কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: রহস্য




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


রহস্য


“ব্লোয়েমফনটেইন দূর্গে যুদ্ধের পর ফেলে রাখা কোনো নৌবাহিনীর গোলা-বারুদ অধিগ্রহণ করতে সেই একই সন্ধ্যায় ভিকারি সাহেব  দেশের অভ্যন্তরের দিকে গেলো। ভিকারি সাহেবকে সঙ্গ দেয়ার জন্য বিস্তারিত কোনো কিছুর আদেশ দেয়া হয় নি। নিজেকে নিজেই সে অনন্য প্রথম একক ব্যক্তি হিসেবে ভর্ৎসনা করেছিলো।”

সমুদ্র জাহাজে কর্ণভেদী বাঁশি বাজলো। “এটাই ভেবেছিলাম,” পাইক্রোফট বললো। “তার সাথে তীরে গেলে সে আমাকে স্টেশনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে বললো। শোনার মতো করে ক্লিক করে আওয়াজ করছিলো, অন্যথায় তাকে খানিকটা সুখী মনে হলো।

“ ‘তুমি জানতে চাইতে পারো,’ সে বলে, ‘যে ফিলিসের সার্কাস কাল রাতে ওয়োরসেস্টারে অনুষ্ঠান করবে। তাই আমি আবারও দেখবো। তুমি আমার কাছে অনেক ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়েছো,’ সে বলে।

“ ‘ভিকারি, এখানটায় দেখো,’ আমি বললাম, ‘আমি যতটা সইতে পারি এ জিনিসটা ঠিক ততটাই হয়েছে। তোমার নিজের ধোঁয়া ভোগ করো। আমি আর বেশি জানতে চাই না।’

“তুমি!’ সে বললো। ‘কিসের অভিযোগ করবে? — তোমার শুধু দেখার রয়েছে। আমিই সেটা ,’ সে বলে, ‘কিন্তু সেটা এখানেও নয়, ওখানেও নয়,’ সে বলে। ‘করমর্দন করার আগে আমার একটা কথা বলার আছে। মনে থাকে যেন,’ সে বলে — আমরা তো তখন অ্যাডমিরালের বাগানের দরজায় ছিলাম — ‘মনে থাকে যেন আমি খুনি নই, কারণ আমি বেরিয়ে আসার ছয় সপ্তাহ পর শিশু জন্মদানের বিছানায় আমার বৈধ স্ত্রী মারা যায়। এটুকুর ব্যাপারে আমি অন্তত পরিস্কার,’ সে বলে।

“ ‘তাহলে তুমি যা করেছো তার মানে কী দাঁড়ায়?’ আমি বললাম। ‘এর বাকিটা কী?’

“ ‘বাকিটা নীরবতা,’ সে বলে, আর করমর্দন করে সিমন্সটাউন স্টেশনে ক্লিক করতে করতে গেলো।”

“ওয়োরসেস্টারে মিসেস ব্যাথার্স্টের সাথে দেখা করার জন্য সে কি থেমেছিলে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“জানা যায় নি। সে ব্লোয়েমফনটেইনে রিপোর্ট করে ট্রাকের মধ্যে গোলা-বারুদগুলো দেখেছিলো, আর তারপর সে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলো। বাইরে গিয়েছিলো — বলতে পারো, ছেড়ে গিয়েছিলো — তার পেনশনের আট মাসের মাথায়, আর তার স্ত্রী সম্পর্কে যা বলেছিলো তা সত্য ছিলো। সে তখন মুক্ত মানুষ ছিলো। তুমি একে কীভাবে নেবে?”

রুডইয়ার্ড কিপলিং “মিসেস ব্যাথার্স্ট”(১৯০৪)

কয়েক পৃষ্ঠা আগে টমাস হার্ডির পেয়ার অব ব্লু আইজ  এ “উৎকণ্ঠা সৃষ্টিকারী অংশ”( cliffhanger) আলোচনা করে দেখিয়েছিলাম যে নায়িকা পরিশেষে নায়ককে উদ্ধার করে, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে সে কী কৌশল অবলম্বন করেছিলো সে ব্যাপারে শুধু একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। উপন্যাসের সাথে অপরিচিত পাঠকদের জন্য আমি এভাবেই উৎকণ্ঠার প্রভাবকে (“কী ঘটবে?”) একটা হেঁয়ালি বা রহস্যে (“কীভাবে সে এটা করলো?”) রূপদান করেছিলাম। এ দুটি প্রশ্ন বর্ণনার আগ্রহ সৃষ্টির মূল শক্তি এবং গল্প বলার মতোই প্রাচীন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রথাগত রোমান্সের মূল উপকরণগুলোর একটি ছিলো চরিত্রসমূহের বংশ ও পিতা-মাতা সম্পর্কে রহস্য যা অনবরত নায়ক-নায়িকার সুবিধা অনুযায়ী হতো। এটা এমন একটা প্লট মোটিফ যা ঊনবিংশ শতকের কথাসাহিত্যের গভীরে বজায় ছিলো এবং আজও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যে বিদ্যমান (কথাসাহিত্যে এর ব্যবহার দেখা যায় প্যারডি হিসেবে, যেমন অ্যান্টনি বার্জেসের এম/এফ, কিংবা আমার নিজের স্মল ওয়ার্ল্ড )। ডিকেন্স ও উইলকি কলিন্সের মতো ভিক্টোরিয়ান ঔপন্যাসিকেরা রহস্যকে ব্যবহার করেছিলেন লঘু ও গুরু অপরাধের সাথে যা পরিণামে পৃথক এক উপবিভাগে বিবর্তন লাভ করে, আর ব্যবহৃত হয়েছিলো কোনান ডোয়িল ও তার উত্তরসূরীদের ধ্রুপদী গোয়েন্দা কাহিনীতে।



মীমাংসিত রহস্য অন্তিম পর্যায়ে পাঠককে আশ্বস্ত করে, প্রবৃত্তির উপর যুক্তির জয়, নৈরাজ্যের উপর শৃঙ্খলার জয় ঘোষণা করে, তা সে শার্লক হোমসের গল্পেই হোক আর সিগমন্ড ফ্রয়েডের কেস হিস্ট্রি হোক যা সেগুলোর এমন উজ্জল ও সন্দেহমূলক সাদৃশ্য বহন করে। সেজন্য গদ্য সাহিত্য বা ছায়াছবি বা টেলিভিশন সোপ — আঙ্গিক যাই হোক না কেন, জনপ্রিয় কথনের অপরিবর্তনীয় উপাদান হচ্ছে রহস্য। এর বিপরীতে আধুনিক ঔপন্যাসিকেরা যারা পরিচ্ছন্ন সমাধান ও সুখী পরিসমাপ্তির ব্যাপারে সজাগ, তাঁদের প্রবণতা রয়েছে রহস্যসমূহকে দ্ব্যর্থকতার আভায় কাজে লাগানো এবং অমীমাংসিত রেখে যাওয়া। মেজি তার পূর্ণবয়স্কদের যৌন আচরণের কী জানতো তা আমরা নিশ্চিত করে আবিষ্কার করতে পাই না, যেমনটা পাই না জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস  এর  কুর্টস কি ট্রাজিক হিরো নাকি মানুষরূপী শয়তান, অথবা জন ফাউলের দ্য ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্ট উমান  এর বিকল্প পরিসমাপ্তিগুলো কি “সত্যিই” তা-ই।

কিপলিংয়ের কাহিনী “মিসেস ব্যাথার্স্ট” এমনই একটি ডাকসাইটে দৃষ্টান্ত; আর বিশেষভাবে মজার হয়ে উঠেছে এমন একজন লেখকের কাছ থেকে আসায় যাঁর ব্যাপক সংখ্যক পাঠক রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই কাহিনীর ব্যাপক আকারে অমীমাংসিত রহস্যময়তার প্রভাবে অবশ্যই হতবুদ্ধি ও ধৈর্য্যচ্যূত হবেন। একই প্রতীকে তিনি দেখিয়েছেন যে তাকে যতটা মূল্য দেয়া হয় তার চেয়ে অনেক বেশি আত্মসচেতন, কৌশলী ও নিরীক্ষাধর্মী লেখক তিনি।

বোয়ের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই দক্ষিণ আফ্রিকায় কাহিনীর শুরু, আর ভিকারি নামক এক ব্রিটিশ নাবিক যে তার বেমানান মেকি দাঁতের জন্য ক্লিক নামে পরিচিত, তার রহস্যময় অন্তর্ধান নিয়ে গল্পটি রচিত। কেইপ উপকূলে রেলওয়েতে হঠাৎ দেখা পাওয়া চারজনের মধ্যকার কথাবার্তা চলাকালে ধীরে ধীরে ঘটনাটির অল্প কয়েকটি জানা তথ্য প্রকাশিত হয়। সে চারজন হলো: ভিকারির জাহাজের বন্ধু পাইক্রফট, প্রিটচার্ড নামে নৌবাহিনীর এক সার্জেন্ট, হুপার নামে এক রেলওয়ের পরিদর্শক এবং বেনামী “আমি” কথক (ইঙ্গিতার্থে কিপলিং নিজেই) যারা তাদের সাক্ষাতের পরিস্থিতি বর্ণনা করে গল্প নির্মাণ করে এবং তাদের কথাবার্তা জানান দেয়। পাইক্রফট বর্ণনা করে কীভাবে তার অন্তর্ধানের ঠিক আগে আগে ভিকারি সিনেমার সংবাদচিত্র দেখতে তাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে পীড়াপীড়ি করছিলো। এ সংবাদচিত্রটি ছিলো ফিলিসের সার্কাস নামক দলগুলোর জন্য যাত্রাকালীন বিনোদনের অংশ। তার পীড়াপীড়ির কারণ ছিলো প্যাডিংটন স্টেশনে ট্রেন থেকে নামছে এমন এক মহিলাকে এতে এক নজর দেখা যেতো। সে মহিলা এক বিধবা ছিলো যার নাম মিসেস ব্যাথার্স্ট। নিউজিল্যান্ডের পানশালার বন্ধুসুলভ মালিক হিসেবে সে পাইক্রফট ও প্রিটচার্ডের কাছেও পরিচিত ছিলো। এর সাথেই ভিকারি স্পষ্টভাবে দোষ বোধে পীড়িত এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে তোলে (প্রিটচার্ডের প্রমাণ অনুযায়ী মিসেস ব্যাথার্স্ট যদিও নির্দোষ ছিলো)। ছবির এই অংশের দেয়া পাইক্রফটের (অর্থাৎ কিপলিংয়ের) উল্লেখযোগ্য বিবরণ — সে এ যাবৎ প্রথম যা যা দেখেছে — সিনেমার সবচেয়ে আগেকার সাহিত্য বর্ণনাগুলোর একটির মধ্যে পড়ে, আর কাহিনী মূলের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকাকে প্রকাশ করে:



“তারপর দরজাগুলো খুলে গেলে যাত্রীরা বের হয়ে এলো এবং কুলিরা বোঁচকা-বাঁচকি নিয়ে গেলো — ঠিক জীবনের মতো। শুধু — শুধু যখন কেউ এত দূরে আমাদের কাছে চলে এসে লক্ষ্য করলো যে তারা, বলতে গেলে, হেঁটে দৃশ্যটির ঠিক বাইরে চলে গেছে…। একদম ধীরে ধীরে পিছন থেকে দুজন কুলি ছোট্ট একটা ভ্যানিটি ব্যাগ বহন করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো — আমাদের মিসেস ব্যাথার্স্ট আসে। সামনে চলে আসে — ঠিক সামনে — সে সোজা আমাদের দিকে খানিকটা অন্ধ দৃষ্টি দিয়ে তাকালো যা প্রিটচ উল্লেখ করেছিলো। সে হেঁটেই চললো আর চললো যে পর্যন্ত না সে দৃশ্যটি থেকে মিলিয়ে গেলো — মোমবাতির উপর লাফিয়ে পড়া ছায়ার মতো।”

ভিকারি নিশ্চিত যে মিসেস ব্যাথার্স্ট “তাকে খুঁজছে”। বারবার এই ঘটনার দ্বারা সে এতই বিরক্ত হয় যে তার কমান্ডিং অফিসার সন্ত্রস্ত হয়, আর তাকে একাকী অভিযানে পাঠিয়ে দেয় এমন এক জায়গায় যেখান থেকে সে কখনো ফেরে না। উদ্ধৃত প্যাসেজটিতে পাইক্রফট যখন ভিকারিকে সমুদ্র তীর পর্যন্ত সাথে নিয়ে যায় তখন তাকে শেষ দেখার দৃশ্য বর্ণনা করে সে, আর তার অন্তর্ধানের হেঁয়ালি করে।

রহস্য প্রভাব একটিমাত্র উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব, কেননা এটি ইঙ্গিত, তথ্যসূত্র ও বিভ্রান্তিকর উপাত্তের ক্রম ধারা রক্ষা করে চলে। আর “মিসেস ব্যাথার্স্ট” এর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় রহস্য কী সে ব্যাপারে বাড়তি রহস্যময়তা রয়েছে। চারজন ব্যক্তির সাক্ষাতের গল্প কাঠামোটি, আর তাদের হাসিঠাট্টা, যুক্তিতর্ক ও দীর্ঘ উপাখ্যানমূলক স্মৃতিচারণকে মনে হয় ভিকারির কাহিনীর চেয়ে বেশি জায়গা দখল করে আছে। উদ্ধৃত প্যাসেজটি যেখানে তার অন্তর্ধানের হেঁয়ালি সবচেয়ে স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছে, আর যা শার্লক হোমসের গল্পের শুরুর দিকে চলে আসতো, তা আদতে এ গল্পের শেষের দিকে আসে।

ভিকারি যেমন খুনের কথা উল্লেখ করে শুধু নিজেকে নির্দোষ ঘোষণা করতে, কিপলিংও তেমনই গোয়েন্দা কাহিনী আবাহন করেন শুধু এর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে। “পরিদর্শক” হুপারের (উপাধিটি পুলিশের পরিবর্তে ভুল করে ব্যবহৃত হতে পারে) কোমরের পকেটে থাকে এক সেট মেকি দাঁত যা পাওয়া গিয়েছিলো দুটি লাশের একটির উপর, যে লাশগুলো আবার দেশের অভ্যন্তরে সেগুন বনের আগুনে জীবন্ত দগ্ধ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো। ভিকারি কীভাবে তার অন্তিমের দেখা পায় এটা বোধ হয় তারই আদালতি প্রমাণ। “মেকি দাঁতগুলোই স্থায়ী জিনিস। সব খুনের বিচারে আপনি সেগুলোর ব্যাপারে পড়েছেন,” হুপার বলে; কিন্তু গল্পের শেষে কথক জানায় যে সে “তার কোমরের পকেট থেকে খালি হাত সরিয়ে এনেছিলো।” হুপারের শিষ্টাচার বোধের বদৌলতে হলেও রহস্য উদঘাটনে খালি হাত পাঠকের আকাঙ্খার নৈরাশ্যকেও প্রতিকায়ত করে। ভিকারির শনাক্তকরণ ও তার অন্তিম সম্পর্কে  বয়ান আমরা মেনে নিলেও আমরা জানি না কোন কাজের দরুন সে এমন চরমে পৌঁছালো, অথবা জানি না তার পাশে পাওয়া দ্বিতীয় লাশটির পরিচয় (বহু পণ্ডিত এসব প্রশ্ন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে উদ্ভাবনী, কখনো কখনো অদ্ভূত, এবং সর্বদা মীমাংসাহীন জবাব প্রদান করেছেন)। সংবাদচিত্রের মিসেস ব্যাথার্স্টের মতো ভিকারি দৃশ্যটি থেকে মিলিয়ে গেছে, গল্পের কাঠামো থেকে লাফ দিয়েছে, আর তার সম্পর্কে অন্তিম সত্য চূড়ান্তরূপে অপরিবর্তনীয় থেকে গেছে।



কিপলিং কেন তাঁর পাঠককে এভাবে জ্বালাতন করেন? আমার বিশ্বাসমতে কারণটা হচ্ছে “মিসেস ব্যাথার্স্ট” রহস্য কাহিনীর স্বাভাবিক অর্থের আবশ্যিক বিচারে আদৌ কোনো রহস্য গল্প নয়, তবে ট্রাজেডি। হ্যামলেট  এর যে উদ্ধৃতিটি রেকর্ড করা ভিকারির শেষ কথা (“বাকিটা নীরবতা”), যা মার্লোর ফসটাসের আগের দিককার জবানের প্রতিধ্বনি (“এ নরক কেন, আমি এর বাইরেও নই”), (“তোমার শুধু দেখার রয়েছে। আমিই সেটা,), তা গল্পে উঁচু মানের ট্রাজেডির পরোক্ষ উল্লেখের (allusion) কয়েকটি। অন্য জায়গার মতো এখানেও কিপলিং দেখিয়েছেন যে সেসব সাধারণ মানুষ যারা “হ” উচ্চারণ করতে পারে না এবং যাদের বেমানান কৃত্রিম দাঁতের সারি আছে, তারা সবকিছু সত্ত্বেও প্রবল আবেগ, উদগ্র বাসনা ও পঙ্গুকারী দোষের যোগ্য; আর দেখিয়েছেন যে সব কিছুর উপরে সবচেয়ে বড় রহস্য হচ্ছে মানুষের হৃদয়।


আগের পর্ব                                                                                                                         পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*