কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: পরিচিতিরহিতকরণ

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


পরিচিতিরহিতকরণ


আমার মতে এ ছবিটাকে সংগ্রহের রাণী বলে বিবেচনা করার মতো মনে হলো।

            এতে এক নারী ছিলো, ভাবলাম, জীবনের থেকেও বিশাল বড়। আমার হিসেবে বিশালায়তনের এক পণ্য পাওয়ার উপযুক্ত নিক্তিতে রাখলে এ ভদ্রমহিলার ওজন হবে অভ্রান্তভাবে চৌদ্দ থেকে ষোল স্টোনে। বস্তুত সে চরম খাওয়া-দাওয়া করেছে জীবনে; প্রস্থে ও উচ্চতায় এতটা বাড়ার জন্য, এতটা পেশীসম্পদ ও মাংসবহুল হওয়ার জন্য– রুটি, শাকসবজি ও তরলের কথা না বললেও– কসাইয়ের দেয়া খুব বেশি মাংস অবশ্যই সে ভোগ করে থাকবে। সোফায় অর্ধশোয়া অবস্থায় পড়ে আছে সে –কেন, বলা কঠিন হবে; দিবালোক তাকে প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছে। বিশাল স্বাস্থ্য নিয়ে হাজির হলো, সাধারণ দুজন বাবুর্চির সমান কাজ করার মতো যথেষ্ঠ সবল; সে দুর্বল মেরুদণ্ডের অজুহাত দিতে পারলো না; তার দাঁড়িয়ে থাকা উচিৎ ছিলো, অথবা নিদেনপক্ষে একদম সোজা হয়ে বসা উচিৎ ছিলো। দুপুরে সোফায় আরাম করার প্রয়োজন ছিলো না তার। একইভাবে শালীন পোশাক পরা উচিৎ ছিলো — যে পোশাক তাকে যথাযথভাবে ঢেকে ফেলবে, যা আসলে দেখা গেলো না। আমি বলবো সাত ও বিশ গজ বেশি কাপড় থাকার দরুন সে অকাজের পোশাক বানাতে পেরেছে। তারপর তার চারপাশে জরাজীর্ণ অপরিচ্ছন্নতার কারণে কোনো অজুহাত চলে না। পাত্র ও কড়াইগুলো — হয়তো বলা উচিৎ ভাজন ও হাতাবিহীন পানপাত্রগুলো — মাটিতে এখানে সেখানে পড়ে আছে; ফুলের নিখুঁত আবর্জনা সেগুলোর সাথে মিশে গেছে, আর আজগুবি এবং অগোছালো পর্দাগুলো দিয়ে সোফাটি ভরে গেছে এবং মেঝেটি ভারী হয়ে গেছে। ক্যাটালগ দেখার পর বুঝতে পারলাম যে এই উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিটির নাম “ক্লিওপেট্রা”।

শার্লট ব্রোনটি ভিলেট (১৮৫৩)



ostranenie (আক্ষরিক অর্থ “অদ্ভূত করে তোলা”) শব্দের সাধারণ তর্জমা হলো defamiliarisation বা পরিচিতিরহিতকরণ, যা রাশিয়ান ফর্মালিস্টদের উদ্ভাবিত অমূল্য সমালোচনামূলক শব্দসমূহের মধ্যে আরেকটি শব্দ। ১৯১৭ সালে প্রথম প্রকাশিত বিখ্যাত এক প্রবন্ধে ভিক্টর শক্লোভস্কি যুক্তি দেখান যে শিল্পের প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিচিত জিনিসকে অপরিচিতভাবে উপস্থাপন করে অসাড় প্রভাব কাটিয়ে ওঠা:

কাজকর্ম, কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র, কারো স্ত্রী এবং যুদ্ধের ভয়কে অভ্যস্তকরণ গ্রাস করে ফেলে…। আর শিল্পের অস্তিত্ব আছে যাতে করে কেউ জীবনের সংবেদনকে পুনরুদ্ধার করতে পারে; অস্তিত্ব আছে কাউকে বস্তুসমূহ অনুভব করাতে, পাথুরেকে পাথুরে  করতে। শিল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে বস্তুসমূহ যেভাবে প্রত্যক্ষণ করা হয়, সেভাবে সেগুলোর সংবেদন প্রদান করা এবং সেভাবে নয় যেভাবে সেগুলো পরিচিত।

এ তত্ত্বে আধুনিক রচনার বিকৃতি ও বিপর্যয়ের সত্যতার প্রতিপাদন মেলে, কিন্তু বাস্তববাদী উপন্যাসের মহান চর্চাকারীদের বেলায়ও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। শক্লোভস্কির একটি দৃষ্টান্ত ছিলো একটি অনুচ্ছেদ, যেখানে টলস্টয় অপেরাকে উপহাস করেন এই বলে, যে ব্যক্তি আগে কখনো অপেরা দেখে নি বা শোনে নি, সে রকম কারো চোখে যেন এর অভিনয় বর্ণনা করা (উদাহরণস্বরূপ, “তখনো আরো লোক ছুটে ছুটে এলো এবং মেয়েটি যে সাদা পোশাক  পরে থাকতো কিন্তু যে  এখন আসমানি নীল পোশাক পরেছে, তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। তারা তাকে তৎক্ষণাৎ টেনে নিয়ে যায় নি, তবে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার আগে তার সাথে অনেকক্ষণ গেয়েছিলো”।) ভিলেট  থেকে এখানে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটিতে শার্লট ব্রোনটি স্যালন  আর্টের অনুরূপ কিছু একটা করেন।

            ভিলেট হচ্ছে ব্রাসেলসের কাল্পনিক নাম যেখানে নায়িকা ও কথক, লুসি স্নোয়ি বালিকাদের বোর্ডিং স্কুলে শিক্ষক হিসেবে জীবিকা উপার্জন করতে বাধ্য হয়। সে গোপনে ও নৈরাশ্যজনকভাবে এক ইংরেজ ডাক্তার, জন ব্রেটনের প্রেমে পড়ে, যে তাকে শিল্প গ্যালারিতে সাথে নিয়ে যায়, তবে সেগুলো অনুসন্ধান করে আরো কিছু আবিষ্কার করার ভার তার উপর ছেড়ে দেয় — এমন একটা আয়োজন যা তার স্বাধীন চেতনার সাথে খাপ খায়।

            এখানে পর্যবেক্ষণাধীন চিত্রকর্মটি শনাক্তযোগ্য চিত্রকর্ম যার মধ্যে নারী নগ্নতার রগরগে চিত্রায়ন যেন সম্মাননীয় করে তোলা হয়েছে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক উৎসের সাথে সংযুক্তি ঘটিয়ে, ভীতিকর জাঁকজমক দিয়ে, আর অন্যান্য নানা প্রতীকি চিহ্ন দিয়ে– যা উচ্চ সংস্কৃতির বিষয়। এমন দৃশ্যে স্ববিরোধিতা অবশ্য আরো বেশি লক্ষ্য করা যায় শার্লোট ব্রোনটির নিজের সময়ে যখন আমাদের সময়ের তুলনায় নারীরা সব সময় তাদের শরীরের প্রায় প্রতিটি ইঞ্চি ঢেকে রাখতো। তাঁর নায়িকার মাধ্যমে শার্লোট ব্রোনটি উন্মোচন করেন এসব স্ববিরোধীতা; আর  আক্ষরিকভাবে ও সত্যিকারভাবে চিত্রকর্ম বর্ণনা করে, নারীদেরকে বাস্তব জীবনের নিরিখে রেখে, আর শিল্প ইতিহাস ও সমঝদারিত্বে “অভ্যাসবশত” প্রত্যক্ষণ করার ডিসকোর্সকে উপেক্ষা করে উন্মোচন করেন এ ধরনের শিল্পে প্রয়োজনীয় মিথ্যাকে (যেমনটা তিনি দেখেছিলেন)।



            এভাবে নারী দেহের স্তম্ভাকৃতি ও তাকে ঘিরে পোশাকের অপ্রয়োজনীয়তা, প্রথাগত শিল্প মুল্যায়নে উপেক্ষিত কিংবা দমিত প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা হয় ওজন ও পরিমাণের প্রায়োগিক, আপাত-বৈজ্ঞানিক হিসাব-নিকাশ দ্বারা: “চৌদ্দ থেকে ষোল স্টোনে… আমি বলবো সাত ও বিশ গজ বেশি কাপড় ।” হয়তো উপস্থ মাংসের কয়েক ইঞ্চি ব্যতীত কোনো কিছু না ঢেকে কুণ্ডলিত ভাঁজে দেহের চারপাশে নগ্নদেহের ধ্রুপদী চিত্রকর্মে কাপড়ের ব্যবহারে আমরা এতটা পরিচিত হয়েছি যে এর প্রয়োজনীয় কৃত্রিমতা আমরা আর উপলব্ধি করি না। এ ধরনের চিত্রকর্মের পুরোভূমিতে নানা ধরনের বস্তু ও  জিনিসপত্রের চিত্রবৎ আয়োজনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার প্রযোজ্য — ঐ পানপাত্রগুলো সব সময় মেঝেতে উল্টে পড়ে থাকে কেন, যখন চিত্রায়িত ব্যক্তিত্বদের অফুরন্ত সুযোগ থেকে থাকবে, অথবা চাকর-বাকরদের সেগুলো তুলে রাখতে পারতো? লুসির নিস্পলক নিরীক্ষণ গ্যালারি দেখার রীতিতে অভ্যাসবশত দমিত প্রশ্ন তোলে। যৌনতার নীরব আহ্বানে রমণীটির অবসন্নভাবে শুয়ে থাকার ভঙ্গিকে অবজ্ঞা করা হয় চিত্রায়িত দিনের সময়ের সাথে অসঙ্গতি ও বিষয়টির শারীরিক দুর্বলতার কোনো প্রমাণের অভাবের উপর মন্তব্য করে। আর তার বর্ণনার শেষ অব্দি “ক্লিওপেট্রা” শিরোনামটিকে ধরে রেখে লুসি ইঙ্গিত দিচ্ছে চিত্রকর্মটির দাবিতে ঐতিহাসিক/পৌরাণিক যথার্থতার স্বেচ্ছাচারিতা ও অসাধুতাকে, যে চিত্রকর্মটি আরো ঠিকভাবে বলা যায় “ডিডো” কিংবা “ডেলিলাহ্”, কিংবা (আরো সততার সঙ্গে) “ওডালিস্ক”।

            চিত্রকর্ম বর্ণনার এমনিতে কোনো কথন বিষয় থাকে না; গল্প “কিছুক্ষণ থামে” যাতে করে ডেলিভার করা যায়। কিন্তু এর কথন ক্রিয়া (narrative function) রয়েছে। প্রথমত, এটি লুসি স্নোয়ির চরিত্র চিত্রায়ণে অবদান রাখে, যে দৃঢ়, স্বাধীন ও প্রথাবিরুদ্ধ মতের একজন যুবতী নারী যদিও তার সৌন্দর্য, সামাজিক অবস্থান বা সম্পদের অভাব বেশিরভাগ সময় তাকে সেগুলোকে নিজের কাছে রাখতে বাধ্য করে। দ্বিতীয়ত, খিটখিটে মেজাজের, অনাকর্ষণীয় এম. পল এমানুয়েলের সাথে এটি এক মজার দৃশ্যের উদ্রেক করে,  তবে লুসির স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকটিকে সে যথাসময়ে শনাক্ত করে বাহ্যিকভাবে যোগ্য ড. জনের চেয়ে আরো বেশি সুখদ সঙ্গী হিসেবে। পল এমানুয়েল তাকে “ক্লিওপেট্রা”র সামনে আবিষ্কার করে এবং আহত বোধ করে — এমন এক প্রতিক্রিয়া যা তাকে সমঝদারিত্বের (চিত্রকর্মটির উচ্চ সাংস্কৃতিক ভানে সে মুগ্ধ হয় না) সাংকেতিক ভাষায় সুরক্ষিত হিসেবে দেখায়, কিন্তু গৎবাঁধা লৈঙ্গিক উপস্থাপনের মুগ্ধতায় (যুবতী নারী চিন্তা-ভাবনা করার উপযুক্ত নয় বলে সে মনে করে)। ধার্মিক এক মহিলার জীবনের তিনটি ভাবাবেগপূর্ণ দৃশ্যের আরেকটা চিত্রকর্ম দেখতে সে লুসিকে টেনে নিয়ে যায়, যে ছবিটা লুসির কাছে ক্লিওপেট্রার মতো আজগুবি ও অপ্রাসঙ্গিক লাগে।

            অকাল মৃত্যুর আগে শার্লোট ব্রোনটি তাঁর শেষ উপন্যাস ভিলেট  লেখেন, আর এটি তাঁর সবচেয়ে পরিণত উপন্যাস। সমসাময়িককালে এটি প্রধান পাঠ্যে পরিণত হয়েছে যেসব কারণে তা এ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট। কিন্তু ঐতিহাসিক চিত্রকর্মে নারীদের উপস্থাপনকে পরিচিহিরহিতকরণ করে শার্লোট ব্রোনটি শিল্প সম্পর্কে এবং যৌন রাজনীতি সম্পর্কে, আর বিশেষ করে মেলোড্রামা ও রোমান্সের মিথ্যা প্রতিপাদন ও ইচ্ছাপূরণ থেকে একটু একটু করে এবং যন্ত্রণাদায়কভাবে মুক্ত হওয়া তাঁর নিজের শিল্প সম্পর্কে নিজস্ব মত পোষণ করছিলেন। এই অনুচ্ছেদের আগে লুসি স্নোয়ি বলে, “আমার কাছে মনে হলো যে ঠিক মৌলিক ও উত্তম বইয়ের মতোই মৌলিক ও উত্তম ছবি দুর্লভ ছিলো।” ভিলেট  এমনই একটা বই।



            প্রশংসার জন্য এটা তো সর্বজন ব্যবহৃত শব্দ — আমরা যখন বলি, কোনো বই “মৌলিক”, তখন আমরা কী বুঝিয়ে থাকি? সাধারণত এটা নয় যে লেখক নজিরবিহীন কিছু একটা উদ্ভাবন করে ফেলেছেন, তবে এটা বোঝাই যে    বাস্তবতাকে প্রথাগত, অভ্যাসমাফিক উপস্থাপন করার রীতি থেকে বিচ্যূত হয়ে ধারণাগত অর্থে আমরা ইতোমধ্যেই যা “জানি”, তা তিনি আমাদেরকে “উপলব্ধি করা” তে পেরেছেন। সংক্ষেপে পরিচিতিরহিতকরণ হচ্ছে “মৌলিকত্ব” এর আরেক নাম। কথাসাহিত্যের শিল্পরূপের দিকে  এসব নজরে আবার আমি এর আশ্রয় নেবো।


    আগের পর্ব                                                                                                                                    পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*