মূল: ড্যাভিড লজ
অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম
মুখবন্ধ
১৯৯০ এবং ১৯৯১ সালের মধ্যে বারো মাস ধরে কবি জেমস ফেনটন দী ইনডিপেন্ডেন্ট অন সানডে তে “আর্স পোয়েটিকা” শিরোনামে সাপ্তাহিক কলাম লেখেন, যেটি রোমান কবি হোরেসের কবিতার উপর বিখ্যাত গবেষণামূলক আলোচনা-গ্রন্থের শিরোনাম ছিলো। ফেন্টন প্রতি সপ্তাহে ছোট একটি কবিতা বা কবিতার অংশবিশেষ মুদ্রণ করতেন এবং সাধারণভাবে কাব্য শিল্পের কোনো কোনো দিক ও টেক্সটের উপর আলোকপাত করার উদ্দেশ্যে ভাষ্য লিখতেন। ১৯৯১ সালের আগের দিকে পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক ব্লেক মরিসন আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন জেমস ফেন্টন তাঁর অংশ শেষ করলে গদ্য সাহিত্য নিয়ে একই রকম কিছু লিখতে আমি আগ্রহী হবো কিনা।
আমি সাধারণত পত্রিকার প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য সময় নেই, আর প্রায়শই অন্তিমে না বলে দেই; কিন্তু ব্লেক তাঁর অংশ শেষ করার ঠিক আগে আগে এ উপলক্ষে আমি হ্যাঁ বলার সিদ্ধান্ত নেই। ১৯৬০ এবং ১৯৮৭ সালের মধ্যে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে আমি একজন শিক্ষক ও ঔপন্যাসিক ছিলাম, বার্মিহাম ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য পড়াতাম। সে সময়ে সাহিত্য সমালোচনা, প্রধানত উপন্যাসের সমালোচনা এবং “উপন্যাস” নিয়ে কিছু বই প্রকাশ করি। সে সময়ে অনেক বছর ধরে ‘কথাসাহিত্যের আঙ্গিক’ নামে একটা কোর্স প্রস্তাব করি। ১৯৮৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ থেকে আগাম অবসর নেয়ার পর দেখতে পেলাম যে প্রয়োজনীয়ভাবে পাঠ্যসূচীতে নিবদ্ধ পাঠককূলের জন্য সমালোচনা লেখা চালিয়ে যাওয়ার প্রতি আমার তেমন কোনো ঝোঁক বা প্রণোদনা নেই; কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ ও উপন্যাসের ইতিবৃত্তান্ত সম্বন্ধে বলার মতো আমার তখনো কিছু ছিলো, যা আরো বেশি সাধারণ পাঠকের কাছে আগ্রহ উদ্দীপক হতে পারে। আরো টের পেয়েছিলাম যে এজন্য সাপ্তাহিক পত্রিকার কলাম আদর্শ একটা প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।
অজস্র দারুণ কবিতার কথা ভিন্ন। কিন্তু উপন্যাস যেহেতু পত্রিকার প্রবন্ধে সামগ্রিকভাবে উদ্ধৃত করা যায় না, সেহেতু পাঠ্যকেন্দ্রিকের চেয়ে বিষয়কেন্দ্রিক আঙ্গিকের উপর লিখবো বলে বেশ দ্রুত ঠিক করি। “কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ” এর কোনো কোনো দিক উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর জন্য প্রতি সপ্তাহে ধ্রুপদী ও আধুনিক উপন্যাস বা গল্প থেকে একটা দুটো সংক্ষিপ্ত অংশবিশেষ নির্বাচন করি। (সিরিজটার জন্য কম-বেশি অপরিহার্য নাম ফেন্টনের “আর্স পোয়েটিকা” অনুসরণ করে হেনরি জেমসের শ্রদ্ধাপূর্ণ রচনার শিরোনামে অনধিকার প্রবেশের কিছুটা অস্বস্তি সত্ত্বেও বইটার জন্য আমি তা রেখে দিয়েছি।) জেইন অস্টিন, জর্জ এলিয়ট, হেনরি জেমস ব্যতিরেকে প্রতি সপ্তাহে ভিন্ন এক লেখক বা লেখক যুগলের থেকে দৃষ্টান্ত টেনেছি। বলতে গেলে ইংরেজি ও আমেরিকান লেখকদের মধ্যেই একান্তভাবে সীমাবদ্ধ থেকেছি, কেননা এটা হচ্ছে শিক্ষাবিদদের মতে “আমার ক্ষেত্র” এবং এর বাইরে উপন্যাসের নিবিড় সহী বিশ্লেষণ করার ব্যাপারে আমি কম আস্থাবান। আগে মুদ্রণ অবস্থায় এ প্যাসেজগুলোর কোনো কোনোটা সম্পর্কে আমার মন্তব্য আছে, কিন্তু ঠিক একই ভাষায় নয়।
“সূচনা” দিয়ে শুরু করেছি, আর সব সময়ই ইচ্ছে ছিলো “সমাপ্তি” দিয়ে শেষ করার। এ দুটোর মধ্যে এক সপ্তাহের প্রবন্ধে কখনো কখনো পরবর্তী সপ্তাহের বিষয় নিহিত ছিলো, কিন্তু উপন্যাসের তত্ত্বের প্রথামাফিক, অগ্রগতিশীল ভূমিকা হিসেবে সিরিজটা সাজাই নি। বই প্রকাশের তাগিদে প্রবন্ধগুলো রিভাইজ করতে আমি কিছু সংখ্যক ক্রস-রেফারেন্স ঢুকিয়ে দিয়েছি, আর সূচী সংযোজন করেছি, যা বিষয়সমূহের কতকটা এলোমেলো ধারার ক্ষতি পুষিয়ে নেবে। একবার যিনি শিক্ষক সব সময়েই তিনি শিক্ষক। বইটা যদিও “সাধারণ পাঠক” এর জন্য প্রণীত, তবুও ব্যাখ্যাসমেত কিছু সংখ্যক শাস্ত্রীয় শব্দ ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবেই ব্যবহার করেছি। এ শব্দসমূহ এমন পাঠকের কাছে অপরিচিত হতে পারে, কেননা যথাযথ বর্ণনামূলক শব্দ ছাড়া আপনি সাহিত্য পাঠ বিশ্লেষণ করতে পারবেন না, যেমনটা পারবেন না যথাযথ যন্ত্রপাতি ছাড়া কোনো ইঞ্জিনকে খুলে পরিস্কার করতে। এ শব্দগুলোর কোনো কোনোটা আধুনিক যেমন- “ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি” এবং “মেটাফিকশন”, আর কোনো কোনোটা প্রাচীন যেমন- ধ্রুপদী অলঙ্কারের নাম (“মেটানিমি”, “সিনেকডকি” ইত্যাদি), যার উপর আধুনিক ভাষাতত্ত্ব এখনো বিকশিত হয় নি। ওয়েনি বুথ যদি ইতোমধ্যেই নামটা ব্যবহার না করতেন, তাহলে এ বইয়ের নাম হতো কথাসাহিত্যের অলঙ্কার। কথাসাহিত্যকে আমি সব সময় প্রয়োজনীয়ভাবে আলঙ্কারিক শিল্প হিসেবে গণ্য করেছি– অর্থাৎ ঔপন্যাসিক বা ছোট গল্পকার পঠন অভিজ্ঞতার স্থায়িত্বকালের জন্য জগত সম্পর্কে এক ধরনের দৃষ্টি ভাগাভাগি করতে প্ররোচিত করেন, আর তাতে সফল হলে কল্পিত বাস্তবতায় সেই গভীর মগ্নতা কার্যকর করেন। যেমনটা ভ্যান গগ তাঁর চিত্রকর্ম “দ্য নভেল রীডার” এ এত মনোজ্ঞভাবে বিধৃত করেছেন। ঔপন্যাসিকেরাও নিজেদের শৈল্পিক উদ্দেশ্যে ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবেই ভাঙচুর করেন যে সেই মোহমুগ্ধতা আগে সৃষ্টি করতে হবে।
মৌলিক প্রবন্ধগুলো লেখা হয়েছে ফরমায়েশি কলেবরে, কিন্তু আমি সাধারণত আমার কপিটা একটু বড় কলেবরে জমা দেই। আর কাটছাঁট করে সুপ্রাপ্য জায়গা করে নেওয়ার ভারটা দেই ব্লেক মরিসন ও তাঁর সহকারি জ্যান ড্যালির সুযোগ্য হাতে। ( যে নিপুণতা ও দক্ষতা সহকারে তাঁরা এ কাজটা সমাধা করেছেন তার জন্য এখানে তাঁদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই।) বই প্রকাশের জন্য প্রবন্ধগুলো রিভিশন করতে গিয়ে তাঁরা যে প্যাসেজগুলো বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন সেগুলোর কোনো কোনোটা আমি পুনরুদ্ধার করে এনেছি, আর আগের খসড়া থেকে যেগুলো আমি নিজেই বাদ দিয়েছি সেগুলোর কিছু কিছু এ রকম প্রায় সবগুলোতে নতুন উপকরণ- দৃষ্টান্তমূলক ও যুক্তিমূলক- উভয়ই যোগ করেছি। একটা উপকরণ নতুন প্রবন্ধ “অধ্যায়” দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছি। কথাসাহিত্যের প্রায়োগিক খুঁটিনাটির উপর আলোকপাত করতে গিয়ে লেখক হিসেবে আমি প্রায়ই আমার লব্ধ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেছি– যেমনটা আসল পত্রিকার প্রবন্ধে হয় যথাযথ না হয় প্রায়োগিক মনে হয়েছে– তার থেকে বেশি বেশি।
বইটা আসল সিরিজের চেয়ে প্রায় ত্রিশ গুণ বেশি বড়। কিন্তু কোনো বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করতে চেষ্টা করি নি। মোটের উপর সেগুলোর সিংহভাগই পূর্ণ দৈর্ঘ্যের রচনার কিংবা পূর্ণাঙ্গ আয়তনের বিষয় হতে পারতো, আর অনেক ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। এ বইটা সে সমস্ত লোকের জন্য যাঁরা তাদের সাহিত্য সমালোচনা অল্প অল্প মাত্রায় সেবন করতে পছন্দ করেন। এটি ভাসা ভাসা এবং গভীরভাবে পড়ার মতো একটি বই; এমন বই যাতে নেই আলোচিত বিষয়গুলোর যে কোনোটির ব্যাপারে নির্দিষ্ট শব্দ বলে দেওয়ার প্রয়াস, তবে আমি আশা করি এটা এমন বই যা পাঠকের গদ্য সাহিত্যের বোধগম্যতা ও রসাস্বাদন বাড়িয়ে দেবে, আর তাদের জন্য পঠনের নতুন নতুন সম্ভাবনার অভিঘাত সঞ্চার করবে। আর কে না জানে এই ব্যাপক বৈচিত্রময় ও সার্থক সাহিত্য আঙ্গিকে লেখার ক্ষেত্রেও তা ঘটবে।
ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ডের বিখ্যাত সূচনা বাক্যটি কলার ধরে দ্বারপ্রান্তের উপরে আমাদের কার্যত টেনে নিয়ে পাঠকের মনোযোগ নিবদ্ধ করার স্পষ্ট এক কৌশল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক
বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অস্পষ্টতা ও নির্দেশহীনতা, সত্য আবিস্কারের সম্ভাবনা সম্পর্কে উদ্বেগ কথনকে আক্রান্ত করে। কে এই ব্যক্তি আমাদের সম্ভাষণ জানাচ্ছে? সে ইংরেজি ব্যবহার করে, অথচ নিজে ইংরেজ নয়। “বিষাদময় গল্প” এর বিষয় হিসেবে যাদের মনে হচ্ছে সেই ইংরেজ দম্পতিকে সে চেনে অন্তত নয় বছর ধরে, তবু দাবি করে কথনের এ মুহূর্ত পর্যন্ত ইংরেজদের সম্পর্কে “কিছুই জানি না” । প্রথম বাক্যটির “শোনা” ইঙ্গিত দেয় যে সে অন্য কারো গল্প বর্ণনা করতে যাচ্ছে, কিন্তু পরপরই প্রায় এ ব্যঞ্জনা নিহিত থাকে যে কথক, এবং সম্ভবত তার স্ত্রী, নিজেরাও এর অংশ। অ্যাশবার্নহ্যাম পরিবারকে কথক ঘনিষ্ঠভাবে চেনে- এবং আদৌ জানে না। এসব স্ববিরোধী কথা যুক্তিসঙ্গত করে তোলা হয় ইংরেজপনার, ইংরেজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আচরণের প্রকাশ ও বাস্তবতার মধ্যে অসমতার প্রভাব হিসেবে। কাজেই যদিও আগাম বোধের অন্তর্নিহিত সুরে এমা কমিক না হয়ে বরং ট্রাজিক তবুও সেটার সঙ্গে এর শুরুটা একই ধরনের বিষয়বস্তুগত সুর (thematic note) তোলে। “বিষাদময়” শব্দটি অনুচ্ছেদের শেষের দিকে বারবার এসেছে, আরেকটা প্রধান শব্দ “হৃদয়” (দুটি চরিত্রেরই কথিত হৃদয়াবস্থা আছে, এলোমেলো আবেগপূর্ণ জীবন যাপন করে) শেষের আগের বাক্যে বাদ পড়ে গেছে।
Be the first to comment