কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: টেক্সটে পাঠক

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


টেক্সটে পাঠক


ম্যাডাম, শেষ অধ্যায়টা পড়তে গিয়ে আপনি এত অমনোযোগী হতে পারলেন কী করে? আমি তো আপনাকে বলেছিলাম যে, আমার মা রোমান ক্যাথলিক ছিলো না। — রোমান ক্যাথলিক! আপনি আমাকে এ রকম কোনো কিছু বলেন নি, স্যার। ম্যাডাম, আমি আবার আপনাকে বলছি, আমি যে আপনাকে অন্তত অনুমান করে কথার মতো সরলভাবে বলেছিলাম তাতে এমন কথা বলা থাকতে পারে। — তাহলে, স্যার, একটা পৃষ্ঠা আমার বাদ গেছে। — না, ম্যাডাম, — আপনি একটা শব্দও বাদ দেন নি। — তাহলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, স্যার। — ম্যাডাম, আমার গর্বে সে আশ্রয়ের অনুমতি নেই। — তাহলে আমি বলে দেই যে, ও বিষয়ে আমি আদৌ কিছু জানি না। — ম্যাডাম, এই দোষটাই আমি আপনাকে দেই; আর এর শাস্তিস্বরূপ আমি জোর দিয়ে বলছি যে, আপনি এক্ষুণি ঘুরে দাঁড়ান, অর্থাৎ পরবর্তী দাঁড়িতে পৌঁছালেই পুরো অধ্যায়টা আবার পড়ুন।

            ভদ্রমহিলার উপর আমি এ প্রায়শ্চিত্ত আরোপ করেছি, তবে কামুকতা কিংবা নিষ্ঠুরতা থেকে নয়, সর্বোত্তম উদ্দেশ্য থেকে; আর কাজেই তিনি ফিরে এলে এর জন্য তার কাছে আমার কোনো ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে না: — এ তো দুষ্টু রুচিকে উপহাস করা যা তাকে ছাড়াও হাজার হাজার জনের মধ্যে একটু একটু করে ছড়িয়ে গেছে, — সুগভীর পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান, যা এ ধরনের বই পুনরায় পড়া হলে তাদেরকে অব্যর্থভাবে প্রদান করবে, তার চেয়ে দুঃসাহসিকতার সন্ধানে বেশি সোজাসুজি পড়ার দুষ্টু রুচিকে উপহাস করা।

লরেন্স স্টার্ন দ্য লাইফ এন্ড অপিনয়নজ অব ট্রিসট্রাম শ্যান্ডি, জেন্ট (১৭৫৯-৬৭)

কথক যতই নৈর্ব্যক্তিক হোক না কেন, প্রতিটি উপন্যাসে একজন কথক অবশ্যই থাকতে হবে, তবে কথিত (বর্ণিত) চরিত্রকে যে থাকতেই হবে তা নয়। কথিত চরিত্র হচ্ছে টেক্সটেরই মধ্যে উপন্যাসের পাঠকের প্রতিভূ বা স্মৃতি-জাগানিয়া। এটা ভিক্টোরিয়ান ঔপন্যাসিকদের পরিচিত সম্বোধন-অলঙ্কার (apostrophe), “প্রিয় পাঠক,” এর মতো ক্যাজুয়াল হতে পারে, অথবা কিপলিংয়ের “মিসেস ব্যাথার্স্ট” এর কাঠামোর মতো বিস্তারিত হতে পারে। কিপলিংয়ের এ কাঠামোটি অবশ্য আগের দিকটায় (সেকশন ৭) আলোচনা করা হয়েছে, যেখানে “আমি” কথক অন্য তিন চরিত্রের অনবরত বদল করা ভূমিকায় বলা গল্পের কথিত চরিত্রও বটে। ইটালো ক্যালভিনো তাঁর ইফ অন উইনটার নাইট ট্রাভেলর  শুরু করেন পাঠককে গ্রহণশীল  ভাবের মধ্যে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে: “মনটাকে শিথিল করুন। পূর্ণ মনোযোগ দিন। অন্য যে কোনো চিন্তা ঝেঁড়ে ফেলুন। আপনার চারপাশের জগৎটাকে মিলিয়ে যেতে দিন। দরজাটা বন্ধ করতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়; পাশের কক্ষে টিভিটা সব সময় চালু থাকে।” তবে কথিত চরিত্র যেভাবেই নির্মিত হোক না কেন, তা সব সময়ই আলঙ্কারিক কৌশল, টেক্সটের বাইরে থাকা আসল পাঠকের সাড়াকে জটিল করে তোলার ও নিয়ন্ত্রণ করার উপায়।

ট্রিসট্রাম শ্যান্ডির হালকা ছদ্মবেশে বর্ণনা করে লরেন্স স্টার্ন কথক-কথিত সম্পর্ক নিয়ে সব ধরনের খেলা খেলেন। মিউজিক-হলের কমেডিয়ান যিনি দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে ভাঁড় হয়ে তাদের মন্তব্য, বিবৃতি বা প্রশ্ন তার পরিবেশনায় সমন্বিত করেন, বেশ খানিকটা তার মতো করে লরেন্স স্টার্ন মাঝে মাঝে তাঁর পাঠকদেরকে ভদ্রমহিলা বা ভদ্রমহোদয় হিসেবে ব্যক্তিত্ব আরোপ করে জেরা করেন, জ্বালাতন করেন, সমালোচনা করেন ও তোষামোদ করেন আমাদের মধ্যকার বাকিদেরকে শিক্ষা ও আনন্দ দানের জন্য।

ট্রিসট্রাম শ্যান্ডি  উঁচু মাপের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উপন্যাস যার একই নামের কথক তার গর্ভধারণ থেকে শুরু করে পূর্ণ বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তার জীবনকে বর্ণনার ভার গ্রহণ করে, কিন্তু তার পঞ্চম বছরের পরে কখনো যায় না, কারণ প্রতিটি ঘটনাকে বিশ্বস্ততার সাথে বিস্তারিতভাবে বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা তাকে অশেষ বিচ্যূতির দিকে চালিত করে। আগে কিংবা পরে বা অন্য জায়গায় ঘটে যাওয়া অন্যান্য বিষয়ের সাথে সব কিছুই সম্পৃক্ত থাকে। সাহসের সাথে, তবে নিরাশ হয়ে ট্রিসট্রাম কালানুক্রমিক বিন্যাস সংরক্ষণের সংগ্রাম করে। ১৯ নং অধ্যায়ে তখনো নৈরাশ্যজনকভাবে তার জন্ম-পূর্ব ইতিহাসে মুখ থুবড়ে পড়ে থেকে সে তার বাবার বক্রাঘাতমূলক নিয়তির উল্লেখ করে, যে বাবা সবার উপরে “ট্রিসট্রাম” নামটি জঘন্যভাবে ঘৃণা করে, কিন্তু তার ছেলে যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে এ নামটি রাখে তা দেখার জন্য বেঁচে থাকে, আর ট্রিসট্রাম ঘোষণা দেয়: “আমার খ্রীষ্টান নাম রাখার আগে আমার জন্ম নেয়ার প্রয়োজন যদি না হতো, তবে এই মুহূর্তে পাঠককে এর বিবরণ দিতাম।”

তার মায়ের ধর্মীয় আনুগত্যের তথ্যসূত্র তার ভদ্রমহিলা পাঠককে এ বাক্যটিতেই (যে প্যাসেজটি আমি উদ্ধৃত করেছি তার পরে সে প্রকাশ করে দেয়) দেয়া উচিৎ ছিলো, কারণ “ম্যাডাম, আমার মা যদি রোমান ক্যাথলিক হতেন, তাহলে সেই পরিণাম হতো না।” ট্রিসট্রামের টেক্সটে পুনর্মুদ্রণ করা (মূল ফ্রেঞ্চে) দলিল অনুযায়ী কারণটা এমন হওয়ায়, সরবোনের কোনো কোনো শিক্ষিত ধর্মবেত্তা  “স্কুয়ার্ট” এর মাধ্যমে ইন ইউটেরো তে কঠিন জন্ম দ্বারা বিপন্ন নবজাতকের শর্তসাপেক্ষে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার ধারণা সম্প্রতি অনুমোদন করেছেন। কাজেই রোমান ক্যাথলিক দেশে কেউ জন্ম নেয়ার আগে তার আকীকা করে নাম দেয়া সম্ভব।

গোপন অঙ্গাদি সম্পর্কে হাস্যরসে মজে যাওয়া ও রোমান ক্যাথলিকদের (সে নিজেই অ্যাংলিক্যান ভিকার ছিলো) উত্যক্ত করা স্টার্নের লেখার বৈশিষ্ট্য, যে লেখা মাঝে মাঝে তাঁরই বিরুদ্ধে চলে যায়, কিন্তু “ম্যাডাম (এর প্রাণবন্ততা স্টার্নের মুক্ত ও নিজস্ব বিরাম চিহ্নে অত্যন্ত বর্ধিত) এবং পাঠকের প্রতি “জনান্তিক” বলে তাঁর সরস বুদ্ধিদীপ্ত ও মার্জিত জবাবে মুগ্ধ না হওয়ার জন্য খুবই অতৃপ্ত পাঠক হতে হবে আপনাকে। কেননা এ বিচ্যূতির প্রকৃত কাজ হচ্ছে তাঁর নিজের শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করা ও রক্ষা করা। ভদ্রমহিলাটিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় আগের অধ্যায়টা পুনরায় পাঠ করার জন্য, “দুষ্ট রুচিকে উপহাস করার জন্য… সুগভীর পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান যা এ ধরনের বই আগাগোড়া পড়া হলে তাদেরকে অব্যর্থভাবে প্রদান করবে তার চেয়ে দুঃসাহসিকতার সন্ধানে বেশি সোজাসুজি পড়ার …।”

বিস্ময়ের কিছু নেই যে ট্রিসট্রাম শ্যান্ডি আমাদের শতকে নিরীক্ষাধর্মী ঔপন্যাসিক ও উপন্যাস তাত্ত্বিকদের প্রিয় বইয়ে পরিণত হয়েছে। পূর্ববর্তী সেকশনে যেমনটা নির্দেশ করেছি, প্রথাগতভাবে নির্ভরশীল সময় পরম্পরা ও কার্যকারণ সম্পর্কজনিত শৃঙ্খলের ব্যাঘাত ঘটিয়ে ও একে পুনরায় সাজিয়ে নিয়ে আধুনিকতাবাদী ও উত্তরাধুনিকতাবাদী ঔপন্যাসিকেরা গল্পের সাধারণ আনন্দ থেকে পাঠকদের ছাড়িয়ে নিতেও চেয়েছেন। মানব মনের খেয়ালী কল্পনাকে কথনের আকার ও দিক নির্ধারণ করতে দেয়ার ক্ষেত্রে জয়েস ও ভার্জিনিয়া ঊল্ফের আগে আগাম কাজটি করেন স্টার্ন। আর আধুনিকতাবাদী কবিতাশাস্ত্রের একটি স্লোগান হচ্ছে “স্থানিক আঙ্গিক”, যার মানে হলো ট্রিসট্রামের সুপারিশকৃত রীতিতে টেক্সট “পুনরায় পড়া”র মাধ্যমে কেবল উপলব্ধি করা যায়, এমন আন্তঃসম্পর্কযুক্ত মোটিফের বিন্যাস দ্বারা সাহিত্য কর্মকে ঐক্য প্রদান করা।

পাঠকের সাথে তার সংলাপ পঠন অভিজ্ঞতার কালিক প্রকৃতিকে আরো সম্পূর্ণরূপে স্থান করে দেয়। উপন্যাসটি এমন একটা কক্ষ হিসেবে আবিভূত হয় যেখানে পাঠক হিসেবে আমরা কথকের সাথে গোপন সাক্ষাতে মিলিত হই। যেমন– তাকে গর্ভধারণের নিবিড় বিবরণ দেয়ার আগে সে ঘোষণা করে যে “এটা শুধু উৎসুক ও কৌতুহলীদের জন্য লেখা,” আর এমন বর্ণনায় অনাগ্রহী পাঠকদেরকে তা এড়িয়ে যেতে আমন্ত্রণ জানায় এই বলে যে:

“——দরজা বন্ধ করুন——”

চতুরভাবে আস্থাশীল যে আমরা তার সাথে থাকাটাকেই বেছে নেবো।

উদ্ধৃত প্যাসেজটিতে আমাদের দলের একজন, ভদ্রমহিলাটিকে আগের অধ্যায়টি পুনরায় পড়তে পাঠিয়ে দেয়া হয় “পরবর্তী দাঁড়িতে পৌঁছালেই” (পঠন প্রক্রিয়ার প্রকৃতির পরিপাটি, বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত স্মারক)। আমরা যারা যেন লেখকের সাথেই থাকি, তাদেরকে তাঁর আস্থা দ্বারা সম্মানিত অনুভব করানো হয় ও অবোধ্য পাঠক এবং শুধু গল্পের জন্য উপন্যাস পড়ার “দুষ্ট রুচি যা তাকে ছাড়াও হাজার হাজার জনের মধ্যে একটু একটু করে ছড়িয়ে গেছে এমন দুষ্ট রুচি” থেকে আমাদেরকে দূরে থাকার নীরবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। রোমান ক্যাথলিকবাদের উল্লেখের ব্যাপারে ভদ্রমহিলাটি যতটা অন্ধকারে ততটা অন্ধকারে থেকে আমরা লেখকের প্রতিরক্ষার প্রতিরোধ খুব একটা করতে পারি না।


আগের পর্ব                                                                                                           পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*