বেঙ্গল কিটেনস

গল্প




বেঙ্গল কিটেনস

–শাহীনুর ইসলাম


‘শরৎ আসার আর দুই সপ্তাহ বাকি আছে।‘ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে ওঠে রিনি।

তার উচ্চারিত কথাটা আমার কানে আসন্ন শরতের টকটকে বর্ণবৈচিত্র্যের মেদুর সুরলালিত্যে বাজতে থাকে।

পড়ন্ত বিকেলে ডাইনিং টেবিলে বসে চা-নাশতা খাচ্ছিলাম আমরা দুজন। শরৎ সম্পর্কে তার পূর্বাভাষটা শোনামাত্রই জানালা দিয়ে উঁকি দেই আমি। দেখি বিকেলের হেলে পড়া রোদটা সামনের বাড়ির ছাইরঙা ছাদে কিঞ্চিৎ উষ্ণতা লেপে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবু কালচে পটভূমিতে নিমিষে মিলিয়ে যাচ্ছে এবং দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাপল গাছের পাতায় বসে ঈষদোজ্জ্বল হাসিতে থেকে থেকে চিকচিক করছে। গত কয়েক মাসের তীব্রতা আজকে হঠাৎ করেই যেন কমে গেছে। শরতের এ পূর্বাভাষে খারাপও লাগছে এই ভেবে যে, বাইরে প্রাণ খুলে আনন্দ করতে পূর্ণ অনুমতি প্রদানকারী গ্রীষ্মটা দু’সপ্তাহ আগেই মনে হয় বিদায়ের সুর বাজাচ্ছে!

এর মধ্যে দরজায় করাঘাত শুনতে পাই। রিনিকে শুনিয়ে বলি,

-আমাদের আদরের বাছাধন নিশ্চয়ই। সারাদিন খাওয়া নাই, দাওয়া নাই, শুধু টই-টই করে ঘুরে বেড়ায়।

বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলি। খুলেই দেখি ওর হাতে দুটো বিড়ালছানা। আমার চোখদুটো ছানাবড়ো হয়ে যেন বেরিয়ে পড়ে।

সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সোনালি চেহারাটা নিয়েছে ছানাদুটো। তবে গায়ে ডোরাকাটার পরিবর্তে কালো কালো ফুটকি আছে। চাহনিতে আছে আদুরে মায়া। আমাকে দেখেই মিঁঞ করে ডেকে আমার ফাঁকা কোলে লাফিয়ে আসার জন্য যেন ছটফট করছে। চোখের এক দেখায় ওরা কি আমাকে ওদের দাদুভাই মনে করল নাকি?

হয়ত-বা!



ছানাদুটো আমার মনোজমিনের পতিত এক কোণা থেকে চোরা একটা গন্ধ জাগায় চিতাবাঘের ছুটে চলার ক্ষিপ্রতায়। যে ক্ষিপ্রতাকে তাৎক্ষণিকভাবে সামাল দেওয়া আমার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবু গন্ধটাকে মুহূর্তকালের জন্য চেপে রেখে অন্তুর চেহারার দিকে নজর দেই। ওর মুখটা শুকনো দেখে বকা দেওয়ার ছলে জিজ্ঞেস করি,

-দুপুরে খেতে আসিস নাই কেন? এগুলো কোত্থেকে নিয়ে আসলি আবার?

-খাওয়া-দাওয়া করেছি বন্ধুরা মিলে। ছানাদুটোকে আমি পুষব বলে কিনে এনেছি। জানো বাবা, এগুলো হল বেঙ্গল কিটেনস? কিউট না?

আমার কাশির বেগ পায়। সঙ্গে সঙ্গে ছেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পরপর দু’তিনটা কাশি দিয়ে আমি আবার চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ি।

গন্ধটা এখন গড় গড় করে মনে করিয়ে দিচ্ছে বাবা ও তার তিনটা পোষা কুকুরের কথা। কুকুর তিনটির আনুগত্য ও ভক্তির কথা। বিশেষ করে বাবার জীবনকে রক্ষা করার ঘটনাটার কথা।

আমার দশ বছর বয়স পর্যন্ত মাকে বুকে জড়িয়ে যখন ঘুমাতে যেতাম আমি, তখন অন্যান্য গল্প বলার পাশাপাশি ঘটনাটার বিবরণ মা এতবার শোনাতেন যে, এখনো মনে হয় পুরো ঘটনাটা আমি নিজের চোখেই ঘটতে দেখেছি। এতটাই জীবন্ত ও তাজা! এর প্রধান দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, শুধু প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া ছাড়া ঘটনার পরিবেশ, প্রেক্ষাপট, উপাদান, চরিত্র—সবকিছু আমার অনেক বেশি চেনা ছিল, যেভাবে নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে এখনো চেনা আছে আমার নিজেরই নিঃশ্বাস। দ্বিতীয়ত, মায়ের গল্প বলার যতি ও গতি বোধ, স্বরের উত্থান ও পতন প্রয়োগ।

বাবার ছিল পাখি শিকারের নেশা। তিনি ও আমার বড় দুই ভাই শীতের কাক ডাকা এক ভোরে ব্রহ্মপুত্রের চরে নৌকা করে পরিযায়ী পাখি শিকার করতে যান। তখন নদী ভরা পানি ছিল। জাহাজ, কারগো, ফেরি চলাচল করত অনায়াসেই। তাদের নৌকাটি ছোটখাট ও হালকা পাতলা হওয়ায় মাঝ পথে সহজেই তারা তুফানের কবলে পড়ে নৌকাডুবির শিকার হন। বিক্ষুব্ধ ঢেউ ও তীব্র স্রোতের সাথে নিজেদের ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করতে করতে একটু পরেই তারা হতাশার ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন। সলিল সমাধি ছাড়া আর কোনো উপায় না দেখে প্রাণেশ্বরকে একাগ্রচিত্তে স্মরণ করতে থাকেন। চারদিকে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। সেই অন্ধকারে  ভাগ্যক্রমে একটু দূরে দেখতে পান জোনাকির মতো জ্বলে ওঠা একটা জাহাজ। তাদের হতাশাগ্রস্ত প্রাণাকাশে আশার বিজলি দপ করে জ্বলে ওঠে। আর জাহাজের নাবিকটিও তাদের হাবুডুবু খাওয়ার ও ঢেউয়ের ধাক্কা থেকে বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা দেখতে পেয়ে তাদের কাছে জাহাজটি ভেড়ায়। এতক্ষণ বাবা ও ভাইয়েরা তাদের নিজ নিজ হাতকে পানির মধ্যে বৈঠার মতো করে সঞ্চালন করে টিকে ছিলেন। শুধু বড় ভাই এ কাজটি ডান হাত দিয়ে করছিলেন। কারণ তার বাঁ হাত বন্দুকটা উপরের দিকে উঁচিয়ে রাখতে ব্যস্ত ছিল । কিন্তু অস্ত্রটি দেখে নাবিক ও তার সহকর্মীরা থমকে যায়। সন্দেহ করে এরা নিশ্চয়ই ডাকাতের দল। এদের উদ্ধার করা মানে খাল কেটে কুমির ডেকে আনা। এদের উদ্ধার করা মানে নিজেদের সর্বনাশ করা। এদের বাঁচানো মানে নিজেদের মরণ ডেকে আনা। এই ভেবে তারা জাহাজের গতিপথ পাল্টানোর জন্য প্রস্তুত হয়। গতিপথ পাল্টানোর দৃশ্য দেখে আমার বাবা ও ভাইযুগল একেবারে হতাশ হয়ে পড়েন। এ যেন সাক্ষাৎ তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার মতো। এ যেন বাতাসে ডুবে থেকেও অক্সিজেন না পাওয়ার মতো। তাদের আশার শেষ বিজলি শিখাটুকু যেন দপ করে জ্বলে আবার নিভে যায়। তারা কাকুতি-মিনতি করে, অনুরোধ-উপরোধ করে, প্রাণ ভিক্ষাও চায়। কিন্তু  নাবিক কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না তাদের। নিজের সিদ্ধান্তে ভারী প্রস্থরখণ্ডের ন্যায় অনড়, অবিচল থাকে। তখন জাহাজ ফেরাতেই নাবিকের চোখ পড়ে নদীর তীরের দিকে। সেখানে দেখে ঘেউ ঘেউ করছে তিনটা কুকুর। আর কোনো প্রাণী কিংবা মানুষ নেই। তীরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছটফট করে একবার সামনে একবার পিছনে যাচ্ছে কুকুরগুলো। অনবরত লেজ নাড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে কাতর দৃষ্টিতে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেও। আবার ঘেউ ঘেউ করছে। কিন্তু তীর থেকে একটুও সরছে না। কুকুরগুলোর দৃষ্টি তাক করা আছে মূলত এই ডুবন্ত লোকদের উপর। অতদূর থেকে ঝড় ও জাহাজের শব্দের মধ্যে যদিও তাদের ঘেউ ঘেউ শুনতে পায় না, তবে তাদের অঙ্গভঙ্গির ভাষা নাবিক একটু পরে ঠিকই বুঝে যায়। আর এটা তো তার আগেই জানা ছিল যে, কুকুরের মতো প্রাণী মিথ্যে বলে না। তখন নাবিক তার ভুল ধারণা থেকে সরে এসে জাহাজটি আবার ফেরায় এবং বাবা ও দুই ভাইকে পরিশেষে উদ্ধার করে জাহাজে তোলে।

এ রকম দুর্ঘটনা তো নদী কিংবা সাগরে তেমন কোনো দুর্লভ ঘটনা না। তবু এ ঘটনা মায়ের আকর্ষণীয় গল্প বলার ভঙ্গিতে যতবার শুনতাম, ততবার আমার গা শিউরে উঠত। ভয়ে মুখ লুকাতাম তার বুকে। কারণ ঘটনার শিকার আমারই বাবা ও ভাইযুগল, বলতে গেলে, সে সময়ে যারা ছিল আমার বাইরের পৃথিবী।

কিন্তু যতটা না আতঙ্কিত ও চিন্তিত হতাম, বিস্মিত হতাম তার চেয়েও বেশি বাবার কুকুরগুলির কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় পেয়ে। ভেবে ভেবে শুধু অবাক হতাম কীভাবে কুকুরগুলো সবার আগে খবর পেয়ে গেল? কীভাবে নদীর তীরে তাদের দম ফাটানো চিৎকার ঢেউগুলোকে বিদীর্ণ করল এবং তা কীভাবে পৌঁছেও গেল নাবিকের কাছে?

এই যে প্রভু বা মালিকের প্রতি এত বিশ্বস্ততা এবং প্রভুর বিপদকে সবার আগে বুঝতে পারা এবং সে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে যাওয়া—একমাত্র পোষা প্রাণী, বিশেষ করে কুকুর ছাড়া সেটা আর কার দ্বারা সম্ভব? যদিও এক ধরণের মানুষ থাকে যারা আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠতে পারেন। তবে  সেটাও মনে হয় নিঃশর্তরূপে নয় কখনো। যদিও শর্তসাপেক্ষেও সেরকম মানুষের দেখা আমি পাইনি এখনো। তাই মায়ের মুখে ঘটনাটা শোনার পর থেকে শুধুমাত্র পোষা কুকুরই আমার আত্মার আত্মীয়ের জায়গাটা দখল করে আছে এখনো।



কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে, নিজের জীবনের অস্থিরতা ও জীবন-যাপনের অস্থায়ী পদ্ধতির কারণে কুকুরকে কখনো পোষা হয়নি আমার। আর শেষে তো এমন অসুখ এসে বাসা বাঁধল যে, পশমী কোনো প্রাণীর ধারের কাছে থাকাও হারাম আমার জন্য। অথচ আজ আমার অগোচরে আমারই আরেক সত্ত্বা অন্তু সেই কাজটি করল, কুকুর না হোক অন্তত দুটো বিড়ালছানা এনে। ভাবতেই এক ধরণের  আনন্দ লাগছে। বুকের ও পাঁজরের হাড়ে হাড়ে খুশির কাঁপন লাগছে। পিতার অসামর্থ্যকে যে সন্তান সমর্থ করে তোলে, পিতার অপূর্ণ স্বপ্ন যে সন্তান পূরণ করে তোলে সে সন্তান সেই পিতার পরম আনন্দের উৎস সন্দেহ নেই। বস্তুত, এর চেয়ে বড় কোনো প্রাপ্তি ইহজগতে তেমন একটা নেই-ও।

কিন্তু গ্রীষ্মের পড়ন্ত যৌবন ম্যাপলের পাতায় হাসির আড়ালে যেভাবে ঐ বাড়িটার ছাদে মিইয়ে যাচ্ছে, আমার আনন্দটুকুও দ্রুত সেভাবে মিইয়ে আসছে। নতুন চিন্তা আমাকে গ্রাস করে। আমার চেয়েও বেশি গ্রাস করে রিনিকে। কারণ সে এর কারণটা বেশ ভাল করেই জানে এবং সেজন্য উৎকণ্ঠাবোধ করে। তাই আমাকে ফেলে রেখে ইতিমধ্যেই সে চলে গেছে। চলে গেছে ছেলের ঘরের একেবারে ভেতরে এটা বোঝাতে যে, তার শখের খেসারত দিতে হবে তার বাবাকে প্রাণ দিয়ে। সেটা কি সে শেষ পর্যন্ত ভাল হবে?

অন্তু তার মায়ের কথাটা শুনে বিস্মিত হয়, মর্মাহতও হয়। বুঝে ওঠে না তা কী করে হয়। মা, নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে বলছে। এখানে প্রায় সবারই তো পোষা প্রাণী আছে। সে রাখলে ক্ষতি কী? তাই ছানাদুটোকে রাখবে—এ সিদ্ধান্তে  সে অনড় থাকে। দুটোকে দুই বগলে বন্দী করে এবং মুষ্টিতে ওদের প্যাকেট খাবার নিয়ে উচ্ছ্বাস ভরে সে বসার ঘরে আমার কাছে আবার ফিরে আসে।

রিনির কাছে প্রশ্রয় না পেয়ে আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। ছানাদুটো আমাকে দেখে লেজ সোজা করে আবার মিঁঞ করে ডেকে ওঠে। এক মিনিট পর আমার আবারও কাশির বেগ পায়। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে কাশি দিয়ে অন্তুকে বলি ছানাদুটোকে তার ঘরে রেখে আসতে। বলতেই সে প্রতিক্রিয়া জানায়,

-ছানাদুটো কত কিউট, বাবা! বাসায় যতক্ষণ থাকব ততক্ষণ আমি এদের সাথে সাথে রাখব। যেখানে পশুপাখি নিরাপদ নয়, সেখানে মানুষও নিরাপদ নয়।

অন্তু হয়ত মনে করেছে যে, আমি এদের পছন্দ করিনি বা পুষতে বাধা দিচ্ছি। কিন্তু ছানাদুটোকে দেখলে যে কারো সহজেই মায়া হতে পারে। যে কেউ সহজে পোষার বাসনা ব্যক্ত করতে পারে। আর আমার তো একটা দুর্বলতা আছেই পোষা প্রাণীর প্রতি।

এরপর রিনি এসে ছেলেকে আবারও বুঝিয়ে বলতে থাকে,

-ডাক্তার বারণ করেছে রোমশ বা পশমী কিছু ঘরে রাখতে। এতে তোমার বাবার এ্যালার্জিটা বেড়ে যাবে। কাশতে কাশতে জান বের হয়ে যাবে। গত মাসে এ জন্যই তো মেঝের কার্পেটটাও সরিয়ে ফেলেছি আমরা।

কথাগুলো শুনে ভীষণ মন খারাপ করে অন্তু। ছানাদুটোকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে তার ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে সারা রাত নিজেকে বন্দী করে রাখে। অনেক বলার পরও নৈশভোজের জন্য দরজাটা একবারও খোলে না।

সকালে উঠেই ওর দরজায় প্রথমে করাঘাত করে ওকে সান্ত্বনা দেই এই বলে—ঠিক আছে, ছানাদুটো থাকবে আমাদের বাসায়। যদিও আমি তখনো জানি না কীভাবে রাখব। কারণ ওদের রাখা মানে আমার অসুখটা আরো বেড়ে যাওয়া।

আমার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে দরজা খুলে আমাকে সোজা জড়িয়ে ধরে। আলিঙ্গন শেষে ওর মুখের দিকে তাকাতেই দেখি ওর চোখদুটো কান্নাভেজা রক্তিম হয়ে আছে। আমার চোখ থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে সে বলে,

-বাবা, ছানাগুলো পুষব না। তুমি এগুলো এখনই হিউমেইন সোসাইটিতে দিয়ে এসো।

আমার ছেলেকে আমি জানি। প্রথমে সব কিছুই আমাদের উল্টো করবে। পরে আবার আমাদের পথেই আসবে। রিনির কালকের কথাগুলো ও সারা রাত চিন্তা করেছে এবং সেই সাথে ছানাদুটোর জন্য ওর যে মায়া লেগে ছিল তা ছুটাতে পুরো একটা রাত নিয়েছে। তাই আমি আবারো পুষতে বললে সে আবারো অস্বীকৃতি জানায়।



মুখে যতই অস্বীকৃতি জানাক, ছানাদুটোর প্রতি ওর মায়াটা পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পারেনি সে। পারেনি ইতিমধ্যে নিজের করে নেওয়া অনুভবটাকে ছাড়তে। তার স্পষ্ট ছাপ আছে ওর চোখের চাহনিতে ও মুখের হাবভাবে। সেটাকে অস্বীকার করে শুধু আমার কথা ভেবে। ছানাদুটোকে রেখে আসতে বার বার পীড়াপীড়ি করছে আমাকে। সে যদি আনতে পারে, তবে সে তো রেখে আসতেও পারে। সেটাই সরল সমীকরণ। আমি জানি সে সেটাও পারবে না। মানে সইতে পারবে না। তাই এও বলেছে যে, সে বাসা থেকে বের হয়ে গেলে যেন ছানাদুটোকে আমি রেখে আসি।

রেখেই এলাম ওর অগোচরে। রাখার সময় ছানাদুটো আমাকে যেন ছাড়তেই চাইছিল না। নামাতে গেলে লাফিয়ে লাফিয়ে একবার আমার কোলে আরেকবার ঘাড়ে উঠছিল। উঠে মুখ লাগিয়ে আমার গায়ে ঘষা দিচ্ছিল। জোরে জোরে মিঁঞ মিঁঞ করে আকুতিভরে যেন বলছিল—আমরা চিরদিনের আশ্রয় পেয়ে গেছি। এ আশ্রয় ছাড়তে চাই না আর। আর নিচে নামিয়ে রাখলে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল এবং পাগুলো প্রসারিত করে রাখছিল।

ছানাদুটোকে হিউমেইন সোসাইটিতে রেখে আসার পর অন্তুর বিষাদিত মুখ ও অশ্রুভারাতুর চোখদুটো বার বার মনে পড়ছিল। ওর শখের মূল্যটাও আমি দিতে পারলাম না আমারই অসুখের জন্য। এই অক্ষমতা আমার চোখদুটোকে শুধু ঝাপসা করে দিচ্ছিল এবং তখন বাসায় ফেরার রাস্তাটাকে খাড়া, অগম্য একটা পাহাড় ছাড়া অন্য কিছু মনে হচ্ছিল না। এতটাই খারাপ বোধ করছিলাম যে, সরাসরি বাসায় ফিরতে একটুও ইচ্ছে করছিল না আমার। তাই গাড়ি চালিয়ে একটা পার্কের বেঞ্চিতে এসে একলাটি বসে আছি।

বসে বসে দেখছি সবুজ রঙের ম্যাপল, সিডার, ওক গাছগুলি দুলছে বাতাসে। রোদ এসে নাচছে পাতায় পাতায়। শুধু একটি ম্যাপল গাছ সবুজ রঙ হারিয়ে এখনই অনেকটা হলদে রঙ ধারণ করেছে। নিজের সাথে গাছটার বেশ মিল দেখে ভাবতে থাকি— কেউ কেউ খুব দ্রুত বদলে যায় কিংবা অস্তিত্বের স্বার্থে তাকে বদলাতে হয়। ইচ্ছে করলেও ধরে রাখতে পারে না মনের কাঙ্খিত রঙ। আমি যেমন আত্মার খোরাককে বিসর্জন দিয়ে কোনোরকমে টিকে আছি শরীরটাকে স্রেফ সুস্থ রাখব বলে।

নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলি—আমার শরৎ দু’সপ্তাহ আগেই এসে গেছে, রিনি। এর রঙে বাহার আছে, ঔজ্জ্বল্য আছে, চমকও আছে, কিন্তু আত্মার সজীবতাটুকু যেন নেই।


copyright © 2017 by the author




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*