কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: টিনেজ স্কাজ

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


টিনেজ স্কাজ


লান্টদের সম্পর্কে বকবক করা ছাড়া বুড়ি স্যালি খুব বেশি কথা বলে নি, কারণ সে রাবার খেলায় ও নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলায় ব্যস্ত ছিলো। তখন হঠাৎ করে দেউড়ির অপর প্রান্তে চেনা এক হাঁদারামকে দেখতে পেলো। সেইসব ঘন কালো ধূসর ফ্ল্যানেল স্যূট ও চেকের গেঞ্জি পরিহিতি এক লোক। কঠোরভাবে আইভি লীগ। বিরাট ব্যাপার। দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে মরার মতো ধূমপান করছিলো এবং নরকের মতো বিরক্ত দেখাচ্ছিলো। বুড়ি স্যালি বলতেই লাগলো, “আমি জানি ছেলেটা যেন কোথাকার।” সে সব সময় কাউকে না কাউকে চিনতো, যে কোনো জায়গায় তাকে নিয়ে গেলে সেটা চিনতো, কিংবা চিনতো বলে মনে করতো। আমি খুবই বিরক্ত না হওয়া পর্যন্ত সে সেটা বলেই চললো। তাকে বললাম, “তাকে যদি চিনেই থাকো তবে ওখানটায় গিয়ে আত্মা নিংড়ানো বড় একটা চুমু খেয়ে আসলেই তো পারো। তারও ভাল লাগবে।” এটা বলায় সে আহত হলো। যদিও অবশেষে হাঁদারামটা তাকে লক্ষ্য করে এসে সম্ভাষণ জানালো। তারা যেভাবে সম্ভাষণ জানালো আপনি সেটা কখনো দেখেন নি। হয়তো ভাবছেন বিশ বছরে তাদের দেখা হয় নি। হয়তো ভাবছেন ছেলেবেলায় তারা একই গোসলখানায় বা একই সাথে অন্য কোনো জায়গায় গোসল করেছে। বুড়ো বাল্যবন্ধু। বিবমিষাকর। মজার ব্যাপার হচ্ছে তারা হয়তো একবার শুধু কোনো নকল পার্টিতে পরস্পরের সাথে দেখা করেছে। অবশেষে বুড়ি স্যালি আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলো। তার নাম কী যেন জর্জ — আমার মনেও নেই — আর সে অ্যান্ডোভারে গেলো। বিরাট বড় ব্যাপার। নাটকটা তার কেমন লেগেছিলো বুড়ি স্যালি তাকে জিজ্ঞেস করলে আপনি তাকে দেখে থাকবেন। সে এমন এক ধরনের নকল ব্যক্তিটি ছিলো যে যখন তারা কারো প্রশ্নের উত্তর দেয় তখন তাকে তাদের নিজেদের জন্য জায়গা করে দিতে হয়। তার পিছনের ভদ্রমহিলার ঠিক পায়ের উপর সে পা ফেললো। সে সম্ভবত তার পায়ের সব আঙ্গুল ভেঙ্গে ফেলেছিলো। বললো যে নাটকটা উৎকৃষ্টমানের তেমন কিছু ছিলো না, তবে লান্টরা অবশ্যই একেবারে দেবদূত ছিলো। দেবদূত। যীশুর দোহাই। দেবদূত। সেটাই আমাকে মেরে ফেলেছে। তারপার সে ও বুড়ি স্যালি যাদের যাদের চিনতো তাদের সম্পর্কে কথা বলতে লাগলো। এ আলাপ ছিলো আপনার জীবনে শোনা সবচেয়ে মেকি আলাপ।

জে. ডি. স্যালিঞ্জার দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই (১৯৫১)

রাশিয়ান শব্দ স্কাজ  বড়ই আকর্ষণীয় শব্দ (যা ইঙ্গিত দেয় “জ্যাজ” ও “স্ক্যাট” এর, যেমন ইংরেজদের কানে “স্ক্যাট-গাওয়া” শোনায়)। এটি এক ধরণের উত্তম-পুরুষের বর্ণনা রীতিকে বোঝায় যেখানে লিখিত ভাষার চেয়ে বরং মৌখিক ভাষার বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ধরনের উপন্যাস বা গল্পে কথক এমন এক চরিত্র হয় যে নিজেকে “আমি” হিসেবে সম্বোধন করে, আর পাঠককে “আপনি বা তুমি” বলে সম্বোধন করে। সযত্নে নির্মিত ও পরিমার্জিত লিখিত বর্ণনা প্রদান করার চেয়ে বরং কথ্য ভাষার শব্দ ও বাক্যবিন্যাস ব্যবহার করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গল্প বলতে দেখা যায় তাকে। সে গল্প আমরা যতটা শুনি ততটা পড়ি না। যেমনটা দেখা  যায় কোনো পানশালা বা রেলগাড়ির কামরায় কোনো বাঁচাল আগন্তুকের বেলায়। বলা বাহুল্য, এটা এক ধরনের ভ্রম, “প্রকৃত” লেখকের বহু চিন্তিত প্রয়াস ও কষ্টসহিষ্ণু পুনর্লিখনের এক ধরনের  ফসল। যে বর্ণনা বা কথন রীতি বিশ্বস্ততার সাথে বাস্তব কথাকে অনুকরণ করে তা কার্যত বোধগম্য হবে না, ঠিক যেমনটা ঘটে বাণীবদ্ধ করা কোনো আলাপের অনুলিপির ক্ষেত্রে। কিন্তু এ ধরনের ভ্রম প্রকৃত রূপ, আন্তরিকতা ও সত্য বলার ব্যাপারে শক্তিশালী প্রভাব সৃষ্টি করে।



 আমেরিকান ঔপন্যাসিকদের কাছে ইংল্যান্ড ও ইউরোপের উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত সাহিত্য ঐতিহ্য থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য স্কাজ সুস্পষ্ট একটি উপায়। মার্ক টোয়েন একে বেগবান করেছিলেন। “আমেরিকার সব আধুনিক সাহিত্যের জন্ম হয়েছে মার্ক টোয়েনের একটি বই থেকে যার নাম — হাকলবেরি ফিন,” বলেছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। কথাটি যদিও অতিশয়োক্তি, তবুও প্রদীপ্ত। টোয়েনের পরম দক্ষ অভিঘাত ছিলো দেশজ ভাষার কথ্য রীতিকে সহজ-সরল, অপরিণত কথকের সাথে মেলবন্ধন ঘটানোর মধ্যে, যেখানে  এক কিশোর যে কিনা নিজে যা জানে তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী, আর বয়স্কদের জগত সম্পর্কে যার দৃষ্টিতে বিধ্বস্তকারী সজীবতা ও সততা রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিভিন্ন ধরনের খ্রিস্টান বিশ্বাসের প্রতি হাকের এই প্রতিক্রিয়াটি লক্ষ্য করা যাক:

বিধবাটি মাঝে মাঝে আমাকে এক পাশে নিয়ে যেতো এবং মুখে পানি আসার মতো করে ঈশ্বরবিধান সম্পর্কে কথা বলতো; কিন্তু পরের দিন মিস ওয়াটসন হয়তো এটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আবার পুরো ধুলিসাৎ করে দেবে। আমার বিচারে দেখতে পেলাম দুটি ঈশ্বরবিধান আছে, আর  এক বেচারা বিধবাটির ঈশ্বরবিধান ব্যাপকভাবে দেখিয়ে বেড়াবে, কিন্তু মিস ওয়াটসনের ঈশ্বরবিধান যদি তাকে পেয়ে বসে, তবে তার আর কোনো আশা থাকবে না।

জে. ডি. স্যালিঞ্জারের হোল্ডেন কোলফিল্ড হচ্ছে হাক ফিনের উত্তরসূরী: আরো বেশি শিক্ষিত ও অত্যাধুনিক, ধনী নিউইয়র্কবাসীর ছেলে, কিন্তু হাকের মতো প্রাপ্তবয়স্কদের ভণ্ডামি, অর্থলালসা এবং তার নিজের প্রিয় ভাষায়, মেকি ভাবের জগৎ থেকে ফেরারী এক যুবক। হোল্ডেনকে বিশেষভাবে যা আতঙ্কিত করে তোলে তা হচ্ছে সেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের আচরণ মেনে নিতে তার সহচরদের আগ্রহ। গল্প চলাকালে হোল্ডেন  ব্রোডওয়েতে বিখ্যাত অভিনয় জুটি, আলফ্রেড ও লিন লান্টের বৈকালিক নাটক দেখতে তার বান্ধবীকে নিয়ে যায়। “বুড়ি স্যালি” ও বিরতির সময় দেউড়িতে দেখা পাওয়া পরিচিত ব্যক্তিটিকে উদ্ধৃত অংশে বর্ণনা করা হয়েছে সম্পূর্ণ নকল ধরনের প্রাপ্তবয়স্ক সামাজিক আচরণের প্রকাশ হিসেবে।

হোল্ডেনের বর্ণনা রীতির যে বৈশিষ্ট্য লিখিত ভাষার চেয়ে বরং মৌখিক ভাষার মতো শোনায়, আর তাতে যে এক কিশোরের কথা আছে, তা অনায়াসেই শনাক্ত করা যায়। অজস্র পুনরাবৃত্তি আছে (কারণ শব্দসম্ভারের মার্জিত পরিবর্তনে সতর্ক ভাবনার প্রয়োজন হয়) বিশেষ করে অপশব্দের পুনরাবৃত্তি, যেমন- “হাঁদারাম”, “নরকের মতো বিরক্ত”, “নকল”, “বিরাট ব্যাপার”, “আমাকে মেরে ফেলেছে” এবং “বুড়ি” (এ বিশেষণটি যে কোনো বয়সের পরিচিত কোনো কিছুর ক্ষেত্রে নির্বিচারে প্রয়োগ করা হয়)। অনেক যুবকের মতো হোল্ডেন অনুভূতির শক্তিকে প্রকাশ করে অতিরঞ্জন দিয়ে, অলঙ্কারশাস্ত্রবিদগণ যাকে বলেন অতিশয়োক্তি: “মরার মতো ধূমপান করছিলো”, “হয়তো ভাবছেন বিশ বছরে তাদের দেখা হয় নি”। বাক্য বিন্যাস সরল। আর বাক্য বিশিষ্টরূপে সংক্ষিপ্ত ও জটিলতা মুক্ত। অনেক বাক্যই যথাযথভাবে গঠন করা হয় নি, সমাপিকা ক্রিয়া নেই (“কঠোরভাবে আইভি লীগ। বিরাট ব্যাপার।”) কথকের কথায় প্রায়শই ব্যাকরণগত ভুল পরিলক্ষিত হয় (সে এমন এক ধরনের নকল ব্যক্তিটি ছিলো … তাকে তাদের নিজেদের জন্য জায়গা করে দিতে হয়।) দীর্ঘ বাক্যগুলোতে উপবাক্যগুলো এমনভাবে সাজানো যেন মনে হয় সেগুলো জটিল বাক্যে সংযোজক অব্যয় দিয়ে গঠিত হওয়ার চেয়ে বরং বক্তার কাছ থেকে আসছে।



হোল্ডেনের ডিসকোর্সের নিয়মব্যতিরেকী (informality) তার স্বতঃস্ফুর্ততা ও যথার্থতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। জর্জের সুগঠিত ও আত্মাভিমানী ছোট-খাট কথায় এর স্বস্তি মেলে: “বললো যে নাটকটা উৎকৃষ্টমানের তেমন কিছু ছিলো না, তবে লান্টরা অবশ্যই একেবারে দেবদূত ছিলো।” এ উচ্চারণকে আরো তুচ্ছজ্ঞান করা হয়, আর আনুষ্ঠানিকতাক্লিষ্ট হিসেবে প্রতিভাত করা হয় যখন একে পরোক্ষ উক্তিতে বলা হয়। এ উক্তিটি স্যালির প্রতি ধৈর্য্যচ্যূত বহিঃপ্রকাশের বিপরীতে বলা হয় যা উদ্ধৃত আছে এমনভাবে: “…ওখানটায় গিয়ে আত্মা নিংড়ানো বড় একটা চুমু খেয়ে আসলেই তো পারো।”

হোল্ডেনের বর্ণনা রীতিকে বর্ণনা করা আমার মতে যথেষ্ট সহজ; কিন্তু পুরো উপন্যাস জুড়ে আমাদের কীভাবে আনন্দ দেয় ও মনোযোগ ধরে রাখে তা ব্যাখ্যা করা বেশি কঠিন। কেননা শৈলীর কারণেই বইটি নিশ্চয়ই মজাদার হয়ে উঠেছে। এতে যে গল্প বলা আছে তা পর্যায়ক্রমিক, অনিশ্চায়ক ও ব্যাপকভাবে তুচ্ছ ঘটনার উপর নির্মিত। তবুও সাধারণ সাহিত্য বিচারে ভাষা নিতান্ত দীন। স্যালিঞ্জার যিনি অদৃশ্য মায়াকণ্ঠী, যিনি হোল্ডেনের মাধ্যমে আমাদের সাথে কথা বলেন, জীবন-মৃত্যু ও সতের বছর বয়সী নিউ ইয়র্কবাসীর অপভাষার চৌহদ্দিতে পরম মূল্যবোধ সম্পর্কে তাঁর যা যা বলার আছে, তার সবকিছু তিনি অবশ্যই বলবেন।

স্যালি ও জর্জের প্রদর্শিত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ভব্য ছলচাতুরীর জন্য হোল্ডেনের “নিচু” ভাষার প্রয়োগ উত্তরের অংশবিশেষের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই বিদ্রুপাত্মক হাস্যরস সৃষ্টি করে। তার ইংরেজির নিয়মানুগ অশুদ্ধতাও হাস্যরসের উৎস — উদ্ধৃত অংশের সবচেয়ে মজার অংশ হচ্ছে, “সে সম্ভবত তার পায়ের সব আঙ্গুল ভেঙ্গে ফেলেছিলো”, যা “তার শরীরের সব হাড়গোড়” এর বিকৃত রূপ, আর আরেকটা অতিরঞ্জিত প্রকাশ। আরেকটি কারণ হচ্ছে যে হোল্ডেনের ভাষা যা বর্ণনা করে তার বেশি ইঙ্গিত দেয়। উদাহরণস্বরূপ, উদ্ধৃত অংশে হোল্ডেনের দিক থেকে জর্জের প্রতিদ্বন্দী পুরুষ চরিত্রের প্রতি স্পষ্টতই ঈর্ষার অস্বীকৃত বিষয় আছে, যদিও হোল্ডেন তার মর্যাদা প্রদানকারী আইভি লীগ পোশাক ও আপাতমধুর ব্যবহারকে অবজ্ঞা করে বলে দাবি করে। এখানে এবং পুরো বই জুড়ে হোল্ডেন কোলফিল্ডের করুণ রস সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত না হওয়ায় আরো বেশি ফলপ্রসু।



যদিও শেষ বিশ্লেষণে এ গদ্যের চমকপ্রদ কাব্যিক কিছু একটা রয়েছে, রয়েছে কথ্য ভাষার ছন্দের সূক্ষ্ম ব্যবহার, যার ফলে এটি একবার এবং বারবার পড়লে অনায়াসেই আনন্দ পাওয়া যায়। যেমনটা জ্যাজ সঙ্গীতবিশারদগণ বলেন, দোল খায়।


আগের পর্ব                                                                                                                        পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*