কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: অন্তর্গত স্বগতোক্তি

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


অন্তর্গত স্বগতোক্তি


দরজার সিঁড়িতে চাবির খোঁজে সে পকেট হাতড়ালো। সেখানে নেই। ট্রাউজারে ফেলে এসেছি। অবশ্যই আনতে হবে। আলু আছে আমার। ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ করা ওয়োরড্রোব। তাকে বিরক্ত করে লাভ নেই। সে সময় সে ঘুমের মধ্যে পাশ পরিবর্তন করলো। তার পিছনের হল দরজাটা আলগোছে টান দিলো, আরো আলগোছে যে পর্যন্ত না দ্বারপ্রান্তে পায়ের পাতা আলতোভাবে পড়লো, চোখের পাতা ঢুলুঢুলু। বন্ধ দেখালো। যে কোনোভাবে আমার ফিরে আসা পর্যন্ত সব ঠিক।

            পঁচাত্তর নাম্বারের ভূগর্ভস্থ কক্ষের আলগা ঝুলন্ত অংশ এড়িয়ে সে পার হয়ে উজ্জ্বল দিকে গেলো। সূর্য জর্জের গির্জার চূড়ার কাছাকাছি আসছিলো। উষ্ণ দিন হবে মনে হয়। বিশেষ করে এই কালো কাপড়ে বেশ টের পাচ্ছি। কালো তো তাপ পরিবাহিত করে, প্রতিফলিত করে(নাকি প্রতিসরিত করে?)। কিন্তু সেই হালকা স্যূট পরে যেতে পারলাম না। এতেই একটা পিকনিক হয়ে যাক। যখন সে খুশির উষ্ণতায় হেঁটে চললো, তখন তার চোখের পাতাগুলো প্রায়ই নীরবে বসে গেলো।



*

লীহির টেরাস, ফ্রয়েনজিমার থেকে তারা সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নিচে নেমে এলো; আর কাদামাটিতে ডুবে যাওয়া তাদের চওড়া, চ্যাপ্টা ও উপরের দিকে উল্টানো পাগুলো ক্রমশ ঢালু উপকূল বেয়ে নিস্তেজভাবে নেমে এলো। এক নাম্বার তার ধাত্রীর ব্যাগটি লূয়ারডিলি (ভারী করে) দোলালো, অন্যজনের ছাতাটা সমুদ্রের বেলাভূমিতে গুঁজে রাখলো। সে দিনের মতো বিশেষ সুবিধা শেষ হয়ে গেলো। ব্রাইড স্ট্রীটের প্রয়াত পাট্ক ম্যাকক্যাবের বিধবা স্ত্রী মিসেস ফ্লোরেন্স ম্যাকক্যাবে গভীর শোক করলো। তার নারীসঙ্ঘের একজন জীবন সম্পর্কে অনুযোগ জানাতে আমাকে টেনে নিয়ে গেলো। শূন্য থেকে সৃষ্টি। তার ব্যাগে কী আছে? লাল পশমী সূতার আড়ালে বেড়ে ওঠা নাড়ীসহ ভুল করে জন্ম নেয়া কেউ। সবার নাড়ির আবার সংযোগ ঘটে সব মাংসের স্ট্র্যান্ডেনটোয়াইনিং তারের সাথে। সে জন্য মরমি সন্যাসীরা। আপনারা কি দেবতাদের মতো হবেন? আপনাদের ওমফ্যালোসে (নাভি) তাকিয়ে থাকেন। হ্যালো। কিন্চ এখানে। আমাকে ইডেনভিলের দিকে মনোযোগ দিতে দিন। আলেপ, আলফা: শূন্য, শূন্য, এক।

*

হ্যাঁ কারণ দুটো ডিম দিয়ে বিছানায় নাস্তা এনে দিতে বলার মতো আগে সে এমনটা কখনো করে নি যেহেতু সিটি আর্মজ হোটেলে যখন অসুস্থ কণ্ঠস্বরে বিছানায় পড়ে থাকার ভান করতো সেহেতু সেই বৃদ্ধা সমকামী মিসেস রিওরডেনের কাছে নিজেকে মজার করে তোলার জন্য সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এমনভাবে যে সে ভাবলো তার নিজের বিশাল একটা পা আছে আর মিসেস রিওরডেন নিজের নৈশভোজের জন্য আমাদের কাছে কখনো সিকি আনাও রেখে যায় নি এবং এ যাবৎকালের মধ্যে তার শ্রেষ্ঠ কৃপণ আত্মা আসলে মিথাইল স্পিরিটের জন্য চার পেনি দিতে ভয় পেয়ে আমাকে তার যে যে অসুখ ছিলো তা বলেছিলো রাজনীতি ও ভূমিকম্প এবং পৃথিবীর ধ্বংস নিয়ে পুরানো অনেক কথা বলতো চলুন একটু মজা করি প্রথমে ঈশ্বর পৃথিবীকে সাহায্য করুক যদি সব নারী তার  স্নান পোশাক ও গলাকাটা কাপড় নামিয়ে রাখতো অবশ্য আমার মনে হয় সে পরুক কেউ তা চায় নি সে ছিলো ধার্মিক কারণ কোনো পুরুষ তার দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতো না।

জেমস জয়েস ইউলিসিস (১৯২২)

জেমস জয়েসের ইউলিসিস  শিরোনামটি এমন একটা তথ্যসূত্র –পুরো টেকস্টে কোনোভাবে বাদ না যাওয়া একমাত্র তথ্যসূত্র — যে ১৬ জুন ১৯০৪ তারিখে ডাবলিনের বেশ সাদামাটা দিনের বিবরণে হোমারের ওডিসি  (যার নায়ক, ওডিসিয়াসকে ল্যাটিন ভাষায় ইউলিসিস বলা হতো) এর কাহিনীর পুনর্পরিবেশন, অনুকরণ কিংবা প্রহসন রয়েছে। মধ্যবয়স্ক ইহুদি বিজ্ঞাপন প্রচারক, লিওপোল্ড ব্লুম হচ্ছে অনায়কোচিত নায়ক যার স্ত্রী মলি তার সমতুল্য, পেনিলোপির মতো স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারে না। ওডিসিয়াসকে যেমন ট্রয় যুদ্ধ থেকে বাড়ি ফেরার পথে বিরূপ ঝড়ো বাতাসের দ্বারা ভূমধ্যসাগরের চারপাশে উড়িয়ে নেয়া হয়েছিলো, তেমনই নানা অসমাপ্ত ভ্রমণে ডাবলিন শহর পারাপার করার পর ব্লুমও যে গল্পের টেলিমেকাস, যে জয়েসের নিজের প্রতিকৃতি, তরুণ বয়সের সত্ত্বা — অহংকারী, কপর্দকশূন্য, পিতার কাছ থেকে যে বিচ্ছিন্ন, যে আকাঙ্খী লেখক সে স্টিফেন ডিডেলাসের সাক্ষাৎ পায় এবং তার সাথে পিতা-মাতার মতো বন্ধু হয়ে যায়।

            ইউলিসিস  বীরত্বমূলক মহাকাব্যের চেয়ে বরং মনস্তাত্ত্বিক মহাকাব্য। মূল চরিত্রদের সম্পর্কে না বলা হলেও নীরব, স্বতঃস্ফূর্ত, অবিরাম চেতনা প্রবাহ হিসেবে উপস্থাপিত তাদের সবচেয়ে একান্ত চিন্তা-ভাবনা ভাগাভাগি করে আমরা তাদের সাথে পরিচিত হই। পাঠকের কাছে এটা বরং কারো মগজে ইয়ারফোন সেট করে পরার মতো, আর বিষয়ের ধারণা, চিন্তা, প্রশ্ন, স্মৃতি ও অবাধ কল্পনার অশেষ টেপ-রেকর্ডিং পর্যবেক্ষণ করছে, যেহেতু সেগুলোর সূত্রপাত ঘটে শারীরিক সংবেদন কিংবা ধারণা-অনুষঙ্গের মাধ্যমে। অন্তর্গত স্বগতোক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে জয়েসই প্রথম লেখক নন (ঊনিশ শতকের শেষের দিকে এক অখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক এদুয়া দুজারদাঁর উদ্ভাবন বলে তিনি কৃতিত্ত্ব দেন), আবার শেষ লেখকও নন, কিন্তু তিনি একে এমন নিখুঁত পর্যায়ে আনেন যে  ফকনার ও বেকেটকে বাদ দিলে অন্যান্য লেখককে তুলনামূলকভাবে বেশ দুর্বল দেখায়।



            স্বার্থকভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্তর্গত স্বগতোক্তি অত্যন্ত দুরূহ একটি কৌশল, সব কিছু এত যথাযথ হতে হয় যে কথনের উপর যন্ত্রণাদায়কভাবে ধীর গতি আরোপ করা যায় না এবং অজস্র খুঁটিনাটি বিবরণ দিয়ে পাঠককে বিরক্ত করা যায় না। স্রেফ শব্দ-প্রতিভার বদৌলতে জয়েস এসব ত্র“টি অংশত এড়িয়ে গেছেন, যার ফলে সবচেয়ে সাদামাটা ঘটনা কিংবা বস্তুকে অত্যন্ত মজাদার করে তুলেছেন যেন সেগুলোর সাথে আমাদের আগে কখনো দেখা হয় নি, তবে এছাড়াও রয়েছে তাঁর ডিসকোর্সের ব্যাকরণগত কাঠামোর সুচতুর তারতম্য, মুক্ত পরোক্ষ রীতি ও গোঁড়া কথন রীতির সাথে অন্তর্গত স্বগতোক্তির সমন্বয়সাধন।

            নাস্তা করার জন্য শুকরের কিডনি কিনতে খুব সকালে লিওপোল্ড ব্লুমের বাড়ি ছাড়ার ঘটনা নিয়ে প্রথম উদ্ধৃত অংশটি। “দরজার সিঁড়িতে চাবির খোঁজে সে পকেট হাতড়ালো” এ বাক্যটি ব্লুমের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারই কর্মকাণ্ডকে বর্ণনা করে, কিন্তু ব্যাকরণগত দিক দিয়ে, যতই নৈর্ব্যক্তিক হোক না কেন, একজন কথকের ইঙ্গিত প্রদান করে। “সেখানে নেই” হচ্ছে অন্তর্গত স্বগতোক্তি, ব্লুমের অনুচ্চারিত ভাবনা, “এটা সেখানে নেই।” এর সংক্ষিপ্ত রূপ। কর্তার অনুপস্থিতি আবিস্কারের তাৎক্ষণিকতাকে জানান দেয়, আর এতে হালকা আতঙ্ক বোধ জড়িয়ে থাকে। তার মনে আছে যে চাবিটা আরেক ট্রাউজারে যা সে “ফেলে এসেছে” কারণ পড়ন্ত দিনে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় যোগদানের জন্য সে একটা কালো স্যূট পরে আছে। “আলু আছে আমার” প্রথম বারের পাঠকের কাছে সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্তিকর: যথা সময়ে আমরা আবিষ্কার করি যে এক ধরনের তাবিজ বা রক্ষাকবচ হিসেবে ব্লুম তার সাথে কুসংস্কারাচ্ছন্নভাবে একটা আলু বয়ে বেড়ায়। এমন বিভ্রান্তি রীতিটিকে যথার্থতা প্রদান করে, কারণ অন্য ব্যক্তির চেতনা প্রবাহকে সম্পূর্ণরূপে স্বচ্ছ অবস্থায় পাওয়ার প্রত্যাশা করা আমাদের ঠিক নয়। চাবিটা আনার লক্ষ্যে শোবার কক্ষে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্লুম কারণ ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে আওয়াজ করা ওয়োরড্রোবের দরজা তার স্ত্রীকে বিরক্ত করতে পারে, যে তখনো বিছানায় ঝিমোচ্ছে — ব্লুমের প্রয়োজনীয়ভাবে দয়ালু ও বিবেচক প্রকৃতির ইঙ্গিত। সে মলিকে শুধু “তাকে” বলে (আর শেষ বাক্যে “সে” বলে) কারণ তার চৈতন্যে তার স্ত্রী এতটা জায়গা দখল করে আছে যে তাকে নাম ধরে শনাক্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই তার — কথক হিসেবে পাঠকের আগ্রহ মাথায় রাখলেই যথেষ্ট।

            পরের চমৎকার মূকাভিনয়ের বাক্যটি যেখানে ব্লুম বাড়ির দরজা কীভাবে টেনে প্রায় বন্ধ করে ফেলে তার বর্ণনা আছে, সেটি কথন রীতিতে ফিরে আসে, কিন্তু ব্লুমের দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে তার শব্দভাণ্ডারের সীমার মধ্যে থেকে যায় যাতে করে অন্তর্গত স্বগতোক্তির খণ্ডাংশ, “আরো” কোনো অসুখকর অনুভূতি ব্যতিরেকেই এতে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। পরের বাক্যটির অতীত কাল “বন্ধ দেখালো” এতে মুক্ত পরোক্ষ রীতির বৈশিষ্ট্য এনে দেয়, আর অন্তর্গত স্বগতোক্তিতে অনায়াসে ফেরত যাওয়ার বাঁক হিসেবে কাজ করে: “যে কোনোভাবে আমার ফিরে আসা পর্যন্ত সব ঠিক,” এর মধ্যে “সব ঠিক” অংশটি “সব কিছু ঠিক থাকবে” এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এ উদ্ধৃত অংশে কথনের বাক্যগুলি বাদ দিলে বাকি বাক্যগুলি ব্যাকরণগতভাবেও শুদ্ধ নয়, আবার মানের কঠোরতায় সম্পূর্ণও নয়, কারণ আমরা সুগঠিত বাক্যে চিন্তা তো করিই না, এমনকি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথাও বলি না।



            সমূদ্র তীরে হাঁটতে হাঁটতে দুজন নারীকে দেখতে পাওয়া স্টিফেন ডেডালাসের বর্ণনাসমেত দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি ডিসকোর্সর রূপের একই বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। কিন্তু ব্লুমের চিন্তাধারা যখন বাস্তবসম্মত, ভাবাবেগপূর্ণ আর অশিক্ষিতভাবে বিজ্ঞানসম্মত (তাপের প্রতি কালো কাপড়ের প্রতিক্রিয়ার জন্য সঠিক পরিভাষা সে অনিশ্চয়তা ভরে হাতড়ায়), অন্যদিকে তখন স্টিফেনের চিন্তাধারা জল্পনামূলক, হাস্যদীপ্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত, সাহিত্যগুণ সম্বলিত — আর তা বোঝা অত্যন্ত দুরূহ। “অ্যালগি” কবি অ্যালগেরনন সুইনবার্নের পরিচিত নাম, যিনি সমুদ্রকে বলেছিলেন “মহামিষ্টি মাতা”, আর “লুয়ারডিলি” হয় সাহিত্যে অপ্রচলিত শব্দ নতুবা প্যারিসে স্টিফেনের বোহেমিয়ান জীবন-যাপনের প্রভাবে উদ্ভাবিত শব্দ (ফরাসি ভাষায় লূয়ারড মানে “ভারী”)। মিসেস ম্যাকক্যাবের ডাকে চমকপ্রদ মূর্ততার সাথে নিজের জন্মকে প্রকাশ করার জন্য স্টিফেনের লেখকসুলভ কল্পনা জেগে ওঠে: “তার নারীসঙ্ঘের একজন জীবন সম্পর্কে অনুযোগ জানাতে আমাকে টেনে নিয়ে গেলো,” আরেকটি দৈব মূকাভিনয়ের বাক্য যা ধাত্রীর হাতে নবজাতকের পিচ্ছিল শরীর আপনাকে অনুভব করায়। অপ্রীতিকর বিষয়ে খানিকটা আগ্রহী কল্পনা, যেমন- মিসেস ম্যাকক্যাবের ব্যাগে গর্ভপাতঘটিত ভ্রুণ আছে, এ কল্পনা স্টিফেনের চেতনা প্রবাহকে জটিল ও অবাধে কাল্পনিক দিবাস্বপ্নের দিকে নিয়ে যায় যেখানে নাড়ীটাকে তুলনা করা হয় সকল মানুষের আদি মাতা, বিবি হাওয়ার সাথে সংযোগ ঘটানো এক তারের সাথে, যাতে ইঙ্গিত আছে কেন প্রাচ্যের সন্যাসীরা তাদের নাভি(গ্রীক, ওমফ্যালাস) নিয়ে অনুধ্যান করেন, যদিও স্টিফেন চিন্তাটা শেষ করে না, তার মন লাফিয়ে যায় অন্য আরেকটি রূপকগত কল্পনায়, টেলিফোনের তার হিসেবে মানুষের যুক্ত নাভি যার দ্বারা স্টিফেন (তার সহযোগী, বাক মুলিগ্যানের দেয়া ডাক নাম, কিন্চ) খামখেয়ালীপনার সাথে স্বগীয় বাগানে ডায়াল করছে বলে নিজেকে কল্পনা করছে।

            চেতনা প্রবাহ রীতিতে ইউলিসিস এর পুরোটা জয়েস লেখেন নি। মনস্তাত্ত্বিক বাস্তববাদ যতদূর যায় ততদূর নিয়ে তাঁর উপন্যাসের পরের অধ্যায়গুলোতে তিনি নানা ধরনের প্রকরণ, প্যাস্টিশ এবং প্যারডির শরণাপন্ন হন: এটি ভাষাতাত্ত্বিক এবং একই সাথে মনস্তাত্ত্বিক মহাকাব্য। কিন্তু সব অন্তর্গত স্বগতোক্তির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত স্বগতোক্তি, মলির স্বগতোক্তি দিয়ে তিনি উপন্যাসটি শেষ করেন।

            শেষ “পর্বে” (ইউলিসিস  এর অধ্যায়গুলোকে যেমনটা বলা হয়), লিওপোল্ড ব্লুমের স্ত্রী, মলি যে এ যাবৎ ব্লুম ও অন্যান্য চরিত্রের ভাবনা, পর্যবেক্ষণ ও স্মৃতির পাত্রী হয়েছে, সে বিষয়ে পরিণত হয়, চৈতন্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বিকালবেলা সে লিওপোল্ডের প্রতি বিশ্বস্ত না থেকে ব্লেজেজ বয়লিন (অর্ধ পেশাজীবী এক গায়িকা) নামে এক গণবিনোদনের আয়োজকের সাথে সম্পর্ক করে। রাত এখন গভীর। ব্লুম মলিকে বিরক্ত করে ঘুমাতে এসেছে, আর মলি আধো ঘুম আধো জাগরণে সে দিনটি ও তার অতীত জীবনের ঘটনা স্মরণ করছে, বিশেষ করে তার স্বামী ও বিভিন্ন প্রেমিকের সাথে অভিজ্ঞতার কথা। বস্তুত নবজাতক অবস্থায় তাদের ছেলেকে হারানোর মানসিক যন্ত্রণার পর ব্লুমরা অনেক বছর ধরে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক উপভোগ করে নি, কিন্তু তারা পরস্পরের সাথে এক সূত্রে গাঁথা থাকে ঘনিষ্ঠতার দরুন, এক ধরনের ধৈর্য্যচ্যূত সোহাগ ও এমনকি ঈর্ষার দরুন। মলির অভিসারের ব্যাপারে তার সচেতনতা দিয়ে ব্লুমের দিনটা ছেঁয়ে যায়, আর তার দীর্ঘ, প্রায় সম্পূর্ণ বিরামহীন স্বগতোক্তি শুরু হয় এই জল্পনা দিয়ে যে ব্লুমের অবশ্যই যৌন দুঃসাহসিকতামূলক কাজ থেকে থাকবে, কেননা ব্লুম স্বভাবদুর্লভভাবে নিজেই হলফ করে দাবি করেছে যে পরের দিন সকালে মলি যেন তার বিছানায় নাস্তা আনে, এমন কিছু ব্লুম সুদূর সময় থেকে কখনো করে নি যখন ব্লুম অক্ষম সেজেছিলো মিসেস রিওড্যান (স্টিফ্যান ডিডেলাসের আন্টি, বস্তুত অনেক ছোট-খাট কাকতালীয় ঘটনার একটি যেগুলো ইউলিসিস  এর আপাত এলোমেলো ঘটনাগুলোকে একসাথে গেঁথে রেখেছে) নামে এক বিধবাকে মুগ্ধ করতে, যার কাছ থেকে সে উত্তরাধিকার পাওয়ার আশা করছিলো, যদিও মিসেস রিওড্যান আসলে কিছুই রেখে যায় নি, কথিত আছে যে তার আত্মার শান্তির জন্য এর সব টাকা পরিশোধ করতে গেছে…(মলি ব্লুমের স্বগতোক্তি সহজ ভাষায় বলতে গেলে যে কারো তার নিজের অবাধ প্রবাহ রীতির মধ্যে পড়ার প্রবণতা থাকে)



            স্টিফেন ও ব্লুমের চেতনা প্রবাহ যখন তাদের ইন্দ্রিয় ধারণা দিয়ে উদ্দীপিত হয় এবং ধারা পরিবর্তিত হয়, অন্যদিকে তখন অন্ধকারে অবস্থান করে বিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো থেকে থেকে রাস্তার গোলমালে মলির কাছে তার নিজের স্মৃতিগুলো তাড়া করে, একেকটা স্মৃতি অন্য আরেকটিকে অনুষঙ্গের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলে। আর স্টিফেনের চৈতন্যে অনুষঙ্গ যখন রূপকপ্রবণ (সাযুজ্যের মাধ্যমে এক জিনিস আরেক জিনিসের ইঙ্গিত দেয়, প্রায়ই গুপ্ত কিংবা কল্পনাপ্রসূত ধরনের), আর ব্লুমের মেটানিমিক (কার্যকারণ কিংবা স্থান/কালের সন্নিহিতি সম্পর্কে যুক্ত দুটি জিনিস যেখানে একটি আরেকটির ইঙ্গিত দেয়), অন্যদিকে মলির চৈতন্যে অনুষঙ্গ তখন একেবারে আক্ষরিক: বিছানায় একবেলার নাস্তা তাকে অন্য বেলার নাস্তার কথা মনে করিয়ে দেয়, যেভাবে তার জীবনের এক পুরুষ অন্য এক পুরুষের কথা মনে করিয়ে দেয়। ব্লুমের চিন্তা-ভাবনা যেহেতু তাকে অন্য প্রেমিকদের সম্পর্কে ভাবায়, সেহেতু “সে” বলতে মলি কাকে বোঝায় তা নির্ধারণ করা সব সময় সহজ নয়।


আগের পর্ব                                                                                                                                                  পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*