মূল: ড্যাভিড লজ
অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম
কাল বদল
মনিকার মুখমণ্ডলে রাগ বেড়েই চলছিলো। “তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিলো মিঃ লয়েড,” সে বললো। “আমি তাদের দেখেছি। দুঃখিত যে তোমাকে বলে ফেললাম। একমাত্র রোজই আমাকে বিশ্বাস করে।”
রোজ স্ট্যানলি তাকে বিশ্বাস করতো, তবে এর কারণ সে উদাসীন ছিলো। মিস ব্রডির প্রেম নিয়ে, বা অন্য কারো যৌন ব্যাপার নিয়ে সব ব্রডির মধ্যে সে-ই সবচেয়ে কম উত্তেজিত ছিলো। আর সব সময় একই থাকতো। পরবর্তীতে সে যৌনতার ব্যাপারে খ্যাতি অর্জন করলে তার জৌলুসপূর্ণ আবেদনময়ী গুণাবলী আসল যে ঘটনায় নিহিত ছিলো তা হলো যৌনতার ব্যাপারে তার আদৌ কোনো কৌতুহল ছিলো না, সে কখনো এটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে নি। মিস ব্রডি যেমনটা বলেছিলো, তার প্রবৃত্তি ছিলো।
“রোজই কেবল আমাকে বিশ্বাস করে,” মনিকা ডগলাস বললো।
উনিশ শত পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে সন্যাস আশ্রমে সে স্যান্ডিকে দেখতে গেলে মনিকা বলেছিলো, “আমি সত্যি সত্যি দেখলাম একদিন শিল্প কক্ষে টেডি লয়েড মিস ব্রডিকে চুমু খাচ্ছে।”
“জানি তো তুমি দেখেছো,” স্যান্ডি বলেছিলো।
সে এটা জানতো এমনকি মিস ব্রডিরও একদিন যুদ্ধ শেষে তা বলার আগে, যখন তারা ব্রেড হিলস হোটেলে বসে স্যান্ডউইচ ও চা খাচ্ছিলো যা মিস ব্রডির বাসার রেশনে হবে না। তার দীর্ঘকালের সুরক্ষিত কালো মাসকোয়শ কোটে মিস ব্রডি বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়ে ও সঙ্কুচিত হয়ে বসে পড়লো। সময়ের আগে সে অবসরে গিয়েছিলো। সে বললো, “আমার সুর্বর্ণ সময়কে পার করে এসেছি আমি।”
“সেটা উত্তম সুবর্ণ সময় ছিলো,” স্যান্ডি বললো।
মুরিয়েল স্পার্ক দ্য প্রাইম অব মিস জন ব্রডি (১৯৬১)
গল্প বলার সরলতম উপায়, যা উপজাতীয় চারণ কবি ও ঘুমানোর সময় পিতা-মাতারা সমানভাবে পছন্দ করেন, তা হলো শুরুতে শুরু করে শেষে না পৌঁছানো পর্যন্ত কিংবা আপনার শ্রোতা ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া। তবে প্রাচীনকালেও গল্প বলিয়েরা মজাদায়ক প্রভাবকে উপলব্ধি করেছিলেন, যে প্রভাব কালানুক্রমিক বিন্যাস (chronological order) থেকে সরে এসে মিলতো। ধ্রুপদী মহাকাব্য শুরু হতো ইন মিডিয়া রেস এ, গল্পের মাঝখানে। যেমন– ওডিসি র কথন শুরু হয় মাঝামাঝি, দেশের উদ্দেশ্যে নায়কের ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রায়, তার আগেকার দুঃসাহসিক অভিযানসমূহ বর্ণনা করতে পিছন ফিরে বাঁক নেয়, তারপর ইথাকায় গল্পের সমাপ্তি ঘটে।
কাল বদলের মধ্য দিয়ে কথন শুধু একটার পর একটা জিনিস দিয়ে জীবনকে উপস্থাপন করা এড়িয়ে চলে, আর ব্যাপকভাবে পৃথক করা ঘটনাসমূহের মধ্যকার কার্যকারণ ও বক্রাঘাতের সম্পর্ক স্থাপন করতে দেয়। কথনের কেন্দ্রবিন্দুকে অতীত কোনো সময়ে পরিবর্তন করলে তা গল্পের কালানুক্রমে অনেক পরে ঘটে যাওয়া কোনো কিছুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পরিবর্তন ঘটাতে পারে, তবে টেক্সটের পাঠক হিসেবে আমরা ইতোমধ্যে যা কিছুর অভিজ্ঞতায় লাভ করেছি তার। এটি সিনেমার পরিচিত কৌশল যার নাম, ফ্ল্যাশব্যাক। ছবির আরো ঝামেলা আছে “ফ্ল্যাশফরওয়ার্ড” প্রভাবকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে । কথনের ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে তার আগাম ঝলকই হচ্ছে ফ্ল্যাশফরওয়ার্ড, যা ধ্রুপদী আলঙ্কারিকদের কাছে “পূর্বানুমান”(prolepsis) নামে পরিচিত। এ কারণেই এমন তথ্য একজন কথকের অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়, যে গোটা গল্পটা জানে, আর ছবিতে সাধারণত কোনো কথক থাকে না। এটা তাৎপর্য্যপূর্ণ যে এ ব্যাপারে দ্য প্রাইম অব মিস জন ব্রডি ছবিটি উপন্যাসটির চেয়ে খুবই কম জটিল ও কম উদ্ভাবনমূলক ছিলো। ছবিতে গল্প বলা হয় সোজাসুজি কালানুক্রমিকভাবে, অন্যদিকে উপন্যাসটি বিখ্যাত হয়ে আছে পুরো ঘটনা জুড়ে একবার সামনে একবার পিছনে দ্রুত গিয়ে সময়কে সাবলীলভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
গল্পটির বিষয় হচ্ছে এডিনবার্গ বালিকা বিদ্যালয়ে দুই মহাযুদ্ধ মধ্যকালীন একজন খামখেয়ালি ও ক্যারিজম্যাটিক শিক্ষক, জন ব্রডি, আর একদল ছাত্র-ছাত্রী যারা তার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে ছিলো; এ দলে ছিলো মনিকা যে তার অঙ্ক দক্ষতার জন্য বিখ্যাত ছিলো, রোজ যে যৌনতার জন্য বিখ্যাত, এবং স্যান্ডি স্ট্রেঞ্জার যে তার স্বরধ্বনির জন্য বিখ্যাত ছিলো আর “কেবল কুখ্যাত তার ছোট, প্রায় অস্তিত্বহীন চোখজোড়ার জন্য।” এ চোখের অবশ্য কোনোকিছুই অগোচরে থাকে না এবং স্যান্ডি হচ্ছে উপন্যাসটির মূল দৃষ্টিভঙ্গির চরিত্র। এ দৃষ্টিভঙ্গি শুরু হয় যখন মেয়েরা সিনিয়র তখন, এটি জুনিয়র হিসেবে তাদের সময়টাকে বর্ণনা করতে দ্রুত ফিরে আসে যখন মিস ব্রডির প্রভাব ছিলো সর্বোচ্চ, আর পূর্ণ বয়স্ক নারী হিসেবে তাদের এক ঝলক দেখানোর জন্য ঘন ঘন সামনে চলে আসে; তাদের অসামান্য শিক্ষকের স্মৃতি তাদেরকে এখনো জ্বালিয়ে মারে ও তাড়া করে ফেরে।
জুনিয়র স্কুলে মিস ব্রডির যৌন জীবন নিয়ে, বিশেষ করে মিঃ লয়েড যে সুদর্শন শিল্প শিক্ষক এবং বিশ্বযুদ্ধে যে তার একটা হাতার “জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলেছিলো” তার সাথে ব্রডির কোনো সম্পর্ক চলছে কিনা সে ব্যাপারে তারা নিবিষ্ট মনে জল্পনা-কল্পনা করে। মনিকা দাবি করে যে সে শিল্প কক্ষে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে থাকতে দেখেছে, আর বিরক্ত বোধ করে যে শুধু রোজ তাকে বিশ্বাস করে। স্যান্ডির প্রতি তার মন্তব্য বছর বছর পরে ইঙ্গিত দেয় যে এই অবিশ্বাসপ্রবণতা এখনো তাকে সংক্ষুব্ধ করে তোলে। এদিকে ইতোমধ্যে এক আবদ্ধ ব্যবস্থায় সন্যাসিনী হওয়া স্যান্ডি স্বীকার করে যে মনিকার কথাই ঠিক ছিলো। কথক বলে যে যুদ্ধ শেষ হওযার পরপরই মিস ব্রডি একদিন তাকে বলার আগে থেকেই সে এটা জানতো।
সংক্ষিপ্ত এ প্যাসেজটিতে পাঠককে সময়ের অজস্র মুহূর্তে শ্বাসরুদ্ধকর দ্রততার সাথে পেছনে ও সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। মূল কথনের সময় থাকে, সম্ভবত ১৯২০ এর দশকের শেষ দিকটা, যখন জুনিয়র স্কুলের মেয়েরা মিস ব্রডির প্রেম জীবন নিয়ে আলোচনা করছে। সিনিয়র স্কুলে সময় থাকে ১৯৩০ এর দশকে, যখন রোজ যৌনতার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সময় থাকে ১৯৫০ এর দশকে, যখন স্যান্ডি চা পান করে বাধ্যতামূলকভাবে অবসর নেওয়া মিস ব্রডির সাথে। আর অনির্দিষ্ট সময় থাকে যখন স্যান্ডি আবিষ্কার করে যে মিস ব্রডিকে মিঃ লয়েড শিল্প কক্ষে আসলেই চুমু খেয়েছিলো।
সে সিনিয়র স্কুলে থাকাকালে এটা আবিষ্কার করে, আর বইয়ে সেটা আমরা অনেক পরে জানি। উপলক্ষটা একটা কথোপকথন যেখানে মিস ব্রডি ঘোষণা করে যে রোজ নিজেই মিঃ লয়েডের প্রেমিকা হবে, কারণ সে লয়েডের মেয়েদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে। স্যান্ডি ঠিক করে যে তার শিক্ষকের লাগামহীন অহংবোধের ব্যাপারে বিপজ্জনক ও উচ্ছ্বসিত কিছু একটা আছে। “স্যান্ডি ভাবলো যে সে ভাবে সে দেবী, সে ভাবে সে ক্যালভিনের ঈশ্বর, সে শুরু এবং শেষ দেখতে পায়।” ঔপন্যাসিকরাও অবশ্য তাঁদের গল্পের শুরু ও শেষ দেখতে পান, কিন্তু মুরিয়েল স্পার্কের ইঙ্গিতে প্রয়োজনীয় কথাসাহিত্য এবং বিপজ্জনক মিথ্যা ধারণার মধ্যে পার্থক্য থাকে — সম্ভবত ক্যাথলিক ঈশ্বর যে ইচ্ছা স্বাধীনতার অনুমতি দেয় এবং ক্যালভিনিস্টিক ঈশ্বর যে তা দেয় না তার মধ্যেও পার্থক্য থাকে। ক্যালভিনের পূর্বনির্ধারণ মতবাদ অনুযায়ী “মানুষ জন্মলাভ করার আগেই ঈশ্বর বাস্তবে সবার জন্য নোংরা চমক পরিকল্পনা করে রেখেছিলো যে কখন তারা মারা যাবে।”, উপন্যাসের অন্য কোথাও এ মতবাদের ফলপ্রসূ বর্ণনা আছে।
মিস ব্রডির ভবিষ্যদ্বাণীকে স্যান্ডি মিথ্যা প্রতিপাদন করে, আর এভাবে নিজেই লয়েডের প্রেমিকা হয়ে অন্যের নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করার দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। পরবর্তীতে সে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ফ্যাসিবাদী স্পেনে মারাত্মক দুঃসাহসিকতায় আরেক ছাত্রকে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য মিস ব্রডি সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। সে জন্য উদ্ধৃত অংশটিতে মিস ব্রডিকে বর্ণনা করা হয় “বিশ্বাসঘাতকতার শিকার” হিসেবে, আর ধর্মীয় বৃত্তি সত্ত্বেও স্যান্ডিকে এ ব্যাপারে কখনো দোষ বোধ থেকে মুক্ত মনে হয় না। মিস ব্রডিকে বর্ণনা করা হয় “সঙ্কুচিত” হিসেবে, কারণ সে ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে, তাই এ দৃশ্যটি করুণ। কিন্তু উপন্যাসের অর্ধেকের কম জায়গা জুড়ে এটি রাখা হয়, আর করুণ রসের বিপরীতে থাকে মিস ব্রডির সুবর্ণ সময়ের অনেক কিছু।
আধুনিক কথাসাহিত্যে কাল বদল খুবই সাধারণ একটা প্রভাব, কিন্তু একে স্মৃতির কাজ হিসেবে সাধারণত “স্বভাবীভূত” করা হয় কোনো চরিত্রের চেতনা প্রবাহ চিত্রায়নে (মলি ব্লুমের অন্তর্গত স্বগতোক্তি তার জীবনের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে এলপি ডিস্কে ট্র্যাকের মধ্যে গ্রামোফোন পিক আপের সামনে পিছনে দোলাচলের মতো অনবরত বদল হচ্ছে) নয়তো আরো আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে গেলে, চরিত্র-কথকের স্মৃতিচারণ বা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে (যেমন- ফোর্ডের দ্য গুড সোলজার এ ডোয়েল)। গ্রাহাম গ্রীনের দী এন্ড অব অ্যাফেয়ার্স (১৯৫১) চরিত্র-কথকের স্মৃতিচারণের নিপুণ পরিবেশন। কথক একজন পেশাদারী লেখক; নাম বেনড্রিক্স, যে তার কথনের শুরুতে সারাহ্র স্বামী, হেনরির দেখা পায়; এই সারাহ্র সাথে বেনড্রিক্সের অনেক বছর আগে সম্পর্ক থাকে, যা সারাহ্ হঠাৎ করে ভেঙে দেয়। বেনড্রিক্স ধরে নেয় যে সারাহ্ আরেকজন প্রেমিক খুঁজে পেয়েছে; সে এখনো তিক্ত ও ঈর্ষান্বিত, আর হেনরি যখন সারাহ্র অবিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিজের সন্দেহের কথা বিশ্বাস করে জানিয়ে দেয়, বেনড্রিক্স তখন তার গোপন কথা আবিষ্কার করতে বিকৃতভাবে এক গোয়েন্দা ভাড়া করে। গোয়েন্দাটি যা বের করে আনে তা সারাহ্র রাখা একটা পত্রিকা, যাতে তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেনড্রিক্সের সাথে সম্পর্কের বর্ণনা আছে; সেই সম্পর্ককে ভেঙে ফেলার জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত উদ্দেশ্যের উন্মোচন আছে, আর আছে নিঃসন্দেহ ধর্মীয় রূপান্তর। এসব ঘটনা তাদের সঠিক কালানুক্রমিক জায়গা থেকে কথিত হওয়ার দরুন বেশি আপাতগ্রাহ্য ও নাটকীয় হয়ে উঠেছে।
রচনার কৃত্তিম নির্মাণে মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং কথাসাহিত্যের গল্পে কিংবা কেন্দ্রীয় চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক গভীরতায় সময়গত পার্থক্যের ক্রমপরম্পরায় (temporal continuum) “নিজেকে হারানো” থেকে আমাদের রক্ষা করে, মুরিয়েল স্পার্কের লেখকীয় নাম-পুরুষ কথনের সাথে ঘন ঘন কাল বদলের সংমিশ্রণ একেবারে উত্তর-আধুনিকতাবাদী কৌশল। ভোনেগাটের স্লোটারহাউস ফাইভ (১৯৬৯) এর কার্ট আরেকটি অনন্য দৃষ্টান্ত। লেখক শুরুতে আমাদেরকে বলেন যে ১৯৪৫ সালে মিত্রদের বোমায়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতম বিমান হামলার একটি, তাতে ড্রেসডেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে সেখানে তাঁর যুদ্ধবন্দী হওয়ার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তাঁর নায়ক, বিলি পিলগ্রিমের গল্পটা রচিত। মূল গল্পটি শুরু হয়: “শোনো। বিলি পিলগ্রিম ঠিক সময়ে ব্যর্থ হয়েছে,” আর আমেরিকার মধ্য-পশ্চিমে চক্ষু বিশারদ, স্বামী ও বাবা হিসেবে বিলির বেসামরিক জীবনের বিভিন্ন পর্ব এবং ড্রেসডেনের বিভীষিকার তুঙ্গে পৌঁছানোর মতো তার যুদ্ধ সেবার পর্বের মধ্যে ঘন ঘন ও আকস্মিকভাবে এর বদল ঘটে। এ তো স্মৃতির কাজের চেয়েও বেশি। বিলি “সময়-অভিযাত্রী”। সময় ও আন্তঃগ্যালাক্সিয় মহাশুন্যের (যা সময়ের একক, “আলোকবর্ষে” মাপা হয়) মধ্য দিয়ে প্রচেষ্টাহীন ভ্রমণের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পুরাণ দ্বারা আধুনিক ইতিহাসের অসহনীয় সত্য ঘটনা থেকে সে অন্যান্য যন্ত্রণাবিক্ষুব্ধ ঘাগু লোকের সাথে পালিয়ে যেতে চায়। সে দাবি করে যে ট্রালফাম্যাডোর গ্রহের দিকে তাকে একটা সময়ের জন্য অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যে গ্রহে ছোট ছোট জীব বসবাস করে এবং যারা দেখতে পাইপ পরিস্কারকারী দণ্ডের মাথার মতো, আর যাদের একটা চোখ উপরের দিকে থাকে। এ প্যাসেজগুলো বিজ্ঞানের কল্প-কাহিনীর প্যারডি যা মজাদার ও একই সাথে দার্শনিকভাবে গুরুগম্ভীর। ট্রালফাম্যাডোরিয়ানদের কাছে সব কাল বর্তমান কাল, আর নিজের অবস্থান চিহ্নিত করতে যে কোনো জায়গাকে যে কেউ বেছে নিতে পারে। এ হচ্ছে সময়ের অবিরাম, দিকহীন চলাফেরা যা আমাদের মানুষের প্রেক্ষিতে জীবনকে করুণ করে তোলে, যদি না কেউ শ্বাশ্বতে বিশ্বাস করে যেখানে সময়কে ফিরিয়ে আনা যায়, আর এর প্রভাবসমূহকে উল্টে ফেলা যায়। এসব ব্যাপারে স্লোটারহাউস ফাইভ বিষন্ন, চিন্তা-উদ্রেককারী ধ্যান, খ্রিস্টান-উত্তর এবং উত্তর-আধুনিক। এর সবচেয়ে বেদনাবিধুর ও চমৎকারভাবে লক্ষণীয় চিত্রকল্পগুলোর একটি হলো যুদ্ধ বিষয়ক ছবির যা বিলি পিলগ্রিম উল্টো দিক থেকে দেখে:
গর্ত আর আহত মানুষ আর লাশে ভরা আমেরিকান প্লেনগুলো ইংল্যান্ডের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছনের দিকে উড়ে গেলো। ফ্রান্সের উপর দিয়ে কিছু জার্মান যোদ্ধা বিমান সেগুলোর পিছন দিকে উড়লো, প্লেন ও নাবিকদের কারো কারো কাছ থেকে বুলেট ও শেলের টুকরো দিয়ে বিদ্ধ হলো। ভূমির উপর আমেরিকান বোমারু বিমানগুলোকের সেগুলো একই অবস্থা করলো, আর সেই প্লেনগুলো বিমান সারিতে যোগ দেয়ার জন্য পিছনের দিকে উপরে উড়লো।
মার্টিন অ্যামিজ (ভোনেগাটের প্রতি যথাযোগ্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে) এক নাৎসি যুদ্ধাপরাধীর জন্ম থেকে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তার জীবন বর্ণনা করে প্রথম প্রথম হাস্যরসাত্মকভাবে কিম্ভূত এবং পরে ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যাহত ও ব্যাঘাতজনক প্রভাব দিয়ে গল্পটা ধ্বংসযজ্ঞের বিভীষিকার কাছাকাছি এনে সম্প্রতি এ কনসিটটাকে টাইমজ অ্যারো নামে গোটা একটা বইয়ে রূপ দিয়েছেন। গল্পটিকে এক ধরনের শুদ্ধিস্থান (purgatory) হিসেবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রের আত্মা তার ভয়ংকর অতীত পুনরায় যাপন করতে বাধ্য হয়, আর বাতিলকৃত মন্দের পুরাণ হিসেবে যার অসম্ভবতা পুরোমাত্রায় স্পষ্ট। মনে আসে এমন কথন কালানুক্রম দিয়ে প্রগতিশীল নিরীক্ষার বেশিরভাগ দৃষ্টান্ত মনে হয় গুরুতর ও লঘুতর অপরাধ এবং পাপ সম্পৃক্ত।
Be the first to comment