পিংক লেক

গল্প




পিংক লেক

শাহীনুর ইসলাম


পিংক লেকের সবুজ জলটুকু নেড়ে-চেড়ে, স্নান শেষে এবং বাতাস বিদীর্ণ করে এক টুকরো ঠাণ্ডা অনুভব হয়ে ভিন্ন একটা স্বর আচমকা প্রবেশ করে শাদা বর্ণের টিম কার্সনের কানে। শুনে তার বেশ খটকা লাগে। বেসুরো ও বাজখাই লাগে। মনে হয় কোকিল শোভিত বনের ঝোঁপ থেকে একটি কাকের কা-কা রব শুনতে পেল সে।

গ্যাটিনো পার্কে লেকটির চারপাশে উদার হাতের মতো শাখা-প্রশাখা তুলে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে নানা ধরণের, নানা বর্ণের বৃক্ষ। আর এর পানিটা শ্যাওলা রং ধারণ করে আছে হারানো সবুজ রঙের ক্ষতিপূরণ হিসেবে। তৈরি করে রেখেছে বর্ণ সুষমা। যেন নিখাদ দৃশ্যমুকুটে শেষ পালক। অবয়বে, অঙ্গে ও প্রত্যঙ্গে গাছগুলো সেজে আছে নববধূর সাজে। মেদুর বাতাস তাদের দোল দিচ্ছে মিতকনে হয়ে। আর বিকেলের সূর্যটার প্রেমাপ্লুত স্পর্শ পেয়ে ভাল লাগার অভিব্যক্তি হিসেবে লাজুক ও মোলায়েম হাসির দীপ্তি ছড়াচ্ছে। তবে তাদের শারদীয় এ আয়োজন আগমনের নয়, বিদায়ের। আসে কিছুটা শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে, যায় অনেকটা ঘোড়দৌড় দৌড়ে। ক্ষণস্থায়ী এ সাজ এত বিচিত্র ও নয়নাভিরাম যে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তাই যারা প্রতি বছর দেখতে আসে, তারা বিস্ময়-বিমুগ্ধ হয় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উচ্চারণ করে বসে, কী অপরূপ বর্ণ বৈচিত্র্য!

এমন সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে লেকটির নিচ থেকে উপরে বেয়ে গেছে কাঠের তৈরি একটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ির চূড়ায় কাঠে ঘেরা ক্ষুদ্রায়তনের একটা বেষ্টনীর মধ্যে দাঁড়িয়ে অন্য সবার থেকে ভিন্ন স্বরটা শোনে টিম।

স্বরটির উৎস খুঁজতে প্রথমে পিছন ফিরে তাকায় সে। কাউকে দেখতে পায় না। ডানে তাকায়। তবুও কিছু পায় না। বামে তাকানোও বাদ রাখে না। কিন্তু কিছুতেই কাউকে খুঁজে পায় না। ব্যাপারটা মন থেকে তুলে ফেলে সে আবার দৃশ্যরস ভোগে মত্ত হয়ে যায়।

স্বরটা কিছুক্ষণ পর আবারও একই ভঙ্গিতে কথা বলে ওঠে। এবার গ্রিল ধরে মাথাটা একটু হেলে নিচে তাকায় সে। তাকাতেই দেখে বাদামি বর্ণের একজন নিচের বেষ্টনীতে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির দৃষ্টি যতটা না শরতের সৌন্দর্য দর্শনে লিপ্ত, তার চেয়ে বেশি যেন ঔদাসিন্যে লিপ্ত। পোশাক-আশাকে যতটা না এলোমেলো, অর্ধ-টেকো চুলগুলো তার চেয়ে বেশি এলোমেলো।

টিম নিশ্চিত হয় স্বরটা লোকটির কণ্ঠ থেকে নির্গত। আশপাশে এখন কেউ না থাকায় পার্কের রূপ বর্ণনার প্রকাশভঙ্গিতে লোকটি যা খুশি তাই বলছে। কিছুক্ষণ পর কথাটা আবারও শুনে উপেক্ষার হাসি হেসে তার দিক থেকে সে মুখ তুলে তাকায়। নির্ধারিত বিরতিতে লোকটি আবারও একই কথা উচ্চারণ করে বসে। এবার বিরক্ত হয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে টিম। আর তার দিকে একটা চকিত তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এমনভাবে নিক্ষেপ করে যে, মনে হয় একদল শাদা মানুষের ভেতরে একজন কালো মানুষকে দেখছে সে। এমনভাবে দেখছে যেন তাতে লিপিবদ্ধ আছে, কোথায় কী বলতে হয় সেটাও শেখেনি। অসভ্যই থেকে গেল। যত্তসব!

লোকটা চতুর্থবারের মতো কথাটা আবারও উচ্চারণ করে। তখন লেক থেকে পাতায়, পাতা থেকে আকাশে, আকাশ থেকে ঝকঝকে রোদের দৃশ্যরস উপভোগে মত্ত থাকা টিম লোকটার দিকে রাইফেল তাক করার মতো করে মুখ ফিরে তাকায়। কিন্তু সরাসরি কিছু বলতে পারে না। দু’হাতের মুষ্টি দিয়ে গ্রিলটাকে শুধু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। নিচের দিকে যখন আবার চোখ ফেরায়, তখন দেখে লোকটি সেখানে আর নেই। এতে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

কিন্তু কথাটা আবারও শুনতে পায় সে। তবে এবার পিছন থেকে। পিছনে না ঘুরে মনে মনে বলতে থাকে, হয়েছে কী আজকে? পাগলা গারদে এসে পড়েছি নাকি?

ষষ্টবারও যখন একই কথা তার কানকে ঝালাপালা করে তোলে, তখন এক মোচড়ে ১৮০ ডিগ্রি কোণে ফিরে দাঁড়ায় সে। দেখে সেই বাদামি বর্ণের পাগল কখন যেন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে কথাটা আবার বলছে। এবার রাইফেলের ট্রিগার টানার মতো চোখ পাকিয়ে টিম বলেই ফেলে,

-আপনি হলেন শীতের দিনের ভেজা কম্বল। বুঝলেন?

-মানে?

-মানে হলো আপনি না পারেন নিজেকে উষ্ণ রাখতে, না পারেন অন্যকে উষ্ণ করতে।

লোকটা তখন প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে,

-তা কম্বলটা ভিজিয়ে রেখেছে কে, শুনি?

টিমের কথা আর যোগাড় হয় না এর যথাযথ উত্তর দেবার। শুধু কটমট করে তাকায়। এতটুকুই তার দৌড়ের ক্ষেত্র। এর ওপারে যে নিত্যই কাড়াকাড়ি হয়, বঞ্চনা চলে, বর্ণ সুষমার নামে বর্ণ বৈষম্যের মেলা বসে, সে খবর সে রাখে না। রাখার তেমন প্রয়োজনও নেই তার। এপারের দৃশ্যাবলীকে সে আর দশজনের মতো করে স্বাভাবিক সুন্দর ভেবে আসছে। আর বাকি সবাই সেরকমই ভাবুক, এটাই তার প্রত্যাশা।

এবার দৃষ্টিকে লোকটির উপর আরো তীক্ষ্ম, আরো স্থায়ী করে টিম প্রশ্ন করে,

-কী বলতে চাইছেন আপনি?

শ্লেষ ভরে লোকটি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়,

-যা বলার সর্বপ্রথমেই বলেছি। আপনার স্মৃতিশক্তি মনে হয় অত্যন্ত দুর্বল। তাই সপ্তমবারের মতো আবারও বলছি, কী অপরূপ বর্ণ বৈষম্য!

-বর্ণ বৈষম্য নয়, জনাব। বলেন, বর্ণ বৈচিত্র্য।

-ঐ একই হলো। আপনার কাছে যেটা বৈচিত্র্য, আমার কাছে সেটা বৈষম্যেরই পোশাকি নাম।

-দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। বুঝলেন? নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যাদের, তারাই ওভাবে দেখে সবকিছু।

-বটে!

এক লহমা গালি মুখগহ্বরে চিবোতে চিবোতে টিম তখন বেষ্টনী থেকে হনহন করে হেঁটে নিচের বেষ্টনীটাতে গিয়ে দাঁড়ায়।

শাদা রঙ ধারণ করলেও গায়ে-গতরে টিম যতটা শাদা রঙের উত্তরসূরী, মন ও মননে শাদা বোধের ততটা নয়। সে বোধ আন্তঃনদীর স্রোতের মতো একাকার হয়ে গেছে। তবে তলানি হিসেবে নিচে পড়ে আছে। তাছাড়া সে তো এর শিকারও নয়, প্রত্যক্ষ শিকারিও নয়। এ দুয়ের মধ্যকার সুবিধাভোগী মাত্র। তাই হয়ত পুরাতন চালটার মাজেজা বুঝতে পারে না সে।

নিচে গিয়ে সে বেশি সুবিধাও করতে পারে না। খুঁটে খুঁটে বৃক্ষদের নানা রঙের সুষমা, নিচে জলরঙের গাম্ভীর্য দেখার সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থান যে উপরের জায়গাটা। কিছুক্ষণ পর টিম তাই আবার বেষ্টনীর দিকে ফিরে আসে। এসে আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়ায়। কিন্তু লোকটির দিকে একবারও দৃষ্টি ফেলে না এবার। যেন তার পাশে আর কেউ নেই এমনভাবে প্রকৃতির অবারিত রূপ দেখতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর টিম একেবারে অন্যদিকে তাকায়। অথবা তাকাতে বাধ্য হয় সে। বর্ণ বৈচিত্র্য বলতে যে পাগল, বর্ণ সুষমায় যে বিমোহিত, সেসব বাদ দিয়ে অন্য দিকে তার তাকানোর কথা না। তবু সে তাকায়। তাকায় তার দৃষ্টির লক্ষপথ ধরে হনহন করে হেঁটে আসে এক মধ্যবয়স্কা মহিলার দিকে।

মহিলাটি টিমের দিকে দূর থেকে শুধু একবারই দৃষ্টি ফেলে। এছাড়া মূলত একবার মাটির দিকে আরেকবার টিমের পাশে লোকটির দিকে কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে আসতে থাকে। এসে বেষ্টনীর ভেতরে প্রবেশ করে। মাটিতে কী যেন খুঁজে দেখছে। না পেয়ে শেষে উত্তেজিত কণ্ঠে টিমকে জিজ্ঞেস করে,

-এখানে কি আমার আই ফোনটা দেখেছেন আপনি?

-না, কোনো ফোনই দেখিনি।

-গাড়ি থেকে নেমে আমি প্রথম এখানেই এসেছিলাম। তারপর এখান থেকে নিচে নেমেছিলাম লেকটার ধারে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। ওখানেই মনে হলো আমার বন্ধুকে একটা ফোন দেই। কিন্তু ফোনটা পেলাম না আমার ব্যাগে। আমার ধারণা এখানেই ফেলে গেছি আমি।

-না, আমি কিছুই দেখিনি। মাটির দিকে তাকানোর সময়ই পাই নি।

-এখানে যে একটা লোক দেখলাম। কই গেল?

টিম পাশে তাকিয়ে দেখে লোকটি সেখানে আর নেই। একটুখানি অবাক হয়ে উত্তর করে,

-এখানেই তো ছিল।

-আমিও তো তাই দেখলাম দূর থেকে। নিশ্চয়ই কালো বা বাদামি বর্ণের ছিল লোকটা, তাই না?

-হ্যাঁ, বাদামি ছিল।

-আমি বেশ নিশ্চিত সে-ই আইফোনটা নিয়ে চলে গেছে। চেনেন আপনি তাকে?

-পাগলদের চিনে রাখার মতো সময় নেই আমার।

-পাগল?

-তা-ই তো মনে হলো।

-চোররা সব সাজতে পারে, শুধু পাগল না।

এরপর মহিলাটি বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে আবার নিচের দিকে দ্রুত চলে যায়। তাতে শুধু উষ্মা বোঝা গেল তার। দাঁতে দাঁত ঠেকে, ভ্রু কুঁচকে প্রকাশ করা উষ্মা। টিম তখন মনে মনে বলে, কই এসে পড়েছি, রে বাবা? এ ধরাধামে নির্মল আনন্দ লাভের সব দরজা বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে।

সৌন্দর্য উপভোগে কাঁটার মতো বিঁধে থাকা দৃশ্যটিকে কিছুক্ষণ পর ভুলে যায় টিম যখন তার চোখ আবার পড়ে রোদে রোশনাই শরতের পাতাগুলোর উপর। তার দাঁড়িয়ে থাকার স্থানটা ছায়াময় হওয়ায় দূরের রোদটাকে বেশ মায়াবী লাগছে, যার আলতো স্পর্শে রঙ বৈচিত্র্য পুরো ক্যানভাসে স্ফটিক স্বচ্ছ হয়ে ফুটে উঠেছে। আর লেকের চারপাশে বেরিয়ে আসা দেবদারু গাছগুলোর ডাল বাতাসে আরাম করে দোল খাচ্ছে। এ দোলা যেন তার প্রাণেও এসে লাগছে।

কিন্তু তার দোল খাওয়া বাধাগ্রস্ত হয় ফোনের শব্দে। তবে সেটা নিজের ফোনের নয়। নিচ থেকে সেই মহিলা তার আইফোনে জোরে জোরে কথা বলতে বলতে উপরের দিকে আসতে থাকে। টিম ভাবে, পাগলটার কাছ থেকে ওটা উদ্ধার করতে পেরেছে তাহলে।

নিচের বেষ্টনী থেকে বিরক্তিকর স্বরটা কথা বলে ওঠে, কী বুঝলেন? টিম তাকিয়ে দেখে সেই লোকটা। ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নেয় তার কাছ থেকে। আর মহিলাটি যখন তার কাছাকাছি আসে, তখন টিম উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আইফোনটা উদ্ধার করলেন কী করে? বুঝেছি এ বিদ্যায় এখনো ঝানু হয়নি বাছাধন।

মহিলাটি তখন কান থেকে ফোনটা কিছুক্ষণের জন্য নামিয়ে উত্তর করে,

-আসলে ব্যাপারটা সেরকম না।

-মানে?

-আমিই ভুলে গাড়িতে রেখে এসেছিলাম। আমার বন্ধু সেখান থেকে ওটা নিচে আমাকে দিয়ে আসে।

-তবু ভাল ভুলে গিয়েছিলেন। নইলে এই লেকের চারপাশে যত গাছ আছে তার সবগুলো কেটে উজাড় করলেও ওটা পেতেন কিনা সন্দেহ ছিল।

-ঠিকই বলেছেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, ভুলে রেখে এসেছিলাম।

চোখের দু’পাতার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাটা যদি একটা আবরণে ঢাকা যায়, যে আবরণের দরুণ কাউকে অযথা হয়রানির চেয়ে কেউ কিছু ভুলে ফেলে রাখলে তার কদর ধরা পড়ে বেশি, তাহলে উপলদ্ধির ছাঁকুনিতে অনেক প্রশ্নই বিরক্তিকর ও অসহনীয়ভাবে আটকা পড়ে থাকবে। ঠিক সেই আবরণে চোখ ঢেকে কথা বলে টিম ও মহিলাটি।

কথা শেষে শাদা মহিলাটি সেখান থেকে তৃপ্তির হাসি হেসে চলে যায়।

-কী বুঝলেন?

মহিলাটি চলে যেতেই নিচ থেকে লোকটি উপরে এসে টিমকে সরাসরি প্রশ্নটা করে। টিম তখন উত্তর করে,

-যা বোঝার তা-ই বুঝেছি।

-যা-তা-ই বুঝেছেন। আসলটা বোঝেননি। বুঝবেনও না কোনোদিন।

শূন্যের দিকে মুখ করে লোকটি আরো বলে,

-সত্যি কী অপরূপ বর্ণ বৈচিত্র্য!

টিম মনে মনে বলে, অবশেষে পাগলের বোধোদয় হল। এতক্ষণ পরে বুঝলি? লাল, কমলা, হলুদ, বাদামি রঙের দৃশ্যমান এই স্বর্গীয় রূপকেও তোর কাছে নারকীয় রূপ মনে হয়েছিল একটু আগে। আর লোকটিকে শুনিয়ে বলে,

-এই না সঠিক লাইনে এসেছেন জনাব। এটাই আমি আপনাকে বোঝাতে চাইছি প্রথম থেকে।

-অবশেষে বুঝে গেছি তাহলে, তাই না?

-বিলকুল। আপনার চেহারা সুরুতে ভদ্রলোকের একটা ছাপ আছে। আমি জানতাম আপনি শেষে ঠিকই বুঝবেন।

লোকটি প্রসঙ্গটি নিয়ে আর এগোয় না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার নীরবতা দেখে টিম মুখ টিপে হাসে।

এবার লোকটি নীরবতা ভাঙ্গে অন্য প্রসঙ্গ তুলে। প্রশ্ন করে,

-কিছু মনে না করলে আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি আপনি কী করেন? আপনাকে দেখে জ্ঞানী মনে হলো। তাই কৌতূহল দমাতে পারলাম না।

-অবশ্যই পারেন। আমি ইঞ্জিনিয়ার। ফেডারেলে চাকুরি করি।

-আপনি?

-আমিও ইঞ্জিনিয়ার।

-তাই নাকি?  চমৎকার।

-ছিলাম। এখন টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করি।

-তা ছাড়লেন কেন?

-ছাড়ি নাই। ঐ পদে ওরা আমাকে কখনো যোগ্য মনে করে নাই এখানে।

-পড়াশুনা করেছেন কোথায়?

-বাইরের দেশের একটা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানকারও ডিগ্রী আছে আমার। আপনি?

-অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি।

-আপনার ডিগ্রী কাজে দিয়েছে। কিন্তু আমারটা দিল না।

একটা বক্র হাসি হেসে বলে লোকটি।

এখন আলোটা আরো তির্যকভাবে পড়েছে দৃশ্যাবলির উপর। এতে শরৎ তার রূপের পাখা পূর্ণরূপে মেলে ধরে পতপত করে উড়তে থাকে যেন। টিম সেদিকে মনোযোগ ফেরায়। গোধূলির আগেকার রূপমাধুরির উপর চোখ রেখে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-এমন দৃশ্য দেখলে জীবনটাকে ধন্য মনে হয়। আরো অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছে হয়।

কিন্তু লোকটির কথার সুরের বদল ঘটে না। ধ্রুপদী সঙ্গীতের নির্দিষ্ট ভাবরস জাগানো সুর-বৃত্তের পরিধি বরাবর সে ঘুরতে থাকে। তাই টিমের এমন কথাতেও সে বলে বসে,

-আমার কিন্তু ইচ্ছে করে না।

-কেন? কেন? এ রকম দৃশ্যই তো আমাদের মনকে চাঙ্গা করে, জীবনীশক্তিকে বাড়িয়ে দেয়।

-সেটা ঠিক আছে। আচ্ছা, বলুন তো এসব দৃশ্য আপনার এত ভাল লাগছে কেন?

-আরে দেখছেন না কত রঙ এক সাথে জীবন্ত হয়ে ফুটে আছে? মনে হচ্ছে ঈশ্বর লেকটাকে ক্যানভাস বানিয়ে স্বর্গীয় চিত্র এঁকে রেখেছেন। সেজন্যই।

লোকটি এই প্রথম প্রকাশ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। টিমের অনুভবকে স্বীকার করে নিয়ে বলে,

-অনেক রঙে বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে সত্যি। তাতে সুষমাও আছে। দেখলে চোখ ও মন দুটোই জুড়ায়।

-হ্যাঁ, তাই তো।

-কিন্তু মানুষের মাঝে এত রঙ—শাদা, কালো, বাদামি, হলুদ—তাতে এ দৃশ্যের মতো বৈচিত্র্যও আছে। তবে এর মতো সুষমা নেই কেনো? কেনো এক রঙ আরেক রঙের উপর শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে বেড়ায়?

বিদ্যুৎ সংযোগ পেলে যন্ত্র যেমন কথা বলে ওঠে, লোকটির কথাগুলো এখন টিমের মধ্যে সে কাজই করতে শুরু করেছে। সে বুঝতে পারে লোকটি গভীরে চিন্তা করছে। তার চিন্তা ছোঁয়াচেও বটে। এতে আক্রান্ত হয়ে সে থমকে যায়। থেমে যায় যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত বিমানের মতো। মহিলাটির আইফোনের ঘটনা এবং লোকটির চাকুরির পদ তাকে এখন কিছুক্ষণ ভাবায়। সবচেয়ে বেশি ভাবায় বিদায় বেলায় লোকটির শেষ কথাটা, বুঝলেন? একই রঙে প্রকৃতি গড়ে সৌষম্য, আর মানুষ গড়ে বৈষম্য।

সঙ্গে সঙ্গে পুরো লেকটা ময়ুরের মতো পেখম মেলে ধরে। তবে বর্ণ বৈষম্যের পেখম।


*পিংক লেক*




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*