কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: পুনরাবৃত্তি

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


পুনরাবৃত্তি


শরতের (fall) সব সময়ই যুদ্ধ হতো, তবে আমরা সেদিকে আর যেতাম না। মিলান শহরে শরতের (fall) ঠাণ্ডা থাকতো এবং অন্ধকার আগে আগে নেমে আসতো । তারপর বৈদ্যুতিক বাতিগুলো জ্বলে উঠতো, আর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে  জানালাগুলোর মধ্যে তাকানোটা সুখকর লাগতো। দোকানগুলোর বাইরে শিকার করা অনেক পশু থাকতো, আর শিয়ালের লোমে পড়ে তুষার গুঁড়া হয়ে যেতো এবং বাতাস তাদের লেজগুলো উড়িয়ে নিয়ে যেতো। হরিণগুলো শক্ত, ভারী ও খালি হয়ে ঝুলে থাকতো, আর ছোট ছোট পাখিগুলো বাতাসে বয়ে চলে যেতো এবং বাতাসে তাদের পালকগুলো উল্টে  যেতো। ঠাণ্ডা শরৎকাল (fall) থাকতো এবং বাতাস পবর্ত থেকে নিচে আসতো।

প্রতিদিন বিকেলে আমরা সবাই হাসপাতালে যেতাম, আর সন্ধ্যায় শহর পেরিয়ে হাসপাতালের দিকে হেঁটে যাওয়ার নানা উপায় ছিলো। দুটো উপায় ছিলো খালগুলো বরাবর, তবে সেগুলো দীর্ঘ পথ ছিলো। যদিও হাসপাতালে প্রবেশ করতে খাল বরাবর ব্রিজ পার হলেন আপনি। তিনটি ব্রিজের মধ্যে বেছে নেয়া যেতো। সেগুলোর একটির উপরে এক মহিলা রোস্টেড চেস্টনাট বিক্রি করতো। তার কাঠকয়লা আগুনের সামনে দাঁড়ালে উষ্ণ লাগতো, আর পরে চেস্টনাটগুলো আপনার পকেটে উষ্ণ থাকতো। হাসপাতালটি ছিলো খুবই প্রাচীন ও খুবই সুন্দর, আর গেট দিয়ে ঢুকে উঠোন হেঁটে পেরোলেই অন্য প্রান্তে একটি গেট দেখা যেতো। সেই উঠোন থেকে সাধারণত অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া শুরু হতো। প্রাচীন হাসপাতালটির ওপারে ইটের নতুন প্যাভিলিয়ন ছিলো, আর সেখানটায় আমরা প্রতিদিন বিকেলে দেখা করতাম এবং কোনো বিষয়ে সবাই খুবই নম্র ও আগ্রহী থাকতাম, আর যন্ত্রগুলোর মধ্যে বসতাম, যা খুব বেশি পার্থক্য তৈরি করতো।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে “ইন আনাদার কান্ট্রি” (১৯২৭)

আপনার সময় ও ইচ্ছে থাকলে কিছু রঙিন কলম ও পেনসিল এনে হেমিংওয়ের গল্পের প্রথম অনুচ্ছেদটিতে একাধিকবার থাকা শব্দগুলো গোল করে চিহ্নিত করুন, প্রতিটি শব্দের জন্য ভিন্ন রঙ, আর সেগুলো এক করে ফেলুন। আপনি দুই ধরনের সংযোগকারী শব্দের জটিল বিন্যাস দেখতে পাবেন: এক, রেফারেনশিয়াল অর্থ, শরৎ, ঠাণ্ডা, অন্ধকার, বাতাস, যেতো, যেগুলোকে আমরা বলতে পারি আভিধানিক শব্দ, আর পদাশ্রিত নির্দেশক, পদান্বয়ী অব্যয় ও সংযোজক অব্যয় যেমন- টি, গুলো, মধ্যে, আর, এবং, যেগুলোকে বলা যায় ব্যাকরণগত শব্দ।

ব্যাকরণগত শব্দের পুনরাবৃত্তি ব্যতিরেকে ইংরেজি লেখা প্রায় অসম্ভব, তাই সাধারণত সেইমতো আমরা তা লক্ষ্য করি না, কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে “আর, এবং” এর অসাধারণ সংখ্যা আপনি খেয়াল করতে ব্যর্থ হবেন না। এটাই এর খুবই পুনরাবৃত্তিমূলক বাক্য বিন্যাসের উপসর্গ যা একটা বাক্যকে আরেকটার অধীন না করে ঘোষণামূলক বাক্যগুলোকে এক সাথে গেঁথে ফেলেছে। আভিধানিক শব্দের পুনরাবৃত্তি কম সমানভাবে বিতরিত হয়েছে, অনুচ্ছেদটির শুরু ও শেষে একত্রে বসেছে।

আভিধানিক শব্দ ও ব্যাকরণগত শব্দের এতটা পুনরাবৃত্তি স্কুলের রচনা লেখায় সম্ভবত খারাপ নম্বর এনে দেবে, আর সেটাই একদম ঠিক। সাহিত্যের ভাল গদ্যের প্রথাগত আদর্শ রূপে “মার্জিত তারতম্য” এর প্রয়োজন হয়: একাধিকবার কোনো কিছু উল্লেখ করতে হলে আপনার উচিৎ তা বর্ণনা করার বিকল্প পথসমূহ বের করার চেষ্টা করা; আর বাক্য বিন্যাসে একই ধরনের বৈচিত্র্য প্রদান করা উচিৎ। ( সেকশন ৬ এ আলোচিত হেনরি জেমসের প্যাসেজটি উভয় ধরনের তারতম্যে উদাহরণ সমৃদ্ধ।)

হেমিংওয়ে অবশ্য প্রথাগত অলঙ্কারকে প্রত্যাখ্যান করেন যেসব কারণে তার কিছুটা সাহিত্যের এবং কিছুটা দর্শনের। তিনি মনে করেন যে “সুচারু লেখা” অভিজ্ঞতাকে মিথ্যা প্রতিপাদন করে, আর রচনাশৈলীর শোভামুক্ত সরল, শাব্দিক ভাষা ব্যবহার করে “আসলে কী ঘটেছিলো, আসল ব্যাপার কী ছিলো যা আপনার অভিজজ্ঞতাজাত আবেগ সৃষ্টি করতো তা লিখে ফেলা”র চেষ্টা  করে।

এটা সহজ দেখায়, তবে অবশ্যই তা নয়। শব্দ তো সরল কিন্তু শব্দের বিন্যাস সরল নয়। প্রথম বাক্যের শব্দগুলোকে বিন্যাস করার অনেক সম্ভাব্য উপায় আছে, কিন্তু হেমিংওয়ের বাছাইকৃত উপায়টিতে “যুদ্ধে যাওয়া” ফ্রেজটিকে ভেঙে দুটোতে পরিণত করা হয়েছে এই ইঙ্গিত দিয়ে যে কথকের ভূমিকায় (persona) এখন পর্যন্ত ব্যাখ্যাহীন টেনশন আছে, স্বস্তি ও বক্রাঘাতের মিশ্রণ আছে। শীঘ্রই যেমনটা আমরা জানতে পারি যে  সে ও তার সাথীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পক্ষে যুদ্ধ করার সময় আহত সৈন্য, এখন যারা আরোগ্য লাভ করছে, কিন্তু তারা সচেতন থাকে, যে যুদ্ধ তাদের মেরেই ফেলছিলো প্রায়, তা তাদের জীবনকে আর যাপনযোগ্য করে নাও তুলে থাকতে পারে। এ গল্প মানসিক যন্ত্রণার গল্প, আর মানুষ কীভাবে সে যন্ত্রণা সামলে ওঠে বা সামলাতে ব্যর্থ হয়, তার গল্প। যে শব্দটি বলা হয় নি, কিন্তু টেক্সটে পুনরাবৃত্ত সকল শব্দের মূল শব্দ, তা হলো “মৃত্যু”।

শরতের আমেরিকান শব্দ, fall, সবুজায়নের মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়, আর যারা যুদ্ধে মারা যায় তাদের প্রথাগত ফ্রেজ “the fallen” (নিহতরা) এর প্রতিধ্বনি। দ্বিতীয় বাক্যে ঠাণ্ডা   অন্ধকার  এর সাথে এ শব্দের পাশাপাশি অবস্থান এসব অনুষঙ্গকে সবল করে তোলে। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত দোকানগুলো দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যায় বলে মনে হয় (এ বাক্যে যে কোনো আভিধানিক শব্দের পুনরাবৃত্তি নেই তা প্রভাবটিকে তুঙ্গে নিয়ে গেছে), কিন্তু কথকের মনোযোগ দোকানগুলোর বাইরে ঝোলানো শিকার করা পশুগুলোর দিকে দ্রুত নিবদ্ধ হয়, যা মৃত্যুর অধিকতর প্রতীক। সেগুলোর লোমে গুঁড়া হওয়া তুষার ও সেগুলোর পালক উল্টানো বাতাসের বর্ণনা আক্ষরিক ও যথাযথ, তবে শরৎ(fall), ঠাণ্ডা, অন্ধকার, বাতাস, যেতো, এর সাথে মৃত্যুর অনুষঙ্গকে জোরালো করে তোলে। শেষ বাক্যে প্রথম বারের মতো তিনটি পুনরাবৃত্ত শব্দ একসঙ্গে আসে সমাপ্তির কাব্যিক প্রভাব নিয়ে: “ঠাণ্ডা শরৎকাল (fall) থাকতো এবং বাতাস পবর্ত থেকে নিচে আসতো।” পর্বতগুলোতেই যুদ্ধ চলছে। বাতাস, যা  ধর্মীয় ও রোমান্টিক লেখায় প্রায়শই জীবন ও চেতনার প্রতীক, তা এখানে প্রাণহীনতার সাথে সম্পৃক্ত। হেমিংওয়ের আগের এই গল্পগুলোতে ঈশ্বর নিতান্তই মৃত। যুদ্ধের মানসিক যন্ত্রণা থেকে নায়ক অধিবিদ্যা ও অলঙ্কারশাস্ত্রকে অবিশ্বাস করতে শিখেছে। সে কেবল তার ইন্দ্রিয়গুলোকে বিশ্বাস করে, আর অভিজ্ঞতাকে দেখে একেবারে মেরুকৃত ভাষায়: ঠাণ্ডা/উষ্ণ, আলো/অন্ধকার, জীবন/মৃত্যু।

দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে মন্ত্রমুগ্ধকর ছন্দ ও পুনরাবৃত্তি বজায় থাকে। “হাসপাতাল” এর জন্য মার্জিত বিকল্প খুঁজে পাওয়া যেতো, কিংবা মাঝে মাঝে সর্বনাম “এটা” সাধারণভাবে ব্যবহার করা যেতো; কিন্তু হাসপাতালটিই সৈন্যদের প্রাণকেন্দ্র, প্রতিদিনকার তীর্থ স্থান, আশা-আতঙ্কের আঁখড়া, আর কাজেই শব্দটির পুনরাবৃত্তি অভিব্যক্তিময়। যে পথ দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছানো যায়, সে পথ পরিবর্তন করা সম্ভব, কিন্তু টার্মিনাল সব সময়ই একই। ব্রিজ বাছাই করা যায়, কিন্তু আপনাকে সব সময় খাল পেরোতে হবে (হয়তো পাতালের স্টিক্স নদীর ক্ষীণ ইঙ্গিত)। কথক ব্রিজটি বেছে নেয় যেখানে সে রোস্টেড চেস্টনাট কিনতে পারে, জীবনের প্রতিশ্রুতির মতো পকেটে উষ্ণ রাখতে পারে — শুধু এই ব্যতীত যে হেমিংওয়ে সে উপমা ব্যবহার করেন না, তিনি শুধু ইঙ্গিত প্রদান করেন; ঠিক যেমন প্রথম অনুচ্ছেদে প্যাথেটিক ফ্যালাসির (পূর্ববর্তী সেকশন দেখুন) যে কোনো উদাহরণের মতো ঋতুর বর্ণনাকে কোনো রূপক ব্যবহার না করেই আবেগপূর্ণভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পেরেছেন। ভরা সারল্য ও কৃত্রিম একঘেয়েমির মধ্যকার লাইনটি চমৎকার একটা লাইন, আর হেমিংওয়ে সর্বদা এর সঠিক দিকে থাকেন নি, তবে তাঁর আগের দিকের কর্মে তিনি তাঁর সময়ের তুলনায় সম্পূর্ণরূপে মৌলিক শৈলী নির্মাণ করেন।

বলা বাহুল্য, পুনরাবৃত্তি জীবনের হতাশাজনক দৃষ্টবাদী, অধিবিদ্যা বিরোধী চিত্রায়নের সাথে আবশ্যকীয়ভাবে যুক্ত নয় যেমনটা আমরা হেমিংওয়ের মধ্যে দেখতে পাই। ধর্মীয় ও মরমীবাদী লেখারও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এটি; আর এটি ব্যবহৃত হয় সেইসব ঔপন্যাসিকদের দ্বারা যাঁদের কাজের সেদিকে যাওয়ার প্রবণতা থাকে — যেমন, ডি. এইচ. লরেন্স। দ্য রেইনবো র হারানো কৃষিভিত্তিক জীবন যাপন রীতিকে মনে করিয়ে দেয়া প্রথম অধ্যায়ের ভাষাটা  ওল্ড টেস্টামেন্টের মৌখিক পুনরাবৃত্তি ও বাক্য বিন্যাসগত সমরূপতাবাদের (parellelism) প্রতিধ্বনি:

কচি শস্য ঢেউ খেলে দুললো এবং রেশমী ছিলো, আর যারা যারা এটি দেখলো তাদের অঙ্গে অঙ্গে দ্যূতি খেলে গেলো। তারা গাভীর ওলান ধরলো, গাভীগুলো দুধ দিলো এবং মানুষগুলোর হাতের সাথে নিয়মিত তালে শব্দ করলো, গাভীগুলোর ওলানের রক্তের পাল্স মানুষগুলোর হাতের পালসে তাল মিলালো।

বক্তা ও প্রচারকদেরও প্রিয় কৌশল হচ্ছে পুনরাবৃত্তি, যে ভূমিকাগুলো চার্লস ডিকেন্স প্রায়শই তাঁর লেখকীয় ভূমিকায় (persona) গ্রহণ করতেন। উদাহরণস্বরূপ, ব্লীক হাইস  এ দূর্গত ক্রসিং ঝাড়–দার, জোয়ের মৃত্যু বর্ণনাকারী অধ্যায়ের উপসংহারটি:

মারা গেছে, মহামান্য। মারা গেছে, প্রভু ও ভদ্রমহোদয়গণ। মারা গেছে, প্রতিটি ব্যবস্থার সঠিক রেভারেন্ড ও ভুল রেভারেন্ড। মারা গেছে, ভাই ও বোনেরা, আপনাদের হৃদয়ে ঐশ্বরিক দয়ায় জাত। আর আমাদের চারপাশে এভাবেই প্রতিদিন মারা যাচ্ছে।

আবার পুনরাবৃত্তি অবশ্যই মজারও হতে পারে, যেমন- মার্টিন অ্যামিজের মানি  র এই প্যাসেজটিতে:

যথেষ্ট মজার ব্যাপার হলো, সেলিনাকে আসলে যে আমার সাথে বিছানায় যেতে চাওয়াতে পারি, তার একমাত্র উপায় হলো তার সাথে বিছানায় না যেতে চাওয়া। এটা কখনো ব্যর্থ হয় না। এতে সত্যিই সে ভাবে থাকে। সমস্যাটা হলো আমি যখন তার সাথে বিছানায় যেতে চাই না (আর তা-ই ঘটে), তখন আমি তার সাথে বিছানায় যাই না। কখন হয় এটা? কখন তার সাথে আমি বিছানায় যেতে চাই না? যখন সে আমার সাথে বিছানায় যেতে চায়। তার সাথে আমি বিছানায় যেতে পছন্দ করি যখন আমার সাথে বিছানায় যেতে চাওয়াটা তার শেষ চাওয়া হয়। সে প্রায় সব সময় আমার সাথে বিছানায় যায়, যদি তার সাথে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করি কিংবা তাকে হুমকি দেই কিংবা তাকে যথেষ্ট অর্থ দেই।

দেখিয়ে দেয়ার কদাচিৎ প্রয়োজন হয় যে “সাথে বিছানায় যাওয়া” বাক্যংশের পুনরাবৃত্তি, যার জন্য যে কোনো সংখ্যক বিকল্প সহজপ্রাপ্য, তা দিয়ে সেলিনার সাথে কথকের যৌন সম্পর্কের হতাশা ও স্ববিরোধীতা খুব বেশি হাস্য-রসাত্মক ও বক্রাঘাতমূলক করে তোলা হয়েছে। (আপনার সন্দেহ থাকলে মার্জিত তারতম্য ব্যবহার করে প্যাসেজটি পুনরায় লেখার চেষ্টা করে দেখুন।) শেষ বাক্যটিও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পুনরাবৃত্তিকে উদাহরণসমেত হাজির করে: পুরো উপন্যাসে বিষয়বস্তুগত মূল শব্দের পৌনঃপুনিকতা — এ ক্ষেত্রে, “অর্থ”। “বিছানায় যাওয়া” নয় “অর্থ”ই এইমাত্র উদ্ধৃত করা অনুচ্ছেদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ শেষ শব্দের জায়গা দখল করে আছে। এভাবে টেক্সটের ম্যাক্রো পর্যায়ের এক ধরনের পুনরাবৃত্তি মাইক্রো পর্যায়ের তারতম্য হিসেবে কাজ করে।


আগের পর্ব                                                                                                                           পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*