মূল: ড্যাভিড লজ
অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম
পত্রোপন্যাস
আমি যা সহ্য করতে পারি না তা হচ্ছে এই যে সে এক মুহূর্তে আমার দাবি-দাওয়া মেনে নিলো, আমার অধিকার স্বীকার করে নিলো। যা আমাকে টেবিলে মুষ্টি দিয়ে আঘাত করাতে চায় তা…
ফোন। বাজছে। একটু অপেক্ষা করো।
না। শুধু ফেল করা কোনো ছাত্র। হ্যাঁ, যা আমাকে দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দেওয়াতে চাচ্ছে তা হলো লন্ডনে তার চলে যাওয়ার চিন্তা, যেন কিছুই হয় নি। আমি তো শুধু জানতে চাই যে এক মুহূর্তের জন্য কাল্পনিক জগৎ থেকে সে তার মাথা তুলে নিয়েছে, আর বলেছে…
যদিও আরেকটা চিন্তা আমার মাথায় এলো। যেন কিছুই হয় নি এমনভাবে সে নাও চলে যেতে পারে। সে হয়তো কোনো অতিথিশালায় ঘটনার কোনো নতুন সংস্করণ পড়ে যাচ্ছে। পাগল করার মতো উপলব্ধিজাত, অদ্ভূত, কাঁকড়ার মতো চলনবিশিষ্ট তার নায়িকাদের একজন কোনো হামবড়া যুবকের, বেগুনী আন্ডারপ্যান্ট দেখে অদ্ভূতভাবে এদিক-সেদিক সরে যেতে পারে। তোমাকে দেখার কোনো দরকার নেই, ধন্যবাদ — এই স্বতঃস্ফূর্ততার বক্রাঘাত আমি বুঝতে পেরেছি। এটা আলাদা যদিও — সে আরামদায়ক কোনো মফস্বলে তার বন্ধুদের একজনকে ব্যক্তিগতভাবে লিখছে না। সে আমার বন্ধুদেরকে লিখছে। আর আমার শত্রুদেরকে। আর আমার সহকর্মীদেরকে। আর আমার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে…
কী? আমার আন্ডারপ্যান্ট কি বেগুনী? অবশ্যই বেগুনী নয়! আমার রুচি সম্পর্কে কি তুমি আদৌ কিছু জানো না? কিন্তু সে বলতে পারে সেটা বেগুনী! তারা, মানে এসব লোক তো তা-ই করে। তারা সত্যের নকশিকর্ম করে, উন্নতিসাধন করে — মিথ্যা কথা বলে।
মাইকেল ফ্রেন দ্য ট্রিক অব ইট (১৯৮৯)
পত্রের আকারে লেখা উপন্যাস আঠারো শতকে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো। স্যামুয়েল রিচার্ডসনের দীর্ঘ, নৈতিক ও মনস্তাত্তিকভাবে প্রখর প্ররোচনার পত্রোপন্যাস, পামেলা (১৭৪১) এবং ক্লারিসা (১৭৪৭) ইউরোপের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে যুগান্তকারী উপন্যাস যা রুশো (লা নুভেল এলোয়াজ) ও লাক্লো (লে লিয়েজোঁ দঁজেরোজ) এর লেখকদের মতো অনেক অনুকরণকারীকে অনুপ্রাণিত করেছে। জেইন অস্টিনের সেন্স এন্ড সেন্সিবিলিটি এর প্রথম খসড়া পত্র আকারে ছিলো, কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় ভাবনায় ঊনবিংশ শতকে পত্রোপন্যাসের জনপ্রিয়তা হ্রাসের ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো। টেলিফোনের যুগে বস্তুত এটি অত্যন্ত দূর্লভ প্রজাতিতে পরিণত হয়েছিলো, যদিও মাইকেল ফ্রেনের দ্য ট্রিক অব ইট সাম্প্রতিককালে প্রদর্শিত হয়েছে, সবটাই হারিয়ে যায় নি, আর ভালভাবে সংরক্ষণযোগ্য হয়েছে।
ফ্যাক্স মেশিনের আবিষ্কার এ আঙ্গিকের পুনরায় ফিরে আনার উস্কানি হতে পারে (এন্ড্রু ড্যাভিজের ডার্টি ফ্যাক্সেজ, ১৯৯০, হয়তো অনাগত দিনের কিঞ্চিৎ আভাস হওয়ায়) কিন্তু, সাধারণভাবে বলতে গেলে আধুনিক পত্র ঔপন্যাসিক এ রীতিটাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে প্রতিভাত করে তোলার জন্য বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে পত্র লেখক বা প্রেরকের থেকে পৃথক হতে বাধ্য। ফ্রেনের নায়ক ত্রিশের মতো বয়সী বেনামী ব্রিটিশ শিক্ষক যে আর একটু পরিণত বয়সের সমসাময়িক এক নারী ঔপন্যাসিকের উপর বিশেষভাবে কাজ করছে, উপন্যাসে তার উল্লেখ পাওয়া যায় আদ্যক্ষর জে. এল. দিয়ে। নায়ক তাকে আমন্ত্রণ জানায় তার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা প্রদান করার জন্য, আর সে নিজে চমকে ওঠে এরপর যখন তাকে মহিলাটি অতিথি কক্ষের বিছানায় আমন্ত্রণ জানায়। এ ঘটনা ও এর জের অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক এক শিক্ষক বন্ধুকে একটার পর একটা চিঠি লিখে নায়ক বর্ণনা করে।
মোহ ও সন্দেহের মাঝে সে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে সে মহিলাটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গর্ববোধ করে, যার কাজের গবেষণা করার জন্য পেশা জীবনটাই সে উৎসর্গ করেছে; অন্যদিকে তার আশঙ্কা যে মহিলাটি এ সম্পর্ককে নতুন কল্পকাহিনীতে পরিণত করে, আর তা প্রকাশ করে ও ভুলভাবে তুলে ধরে শোষণের কাজে ব্যবহার করতে পারে। সে মহিলাটির সাহিত্য ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু ঈর্ষাও করে, আর আপাতবিরোধীরূপে এর জন্য ক্ষুব্ধ হয়। সে বিরক্ত বোধ করে যে মহিলাটির শরীর অধিকার করা সত্ত্বেও (আর পরিণামে তাকে বিয়ে) একই সাথে সে তার ঔপন্যাসিক কল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। নিজেই “এর কৌশল” (অর্থাৎ কথাসাহিত্য লেখা) রপ্ত করার বৃথা চেষ্টা করে সে শেষ করে। বিষয়টি পরিচিত ব্যঙ্গাত্মক — মননশীল ও সৃজনশীল ক্ষমতার মধ্যকার বৈসাদৃশ্য — বলার কৌশলে তাজা ও মজার হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে।
পত্রোপন্যাস এক ধরনের উত্তম পুরুষে কথন, কিন্তু এর সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আরো বেশি পরিচিত ধরন- আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে পত্রপঞ্জী শুরু করার আগে থেকেই কথকের কাছে আত্মজীবনীর কাহিনী জানা থাকে; রিচার্ডসন যেমন বলেছেন: “অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও প্রভাবময়… অবশ্যই তাঁদের আঙ্গিক হয়ে থাকবে যাঁরা বর্তমান দুর্দশার তুঙ্গে থেকে লেখেন, যাঁদের মন অনিশ্চয়তার যন্ত্রণায় পীড়িত… যাঁরা সমস্যা ও বিপদ সম্পর্কিত কোনো এক পুরুষে শুকনো, প্রাণহীন আঙ্গিকের চেয়ে বরং…”
অবশ্য জার্নালের আঙ্গিক ব্যবহার করেও একই প্রভাব লাভ করা যায়, কিন্তু পত্রোপন্যাসের দুটি বাড়তি সুবিধা আছে। প্রথমত, আপনি একাধিক পত্রলেখকের সাক্ষাৎ পেতে পারেন, আর এভাবে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্ন ব্যাখ্যায় একই ঘটনাকে দেখাতে পারেন, রিচার্ডসন যেমনটা ক্লারিসা য় নৈপুণ্যের সাথে দেখিয়েছেন। (উদাহরণস্বরূপ, ক্লারিসা তার বন্ধু মিস হাউয়িকে লাভলেইসের সাক্ষাতকারের ব্যাপারে লেখে যার মধ্যে লাভলেইস মনে হয় তার কামাতুর অতীতকে পরিত্যাগ করতে এক অকৃত্রিম মনোভঙ্গি দেখিয়েছে; চতুর আখ্যানের পর্যায় হিসেবে তাকে প্ররোচিত করতে লাভলেইস একই আলাপ তার বন্ধু বেলফোর্ডকে জানায় ।) দ্বিতীয়ত, ফ্রেন যেমনটা করেছেন, আপনি যদিও নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন এক লেখকে, এক চিঠিতে, যা জার্নালের মতো নয়, তাহলে আপনি নির্দিষ্ট পত্রপ্রাপককে সব সময় সম্বোধন করবেন, যার আগাম উত্তর ডিসকোর্সকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর একে আলঙ্কারিকভাবে জটিল, মজার ও পরোক্ষভাবে অভিব্যক্তিময় করে তোলে।
বিশেষভাবে উত্তম প্রভাব সৃষ্টি করতে ফ্রেন পরের সুযোগটি কাজে লাগান। তাঁর শিক্ষকটি কৌতুকপূর্ণভাবে ত্রুটিপূর্ণ এক চরিত্র, অহমিকা, উদ্বেগ ও মানসিক বৈকল্যে পরিপূর্ণ যা সে অস্ট্রেলিয়ান বন্ধুর প্রতিক্রিয়া কল্পনা করে ও আগাম ভেবে অনবরত প্রদর্শন করে (“তোমাকে দেখার কোনো দরকার নেই, ধন্যবাদ…”)। কখনো কখনো চিঠিগুলো পড়া হয় নাটকীয় স্বগতোক্তির মতো যার মধ্যে সংলাপের শুধু একটা দিক শুনে ফেলে আমরা বাকিটা অনুমান করে নেই: “কী? আমার আন্ডারপ্যান্ট কি বেগুনী? অবশ্যই বেগুনী নয়! আমার রুচি সম্পর্কে কি তুমি আদৌ কিছু জানো না?” এখানে আঙ্গিকটা স্কাজের কাছাকাছি চলে যায়, মৌখিক বর্ণনার অনুকরণ যা আমি পূর্ববর্তী সেকশনে আলোচনা করেছি; কিন্তু এতে আত্মসচেতনভাবে সাহিত্য রসমণ্ডিত লেখারও আরামদায়ক জায়গা হতে পারে, যেমন– “পাগল করার মতো উপলব্ধিজাত, অদ্ভূত, কাঁকড়ার মতো চলনবিশিষ্ট তার নায়িকাদের একজন কোনো হামবড়া যুবকের বেগুনী আন্ডারপ্যান্ট দেখে অদ্ভূতভাবে এদিক-সেদিক সরে যেতে পারে।” এই বাক্যটিকে যদি অতিলিখিত এবং খুব বেশি বিশেষণ ও ক্রিয়া বিশেষণের ভারে ন্যূব্জ মনে হয়, তাহলে সেটা ফ্রেনের উদ্দেশ্যের অংশ বলতে হবে। কথক অবশ্যই প্রাণবন্তভাবে তার দূর্দশার কৌতুকরস পরিবেশন করবে, কিন্তু সত্যিকারের বাগ্মিতার জন্য তাকে অনুমতি দেয়া যায় না, কারণ তাতে “এর কৌশল” রপ্ত করার অসামর্থ্যরে সাথে স্ববিরোধী হবে।
ঠিকভাবে বলতে গেলে লেখা শুধু বিশ্বস্ততার সাথে অন্য লেখাকে অনুকরণ করতে পারে। এতে কথা ও আরো বেশি অবাচনিক ঘটনার প্রতিনিধিত্ব বেশিমাত্রায় কৃত্রিম। কিন্তু কথাসাহিত্যের পত্রকে বাস্তব কোনো পত্র থেকে পৃথক করা যায় না। যে পরিস্থিতির উল্লেখ করে টেকস্টের মধ্যে উপন্যাস লেখা হচ্ছে তা টেকস্টের পিছনের “প্রকৃত” লেখকের অস্তিত্বের দিকে সাধারণত মনোযোগ
কাড়ে, আর এভাবে বাস্তবের কল্পিত ভ্রমকে ভেঙ্গে ফেলে, কিন্তু পত্রোপন্যাসে তা ভ্রম সৃষ্টিতে অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, আমার চলমান উপন্যাসের টেকস্টে আমার মক্কেলের টেলিফোন কল অন্তর্ভুক্ত করি না, কিন্ত বাক্যের মাঝখানে ফ্রেনের শিক্ষকটিকে বাধাগ্রস্ত করা ছাত্রটির কল বাস্তবসম্মত, আর তা চরিত্রকে প্রকাশ করে। (সে এত আত্মমগ্ন থাকে যে সে তার গ্রামের দায়িত্ব উপেক্ষা করে)।
পত্রোপন্যাস রীতির ছদ্ম-প্রামাণিক বাস্তববাদ আগেকার ঔপন্যাসিকদেরকে তাঁদের পাঠকের উপর নজিরবিহীন ক্ষমতা প্রদান করেছিলো, যা কোনো কোনো সোপ-অপেরার আধুনিক টেলিভিশন দর্শকদের উপর মন্ত্রমুগ্ধের প্রভাব বিস্তারের সাথে তুলনীয়। সুদীর্ঘ ক্লারিসা যখন খণ্ডাকারে প্রকাশিত হচ্ছিলো তখন নায়িকাকে মেরে না ফেলার জন্য পাঠকরা রিচার্ডসনকে ঘন ঘন অনুনয় জানিয়েছিলো, আর পামেলা র অনেক প্রথম পাঠক ধরে নিয়েছিলো যে পত্রালাপটা আসল ছিলো, আর রিচার্ডসন শুধু এর সম্পাদক ছিলেন। কথাসাহিত্যের আধুনিক পাঠকদেরকে অবশ্য এভাবে ধোঁকা দেয়া যাবে না; কিন্তু যেভাবে ঔপন্যাসিকেরা বাস্তবকে কল্পনায় রূপদান করেন, এক ধরনের উপন্যাসে রূপদান করেন যা আদতে কল্পনাকে বাস্তবের মতো করে দেখানোর জন্য পরিকল্পিত, সেভাবে ফ্রেনের পক্ষ থেকে তাঁর শিক্ষকটিকে অভিযোগ করাতে এটি একটি পরিচ্ছন্ন কৌশল। (“তারা মানে এসব লোক তো তা-ই করে। তারা সত্যের নকশিকর্ম করে, উন্নতিসাধন করে — মিথ্যা কথা বলে”)
Be the first to comment