কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: প্রদর্শন ও কথন

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


প্রদর্শন কথন


“তুমি তো অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ, বাছা, আর এ তরুণীর মায়ায় একেবারে এত জড়িয়ে পড়েছো যে, যদি ঈশ্বরের প্রয়োজন পড়ে তার তোমার হাতে, আমার ভয় হচ্ছে তুমি অনিচ্ছায় তাকে ছেড়ে দেবে। আমাকে এখন বিশ্বাস করো, এ বিশ্বের কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে কোনো খ্রিস্টানেরই হৃদয় দেওয়া ঠিক নয়, কিন্তু ঐশ্বরিক বিধানে যেভাবেই তার কাছ থেকে যা কিছু প্রয়োজন হোক বা নেয়া হোক না কেন, সে শান্তিপূর্ণভাবে, শান্তভাবে এবং সন্তোষজনকভাবে তা ইস্তফা দিতে পারবে।” যে কথায় কেউ তাড়াতাড়ি করে ভেতরে এসে অ্যাডামস সাহেবকে জ্ঞাপন করলো যে তার ছোট ছেলে ডুবে গিয়েছে। কিছুক্ষণ সে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো, আর শীঘ্রই রূমে পায়চারী করে তিক্ততম যন্ত্রণার সাথে তার ক্ষতিটার নিন্দা জানাতে শুরু করলো। জোসেফ, যে এ রকম উদ্বেগে অভিভূত ছিলো, সে পুরোহিতকে স্বস্তি প্রদান করার চেষ্টায় নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিলো; যে চেষ্টায় সে নানা যুক্তিতর্ক দেখালো যে, ব্যক্তিগত ও মানুষের আলোচনা– উভয়টাতে তাকে কয়েক বার মনে করা হয়েছিলো (কারণ চরম আবেগের সে পরম শত্রু ছিলো, আর যুক্তি ও সুষমা দিয়ে তা জয় করার চেয়ে বেশি কিছু প্রচার করে নি), কিন্তু তার উপদেশ শোনার অবসর ছিলো না তার। “বাছা, বাছা,” সে বললো, “অসম্ভব নিয়ে পড়ে থেকো না। আমার সন্তানদের অন্য কেউ হলে আমি মুখ বুঁজে তা সহ্য করতে পারতাম; কিন্তু আমার সবেমাত্র বোল ফোটা ছোট্ট ছেলেটা, আমার বৃদ্ধ বয়সের আদরের ধন ও সুখ — হতভাগাটাকে জীবনের একেবারে শুরুতেই ছিনিয়ে নিয়ে গেলো; সবচেয়ে মিষ্টি, সবচেয়ে ভাল মেজাজের ছেলে, যে কখনো আমাকে আঘাত দেয়ার মতো কিছু করে নি। এই তো আজ সকালে তাকে কী জীনাস এর প্রথম ছবক দিলাম। এই বইটাই সে শিখেছিলো; বেচারা! এখন এটা তোমার আর কোনো কাজে লাগবে না। সে হয়তো সব থেকে সেরা পণ্ডিত হতে পারতো, আর গির্জার অলঙ্কার হতে পারতো; — এত গুণ ও এত ভাল এত অল্প বয়সে কারো মধ্যে মেলে না।” “আর সবচেয়ে সুদর্শনও বটে,” ফ্যানির বাহুতে মূর্চ্ছা থেকে উঠে মিসেস অ্যাডামস বলে। — “বেচারা জ্যাকি, তোমায় কি আর কখনো দেখতে পাবো না?” পুরোহিত চিৎকার করে বলে। —  “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই,” জোসেফ বলে, “আরো ভাল জায়গায়; আবার দেখা পাবে, কখনো আর ছেড়ে যাবে না।” — আমার বিশ্বাস পুরোহিত এসব কথা শুনতে পায় নি, কারণ  এসব কথায় তার মনোযোগ তেমন ছিলো না, কিন্তু সে বিলাপ করতেই লাগলো, আর অশ্রু চুয়ে চুয়ে তার বুকে এসে পড়লো। অবশেষে কেঁদে বললো, “আমার ছোট্ট আদরের ধন কোথায়?” আর সে পরম বিস্মিত ও আনন্দিত হলো, যাতে আমার আশা পাঠক সহমর্মিতা জানাবে, যখন সে তার ছেলেকে ভেজা অবস্থায় দেখতে পেলো, তবে জীবন্ত এবং তার দিকে ছুটন্ত অবস্থায়।

হেনরি ফিল্ডিং জোসেফ অ্যান্ড্রুজ (১৭৪২)



কী ঘটেছে তা প্রদর্শন করা (showing) এবং কী ঘটেছে তা আমাদের কথন করা বা বলা(telling)– এ দুয়ের মধ্যে কথাসাহিত্যের ডিসর্কোস পর্যায়ক্রমে আসা-যাওয়া করে। প্রদর্শনের বিশুদ্ধতম আঙ্গিক হচ্ছে চরিত্রসমূহের উদ্ধৃত উক্তি, যার মধ্যে ভাষা ঠিকভাবে ঘটনাকে প্রতিফলিত করে (কারণ ঘটনা ভাষাতাত্ত্বিক)। কথনের বিশুদ্ধতম আঙ্গিক হচ্ছে লেখকীয় সারাংশ, যার মধ্যে কথকের ভাষার সংক্ষিপ্ততা, যথাযথতা ও সাধারণ ধারণা (abstraction) চরিত্রসমূহ ও তাদের ঘটনার(action) বিশেষত্ব এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে মুছে ফেলে। পুরোপুরি সারাংশ রীতিতে লিখিত উপন্যাস এ কারণে প্রায় পাঠযোগ্য হয় না। কিন্তু সারাংশের নিজস্ব ব্যবহার রয়েছে: যেমন– ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের তাড়াতাড়ি নিয়ে গিয়ে কথনের লয়কে ত্বরাণ্বিত করতে পারে এটি, যা মজাদারহীন বা অতিমাত্রায় মজাদার হয়ে উঠবে — কাজেই মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাবে, যদি অনেক সময় ধরে তা করা হয়। হেনরি ফিল্ডিংয়ের কাজে এ প্রভাব যাচাই করা সহজ, কেননা মুক্ত পরোক্ষ রীতি (free indirect style) কৌশলের আগেই তিনি লিখছিলেন, যে কৌশলে লেখকের উক্তি ও চরিত্রের উক্তি একসাথে মেশানো হয়, তা খুঁজে পাওয়া গেছে (সেকশন ৯ দেখুন)। তাঁর উপন্যাসগুলোতে এই দু’ধরনের ডিসকোর্সের মধ্যকার সীমানা স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন।

পুরোহিত অ্যাব্রাহাম অ্যাডামস একজন পরোপকারী, উদার, বিষয়-আশয় বিমুখ লোক, কিন্তু সেও বড় একজন কমিক চরিত্র — ইংরেজি কথাসাহিত্যের সবচেয়ে স্মরণীয় চরিত্রগুলোর একটি — কারণ সে নিয়ত স্ববিরোধীতায় বাধাগ্রস্ত। জগৎকে সে যেভাবে বিশ্বাস করে (নিজের মতো পরার্থবাদী লোকে ভরপুর) এবং জগৎ আসলে যে রকম (স্বার্থপর সুযোগসন্ধানীতে ভরপুর) তার মধ্যে; সে যা প্রচার করে (বেশ কঠোর গোঁড়া খ্রিস্টান মতবাদ) এবং সে যা চর্চা করে (সাধারণ প্রবৃত্তিজাত মানব সৌজন্য) তার মধ্যে সব সময় অসাম্য বিরাজ করে। মায়াভ্রম ও বাস্তবতার এই যে বৈসাদৃশ্য (কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে ফিল্ডিং যা ধার করেন সেরভন্টের ডন কিহোতে চরিত্রায়ন থেকে) তাকে নিয়ত কৌতুককর চরিত্রে পরিণত করে — তবে সহানুভূতিশীল চরিত্রে, কারণ তার হৃদয় সঠিক জায়গায় থাকে যদিও তার বিচারে নির্ভর করা যায় না।



উদ্ধৃত অংশে পুরোহিত অ্যাডামস নায়ক জোসেফকে তার প্রিয়তমা ফ্যানিকে বিয়ে করার তর না সওয়ার ব্যাপারে বলছে, যে প্রিয়তমার সাথে সে দীর্ঘ ও ঝক্কিময় বিরহের পর সবেমাত্র মিলিত হয়েছে। কাম ও ঈশ্বরে বিশ্বাসের অভাবের বিরুদ্ধে সতর্ক করে অ্যাডামস তরুণটিকে দীর্ঘ নছিহত শোনায়। ওল্ড টেস্টামেন্টের অ্যাব্রাহামের দৃষ্টান্ত মনে করিয়ে দেয়, যিনি তাঁর ছেলে, আইজ্যাককে প্রয়োজন হলে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। এ উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে উদ্ধৃত করে “প্রদর্শন করানো হয়”। ঠিক অ্যাডামস যেমন ঘোষণা করে- ঈশ্বর যে উৎসর্গ আমাদের কাছে দাবি করে তা আমাদের শান্তভাবে মেনে নেওয়া উচিৎ, তার নীতিগুলো নিষ্ঠুরভাবে পরীক্ষা নেয়ার জন্য প্রণীত: “যে কথায় কেউ তাড়াতাড়ি করে ভেতরে এসে অ্যাডামস সাহেবকে জ্ঞাপন করলো যে তার ছোট ছেলে ডুবে গিয়েছিলো।” এটা একেবারে সাদামাটা ধরনের সারাংশ। “জ্ঞাপন করলো” এ প্রেক্ষিতে শীতল আনুষ্ঠানিক শব্দ বলে মনে হয়, আর আমাদের বলাও হয় না যে “কেউ”টা কে। শোকার্ত পিতার বিলাপ ও তাকে স্বান্ত্বনা দেয়ার জন্য জোসেফের চেষ্টাকেও সারাংশ আকারে বলা হয় — কিন্তু অ্যাডামস যে জোসেফের উপদেশকে প্রত্যাখ্যান করে, তা তার চর্চা ও প্রচারের মধ্যকার স্ববিরোধীতাকে জোরালো করার জন্য “দেখানো হয়”, পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করা হয়, “বাছা, বাছা, অসম্ভব নিয়ে পড়ে থেকো না… ” ।

ফিল্ডিং এখানে ঝুঁকিপূর্ণ খেলা খেলছেন। একদিকে পরিচিত চরিত্রের বৈশিষ্ট্যে কমিক নিশ্চয়তা হিসেবে আমরা স্ববিরোধীতাকে লক্ষ্য করি; অন্যদিকে এক শিশুর মৃত্যুর ব্যাপারে কৌতুককর কিছু নেই। বাইবেলে উল্লেখিত উৎসর্গ করে পূণ্য অর্জনে অ্যাব্রাহাম অ্যাডামসের ব্যর্থতায় উপহাস করার আমাদের যে প্রবণতা, তা দমন করা হয় তার পরিস্থিতির করুণ রস ও তার শোকের স্বাভাবিকতা দিয়ে। আমরা দ্বিধা বোধ করি; কীভাবে এর জবাব দিতে হবে সে ব্যাপারে অনিশ্চিত থাকি।



ফিল্ডিং অবশ্য চরিত্রগুলোর জন্য এবং পাঠকদের জন্য এ অচলায়তন ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিয়েছেন। মিঃ এবং মিসেস অ্যাডামসের বিলাপ ও জোসেফ কর্তৃক তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার বৃথা চেষ্টার আরো কয়েকটা লাইন পরে, অ্যাডামস আবিস্কার করে যে তার ছেলে মোটেও ডুবে মরে নি। আর তা অবশ্যই তত দীর্ঘ নয়, খ্রিস্টান মতে সমর্পণের ব্যাপারে জোসেফকে আনন্দচিত্তে অ্যাডামসের নছিহত শুরু করার আগে তা হয়।

শিশুটির বেঁচে যাওয়ার জন্য কথকের ব্যাখ্যা হচ্ছে যে “যে লোকটি তার  দূভার্গ্যরে খবর এনেছিলো, সে এত বেশি উৎসাহী ছিলো– যেমনটা মানুষ মাঝে মাঝে হয়ে থাকে, আমার বিশ্বাস, যা উত্তম কোনো নীতি থেকে উদ্ভূত নয়–যে সে দূঃসংবাদটি ঠিকমতো বর্ণনা করতে পারে নি, আর শিশুটির সাহায্যে ছুটে যাওয়ার পরিবর্তে তাকে নদীতে পড়তে দেখে সোজা চলে যায় তার বাবাকে জ্ঞাপন করতে এমন এক ভাগ্যের কথা যা সে বর্ণনা করে অপরিহার্য বলে,” অন্য কেউ যে তাকে উদ্ধার করবে তার উপর তাকে ছেড়ে দিয়ে। এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য, অংশত এ কারণে যে উপন্যাসটি জুড়ে মানব নির্বুদ্ধিতা ও হিংসার ক্রমিক দৃষ্টান্ত রয়েছে; আর অংশত এ কারণে যে ঘটনার পর এটি খুব দ্রুত আসে।  বার্তাবাহকের চরিত্র যদি আরো বিশদভাবে বর্ণনা করা হতো এবং ঘটনাটিকে বর্ণনা করা উক্তিটি যদি প্রত্যক্ষ রীতিতে হতো, তবে দৃশ্যটির সমস্ত লয় আরো “প্রাণবন্ত” হতো এবং এর আবেগগত প্রভাব সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন হতো। ছোট্ট ছেলেটির ডুবে যাওয়ার পরিস্থিতিগুলো দুর্দশাজনক বিশেষত্ব অর্জন করতো, আর উপন্যাসের কমিক ভাব চিরতরে নষ্ট হয়ে যেতো। প্রতিবেদনটা যখন মিথ্যে হিসেবে দেখানো হলো, তখন পাঠকের মতো আমরাও বোধ করেছি যে আমাদের ব্যবহার করা হয়েছে। সারাংশের এমন বিচক্ষণ ব্যবহার ঘটিয়ে ফিল্ডিং এসব অযাচিত প্রভাব এড়িয়ে চলেন।




আগের পর্ব                                                                                              পরের পর্ব




1 Trackback / Pingback

  1. কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: ভিন্ন কণ্ঠে বলা || অনুবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*