কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: নামাবলী

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


নামাবলী


… এবং একটা মেয়ে যার সাথে আপনার এখনো পরিচয় হয় নি, যে এখন এগিয়ে আসছে পাশের মধ্যবর্তী পথের ছায়া থেকে, যেখানে সে ওত পেতে আছে বেদির পাতে অন্যদের সাথে যোগদানের জন্য। তাকে ডাকা যায় ভায়োলেট বলে, না, ভেরোনিকা বলে, ভায়োলেট নয়, অসম্ভাব্য একটি নাম। কেননা সে নাম আইরিশ বংশোদ্ভূত ক্যাথলিক মেয়েদের নাম, কেলটিক জনশ্রুতির সাধু-সন্তদের নাম অনুসারে যে নাম প্রথাগতভাবে রাখা হয়, কারণ আমার ভাল লাগে ভায়োলেটের ব্যঞ্জনার্থ — সংকোচনশীল, অনুশোচনামূলক, বিষাদময় — বামনাকৃতির, কালো চুলের মলিন সুন্দর মুখাবয়ব যা চুলকানিতে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, স্মার্টলি কাটা মোটা কাপড়ের কোটটি দুঃখজনকভাবে কোঁচকানো ও ময়লায় ভরা; এসব প্রমাণ থেকে আপনি হয়তো আঁচ করতে পারছেন এমন একটি মেয়েকে যে সমস্যা, দোষ, বিপত্তিতে জরাজীর্ণ।

ড্যাভিড লজ হাউ ফার ক্যান ইউ গৌ? (১৯৮০)

আর আপাতত ভিক উইল্কক্সকে সেখানে বাদ দিয়ে নিতান্ত ভিন্ন কোনো চরিত্রের সাক্ষাৎ লাভ করতে যখন সময়মতো দু-এক ঘন্টা আমরা মহাশুন্যে কয়েক মাইল ফিরতি যাত্রা করি । আমার কাছে বেশ অদ্ভূত ঠেকলেও এমন এক চরিত্র যার চরিত্রের ধারণার উপর কোনো বিশ্বাস নেই। অর্থাৎ (তার নিজের প্রিয় একটা বাক্যাংশ) রোবেন পেনরোজ যে রুমিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অস্থায়ী প্রভাষক, তার মত হচ্ছে “চরিত্র” বুর্জোয়াদের পুরাণ, ভ্রম– যা সৃষ্টি করা হয়েছে পুঁজিবাদের আদর্শকে বলবৎ করতে।

ড্যাভিড লজ নাইস ওয়ার্ক (১৯৮৮)

“সে ক্ষেত্রে,” সে বললো, “তোমাকে মান্য করে আমার খুশি লাগছে। আমার নাম কুইন।”

            “আহ্ ,” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে স্টিলম্যান চিন্তাপূর্ণভাবে বললো। “কুইন।”

            “হ্যাঁ, কুইন, কু-ই-ন।”

            “বুঝেছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি। কুইন। হুম। হ্যাঁ। খুবই মজার। কুইন। খুবই অনুরণনশীল একটা শব্দ। টুইনের(জমজ) সাথে ছন্দ মেলে, তাই না?”

            “ঠিক বলেছো। টুইন।”

            “আর সিনের(পাপ) সাথেও, যদি ভুল না করে থাকি।”

            “না ভুল করো নি।”

            “আর একটা এন দিয়ে ইনের(ভেতর) সাথে কিংবা দুটো এন দিয়ে ইনের(সরাইখানা) সাথে। তাই না?”

            “একদম ঠিক।”

            “হুম। খুবই মজার। এ শব্দটির এ কুইনের এ… কুইডিটির (সহজাত বৈশিষ্ট্য) …কুইনটেসন্স(উৎকৃষ্ট রূপ)। যেমন কুইক(দ্রুত)। আর কুইল(পালক)। আর কোয়্যাক(হাতুড়ে ডাক্তার বা হাঁসের ডাক)। আর কুয়ার্ক(মুদ্রাদোষ)। হুম। গ্রিনের(দেঁতো হাসি) সাথে ছন্দ মেলে। কিনের(আত্মীয়) কথা বাদই দিলাম। হুম। খুবই মজার। আর উইন (জয়)। আর ফিন (মাছের ডানা)। আর ডিন(হৈ চৈ)। আর পিন। আর টিন। আর বিন(পাত্র)। জিনের সাথেও ছন্দ মেলে। হুম। আর যদি তুমি এটা ঠিক মনে করো, তাহলে বীনের (হয়ে গেছে এমন) সাথে। হুম। হ্যাঁ, খুবই মজার। তোমার নাম আমার ব্যাপক ভাল লেগেছে, কুইন সাহেব। এ নাম তৎক্ষণাৎ এত ছোট ছোট দিকে চলে যায়।”

            “হ্যাঁ, আমি নিজেই তা প্রায়শই খেয়াল করেছি।”

পল অস্টার সিটি অব গ্লাস (১৯৮৫)




কাঠামোবাদের মৌলিক নীতিগুলোর একটি হচ্ছে “চিহ্নের স্বেচ্ছাচারিতা”, যে ধারণা মতে শব্দ ও যা কিছুর জন্য সে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তাদের মধ্যে আবশ্যিক, অস্তিত্বশীল কোনো সম্পর্ক নেই। লোকটি যেমন বললো “সেগুলোকে ঠিকভাবে শুকর বলা হয়” না,  তবে বলা হয় ভাষাতাত্ত্বিক দৈব বলে। অন্যান্য ভাষায় অন্যান্য শব্দও একই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে। ফার্ডিন্যান্ড দ্য সস্যূরের তিন শত বছর আগে শেক্সপিয়ার লক্ষ্য করেছিলেন “গোলাপকে যে নামেই ডাকেন না কেন তার গন্ধ মিষ্টিই হবে।”

 এ ব্যাপারে সঠিক নামের অদ্ভূত ও মজাদার অবস্থান রয়েছে। আমাদের প্রথম নামগুলো সাধারণত দেয়া হয় অর্থগত অভিপ্রায় নিয়ে, আমাদের পিতা-মাতাদের জন্য যেগুলো কোনো সুখকর কিংবা আশাব্যঞ্জক অনুষঙ্গ বহন করে, কিন্তু সে অনুযায়ী আমরা আমাদের জীবন-যাপন করতেও পারি, নাও পারি। বংশনামগুলোর বর্ণনাত্মক জোর এককালে যতই থাকুক না কেন, সেগুলোকে অবশ্য স্বেচ্ছাচারী হিসেবে দেখা হয়। আমরা প্রত্যাশা করি না যে আমাদের প্রতিবেশী শেফার্ড (মেষপালক) সাহেব ভেড়া দেখাশুনা করুক কিংবা সে পেশার সাথে মানসিকভাবে নিজেকে জড়াক। অবশ্য সে যদি উপন্যাসের চরিত্র হয়ে থাকে, তাহলে গ্রামীণ এবং সম্ভবত বাইবেলের অনুষঙ্গ অপরিহার্যভাবে এসে যাবে। সাহিত্য ইতিহাসের বড় বড় রহস্যের একটি হচ্ছে সে রহস্য যা পরম সম্মানিত হেনরি তাঁর একটি চরিত্রকে ফ্যানি অ্যাসিঙহ্যাম বলে ঠিকঠিক বুঝিয়েছেন।

 উপন্যাসে নাম কখনো নিরপেক্ষ হয় না। নাম সব সময় তাৎপর্য্য বহন করে যদি তা শুধু গড়পড়তা আকারে হয়। কমিক, ব্যঙ্গাত্মক কিংবা শিক্ষামূলক লেখার লেখকেরা তাঁদের নামকরণের (থোয়াকাম, পাম্বলচুক, পিলগ্রিম) ক্ষেত্রে উচ্ছ্বসিতভাবে উদ্ভাবনকুশল, না হয় স্পষ্টত রূপকাশ্রয়ী। বাস্তববাদী ঔপন্যাসিকেরা মামুলি নামগুলো যথাযথ ব্যঞ্জনার (এমা উডহাউস, অ্যাডাম বীড) ব্যবহারে পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেন। চরিত্রের নামকরণ চরিত্র সৃষ্টিতে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যাতে থাকে নানা বিচার-বিবেচনা, আর ইতস্ততা। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তা খুবই সুবিধাজনকভাবে উদাহরণ দিয়ে হাজির করেছি।

 প্রগতিশীল ধর্মতত্ত্ব দ্বারা প্রথাগত ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তি দুর্বল করা এবং “কাঠামো ভেঙে ফেলা” কৌশল দ্বারা সাহিত্য রীতির ভিত্তি দুর্বল করা — উভয় ক্ষেত্রে হাউ ফার ক্যান ইউ গৌ?  শিরোনামের প্রশ্নটি প্রযোজ্য। “কাঠামো ভেঙ্গে ফেলা”র ব্যাপারটি তো আমি অনুপ্রবেশকারী লেখকের কণ্ঠ সম্পর্কে আগেই (সেকশন ২ দেখুন) উল্লেখ করেছি। তো এখন প্রশ্নটি যে উভয়ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলা হলো, তার কারণ টেকস্টের মাঝখানে চরিত্রের নামের ব্যাপারে লেখকের মন খোলাখুলিভাবে পরিবর্তন করার জন্য এটি অনায়াসে চোখে পড়ার মতো বিশেষ স্বীকারোক্তি যে গোটা কাহিনীটা “বানানো”, এমন কিছু যা পাঠক জানে তবে চেপে রাখে, যেমন ধর্ম বিশ্বাসীরা তাদের সন্দেহকে চেপে রাখে। ঔপন্যাসিকেরা তাঁদের চরিত্রগুলোর যে নাম দেন সে নামের ব্যঞ্জনা ব্যাখ্যা করা তাঁদের জন্য প্রথামাফিকও নয়: এরকম পরামর্শ পাঠকের চেতনায় মগ্নচৈতন্যরূপে কাজ করার কথা।



রচনার শেষ পর্যায়ে শুধু কয়েকটা কী চেপে চরিত্রের নাম পরিবর্তন করা সহজ হয়েছে ওয়ার্ড প্রসেসরের কারণে, কিন্তু আমার কথাসাহিত্যে সবচেয়ে ছোট চরিত্র ব্যতীত অন্য কোনো চরিত্রে সেটা করার ক্ষেত্রে আমার প্রবল আপত্তি থাকতো। নাম পছন্দ করার ক্ষেত্রে কেউ দ্বিধা করতে ও যন্ত্রণাকাতর হতে পারে, কিন্তু একবার ঠিক করে ফেললে তা চরিত্র থেকে পৃথক করা যায় না, আর বিনির্মাণবাদীরা যেমনটা বলে থাকেন যে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানে মনে হয় পুরো প্রকল্পটাকে অতলে নিক্ষেপ করা। নাইস ওয়ার্ক  লেখার প্রক্রিয়ায় এ ব্যাপারে আমাকে অনেক সচেতন করা হয়েছিলো।

এ  উপন্যাসে প্রকৌশল কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে বাধ্য একজন তরুণ শিক্ষকের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয় উপজীব্য হিসেবে রয়েছে। উপরের উদ্ধৃতি অনুযায়ী এতে কাঠামো ভেঙ্গে ফেলা কিছু জনান্তিক (aside) থাকলেও হাউ ফার ক্যান ইউ গৌ? এর চেয়ে এ উপন্যাসটি সাধারণত বেশি সোজাসুজিভাবে   বাস্তববাদী, এবং চরিত্রগুলোর নামকরণের ক্ষেত্রে আমি যে নামগুলোর সন্ধান করছিলাম, প্রতীকি যথার্থতা আড়াল করতে সেগুলো যথেষ্ট “স্বাভাবিক” মনে হবে। নামের গড়পড়তা ও ইংরেজপনার অন্তরালে স্থুল পৌরুষের ইঙ্গিত দিতে আমি লোকটির নাম দিয়েছিলাম ভিক উইলকক্স, আর সাহিত্য ও সৌন্দর্যের{( pen and rose) কলম ও গোলাপ} তুলনামূলক ব্যঞ্জনার্থের উদ্দেশ্যে আমার নায়িকার বংশ নাম পেনরোজ দ্রুত ঠিক করেছিলাম। তার প্রথম নাম বাছাইয়ের ব্যাপারে- রাসেল, রেবেকা নাকি রবার্টা- এ দোলাচলে থেকে অবশ্য কিছু সময় দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, আর আমার মনে আছে যে দ্বিতীয় অধ্যায়ে  এতে করে অগ্রগতি বেশ খানিকটা বাধাগ্রস্ত হয়েছিলো, কেননা তার নাম স্থির না করা পর্যন্ত এ চরিত্রকে কল্পনায় জায়গা দিতে পারি নি। পরিশেষে চরিতাভিধানে দেখতে পেলাম যে রবিন বা রোবিন রবার্টার পরিচিত রূপ হিসেবে কখনো কখনো ব্যবহার করা হয়। আমার নারীবাদী ও দৃঢ়প্রত্যয়ী নায়িকার জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষ নাম অনেক যথাযথ মনে হলো, আর সঙ্গে সঙ্গে প্লটে নতুন একটা বাঁকের ইঙ্গিত পেলাম: উইল্কক্স তার ফ্যাক্টরিতে উপস্থিত থাকার জন্য পুরুষ রবিনকে আশা করতে থাকবে।

উপন্যাস লেখার প্রায় মাঝপথে আমার উপলব্ধি হলো যে সম্ভবত ই. এম. ফর্সটারের একই মানসিক পথ ধরে হাওয়ার্ডজ এনড  এর প্রধান পুরুষ চরিত্র, হেনরি উইল্কক্স বুদ্ধিজীবী নারীর প্রেমাবিষ্ট আরেক ব্যবসায়ী, তার বংশ নাম ভিকের জন্য নির্বাচন করে ফেলেছি। আমার নায়কের নাম বদল করার চেয়ে দুটো বইয়ের সমরূপতার (parallel) উপর জোর দিয়ে– যেমন রোবিনের ছাত্রী ম্যারিয়নের টি-শার্টের উপর জনশ্রুতি “শুধু সংযোগ ঘটানো”(ফর্সটারের উপন্যাসের এপিগ্রাফ) দিয়ে উপন্যাসটির ইন্টারটেক্সচুয়াল পর্যায়ে আমি হাওয়ার্ডজ এন্ড কে অন্তর্ভূক্ত করলাম। আর ম্যারিয়ন কেন? হয়তো এ কারণে যে সে একজন “কুমারী মেয়ে” যার নিস্পাপতা ও সতীত্ব রক্ষা করতে রোবিন(রবিন হুডের সাথে তুলনীয়) উদ্বিগ্ন থাকে, হয়তো তার কারণ এই যে সম্ভাবনাময়ী তরুণী জর্জ এলিয়টকে(যে রোবিনের শিক্ষকতায় বিশিষ্টরূপে হাজির হয়) বলা হতো ম্যারিয়ন ইভানজ। আমি “হয়তো” বলেছি, কারণ এসব বিষয়ে লেখকেরা তাঁদের প্রেষণা সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকেন না।

প্যাসেজটি পল অস্টারের সিটি অব গ্লাস  থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এটি তাঁর উল্লেখযোগ্য তিনটি উপন্যাসিকার একটি, যে তিনটি মিলে নিউ ইয়র্ক ত্রয়ী  গঠন করেছে। তো  সে প্যাসেজটি সাহিত্য রসমণ্ডিত টেকস্টের নামসমূহের নিহিত তাৎপর্য্যকে চরম উদ্ভটবাদীর (absurdist) দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ তিনটি গল্প গোয়েন্দা কাহিনীর ব্যবহারজীর্ণ ও গৎবাঁধা ধারণাকে পরিচয়, কার্য-কারণ ও অর্থের ব্যাপারে উত্তরাধুনিক সংশয়বাদের অধীন করে তুলেছে। কুইন নিজেই গোয়েন্দা কাহিনী লেখে উইলিয়াম উইল্সন ছদ্মনামে, যা আবার ঘটনাক্রমে পোয়ের বিখ্যাত ডপেলগ্যাঙ্গার (জীবিত ব্যক্তির ভৌতিক প্রতিরূপ) (সেকশন ৪৭ দেখুন)  এর সন্ধানে ব্যস্ত এক ব্যক্তির  গল্পের নায়কের একই নামে নাম। স্টিলম্যান নামে সাবেক এক অধ্যাপক যে জেল থেকে সম্প্রতি ছাড়া পায়, আর যাকে কুইনের মক্কেল, ওরফে উইল্সন, ওরফে অস্টার বলে আশঙ্কা করা হয়, “অস্টারের গোয়েন্দা এজেন্সির পল অস্টার” কে ভুলভাবে শনাক্ত করে কুইন সে ভূমিকায় অভিনয় করতে প্ররোচিত হয়। স্টিলম্যান একটা বই লিখেছে যেখানে সে এই মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় যে চিহ্নের স্বেচ্ছাচারিতা আদি পাপের পরিণতিতে হয়েছিলো।

স্বর্গীয় বাগানে আদমের একটা কাজ ছিলো প্রতিটি জড় ও জীবের নাম দেওয়ার জন্য ভাষা সৃষ্টি করা। নিস্পাপতার সেই অবস্থায় তাঁর জিহ্বা খুব দ্রুত কাজ করছিলো। যেসব জিনিস তিনি দেখলেন সেসবের জন্য তিনি শুধু তাঁর শব্দ জুড়ে দেন নি, সে শব্দগুলো সেসবের সারসত্তাকে প্রকাশ করেছিলো, আক্ষরিকভাবে সেসবকে জীবন্ত করে তুলেছিলো। কোনো বস্তু এবং তার জন্য ব্যবহৃত নাম বিনিময়যোগ্য ছিলো। পতন ঘটার পর এটি আর সত্য রইলো না। বস্তু থেকে নাম পৃথক হলো; শব্দ পরিণত হলো স্বেচ্ছাচারী চিহ্নের ভাণ্ডারে; ভাষা ঈশ্বরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলো। কাজেই স্বর্গীয় বাগানের গল্পটা মানুষের পতনকেই শুধু ধারণ করে না ভাষার পতনকেও ধারণ করে।

খেয়ালি মুক্ত সাহচর্যের ধারায় স্টিলম্যান ও কুইনের ঘটনাক্রমে দেখা হলে এ বিষয়টাকে দেখাতেই যেন স্টিলম্যান কুইনের নামকে বিনির্মাণ করে। কুইনের নামের দ্যোতনা কোথাও গিয়ে থামে না, আর কাজেই ব্যাখ্যা করার চাবি হিসেবে পাঠকের কাছে অকাজের হয়ে ওঠে।

            দ্বিতীয় গল্প, গৌস্টস  এ রঙের নামে সব চরিত্রের নাম থাকে।

সর্ব প্রথমে নীল থাকে। পরে সাদা, আর তারপর কালো, আর শুরুর আগে বাদামী থাকে। বাদামী তাকে ঢেকে ফেলে, বাদামী তাকে কাজ শেখায়, আর বাদামীর বয়স হয়ে গেলে নীল সে দায়িত্ব নেয়। এভাবেই শুরু হয়…। ঘটনাটি যথেষ্ট সরল মনে হচ্ছে। সাদা চায় নীল কালো নামে এক ব্যক্তিকে অনুসরণ করুক এবং যতক্ষণ সম্ভব তার উপর নজর রাখুক।



সুস্পষ্টভাবে কৃত্রিম নামকরণের এ ব্যবস্থায়  স্বেচ্ছাচারিতা যেখানে (কথাসাহিত্যে নামকরণ) সাধারণত থাকে না সেখানে তা চালু করে অস্টার আবার ভাষার স্বেচ্ছাচারিতার কথা বলেন। তৃতীয় গল্প, দ্য লকড রূম  এ কথক স্বীকার করে যে এক ঔপন্যাসিকের কাজকর্ম প্যারডি করে কীভাবে সে সরকারি আদমশুমারীর ফলাফল নকল করেছিলো:

নাম বানানোর আনন্দ সবচেয়ে বেশি ছিলো। মাঝে মাঝে অদ্ভূত, প্রচণ্ড হাস্যরসাত্মকের জন্য, শব্দ কৌতুকের জন্য, নোংরা শব্দের জন্য আমার তাড়নাকে দমন করতে হয়েছিলো — কিন্তু বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে বাস্তবতার চৌহদ্দির সীমানায় খেলা করে সন্তুষ্ট ছিলাম।

তিনটা গল্পেই দ্যোতককে দ্যোতিতের সাথে সংযুক্ত করার অসম্ভবতা, নিস্পাপতার সেই পৌরাণিক, পতনপূর্ব অবস্থা যার মধ্যে বস্তু ও তার নাম বিনিময়যোগ্য ছিলো, তার অসম্ভবতা প্লটের পর্যায়ে হুবহু নকল করা হয় অপরাধ মীমাংসার রুটিনের ব্যর্থতা দ্বারা । প্রতিটি কথন শেষ হয় গোয়েন্দা চরিত্রের মৃত্যু কিংবা হতাশা দিয়ে, যে চরিত্র মুখোমুখি হয় অমীমাংসাযোগ্য রহস্যের, হারিয়ে যায় নামের গোলক ধাঁধাঁয়।


আগের পর্ব:  রহস্য                                                                                                                      পরের পর্ব: চেতনা প্রবাহ রীতি




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*