এটা বাঁশবন। বাতাসে ভাসা সুরটার ছন্দে ছন্দে বনের পাতাগুলো যেন এপাশ-ওপাশ দুলছে।

আনিলা দরজার খোঁজে ঘরটির ওপাশে চলে যায়। এখানেও একই গাছের সারি এবং একই করুণ অবস্থায়। তখনো মধ্যরাত্রি হয়নি। সুরটা যেন সিডি প্লেয়ারের মতো করে এখনো বেজেই চলছে। আনিলা ভাবে কোনো মানুষ যদি এ সুর বাজাত, তাহলে অনবরত বাজানোর কথা নয়। বাজাত, বিরাম নিত, আবার বাজাত।

ঠিক এপাশেই একটা বন্ধ দরজা পেয়ে যায় আনিলা। বেড়ার মধ্যে ছিদ্র খোঁজার জন্য  ঘরের চারপাশটা একবার প্রদক্ষিণ করে আবার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু তার দৈহিক উচ্চতায় বেড়ার মধ্যে কোনো ফাঁক-ফোকর দেখতে পায় না সে যাতে করে তার মধ্য দিয়ে ভেতরটা এক নজর দেখে একটা ধারণা লাভ করতে পারে—এতে মানুষ নাকি কোনো অতিপ্রাকৃতিক কিছু আছে যা সুরটা অনবরত বাজিয়ে যাচ্ছে।

ভ্রমণ করা তার সুর সাধনা ও সুর সৃষ্টির মতোই নিত্য সঙ্গী। তাই টর্চলাইট ও ছোটখাটো চাকুর মতো টুকটাক প্রয়োজনীয় কিছু সব সময়ই সে তার ব্যাগে রেখে দেয়। সেখান থেকে চাকুটা বের করে দরজার ডান পাশে এক ফুট দূরত্বে একটা ছিদ্র করার জন্য খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করে। এতে বেড়ার ঐ জায়গাটায় হালকা একটা খড়খড় আওয়াজ হয়। সুরটা তখন হঠাৎ থেমে যায় ঠিক অচেনা শব্দে পাখির গান যেভাবে আচমকা থামে। আনিলা তখন চাকুটা সাবধানে বের করে নিঃশব্দ হয়ে থাকে। এক মিনিটের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। সুরটা আর বাজে না। কোনো সাড়াশব্দও নেই।

সুরসাধকেরা মনে হয় শব্দের প্রতি খুব বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। তবে এ সাধক যেই হোন না কেন, অনধিকারবশত তার ধ্যান ভাঙ্গার জন্য আনিলা কিছুটা অপরাধ বোধে ভোগে। কারণ ধ্যান কিংবা সাধনার মাহাত্ম্য সে বোঝে। তবে এখন কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। দরজায় করাঘাত করবে? নাকি ‘ভেতরে কেউ কি আছেন’ বলে ডাক দেবে?

খড়ের বেড়ায় চাকু ঢুকাতে পারলেও দ্বিধার বেড়ায় কেন জানি তা পারে না আনিলা। আবার এতদূর এসে কোনো অর্জন ছাড়াই ফিরে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না।

এ রকম দ্বিধা-দ্বন্দের সাথে যখন সে লড়াই করছে, তখন তার মনে হলো একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো। স্বরটা আবার শুনতে কান খাড়া করে থাকে কিছুক্ষণ। না, কিছুই তো শোনা যায় না। মনের ভুল ভেবে বিষয়টা থেকে সে মন তুলে নেয়।

***

‘ভেতরে আইসতে কইছি। দর্জা খোলা আছে।‘—অপরিচিত স্বরভঙ্গিতে ভেতর থেকে কেউ বলে ওঠে। এবার আনিলা তা স্পষ্ট শুনতে পায়। একজন পুরুষের কণ্ঠ এবং তা ঘরের ভেতর থেকেই উচ্চারিত। এ রকম আকস্মিক স্বরভঙ্গি এই নির্জন আঁধারে তাকে বেশ ভীত-সন্ত্রস্ত করে সন্দেহ নেই।

দ্রু-দ্রু বুকে আনিলা দরজাটা বাহিরের দিকে টান দিতে শুরু করে। খুলেই দেখে প্রদীপের শিখায় আলোকিত জট পাকানো কালো চুলের লালচে প্রান্ত। ভেতরে একটা গুমোট গন্ধ। মুখখানি তার বিপরীতে থাকায় দেখা যাচ্ছে না। তবে মধ্যবয়স্ক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মেঝেতে পাতলা গেরুয়া রঙের একখানা কাপড়ের উপর পদ্মাসনে বসা। দু’পায়ের ঊরুতে হাতদুটো কী যেন ধরে আছে। খুব সম্ভবত ইনিই সর্পিল সুরের যন্ত্র বাজাচ্ছিলেন এতক্ষণ এবং সেটাই এখন তার হাতে অলসভাবে পড়ে আছে।

মুখ না ফিরিয়ে এবং কোনো রকম নড়চড় না করে লোকটি আনিলাকে অভয় দিয়ে বলেন—ডর পাইবার কারণ নাই। সামনে বাড়ান। আর দর্জাটা লাগাইয়া দ্যান।

দরজা বন্ধ করে তখনো কিছুটা ভীত-সন্ত্রস্ত আনিলা লোকটির ডান পাশে এসে দাঁড়ায়। খাট, চৌকি বা চেয়ার বলতে কিছুই নেই। মেঝেতে খড় বিছিয়ে তার উপর কাঁথা রয়েছে লোকটির বাম পাশে। তবে বালিশ নেই।

আনিলাকে বসতে বলার মতো লোকটির মধ্যে কোনো ভদ্রতা জ্ঞান দেখা যায় না। তবে আনিলা তার ধ্যান ভাঙ্গানোর জন্য খুবই দুঃখপ্রকাশ করে। কিন্তু লোকটি এসবের ধার ধারেন না। শুধু এর সূত্র ধরে বলে ওঠেন,

-আইজকে এক ঘন্টা আগে সুরটা থামাইয়া দিতে হইলো। তয় এমনিতে কখনো থামাই না নিশি রাইত না হওয়া পযন্ত।

আনিলা লোকটির সাথে কথা চালিয়ে যাওয়ার সূত্র খুঁজে পায় যেন। এতক্ষণে অনেকটা ভয় উবে গেছে তার। সে সোৎসাহে জিজ্ঞেস করে,

-থামিয়ে দিলেন কেন? আমি ব্যাঘাত ঘটিয়েছি সে জন্য?

-হম।

-আমি আবারও খুবই দুঃখিত। কিন্তু আমি যদি চোর হতাম, তাহলে…?

-সেইটাও হইতে পাইরতেন। এইখানে আইসতে পারে দুই কিসিমের মানুষ। চোর না হয় সাধক। চোর আইসবার সম্ভাবনা এক্কেবারে নাই। কারণ এই এলাকাত যত্তগুলা চোর আছে ব্যাবাকে জানে এ ঘর থাইকা নেওনের মতন কিছু নাই। আর আপনে যেইভাবে আওয়াজ করতেছিলেন, চোর হইলে সেইটা কইরতো না। মোর আন্দাজ আপনে সুর ভালা পান বইলাই এই একলা রাইত পারি জমাইছেন। শুদু সেটাই নয়। আপনে আধ্যাত্মিকও। সেটা না হইলে আপনের এ সমে এ নির্জন ঘরত আসার কোনো কথাও না। সাধকদেরকেই শুদু এ রকম অদ্ভূত কাম কইরতে দ্যাখন যায়। মুইও কইরাছিলাম মোর গুরুকে খুঁইজা পাবার জইন্যে। সুরের লগে আধ্যাত্মিকতার একটা অচ্ছেদ্য সম্পোক্ক আছে। সুরটাই কিন্তুক বস্তুর আধ্যাত্মিকতা। আর  এটাকেই মুই কই ঈশ্বর। জীবনের কোনো না কোনো সমে ঈশ্বরের নিকট ব্যাবাকে নিজকে সারেন্ডার কইরা দেয়। শুদু রূপটা আলাদা। কেহ পিতৃপুরুষের ঈশ্বরের নিকট, কেহ নিজের বোধের ঈশ্বরের নিকট। তয় বোধের ঈশ্বরের লগে প্রচলিত ঈশ্বরের পুরা মিল পাইবেন না। আবার বোধ থাইকা বোধেও সেইটা পাল্টাইয়া যায়।

একই ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে বসা অবস্থায় এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে যান লোকটি। আনিলার সাঙ্গীতিক বোধের সাথে বেশ কিছু বিষয় মিলে যায়, যদিও খড়ের এই ঘরে সঙ্গীতের দার্শনিক কথাবার্তা আশা করেনি আনিলা। সে এসেছিল শুধু উৎস খুঁজতে। কিন্তু এখন জানতে শুরু করেছে উৎসের উৎসও।

লোকটার দার্শনিক উচ্চারণে অনেক গভীরে হারিয়ে গিয়েছিল আনিলা। লোকটা কিছুক্ষণ থামলে এতক্ষণ পর সে খেয়াল করে তার হাতের জাদুকরী যন্ত্রটা। এক ফুটের মতো লম্বা একটা মুরলী। লোকটাকে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু উনি মনে হয় বলেই বেশি স্বস্তি পাচ্ছেন। লোকটি আবার বলতে শুরু করেন,

-আপনার লগে এত গুপ্ত কথা কইতেছি ক্যান জানেন?

-ঠিক জানি না। তবে আমার খুব ভাল লাগছে আপনার কথা শুনে।

-মোদ্দা কারণ আন্ধার রাইতে আপনে নিজে এই ভয়ঙ্কর জাগাটাত আইছেন শুদু সুরকে ভালবাইসা এই জন্যে। এর আগেও ম্যালা সুরপক্ষী আশপাশ থাইকা ঘুইরা গ্যাছে। কিন্তুক তাদের মইদ্দে আধ্যাত্মিকতা ছিল না। সেই জন্যে এদ্দূর পযন্ত পৌঁছাইতে পারে নাই। তয় তাতে কী? তাদের যা পাইবার পাইছে। কেহ চিনি পাইলেই খুশি, কেহ-বা মধু। খুব কমই আছে সুধা খুঁইজতে চায়। মাধবের সুরটাত যে সুধা আছে সেইটা ব্যাবাকে পায় না। শুদু যারা সুরসাধক এবং একই লগে আধ্যাত্মিক, তারাই শুইনতে পায়। তয় সেইটারে ধইরতে ম্যালা সাধন লাগে। আপনে যে সুর শুইনা এ জাগাত আইছেন, সেইটা সুরপক্ষীরা এট্টু অদল-বদল কইরা ভালাই নাম কইরা ফ্যালাইছে। ব্যাবাক খবর পাই। কিন্তুক ওরা পুরাটা পায় নাই। পাইবেও না কখনো।

অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছেন লোকটি। আনিলা তার কথা সুবোধ বালিকার মতো শুনেই যাচ্ছে নিষ্ঠার সাথে। তার সারা জীবনের সুরসাধনার ঘণীভূত ফোয়ারার উৎসমুখে যেন এখন সে। লোকটি আবার শুরু করেন প্রশ্ন দিয়ে,

-সুরকে কখনো ধরা যায়? ছোঁয়া যায়? ঈশ্বরের এত এত প্রাত্থণা, এত নাম জপা, তেবু তাকে কি কেহ দেইখতে পাইছে কখনো। শুদু অনুভব, বোধে তার বাস। এ জন্যেই মুই কম বোধের ঈশ্বর। মাধবের সুর তেমনটাই। ঐ সুরশিল্পীকে কেহ কখনো দ্যাখে নাই। দেখতেও পাইবে না কখনো। শুদু দূর থাইকাই মাইনষে নিজের মতন কল্পনা কইরা কাহিনি বানাইয়া নিছে নিজের স্বার্থমতন।

মাধবের কথা শুনতেই আনিলার মনে পড়ে তার অভিযানের মূল উদ্দেশ্যের কথা। এতক্ষণ সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। আবারও মাধবের সুর রহস্য ও এর সীমান্ত থেকে লোকটির বাজানো সুর শোনা এবং এখানকার সারিবদ্ধ গাছগুলোর গাঁয়ে পেরেকবিদ্ধ অবস্থার কারণসহ অনেক প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি মারে তার মনে। কিন্তু লোকটির কথা বলার স্রোতধারায় এখন বাধ সাধতে চায় না সে।

লোকটা বিষয়ের গভীরে গিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে কথা বলতে পারেন। বেশিরভাগ মানুষেই যেটা পারে না। আবার অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্নও। তাই নিজ থেকেই আনিলাকে জিজ্ঞেস করেন,

-আপনের মনের মইদ্দে ম্যালা প্রশ্ন বিড়বিড়াইতেছে, না?

প্রশ্নটার উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলার সুযোগ না দিয়ে লোকটা নিজেই আনিলার মনের ভেতরকার প্রশ্নমালার উত্তর দিতে শুরু করেন,

-এই ঘরত ঢুকার সমে যে সারিবদ্ধ গাছগুল্যা দেইখছেন, সেগুল্যার নাম হইলো আতর গাছ। ম্যালা মাইনষে আগর গাছও কয়। এদের নাম মুইও জাইনতাম না আগে। জাইনতে পাইরছি মোর যৌবন যখন কড়া নাইড়া ম্যালা পথ চইলা গ্যাছে তখনে। আর ওদের গাঁয়ে যে পেরেক মারা দেইখছেন, সেগুল্যাই মাইনষের কাছে ওদের বাঁইচা থাকার নিষ্ঠুর সিদ্ধি। বড় হইলেই ওদেরকে পেরেক দিয়া ফুইটা কইরা বিঁইধা রাখে। সেই জন্যে বড় হবার সাত-সাথে বড় বড় ফাটল তৈরী হয়। এটাই দরকার মাইনষের। তাতে কইরা এগুল্যার রস ম্যালা ঘন হয়। বড় সুগন্ধিও হয়। তাতে দাম ম্যালা হয়।

একটুখানি নীরব হয়ে যান লোকটি। তার নতুন নতুন কথায় নিজের সব প্রশ্ন হারিয়ে ফেলে আনিলা। লোকটার সব কথা হজম করতে মনোযোগ দেয় সে। লোকটি আতর গাছগুলোর সাথে নিজের জীবনের যোগসাধন করে আবার বলতে থাকেন,

-এই আতর গাছগুল্যার লগে মোর জীবনের মিল আছে।(একটু নীরবতা) সেই জইন্যে এইখানে ড্যাড়া বানাইছি। যুদিও দিনের ব্যালা মুই এইখানে থাকি না। (এক মিনিট নীরবতার পর) পোত্তেক জীবের মইদ্দে একটা বড় শক্তিশালী তাড়না থাকে। সৃষ্টির আদি থাইকাই এইটা চইলা আইসতেছে। এইটাই ব্যাবাক সৃষ্টির মূলে। সেইটা জৈবিক সৃষ্টি হউক আর আত্মিক সৃষ্টি হউক। এই তাড়না যুদি কেহ স্বাভাবিক ধারায় মেটাইতে না পারে, তখনে দেখা যায় বিপর্যয়। সেই বিপর্যয় সব সমে যে খারাপ ফল আনে, তা নয়। ভালা ফলও আইনবের পারে। তয় ভালা ফল আইনতে হইলে তাড়নাটা যখনে অতৃপ্ত থাকে, তখনে তার মোড় ঘুরাইয়া দিতে হয় অন্য যা কিছু সৃষ্টি কইরতে চান সেইটার দিকে। তাড়নার মোড় ঘুরাইতে শুদু মাইনষে পারে। অইন্য জীব পারে না। আবার ব্যাবাক মাইনষেও পারে না। কেহ কেহ পারে। তয় অত্ত সহজ না। সেই জইন্যেও সাধন লাগে। মোর তাড়নাক মুই সুর সৃষ্টি ও মুরলীত সেইটা ধইরব্যার কামে লাগাইছি। তয় আবেগটা তেমনই আছে। ইচ্ছে কইরা যে এইটা করছি তা না। কেহ এইটা ইচ্ছা কইরা কইরতে পারে না। পরিস্থিতিতে পইড়া মুই বাদ্য হইছি। আপনে যুদি বাঁচন-মরণের মতন কোনো কঠিন সমস্যায় পইড়া যান কখনো, আর যুদি হার না মাইনা উইতরানোর পরাণপণ চেইষ্টা কইরা যান, তাইলে দেইখবেন আপনেও কিছু একটা পাইয়া গেছেন। তো মুই ওই মতন মোর তাড়নাক রূপান্তরিত শক্তিতে পরিণত কইরা ফ্যালাইছি।  জীবাশ্ম জ্বালানির লগেও এটার মিল পাইবেন। এইটা এক সমে জীবন্ত একটা শক্তি আছিল। এটাক ব্যবহার কইরব্যার সমেও ম্যালা সাবধান থাইকতে হয়। কারণ একবার আগুন লাইগলে শেষ না হওয়া পযন্ত জ্বইলতেই থাকে। জ্বইলা জ্বইলা নতুন শক্তির সৃষ্টি করে। সেই শক্তিকে  যে যেইভাবে কামে লাগায় তার উপরে নির্ভর করে এইটার নাম। ম্যালা বঞ্চণা থাইকা সৃষ্টি বইলা এইটার মইদ্দে দরিয়ার লাহান হাহাকার থাকে। সেই হাহাকার ধ্বনি থাইকা সুকরুণ অথচ সুমধুর সুর বাইর হইয়া আসে। যেমনটা আতরের গা থাইকা রস আকারে বাইর হয়। এই গুপ্ত কথা আপনেরে কইলাম আপনে সত্যিকারের সাধক বইলা। এই ব্যাপারটা টাউট বেইন্নারা জানে। কিন্তুক তারা সৃষ্টি কইরতে পারে না। যে কইরা ফ্যালায়, নিজের লাভের জইন্য তার উপ্রে আতর গাছের মতন নির্যাতন করে। সুর আদায় করার জইন্যে মোকেও নিষ্ঠুরতম আঘাত হানে। তখন মোর কান্না থাইকা যে সুর বাইর হয়, সেটাই হয় তাদের হাসি। মোর ধ্বংসস্তূপে তারা গইড়া তোলে নিজের সুখসাম্রাজ্য। আর এটাই তারা চায়।

লোকটা এতটুকু সময়ে আনিলাকে এত গভীর গভীর কথা জানিয়েছেন যে তার সম্পর্কে আনিলা একটা ভাল, নির্ভরযোগ্য ও বোদ্ধা মানুষের চিত্র তার মনের মধ্যে এঁকে ফেলে। ভাবে যিনি নিজ থেকেই এত কিছু বলছেন, তাকে প্রশ্ন করাই যায়। তাছাড়া এ রকম সুযোগ জীবনে আর নাও আসতে পারে। সে লোকটির সাথে এবার দ্বিধাহীনভাবে কথা বলার আত্মবিশ্বাস লাভ করে। প্রশ্ন করে,

-আপনি তো জানেন সবকিছু। সুর বাজানো থামিয়ে দিলেই তো পারেন। তাহলে ওরা আপনাকে আগর গাছের মতন নির্যাতন করতে পারবে না।

-না, তা করন যায় না। এইটা এক কিসিমের রোগ। এইটার থাইকা রেহাই নাই। মুই ম্যালা চেষ্টা কইরা দেখছি। কোনো ফায়দা হয় নাই। এই রোগ যাদের আছে, তাদের আর কোনো উপায় নাই। এটাই মোর ভবিতব্য। সেই সুযোগটায় লয় ওরা। তয় এটা রোগ হইলেও এইটার মইদ্দে দুঃখ-কষ্টের আরোগ্য সিদ্দি আছে।

আনিলা এ নিয়ে আর প্রশ্ন করে না। লোকটিকে তার মনে ধরেছে। তাই মিনতি করে জানায়,

-আপনার সব কথা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। আরো অনেক কিছু জানার আছে আপনার কাছে। ধীরে ধীরে সব জানার ইচ্ছা আমার। কিন্তু সেটা করতে হলে আপনাকে আমার গুরু মানতে হবে। এখন থেকে আপনাকে আমার গুরু স্বীকার করছি। আশা করছি আপনি সম্মতি দেবেন।

এর উত্তরে তার গুরু কোনো কথা বলেন না। আনিলা আরো যোগ করে,

-আপনার বাজানো সুরটা যে বিন্দুতে শেষ হয়েছে সেখান থেকে মাধবের সুরটা শুরু হয়েছে। এটার রহস্য আমি বুঝিনি।

গুরু এবার একটু নড়েচড়ে বসেন। হাতের মুরলীটা বেড়ার মধ্যে গুঁজে রাখেন। কিন্তু আনিলার দিকে মুখ ফেরান না। এত নিগুঢ় আলোচনা হচ্ছে অথচ কেউ কারও মুখ দর্শন করেনি এখনো।

গুরু আনিলার প্রশ্নের উত্তর দেন,

-মাইনষে যা-ই কইতে থাইক, মাধবের সুরটার উৎস কিন্তুক কেহ বাইর কইরতে পারে নাই। সেই সুরটার মতন সুর তোলাই মোর সাধনা। পোত্তেক পূর্ণিমায় সুরটা বইদলে যায়। বাইজতে থাকে এক মাস পযন্ত। মুই চেষ্টা চালাই হুবহু সুরগুল্যা তোলার। এ্যাখনো সবগুল্যা নিখুত তুইলতে পারি নাই। মাধবের সুরটা মাঝ রাইতে যখন থাইমা যায়, তখনে মুইও থাইমা যাই। সেই সুরটা যিনি বাজান, তাকে মুই গুরু মানি। সেইজন্যে গুরুর সুর যদ্দুর শোনা যায়, তদ্দুর মোর সুর য্যান না শোনা যায়। আবার গুরুর সুরের ব্যপ্তি থাইকা বেশি দূরে যাইয়া য্যান গুরুর লগে দূরত্বটা বেশি বাইড়া না যায়। এইটা একই লগে গুরুক ভকতি জানানো ও নিজকে উন্নত করার জইন্যে মোর নিজের গড়া তরিকা।

আনিলা একে একে অনেক রহস্যই জানতে পারল এতক্ষণে। কিন্তু যিনি এত সব রহস্যের ভারী ভারী পর্দা একটার পর একটা নিজ থেকেই সরিয়ে দিলেন, তার মুখটাও দেখা হল না, নামটাও জানা হল না এখনো। তিনিই যেন এখন সাক্ষাৎ জীবন্ত রহস্য। আনিলা তাই তার কাছে প্রথমে নিজেকে উন্মোচন করার চেষ্টা করে। বিনয়ের সাথে বলে,

-আমার নাম আনিলা।

গুরু তাকে সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দেন এই বলে,

-মুই আপনাক চিনি। আপনের শখ, পেশাও জানি।

আনিলা আবারও বিস্মিত হয়। বাইরের যে কোনো বিষয়ে একজন গভীর জ্ঞান ও বোধ লাভ করতে পারেন। কিন্তু তার নিজের বিষয়ে অচেনা কেউ যদি বলেন ‘মুই আপনাক চিনি, জানি,’ তখন অবাক হতে হয় বৈকি! এ বিস্ময়কে আড়াল করে সে গুরুকে অনুরোধ করে,

-গুরুজী, আপনার নামটা যদি আমাকে একটু বলতেন!

-মোর নাম শুইনলে তো, আবার মোর মুখ দেইখতে চাইবেন। মুখ দেখা হইয়া গ্যালে মোর বিত্তান্ত জাইনতে চাইবেন। এ্যাতো কিছুর দরকার কী? আপনের যা যা জাইনবার দরকার আছিল, কৌতূহুল আছিল তা মুই মোর সাধ্যমতন বলার চেইষ্টা কইরেছি। এতেই ক্ষান্ত থাইকেন। মোর নামটা আপনের কানে সুন্দর লাইগবে না। অইন্য কিছু আরো বিশ্রী লাইগবে। এই সবের ভারও সইতে পারবেন বইলা মনে হয় না।

-ও কথা বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না। আপনার পায়ের ধূলা নিতে চাই আমি। আপনার সঙ্গে যতটুকু সময় কাটালাম ততটুকু সময় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এত অল্প সময়ে যে আপনি আমার মনে গভীর স্থান করে নিয়েছেন, সেটা এর আগে কেউ পারেনি। এতে আমি নিজেকে অনেক ধন্য মনে করছি। এবার দয়া করে আমাকে গ্রহণ করুন। আপনার নামটা আমাকে শুধু একবার বলুন। যে নাম স্মরণ করে আমি রোজ সঙ্গীত সাধনা করব।

-বেশি জিদ সব সমে ভালা না।

আনিলা এবার বুঝতে পারে যে গুরু তাকে মন থেকে গ্রহণ করেনি। এমন উপলব্ধি অনেক দিন পর তার ভেতরটাকে কান্নার স্রোতধারায় পাক খাওয়ানোর উপক্রম করেছে।

আনিলার ভেতরটা মনে হয় অনুভবে দেখতে পাচ্ছেন গুরু । একটু নরম হয়ে যান তার প্রতি। এই প্রথম চোখদুটো খোলেন, কিন্তু মুখ ফেরান না। মুরলীর দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,

-মোর নাম সুরেন্দু। তয় ওই নামটা হারাইয়া গ্যাছে। রূপান্তরিত নাম আতর বাঁশি।

‘সুরেন্দু’ নামটা শুনে আনিলার বহু বছর আগের স্মৃতির শুকনো ঝরা পাতাটা একটু মর্মর ধ্বনি তোলে। তবে সে ধ্বনি বড় অস্ফূট। এখনই স্পষ্ট করে কিছু মনে করাচ্ছে না। কিন্তু সুরেন্দু এতেই তার মনের ক্যানভাসে বিশ্রী, বেদনাদায়ক একটা চিত্র দেখতে পাচ্ছেন। হয়ত-বা তিনি এর পিছনের পুরো গল্পটা জানেন। যে গল্পে তার জীবাশ্ম শক্তি হওয়ার মূল কারণ জানতে পারছেন সেই জীবাশ্ম শক্তির কল্যাণেই। আর দণ্ডায়মান আনিলা সেখানে শুধুই অনুঘটক। কিন্তু তিনি এটা কিছুতেই জানাতে চাইছেন না আনিলাকে। তাই মনে হয় এবার অনর্গল কথা বলছেন না। বরং একেবারে চুপ হয়ে গেছেন। তাছাড়া তিনি তো এখন শুধুই আতর বাঁশি; সুরেন্দুকে জাগানোর কোনো ইচ্ছেও তার মধ্যে নেই।

‘সুরেন্দু’ নামের উচ্চারণ আনিলার মনে একটু কম্পন জাগালেও তা নিতান্তই মৃদু। রাস্তায় মানুষের ভিড়ে চলন্ত অবস্থায় অনেকটা ছোট-খাটো ভূমিকম্পের মতো। তাৎক্ষণিক টের পাওয়া যায় না। তবে পরে পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে তার সংবাদ মেলে।

মধ্য রাত্রি অতিক্রম হয়েছে কখন তাদের কেউ ঠিক বুঝে ওঠে না। হঠাৎ আনিলার বোধোদয় হয়— এখন ফিরতে হবে। তবে ফেরার আগে গুরুকে অনুরোধ করে বলে,

-কালকে মাধবের উৎসে যেতে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন আপনি?

-সেইটা সম্ভব না।

-আমি আপনার চেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আর কাউকে পাচ্ছি না। তাছাড়া জায়গাটাও আমার কাছে নতুন।

-বেশি জিদ সব সমে ভালা না। ও জাগাত কেহ যায় না।

-বেশ, যাব না। আপনি তাহলে আমাকে এবার বিদায় দেন।

-মুই কাউকে আটকাইয়া রাখি নাই।

-যাওয়ার আগে শেষ অনুরোধটা রাখবেন? আপনার মুখটা একবার দেখতে চাই।

-বেশি জিদ সব সমে ভালা না। চইলা যান!

-মুখ না দেখে আমি যেতে চাই না।

-যাওয়া না যাওয়া আপনের ইচ্ছে।

আনিলা এরপর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। গুরুও কিছু বলেন না। আগের মতোই পদ্মাসনে বসে মুরলীর দিকে তাকিয়ে আছেন। এভাবে দশ মিনিট কেটে যায়। এতক্ষণের অস্বস্তিকর নীরবতা গুরুকে অস্থির করে তোলে। তাই বাধ্য হয়ে আচমকা বলে ওঠেন,

-বইলা দিছি না যে, বেশি জিদ ভালা না। ঠিক আছে। সামনে বাড়ান। দেইখাই চইলা যান।

কথাগুলোর মধ্যে কিছুটা চটচটে ভাব থাকলেও আনিলা বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। এতক্ষণের মুগ্ধতার ঘোরেই এখনো আছে সে। ডান পাখানি এক কদম বাড়াতেই কূপের আলোয় আলোকিত গুরুর পূর্ণ মুখখানি দেখে এই প্রথম। মুহূর্তেই মুগ্ধতার ডালি উড়ে যায় বিষাদের ঝড়ে। সুরেন্দুর আনুমানিক পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার মধ্যে যেন প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা খাত দেখে ফেলে আনিলা। চিৎকার করে শুধু বলে ওঠে,

-সুরেন্দু, তুমি?

-বইলা দিছি তো মুই আর সুরেন্দু না। এ্যাখন শুদুই আতর বাঁশি।

এক মুহূর্ত দেরি না করে ঘর থেকে বের হয়ে যায় আনিলা। বের হয়ে গেলেও মারিয়ানা খাতের গভীরতায় যেন নিমজ্জিত হয়ে যায় সে নিমিষে, যে খাতের উপরিতলে এতক্ষণ জাহাজ চরিয়ে অন্য এক গভীরতাকে শুধু আন্দাজ করে গেছে সে।


*আতর বাঁশি*




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*