দিবসেই তমসা

গল্প




দিবসেই তমসা

-শাহীনুর ইসলাম


সকালে ঘুম থেকে উঠেই রিয়ার কেন জানি মনে হতে থাকে, এ জীবন হল ঈশ্বরের সুস্থ পাগলামি, নয়ত নিছক খেয়ালিপনা। একে যতই সুসংহত ও সুসংবদ্ধ করার চেষ্টা করা হোক না কেন, অসঙ্গতি একে কখনো ছাড়বে না। ভাবনাজারিত বিষাদিত সুরটা জিসানকেও শোনায়। শোনায় বদলানো রূপে যে, আজকের ড্রাইভিং পরীক্ষায় সে ফেল করবে।

সকাল সকাল তার মুখ থেকে অমূলক আশঙ্কার কথাটা শুনে জিসানকে থমকে থাকতে দেখা যায়। প্রস্তর যুগের মানুষ কোনো দৈব মন্ত্রে আবির্ভূত হয়ে আধুনিক জামানার কীর্তিকলাপ দেখলে যে রকম বিস্মিত হবে সে রকম বিস্মিত লাগে তাকে। তার সে বিস্ময়ভরা চাহনিতে শুধু একটু বোঝা যায় যে, এ অসম্ভব ধারণাটা তার মনে জন্ম নিল কীভাবে?

উচ্চ স্বরে হেসে রিয়ার আশঙ্কাটাকে ধুলোর মতো উড়িয়ে দেয় জিসান। আর জোর গলায় বলে ওঠে,

-তোমাকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তুমি পাশ করবে।

-কখন কী ঘটবে—সেটার কি কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে?

-তা পারে না ঠিক। তবে কিছু কিছু ব্যাপার মানুষ আগে থেকেই বুঝতে পারে।

-হয়ত পারে। আবার পারেও না।

-বিশ্বাস না হয়, বাজি হয়ে যাক দুই হাজার ডলারের।

রিয়া আর উত্তর করে না। নীরবতা তার অস্বস্তিকে লুকাতেও পারে না। জিসানের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিটা যেন কামনা করছিল—তোমার কথাই যদি সত্যি হত! তর্জনির ডগায় বৃত্তের মতো করে কয়েক বার বৃদ্ধাঙ্গুলির উপরিভাগ চালনা করে। তার যেন বিশ্বাস হতেই চায় না। বাজিতেও রাজি হয় না। রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে উদ্দীপ্ত করতে জিসান আবার বলে,

-প্রায় পনের বছর ধরে গাড়ি চালাই আমি। শেখাই দশ বছর ধরে। কেউ স্টিয়ারিং ধরলেই তার অর্ধেকটা বলে দিতে পারি।

রিয়াও সজ্ঞানে জানে পাশ করার মতো যথেষ্ট ভাল গাড়ি চালায় সে। তারপরও আশঙ্কাটা তার মনে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে কাল রাত থেকে। ঘুরপাক খাচ্ছে রাস্তায় চলা গাড়ির চাকার মতো করে। এ ঘুরপাকের কূল নেই, কিনার নেই, আকার নেই, আয়তনও নেই; দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ—কিছুই নেই; শুধু নির্মাত্রিক একটা ভার আছে। সেটা এতটাই ভারগ্রস্ত করে রেখেছে তাকে যে, জীবনের অন্য কিছু তাতে যেন নিতান্তই নির্ভার লাগে এখন। যেন নিজের শরীরকে বহন করার চেয়েও নির্ভার।

এতদিন ঘুণাক্ষরেও তার মনে হয়নি যে, তার যুক্তি-প্রিয় মনে এ রকম অযৌক্তিক ভাবনা কখনো উদয় হতে পারে। এ আবির্ভাব যেন শরীরে ক্যান্সার বাঁধার মতো অতি সন্তর্পণে তার অজান্তে ঘটে গেছে। আজকের সকালটাই সে আশঙ্কার পরিণত উম্মেষ, যার অস্থির বেদনা কাল সারা রাত তাকে ভাল করে ঘুমোতেও দেয়নি। দুঃস্বপ্নেও দেখেছে লাল বাতির সংকেত না মেনে চলে যাওয়ায় পরীক্ষক তাকে ফেল করে দিয়েছে।

বেলা দেড়টায় রিয়ার G পরীক্ষা। আপনার মনে প্রশ্নের উদয় হতে পারে যে, অন্যদেরকে গাড়ি চালা শেখানো যার প্রায় প্রতিদিনের কাজ, তার স্ত্রী কেন এতদিন পর লাইসেন্স নেওয়ার জন্য পরীক্ষা দিচ্ছে? কেন প্রবাস জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের সময়গুলোতেও লাইসেন্স নেয়নি? আগে নিলে তো জীবনযাত্রা আরো সহজ ও সময়-সাশ্রয়ী হত। নেয়নি হয়ত যে কারণে বাড়ির গরু উঠোনের ঘাস খায় না; নেয়নি হয়ত যে কারণে শিক্ষকের নিজের ছেলেমেয়ে তার কাছে শিখতে চায় না; নেয়নি হয়ত যে কারণে নিজের ঘরে খাবার রেখে পরের ঘরে দাওয়াত খেতে বেশি ভাল লাগে আমাদের।

এই দম্পতি প্রবাসী হয়েছে ত্রিশ বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে । প্রবাসে এসেই আর সবার মতো সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদের। সেই সব গুটিকয়েক সৌভাগ্যের অধিকারী নয় তারা যারা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম মোকাবেলা করে অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা আর দশজনের দলভুক্ত। দেশে থাকলে যে বয়সটাতে স্থির জীবন যাপনের দরুণ একটু আরাম-আয়েশ করার সুযোগ পেত, সেখানে প্রতিদিন টগবগে যুবা বয়সের মতো খাটতে হয়েছে অনভ্যস্তভাবে। তাদের যখন অন্যদের দেওয়ার বয়স, দিয়ে আনন্দ পাওয়ার বয়স, একটু সচ্ছলতার জন্য তখন তারা শুধু কাজ করে গেছে। জীবনের উজ্জ্বলতম, সুবর্ণতম যে সময়গুলোতে পরস্পরের সান্নিধ্য লাভে পরম আনন্দ মেলে, সে সময়গুলো জীবিকা নির্বাহে ব্যয় হয়েছে। আর নিজেদের বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটোকে প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত বাকি সময়টা দিয়েছে। নিজেদের একান্ত করে পাওয়ার যথেষ্ট পরিসর মেলেনি  এ সময়টায়। কিংবা মাঝে মাঝে দূরে কোথাও লম্বা সময়ের জন্য ঘুরে মনটাকে যে আবার চাঙ্গা করবে সেটারও ফুরসত হয়নি।

পনের বছরের অভিবাসী জীবনের একটানা দমবদ্ধ অবস্থা তাদের কেউ-ই জিইয়ে রাখতে চায়নি আর। এই না চাওয়ার শক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করতেই এতদিন লেগেছে তাদের। এখন তারা মোটামুটি সচ্ছল। ছয় মাস আগেই তাই সিদ্ধান্ত নেয় ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়ে বাকি জীবনটাকে উপভোগ করবে। এক সাথে ঘোরাঘুরি করবে। সতেজ ও ফুরফুরে হয়ে উঠবে। যাপিত জীবনের জমে থাকা ক্লেদ-ক্লান্তি, শ্রান্তি-পরিশ্রান্তি মুছে দিয়ে আবার সতেজ ও ফুরফুরে হবে। সতেজ ও ফুরফুরে হবে বহমান নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরের মতো।

তাদের পরিকল্পনামাফিক ছয় মাসের শেষের দিনটা আজ। আনন্দ উদযাপনের সেই যাত্রাটা যাতে আরো নির্বিঘ্ন হয় সেজন্যই তো রিয়ার ড্রাইভিং পরীক্ষারও পরিকল্পনা। উদযাপনের শুরুটা তারা করতে চায় তাদের বিবাহ বার্ষিকীর পঁচিশ বছর পূর্তি দিয়ে। আর ঘটনাক্রমে দিনটা পড়েছে আজকেই। এবারের উদযাপনে তারা ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন রঙ, ভিন্ন গন্ধ ও ভিন্ন স্পর্শে পালন করতে চায় এক সাথে দূরে কোথাও গিয়ে। কথা হয় জিসানই মূলত গাড়ি চালাবে। তবে রিয়া চাইলে মাঝে মাঝে চালাবে।

সকাল দশটা নাগাদ রিয়া আবারও আশঙ্কার কথাটা তুললে জিসান আর স্থির থাকতে পারে না। কথাটাকে আর না কচলিয়ে সে রিয়াকে এখনই নিচে নামতে বলে। রিয়া একটু সময় নিয়ে নিচে নামে। তাকে নিয়ে সরাসরি পার্কিং লটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে চালকের আসনে বসায়। আর একটু ক্ষিপ্রতার সাথে বলতে শুরু করে,

-যতক্ষণ না তুমি পুরো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে ততক্ষণ চালাতে থাকো। প্রয়োজনে পরে পরীক্ষা দেবে।

রিয়া কিছু বলে না। একান্ত অনুগতের মতো জিসানকে অনুসরণ করে গাড়ি চালাতে শুরু করে। জিসান যেভাবে নির্দেশনা দেয়, সে সেভাবে গাড়ি চালিয়ে যায়। ডানে বললে ডানে যায়, থামতে বললে থামে, ত্রিমুখী মোড় নিতে বললে নেয়, লেইন বদল করতে বললে করে, সমান্তরাল পার্কি কিংবা পেছন-পার্কিং করতে বললেও করে। মহাসড়কে উঠেও ঠিক গতিতেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। যত প্রকার জটিলতা আছে সবকিছু সম্পন্ন করে এবং সন্তোষজনকভাবেই করে।

একটানা আধাঘন্টা চালানোর পর জিসান লক্ষ্য করে পরীক্ষায় ফেল করার মতো রিয়া কোনো ভুল করেনি। এমনকি যে সব ভুলের কারণে দু-এক নম্বর কেটে থাকে পরীক্ষক, সে রকম কোনো ভুলও করেনি। বলতে গেলে নির্ভুল ও দক্ষ একজন চালকের মতো চালিয়েছে সে। ঠিক যেন কম্পিউটারে কমান্ড বোতাম টিপে আশানুরূপ ফল পাওয়া।

জিসান এবার গাড়িটা থামাতে বলে এবং জিজ্ঞেস করে,

-আত্ম-বিশ্বাস ফিরেছে? তোমাকে তো ফেল করার মতো কোনো ভুল করতে দেখলাম না। এতেও যদি না ফেরে, তবে আরো চালাতে পারো।

-জানি না তবু এখনো আমার কেন এমন মনে হচ্ছে।

-ঠিক আছে। আর কিছুক্ষণ চালাও।

রিয়ার আরো দশ মিনিট চালানোর পর জিসান আবারও একই প্রশ্ন করে। রিয়া আবারও একই উত্তর করে। জিসানের চোখে-মুখে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। একটু পরে রিয়াকে চাঙ্গা করার জন্য বাজির কথাটা মনে করিয়ে দেয়। সংখ্যাটিও দু’হাজার থেকে তিন হাজারে বাড়িয়ে দেয়। রিয়া তাতেও রাজি হয় না।

আশঙ্কাটা জোঁকের মতো সেঁটে আছে রিয়ার মনে। কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারে না দেখে জিসান লবণ ছিটানোর কথা ভাবে। জোঁকটাকে খতম করার জন্য উপযু্ক্ত লবণ খোঁজে। কিছুক্ষণ ভেবে ঠিক করে অন্য কোনো ভাবনাতে তাকে নিমগ্ন রাখতে হবে।

পরিষ্কার দিন থাকলে শরতের সূর্যটা এখন ঠিক মাথা বরাবর উপরে থাকত। কিন্তু দিনটা বেশ গুমোট, স্যাঁতস্যাঁতে ও নিরানন্দ। সকাল থেকে রোদ মেঘের দেশে ফেরারি হয়ে আছে। আর মুখখানা ছাইরঙা করে আকাশ নিচে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। হলুদ, কমলা, লাল, বাদামি রঙবৈচিত্র্যে চারদিকটা ভরপুর থাকলেও অনেকটা বিষন্নপুরীর মতো লাগছে সবকিছু।

পরীক্ষার আর দেড় ঘন্টা বাকি। এ সময়টায় বাসায় ফিরে কোনো কাজ হবে না দেখে রিয়াকে আরো ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে শেষে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে বলে জিসান। যেতে যেতে বলতে শুরু করে,

-আজ থেকে আমার কানের কাছে আর খ্যাঁচ খ্যাঁচ করতে পারবে না যে, আমি তোমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাই না। যথেষ্ট সময় দেই না। এখন তুমিই আমাকে বেড়াতে নিতে পারবে।

বলেই রিয়ার মুখের দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে হো হো করে হাসে জিসান। ‘খ্যাঁচ খ্যাঁচ’ শব্দটা রিয়ার মনে খ্যাঁচ করে বেজে ওঠে। প্রতিবাদ করে বলে,

-খ্যাঁচ খ্যাঁচ করি? আচ্ছা, বলো তো এই পনের বছরে তুমি আমায় কয়টা দিন পুরোটা সময় দিয়েছ? কয়বার কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেছ?

-আরে, সেজন্যই তো জীবনের বাকি সময়গুলো এখন শুধু তোমার জন্য উৎসর্গ করলাম। আগে কাজের ফাঁকে তোমাকে সময় দিতাম, এখন তোমাকে সময় দেওয়ার ফাঁকে কাজ করবো। হা-হা-হা।

-দেশে থাকতেও অমন বলেছিলে। পারনি তো!

-চাইলেই তো আর হয় না। পরিবেশ অনুকূলে থাকতে হয়। না হলে অনুকূলে রাখতে হয়।

-অনুকূলে রাখার যে মুরোদ নাই সেটা তো এতগুলো বছর ধরে দেখেই আসছি।

-হবে, হবে, সব হবে।

-কচু হবে!

স্বপ্ন পূরণ হবে সে সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে ‘কচু হবে’ উচ্চারণের আড়ালে একটা মৃদু হাসির ঝিলিক খেলে যায় রিয়ার চোখে-মুখে। ঝিলিক শেষ হতে না হতেই তারা কেন্দ্রে পৌঁছে যায়। রিয়ার মুখখানি আবার চুপসে যায়। জিসান খেয়াল করে এতক্ষণের আলাপ, খুনসুঁটিতে আশঙ্কাটা ভুলে গেলেও কেন্দ্রে পৌঁছামাত্র তা খলবলিয়ে আবার জেগে উঠেছে তার মধ্যে, যেন আপাত হাস্যকল্লোল মুখরিত নদীতে কুমিরের মতো ভয়ঙ্কর কিছু একটা জল ভেঙ্গে হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছে। তবুও জোঁকটা ছাড়ানো গেল না যেন। শেষে উপায় না দেখে রিয়াকে অভয় দিয়ে বলে,

-ফেল করলে করবে। আবার দেবে। অসুবিধা কোথায়? আর এখনো যদি দিতে না চাও, তবে চলো বাসা ফিরে যাই।

-না, ঠিক আছে। এসেছি যখন দিয়েই দেই।

পনের মিনিট আগে অফিসে গিয়ে কাগজপত্র দেখায় তারা। এরপর অফিসের নির্দেশ অনুযায়ী আবার গাড়িতে গিয়ে বসে রিয়া। জিসান গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। দশ মিনিট পর পরীক্ষক আসে। তার নির্দেশ মোতাবেক চত্বরে কিছুক্ষণ গাড়ি চালিয়ে রাস্তার দিকে বের হয়ে পড়ে রিয়া।

প্রায় বিশ মিনিট পর রিয়ার গাড়িটা চত্বরে ফিরে আসে। কিছুটা উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা ও অনেকটা সম্ভাবনার আশা নিয়ে জিসান গাড়ির কাছে দ্রুত এগিয়ে যায়। রিয়ার চোখের দিকে তাকাতেই সেখানে একটা উচ্ছল উচ্ছ্বাস, খুশির ঝড় বয়ে যেতে দেখে।  তার বুঝতে বাকি থাকে না এ অদম্য ঝড়ের পিছনের কারণ। যাওয়ার আগে পরীক্ষক রিয়ার গাড়ি চালানোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে শুধু বলে—একেবারে দুর্লভ! সত্যি দুর্লভ! এ রকম পরীক্ষার্থী আমি খুব কমই দেখেছি। ভুলের ধারের কাছেও যায়নি।

প্রশংসা ও মূল্যায়ন বাণীগুলো যেন জিসানের আগের কথাগুলোরই প্রতিধ্বনি। নিজের কথা যে ফলেছে সেটাও তার খুশিকে দ্বিগুণ করে তোলে, পর্যবেক্ষণ দক্ষতার খুঁটিটাকে জোরালো প্রমাণিত করে। জোঁকটা ছেড়ে গেছে তাহলে। গাড়িতে উঠেই রিয়াকে বলে,

-তুমি যদি ফেল করতে, তবে তোমার অন্ধ বিশ্বাসটার জন্য করতে, গাড়ি চালানোর অদক্ষতার জন্য না। হায় রে, বিশ্বাস!

রিয়া কিছু বলে না। জিসান আবার শুরু করে,

-আমি কী বলেছিলাম? সকাল থেকে আমাকে তো গুনছই না। দেখো এবার কার ধারণা সঠিক হলো? জিসান এমনি এমনি কিছু বলে না। বুঝলে? আমার মনে হয় তুমি ন্যাকামি করে বলেছিলে কথাটা।

-ন্যাকামি মানে?

-এখনো মানে খুঁজছ? হাতেনাতেই তো প্রমাণ পেয়ে গেলে। আর সেটাও করলে তুমি।

-তোমাকে কী করে বোঝাই ওটা ন্যাকামো ছিল না। আমার কেন জানি অমন মনে হয়েছিল।

-ইস! কেন যে তুমি রাজি হলে না বাজিতে। তাহলে আমি দুই-তিন হাজার ডলার জিতে যেতাম এখন। তুমি জানতে পাশ করবে। এ জন্য বাজি ধরোনি।

ক্ষতির শিকার না হওয়াটাও এক ধরণের লাভ। আপাতত সেটা হয়নি দেখে রিয়া হেসে বলে,

-ভাগ্যিস বাজি ধরিনি। ধরলে তো অতগুলো ডলার এখনই হারতাম।

-হম, বুঝি। সব বুঝি। এতদিন ধরে তোমায় নিয়ে আছি না!

খুনসুঁটিতে আর মসলা যোগ না করে রিয়া আবার আশঙ্কাটার কথা মনে করিয়ে দেয় এই বলে,

-আচ্ছা, আমি তো সত্যি সত্যি পাস করলাম। তবে ও রকম মনে হয়েছিল কেন?

– সবই মনের ভুল। দুর্বল মন আরো কত কী দেখে, কত কী ভাবে! দড়িকে সাপ মনে করে চেঁচিয়ে ওঠে। নিজের ছায়াকে ভূতের ছায়া ভেবে অজ্ঞান হয়ে যায়। যাক গে, বাদ দাও। চলো বাসায় যাওয়া যাক। তুমি তো এখন পরীক্ষিত চালক। তুমিই চালিয়ে নিয়ে যাও।

-হ্যাঁ, চলো। আজকেই কি আমরা দূরে কোথাও যাচ্ছি?

-তোমার মেজাজ মর্জি ঠিক থাকলে যাব। গেলে ভাল। এখন একটা করে দিন যাবে, আর শীত জেঁকে বসবে। রাস্তাঘাট এক সময় তুষারে তুষারে ছেঁয়ে যাবে। তখন বাইরের যাত্রায় মজার চেয়ে কষ্টটা একটু বেশি হবে।

-ঠিক আছে আজকেই যাই তাহলে।

বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিতেই তারা দেখে চারদিকের বর্ণিল গাছপালাকে নিস্প্রভ করে দিয়ে আকাশের গুমোট ভাবটা আরো বেশি গুমোট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। মেঘগুলো কালচে থেকে কাল হয়ে উঠছে। তবে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় এ জায়গায় কখনো হতে দেখেনি তারা। বৃষ্টি হলে সাধারণত হালকা ঝিরঝিরে ধরণের হয়। তবে অনেক ক্ষণ ধরে ঝরতে থাকে। তাই এখানকার কোনো বৃষ্টিকে ঝড় বলা যায় না কিছুতেই। যদিও তুষার ঝড় হতে দেখা যায়, তবে সে সময়ও এখন নয়। সেজন্য অন্য সময়ের বৃষ্টি দেখে কেউ সহজে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে না। বড় জোর বিরক্ত হয়, বিশেষ করে রাস্তায় চলমান মানুষ।

অচিরেই বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হয়। এর মধ্যেই তারা বাসার দিকে রওয়ানা দেয়। বৃষ্টির কারণে যদিও সামনের দৃষ্টিক্ষেত্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কুয়াশার মতো করে, তবু উইন্ড-শিল্ড ওয়াইপারের অবিরাম এপাশ ওপাশ হেলুনি-দুলুনিতে তা পরিস্কারও হয়ে যায়। যেতে যেতে রিয়া বলে,

-আজকে মনে হয় না দূরে আর কোথাও যেতে পারবো আমরা।

-এ বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকবে না দেখো। বাসায় যাই আগে। আকাশ পরিস্কার না হলে আজকে বের হবো না।

তাদের গাড়িটা বাসার সবচেয়ে কাছের মোড়ে এসে যায়। এ মোড়টি একটা ইন্টারসেকশনে পড়েছে। তবে জটিল, দুর্ঘটনাপ্রবণ কোনো ইন্টারসেকশন নয়, নিতান্তই সোজা, সরল। গত পনের বছরে এখানে দুর্ঘটনার কোনো খবর তারা শোনেনি। এর বাঁ দিকে ঘুরে একশ মিটার গেলেই তাদের বাসা। তারা এখানে আসতেই লাল বাতি জ্বলে ওঠে। রিয়া গাড়িটা থামিয়ে সবুজ বাতির জন্য অপেক্ষা করে। বিশ সেকেন্ড পর সবুজ সংকেত জ্বলে উঠলে বাঁক নেওয়ার জন্য ইন্টারসেকশনের মাঝখানে একটু একটু করে এগোয়।

তখনো বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। বাঁক নেওয়ার সবকিছু নির্বিঘ্ন দেখে রিয়া মোড়টা নিতে থাকে। নেওয়ার সাথে সাথেই বৃষ্টিটা যেন অভাবনীয় বেগের ঝড়ে পরিণত হয়। সবকিছু যেন দুমড়ানো-মোচড়ানো শুরু করে। চারদিকে বিদঘুঁটে অন্ধকার ধেয়ে আসে। চোখের নিমিষে আকাশ ভেঙে বিজলিও ফেটে পড়ে তুমুল গর্জনে।

জীবন বিধ্বংসী এত আওয়াজ, এত অন্ধকার ঘটায় লাল সংকেত অমান্য করা অন্য একটা গাড়ি। বাঁ দিক থেকে ডান দিকে যাওয়ার সময় দ্রুতগতিতে এসে রিয়ার কিছু বোঝার আগেই সজোরে ধাক্কা দেয়। অস্বাভাবিক, বিকট শব্দটা আশপাশ থেকে লোকজনকে হেঁচকা টানের মতো টেনে আনে। একটু পরে টেনে আনে পুলিশ ও প্যারামেডিককে।

জীবন বোঝার আগেই মরণ এসে আচমকা বেতালে কড়া নাড়ে। উত্তাল যৌবনের মধুরতম সময়ের বিনিময়ে তুলে রাখা উপভোগের শুরুর দিবসেই যেন দুঃসময়ের নিঃসীম তমসা ঝুরে ঝুরে পড়ে। আহ্, জীবন!


*দিবসেই তমসা*




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*