সরলীকরণের সমীকরণ




প্রবন্ধ


সরলীকরণের সমীকরণ

শাহীনুর ইসলাম


সরলীকরণ করা মানুষের অন্যতম একটি স্বভাব। অবশ্য এর দ্বারা যে কোনো কিছুকে সহজেই শ্রেণীবদ্ধ ও কাঠামোবদ্ধ করা যায় যদিও তাতে ক্ষতির সম্ভাবনাই থাকে বেশি। শ্রেণীকরণের সুবিধা এই যে তাতে সহজেই পাঠোদ্ধার করা যায়; অন্যদিকে তা না হলে, পাঠোদ্ধারে অনেক ঘাম ঝরাতে হয় এবং পাঠক দিশেহারা হয়ে যায়। অসুবিধা হলো একে নিয়ে রাজনৈতিক চাল চালা যায়, স্বার্থ সিদ্ধি করা যায়, প্রতারণাও করা যায়। সরলীকরণকে যেমন অনেকেই গুণ হিসেবে স্বার্থকরূপে ফুটিয়ে তোলেন তাঁদের বক্তৃতায় কিংবা রচনায়, তেমনই এর দোষ থেকে অনেক প্রতিভাবানও বাদ পড়েন না। কাজেই সরলীকরণ বক্তৃতাশৈলী বা রচনাশৈলীর অলঙ্কার হতে পারে বটে, তবে তা অনেক সময় বক্তা বা লেখকের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে রচনার অর্থকে সুদূরপরাহত ও বিভ্রান্তিমূলক করে তোলে, সত্যকে গোপন করে, কিংবা আংশিক সত্যকে প্রকাশ করে।

সরলীকরণের অর্থনৈতিক সাশ্রয়ী ভূমিকা রয়েছে। আমরা সরলীকরণ করে থাকি সময় ও অর্থ বাঁচিয়ে সিদ্ধান্তে দ্রুত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, সমাধানের সংক্ষিপ্ত রাস্তা উদঘাটনের উদ্দেশ্যে। ঠিক যেমন গরু-ছাগল সরলীকরণ করে উপস্থিত মতো খেয়ে এবং প্রায়শ্চিত্ত করে পরে জাবর কেটে, আমরাও তেমনই ভুগি বা আফসোস করি যখন দেখি যে আমরা আসলে আমাদের সমাধানের রাস্তাকে সংক্ষিপ্ত না করে আরো সুদীর্ঘ ও বিস্তৃত করে রেখেছি। তবে অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাইকৃত সরলীকরণের ক্ষেত্রে আফসোসের মাত্রা থাকে যৎসামান্যই। কারণ সব ক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা আমাদের যাপিত জীবনের সাথে মিলে যায়। আর আমরা বিনা প্রশ্নে তা আপাতত মেনে নেই।



সরলীকরণের রাজনীতিও রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা সরলীকরণ করে থাকি প্রতারণা করে বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিল করতে, তা ব্যক্তি জীবনে হোক, সামাজিক জীবনে হোক কিংবা রাজনৈতিক জীবনেই হোক। এর মাধ্যমে আমরা অন্যকে অপদস্থ বা হেয় করতেও ছাড়ি না। ব্যক্তির বিশেষ কোনো ঘটনাকে তার সমগ্র জীবনের পরিচায়ক হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেমন এক ধরনের সরলীকরণের রাজনীতি, তেমনই গোষ্ঠী চরিত্রের বিশেষ কোনো প্রবণতাকে সেই গোষ্ঠীর একমাত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রচারণা চালানোও সরলীকরণের রাজনীতি। এ রাজনীতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মনে রাখতে হবে যে ভাত টেপার মতো সরলীকরণ সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বিশেষত মানুষের মতো জটিল, চিন্তাপ্রবণ, বহুমুখী, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিশীল জীবের ক্ষেত্রে— যাদের কাজের মাত্রা, চিন্তার বহুমুখিতা, শখের ব্যাপকতা, নেশার আসক্তি, সর্বোপরি জীবন-যাপনের বিচিত্রতা সব ক্ষেত্রে বিদ্যমান। এমন জীবের ক্ষেত্রে সরলীকরণ প্রক্রিয়া অনেক হিসেব কষে প্রয়োগ করতে হয়। আবার এও সত্য যে এক্ষেত্রে সরলীকরণের সমীকরণ মেলানো ছাড়া অনেক সময় কোনো উপায়ও থাকে না। তবে মনে রাখতে হবে যে সেক্ষেত্রে তা যেন হয় সদুদ্দেশ্যে। কারণ কেউ যদি বলেন যে তিনি মানুষের রাজনীতি করেন, তখন প্রশ্ন ওঠে— কোন ধরনের মানুষের রাজনীতি করেন তিনি? তার ‘মানুষ’ কি তার দেশের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল মানুষকে অন্তর্ভূক্ত করে? যদি না করে, তবে স্পষ্টতই তিনি সরলীকরণের রাজনীতি করছেন।

শুধু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই নয়, কোনো কোনো সময় বিশেষ কৃতিত্ব নেয়ার জন্য বা নিজেকে জাহির করার জন্যও আমরা সরলীকরণ করে থাকি, বিশেষত যার উদ্দেশ্যে সরলীকরণ বাক্য উচ্চারণ সে যদি নির্দিষ্ট বিষয়টিতে ওয়াকিফহাল না থাকে এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে তা মেনে নেয়।

আবার সদুদ্দেশ্যেও সরলীকরণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেমন— উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে কাউকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে যখন ব্যক্তির বিশেষ কোনো ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যকে তুলে আনা হয়।

আমাদের আরেকটি প্রবণতা হলো কেউ সফল হলে যেমন তার গুণকীর্তণের সরলীকরণ করে থাকি, তেমনই কেউ ব্যর্থ হলে তার ত্রুটি-বিচ্যূতির সরলীকরণ করে থাকি। যে কোনো ভাবে অর্জিত সাফল্য প্রশংসার সরলীকরণকে চাঙ্গা করে দেয়; আর যে কোনো ভাবে ঘটে যাওয়া ব্যর্থতা নিন্দা ও বিষোদগারের সরলীকরণকে উস্কে দেয়।



আমরা সাধারণত বিশেষ হিসেবে জীবন-যাপন করি বিধায় বিশেষ পরিস্থিতি কিংবা বিশেষ আবেগ-অনুভূতি যখন আমাদের শাসন করে, তখন যদি আমরা সরলীকরণ করি তবে তা সাধারণত বিশেষ সেই পরিস্থিতি বা অনুভবের ঘনীভূত ও কেন্দ্রিভূত ভাবের জন্ম দেয়। আর তা যদি নেতিবাচক হয়, তবে হতাশার হাজারটা একঘেয়ে সুর চেতনে-অবচেতনে, শয়নে-স্বপনে, জাগরণে-নিদ্রায় হৃদ-তন্ত্রীতে বাজতে থাকে। তখন আমরা ভুলে যাই এছাড়াও অন্য কিছু রয়েছে, অর্থাৎ জীবনের শত শত পরিস্থিতি বা আবেগ-অনুভূতির মধ্যে একটি মাত্র অনুভূতি এটি। উদাহরণস্বরূপ, কেউ কোনো লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে যদি ভাবে যে সফলতা তার জন্য নয়, তাহলে তা বিশেষ পরিস্থিতিতে সরলীকরণ হয়ে দাঁড়ায় যা মুহূর্তের জন্য সত্য প্রতিভাত হলেও আদতে নয়। এছাড়াও আরো যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র রয়েছে সেগুলোর ব্যাপারেও এ কথা খাটে, যেমন—কেউ যদি তার সারাটি জীবন হাসপাতালে কিংবা জেলখানায় কাটায়, তাহলে সে ব্যক্তি জীবনকে হাসপাতালের মতো অসুস্থ, যন্ত্রণাদায়ক ও পীড়াদায়ক, কিংবা কখনো-সখনো নিরাময়ক হিসেবে সরলীকরণ করে থাকে, অথবা জেলখানার মতো বন্দী, নিঃসঙ্গ হিসেবে সরলীকরণ করে থাকে— যা বিশেষের বিশেষ ক্ষেত্রেই শুধু প্রযোজ্য, সার্বিক ক্ষেত্রে নয়।

সরলীকরণ প্রক্রিয়াটি মোটেও সরল নয়, যোগাত্মকও নয়, বরং বিয়োগাত্মক। আর বিয়োগাত্মক পদ্ধতিতে সরলীকৃত বাণীতে আমাদের স্বভাবজাত আকর্ষণ থাকে। কেননা আমাদের মনস্তত্ত্ব, বোধ-বুদ্ধি সেভাবেই অভিযোজিত। বাস্তবের সাথে আমরা সেভাবেই মেলাই, নির্দেশিত পথেই যাত্রা করে আরাম বোধ করি, যদিও একটু গভীরে তলিয়ে দেখলে তা সব সময় সার্বিক ও নির্বিশেষ হিসেবে প্রমাণিত হয় না। এটি আমাদের আকর্ষণ করে। তার আরেকটি কারণ বোধ করি আমরা সাধারণত এক সাথে অনেক বিষয় ভাবতে পারি না কিংবা বিষয়ের গভীরে যাওয়ার ধৈর্য বা অবকাশ আমাদের থাকে না। যেমন—রবীন্দ্রনাথের ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম/সে কখনো করে না বঞ্চণা’। আমরা জানি সব সত্য কঠিন নয়। এখানে বরং কঠিন সত্যের কথা বলা হয়েছে, আর সে পথেই অর্থাৎ নির্দেশিত পথেই যাত্রা করে আমরা স্বাচ্ছন্দ খুঁজে পাই। সত্যি বলতে কি, শিল্পের কাজটাই অমন। বস্তুজগৎ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে আমাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার নিজস্ব জগতে নিয়ে যাওয়া। যে শিল্পী যত প্রতিভাবান, সে শিল্পী তত পটুতার সাথে এ কাজটা করে। আর এটা ঘটে শিল্পীর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা, গ্রহণ করার মানসিকতা, সংস্কার-মুক্ত মন, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতা থাকার দরুন, যা সাধারণ মানুষ চর্চা করে না, আর করে না বলেই নির্দেশিত হয়, চালিত হয় এবং পরিশেষে তাতেই তৃপ্তি লাভ করে। তবু্ও কোনো বিষয়ে সরলীকরণ করতে হলে সে বিষয়ে সার্বিক জ্ঞান অর্জন করার পর নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে তা করতে হবে। বিশেষ করে, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট, পরিবেশ-পরিস্থিতি, মানসিক অবস্থা এক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য।



তবে এও সত্য যে একই ধরনের বিষয় বা প্রজাতি সম্পর্কে শুধু কিছু নমুনা সংগ্রহ করে বিচার-বিবেচনায় সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, যেমন— চুলার চাল সিদ্ধ হয়েছে কিনা তা যাচাই করার জন্য কয়েকটি নমুনা চালই যথেষ্ট; হাড়িঁর সমস্ত ভাত টেপার প্রয়োজন নেই।

জীবনের ব্যপ্তি যেহেতু বিশাল এবং সে সম্পর্কে ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ বহু-বিস্তৃত ও অনির্দিষ্ট, কাজেই কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জীবন কিংবা কোনো বিষয় বা ধারণা সম্পর্কে সরলীকরণ প্রক্রিয়া অনেক ভেবে-চিন্তে, অতি সন্তর্পণে প্রয়োগ করতে হয়। কবি কীটস যখন বলেন যে, ‘সৌন্দর্যই সত্য, সত্যই সৌন্দর্য’, তখন তিনি কিন্তু সব ধরনের সত্য কিংবা সৌন্দর্যের কথা বলেন না। তিনি এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেই সত্য বা সৌন্দর্যকে সীমায়িত করে নিয়ে আসেন এবং তারপর এর সরলীকরণ করেন।

অনেক ক্ষেত্রে কোনো ঘটনা যখন প্রায়শই ঘটে, কিন্তু সব সময় ঘটে না, তখন আমরা সরলীকরণ করে থাকি এবং সেটাকেই আমরা— শতভাগ শুদ্ধ না হলেও— প্রশ্নের ঊর্দ্ধে স্থান দেই, যেমন— বর্ষাকালে বৃষ্টি হয় বলতে যদিও বুঝি বর্ষার সব দিনে বৃষ্টি হয় না, তবুও এ সরলীকরণ প্রশ্নাতীত হয়ে আছে। এ রকম ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে, বেশি ঘটে থাকে এমন সম্ভাবনা বা প্রবণতাকেই আমরা প্রাধিকার দিয়ে থাকি। এমন সরলীকরণের দৃষ্টা্ন্ত আরো লক্ষ্য করা যায় সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যমূলক বাক্যে যেখানে অন্যান্য বিষয়কে খর্ব করে সাদৃশ্য কিংবা বৈসাদৃশ্যকে জোর দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় সরলীকরণের মাধ্যমে।

তবে সরলীকৃত বিবৃতি সাধারণত সংক্ষিপ্ত হওয়ার দরুন তা বেশি দেখা যায় সার-বাক্যে, অর্থাৎ প্রবাদ-প্রবচনে এবং জ্ঞান-গর্ভের বাণীতে। এসব ক্ষেত্রেও সরলীকরণের পুরোটা সত্য নয়, আবার কখনো কখনো স্ববিরোধী। যেমন ধরা যাক, ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল’ প্রবাদ বাক্যটি। এটি ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ প্রবাদ বাক্যের সাথে স্ববিরোধী। কিন্তু দুটি প্রবাদই তাদের নিজ নিজ অবস্থান ও পরিস্থিতিতে সত্য। তবে সার্বিক ক্ষেত্রে নয়। আবার বলা যায়, ‘জ্ঞানই শক্তি’ প্রবচনটির সরলীকরণও বিশেষ, নির্বিশেষ নয়। ইংরেজ কবি শেলীর ঐ কথাটাই ধরা যাক না, ‘আমাদের মধুরতম গান সেগুলিই যা দুঃখময় অনুভূতির কথা বলে’ অর্থাৎ বিষাদময় গানই আমাদের মধুরতম সঙ্গীত। হ্যাঁ, অনেকটাই সত্য; সবটাই নয়।

আবার নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের মানুষ ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু ও খাদ্যাভ্যাসের দরুন নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ ও বহন করে থাকে যদিও এর কিছুটা ব্যত্যয়ও দুর্লভ নয়। সেই বৈশিষ্ট্য যদি নির্দিষ্ট কোনো তকমা সেঁটে দেয়ার জন্য সরলীকরণের সিদ্ধান্ত টানার ক্ষেত্রে একমাত্র মাপকাঠি হয়, তবে তা অসদুদ্দেশ্যে করা হয় সন্দেহ নেই।

শেষ কথা এত অসুবিধা, এত রাজনীতি ও প্রতারণা সত্তেও আমরা সরলীকরণ অবশ্যই করবো। কারণ সরলীকরণ হচ্ছে গাণিতিক সূত্রের মতো যা রপ্ত করতে পারলে জীবনের নানা জটিলতর অঙ্ক কষা সহজতর হয়। তবে তা করতে হবে নির্দিষ্ট কিছু রীতি মেনে, যেমন— প্রথমে বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত ও সীমায়িত করতে হবে। এরপর তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সরলীকরণের সমীকরণ কষা যেতে পারে। তবে প্রেক্ষাপট চিত্রায়ন কিংবা সীমায়িতকরণ সব সময় প্রত্যক্ষ নাও হতে পারে। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা থাকে পরোক্ষ ও গোপন। তাহলেই সরলীকরণ প্রক্রিয়া যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, তা সত্যকেই প্রকাশ করবে। তবে বৈজ্ঞানিক সরলীকরণ সাধারণত নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ হয় বিধায় তা সত্যকেই প্রকাশ করে।

 




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*