কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: ফ্যান্সি প্রোজ

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল : ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


ফ্যান্সি প্রোজ


ললিতা, আমার জীবনের আলো, আমার অঙ্গের আগুন। আমার পাপ, আমার আত্মা। ল-লী-তা: জিহ্বার অগ্রভাগ তালুর নিচের দিকে মৃদৃ আঘাত করতে তিন ধাপে যাত্রারত, তৃতীয় ধাপে, দাঁতের উপরে। লো। লী। তা।

            সকালে একটা মোজা পরে চার ফুট দশ ইঞ্চি দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে ছিলো লো, সাদামাটা লো। ট্রাউজারে সে ছিলো লোলা। স্কুলে ছিলো ডলি। ডটেড লাইনে ছিলো ডলারস। কিন্তু আমার বাহুডোরে সে সব সময় ছিলো ললিতা ।

            তার কি কোনো পূর্বসূরী ছিলো? ছিলো, আসলেই ছিলো। প্রকৃত পক্ষে, কোনো ললিতাই থাকতো না যদি, কোনো এক গ্রীষ্মে কোনো এক প্রারম্ভিক মেয়ে-শিশুকে আমি ভাল না বাসতাম। সমুদ্র পাড়ে যুবরাজের রাজ্যে। ওহ্ কখন? ললিতা জন্মানোর প্রায় ততগুলো বছর আগে যতগুলো বছর সে গ্রীষ্মে আমার বয়স হয়েছিলো। ফ্যান্সি প্রোজ শৈলীর জন্য আপনি সর্বদা খুনীর উপর নির্ভর করতে পারেন।

            সভার ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, এক নম্বরে দেখান যা দেবদূতরা, ভুল জানা, সাধারণ, মহৎ ডানাওয়ালা দেবদূতরা ঈর্ষা করেছিলো। কাঁটাগুলোর এ জটে তাকান।

ভ্লাদিমির নবোকভ ললিতা  (১৯৫৫)

কথাসাহিত্যের গদ্যের সোনালী নিয়ম হলো যে প্রত্যেক লেখক তাঁর নিজের জন্য যে নিয়মাবলি প্রতিষ্ঠা করেন সেগুলো ব্যতীত কোনো নিয়ম নেই। পুনরাবৃত্তি ও সারল্য হেমিংওয়ের শৈল্পিক উদ্দেশ্যে (সাধারণত) কাজ করেছিলো। তারতম্য ও শোভাবর্ধন (decoration) কাজ করেছিলো নবোকভের জন্য, বিশেষত তাঁর ললিতা য়। এ উপন্যাসটি এক ব্যক্তির বিশেষ অনুনয়ের উজ্জ্বল লেখার রূপ পরিগ্রহ করে, এক ধরনের বয়ঃসন্ধিকালের মেয়ের প্রতি যার আকর্ষণ, যাকে সে “যৌন আবেদনময়ী কিশোরী” বলে ডাকে, সে আকর্ষণ কুকাজ করতে তাকে চালিত করে। বইটি প্রথম প্রকাশে বিতর্কের সৃষ্টি করে, আর এখনো ব্যাঘাত ঘটায়, কারণ তা এক শিশু নির্যাতক ও খুনিকে প্ররোচনামূলক বাগ্মিতা প্রদান করে। হামবার্ট হামবার্ট যেমনটা বলেন, “ফ্যান্সি প্রোজ শৈলীর জন্য আপনি সর্বদা খুনীর উপর নির্ভর করতে পারেন।”

উপন্যাসটির সূচনা প্যাসেজে অবশ্য প্রচুর পুনরাবৃত্তি রয়েছে, তবে তা আভিধানিক শব্দের পুনরাবৃত্তি নয়, যেমনটা পূর্ববর্তী সেকশনে আলোচিত হেমিংওয়ের প্যাসেজটিতে আমরা দেখতে পাই। এটা সমরূপীয় বাক্যবিন্যাস গঠন ও অনুরূপ ধ্বনির বিষয় — বস্তুত, শুধু এক ধরনের পুনরাবৃত্তি যা আপনি কবিতায় পাওয়ার প্রত্যাশা করেন। (ফ্যান্সি প্রোজের আরেক নাম কাব্যময় গদ্য।) উদাহরণস্বরূপ, প্রথম অনুচ্ছেদে অনুপ্রাসের যথার্থ অগ্নিকর্মের প্রদর্শন রয়েছে, প্রেমিকার নামের উল্লসিত উদযাপনে “l” ও “t” এর উজ্জ্বল বিস্ফোরণ রয়েছে: আলো(light) , জীবন(life), অঙ্গ(loins), অগ্রভাগ(tip), জিহ্বা(tongue), যাত্রা(trip), লো। লী। তা

চারটি অনুচ্ছেদের প্রতিটি ভিন্ন ধরনের ডিসকোর্স প্রদর্শন করে। এর প্রথমটা হচ্ছে গীতিময়তার বহিঃপ্রকাশ, সমাপিকা ক্রিয়া ছাড়াই আবেগসূচকতার পরম্পরা। এ অনুচ্ছেদের সূচনায় রূপকের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত ও শব্দ চয়ন খানিকটা অপ্রচলিত: আমার জীবনের আলো, আমার অঙ্গের আগুন। আমার পাপ, আমার আত্মা। (light of my life, fire of my loins. My sin, my soul.(এখানে বেশি অনুপ্রাস )। পরের রূপক of the tongue tripping down the palate to tap on the teeth, বেশি ঘরোয়া ও হাস্য-রসাত্মক, কিন্তু এটি বাগ্মিতা ও কাম বাসনা উভয় কাজেই ব্যবহৃত অঙ্গের মনোযোগ আকর্ষণ করে, এ চরিত্রে কখনোই তা অনেক দূরে নয়।

দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটি হালকা স্মৃতিচারণমূলক। একই রকম গঠনের উপবাক্যের পরম্পরায় অপবিত্র পুনরাবৃত্তিতে প্রেমিকার বিচিত্র নামের তালিকা থাকে: সে ছিলো লোসে ছিলো লোলাছিলো ডলি …  ছিলো ডলারস। কিন্তু আমার বাহুডোরে সে সব সময় ছিলো ললিতা। আপনি এতে সুর লাগাতে পারেন। (বস্তুত ললিতা র হতভাগা মঞ্চ সঙ্গীত-নাট্য হয়েছিলো। “সুন্দর ছোট্ট ফ্লপ,” নবোকভ তাঁর ডায়েরিতে লেখেন।) আর অবশ্য আমরা ইতোমধ্যে না জানলে, এ অনুচ্ছেদটি প্রথম ধারণা প্রদান করে যে ললিতার উচ্চতা, মোজা ও স্কুলের রেফারেন্সে সে কামনার অল্পবয়সী পাত্রী ছিলো।

তৃতীয় অনুচ্ছেদটিতে অন্য আরেকটি বিষয় উঠে আসে। সেটা আরো কথোপকথনমূলক; নাটকীয় স্বগতোক্তির (dramatic monologue) রীতিতে অনির্দিষ্ট কথোপকথনকারীর নিহিত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে: “তার কি কোনো পূর্বসূরী ছিলো?” কাব্যিক বাহুল্যে এর হ্যাঁ-বাচক উত্তর দেয়া হয়: “ছিলো, ছিলো।” আদালতীয় বাক্যাংশ, “প্রকৃতপক্ষে” শেষ অনুচ্ছেদে আদালত-কক্ষের অনুষঙ্গের স্পষ্ট স্মারকের জন্য আমাদের প্রস্তুত করে। (হামবার্ট বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তাঁর কৈফিয়ত (apologia) লিখছে বলে ধরা যায়।) “ওহ্, কখন?” এ প্রশ্নের ধাঁধাঁময়, পরোক্ষ উত্তর হামবার্ট ও ললিতার বয়সের অসমতা প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।

এ অনুচ্ছেদে কথনের মজা শুরু হয় কার্য-কারণ ঘটিত প্রশ্ন উত্থাপন দিয়ে (“… থাকতো না যদি…  আমি …না …”) এবং “প্রারম্ভিক মেয়ে শিশু”র পরিচয় দিয়ে। এ গদ্যের কাব্যগুণকে উঁচুমাত্রায় পৌঁছে দেয় এডগার অ্যালেন পোয়ের সুপরিচিত কবিতা “অ্যানাবেল লী”র উল্লেখ:

আমি ছিলাম শিশু এবং সে ছিলো শিশু,

সমুদ্রের পাশে এই রাজ্যে

তবে প্রেমাধিক প্রেম দিয়ে ভালবেসেছিলাম–

আমি ও অ্যানাবেল লী–

এমন প্রেম দিয়ে যে স্বর্গের ডানাওয়ালা সেরাফ

হয়েছিলো ব্যাকুল আমার ও তার জন্য।

তরুণীদের উপর হামবার্টের যৌন কাতরতার ব্যাখ্যা ও অজুহাত হচ্ছে যে অ্যানাবেল নামে এক কিশোরী প্রেমিকা তাদের প্রেমের পূর্ণতা পাওয়ার আগে মারা যায়। এই একই বিষয়বস্তুর উপর মৃত্যুর ভাবাবেগপূর্ণ শোকগাঁথা(threnody) হচ্ছে পোয়ের কবিতা: বক্তা ঈর্ষান্বিত দূতদের দোষারোপ করে এ জগৎ থেকে তার প্রেমিকাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এবং তার কবরের পাশে থেকে সান্ত্বনা খুঁজে পায়। হামবার্ট অবশ্য তার অ্যানাবেলের জন্য যৌন আবেদনময়ী প্রতিভূ অসাধুতার সাথে খোঁজে। দেবদূতদের প্রতি সে পৈশাচিক অবজ্ঞামূলক বিশেষণ প্রয়োগ করে, “ভুল জানা, সাধারণ, মহৎ ডানাওয়ালা দেবদূতরা,” এবং দেবত্ব-কলঙ্ক আরোপকারী ইঙ্গিত যে তার নিজের ভোগান্তি কন্টক মুকুটের সাথে তুলনীয়। (একটা টেক্সটের সাথে আরেকটির এমন ভঙ্গি ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি নামে পরিচিত, আর এটি আরেকটি সেকশনের দাবি রাখে।)

নিজের মাতৃভাষা না হয়েও সে ভাষায় নবোকভের নিপুণতা কখনো বিস্ময়রহিত হয় নি; তবে সম্ভবত এ সত্যের বদৌলতে তিনি ইংরেজি গদ্যের পূর্ণ সম্পদ আবিষ্কার করতে পেরেছেন, আর পেরেছেন নিঃসঙ্কোচ আনন্দের সাথে সে সম্পদের ব্যবহার করতে।

ইংরেজি কথাসাহিত্যে “ফ্যান্সি প্রোজ” এর প্রাচীন চর্চাকারীদের একজন হচ্ছেন — বস্তুত কেউ হয়তো তাকে প্রথম হিসেবে বলার ঝুঁকি নিতে পারেন — এলিজাবেথীয় যুগের লেখক জন লিলি, যার ইউফিউয়াস: দী অ্যানাটমি অব উইট (১৫৭৮) সে সময়ে খুবই ফ্যাশনেবল বই ছিলো এবং ইংরেজি ভাষায় “ইউফিউইজম” ও বিশেষণ “ইউফুইসটিক” শব্দ উপহার দিয়েছিলো (ইউফেমিজম/ইউফেমিসটিকের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না)। এই দেখুন তার নমুনা:

সজীবতম রঙগুলো শীঘ্রই বিবর্ণ হয়ে যায়, তীক্ষ্মতম রেজরটির ধার শীঘ্রই ভোঁতা হয়ে যায়, মিহিতম কাপড়টি শীঘ্রই উইপোকায় খেয়ে ফেলে, আর ক্যাম্রিকটি মোটা ক্যানভাসের চেয়ে শীঘ্রই দাগ ফেলে। এই ইউফিউয়াসে যা ভালভাবে আবির্ভূত হয়েছিলো, মোমের মতো যার বুদ্ধি যে কোনো ধারণা গ্রহণ করার যোগ্য ও তার নিজের হাতে মাথা বহন করার যোগ্য লাগাম কিংবা স্পার ব্যবহার করার জন্য, পরামর্শকে তোয়াক্কা না করে, দেশ ত্যাগ করে, তার পুরানো পরিচিতদের অবজ্ঞা করে, বুদ্ধি দ্বারা বিজয় লাভের চিন্তা কিংবা লজ্জা দ্বারা কোনো দ্বন্দকে জিইয়ে রাখে; যে বন্ধুদের সামনে ফ্যান্সি ও আসন্ন সম্মানের সামনে বর্তমান রসবোধ অধিকতর পছন্দ করে, তার রুচির তুলনায় অতি বেশি লবণ থাকায় তিনি পানিতে বুদ্ধি ঢেলেছেন, আর বল্গাহীন স্নেহ অনুসরণ করেছেন, যা তার দাঁতের জন্য সবচেয়ে বেশি সুখকর।

সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃত অংশগুলোতে  এটা চতুর ও মজার, তবে কয়েক পৃষ্ঠা পরে এর শৈলীগত প্রদর্শনবাদের ঘ্যান ঘ্যান দ্বারা আধুনিক পাঠককে ক্লান্ত করার জন্য যথেষ্ঠ। বাক্য বিন্যাস ও ধ্বনির একই ধরন বারবার ব্যবহৃত হয়েছে, আর সব চরিত্র এমনকি লেখকীয় কণ্ঠেও ব্যবহৃত হয়েছে। এ ধরনের গদ্য একান্তই সাহিত্য রসমণ্ডিত, একেবারে লিখিত জগতের অধিকারে। ইউফিউয়াসললিতা র মধ্যে ইংরেজি কথাসাহিত্যের গদ্যে যা বাদ গেছে বা যা ঢুকেছে, তা হলো মানুষের কণ্ঠ বা নানা কণ্ঠের ধ্বনি, যা কথা বলছে বিচিত্র টান, ছন্দ, ও আঞ্চলিক ভাষায়, আর সাহিত্য অলঙ্কারের আঙ্গিকগত বিন্যাসের সংশোধন করছে ও প্রাণবন্ত করে তুলছে। এ ব্যাপারে আরো বলা যাবে “ভিন্ন কণ্ঠে বলা” শিরোনামে (সেকশন ২৭)। তবে প্রথমটা: ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি।


আগের পর্ব                                                                                                                            পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*