কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: আবহাওয়া

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


আবহাওয়া


হার্টফিল্ডে আজকের দিনের সন্ধ্যাটা খুবই দীর্ঘ ও বিষাদময়। বিষন্নতার আবহাওয়া যা যা পারলো তা-ই এর সাথে যোগ করলো। ঠাণ্ডা ঝড়ের বৃষ্টি শুরু হলো, আর বাতাসে নিঃস্ব হওয়া গাছপালা ও ঝোঁপঝাড় ছাড়া জুলাই মাসের কোনো কিছুই দেখা গেলো না, আর দিনের দৈর্ঘ্য এমন নিষ্ঠুর দৃশ্যাবলীকে শুধু আরো দৃশ্যমান করে তুলেছে।

জেইন অস্টিন এমা (১৮১৬)

লন্ডন। সম্প্রতি মাসের মেয়াদ শেষ হলে লর্ড চ্যান্সেলর লিঙ্কন ইন হলে বসে ছিলেন মাইকেল । নভেম্বর মাসের শান্ত-স্নিগ্ধ আবহাওয়া। রাস্তায় যত কাদা, মনে হয় যেন পৃথিবীর মুখ থেকে জলগুলো শুধু নতুন করে অবসর নিয়েছিলো, আর হলবোর্ন পাহাড়ের উপরে হাতিসদৃশ টিকটিকির মতো চলাফেরা করা চল্লিশ ফুটের মতো লম্বা মেগালোসোরাসের সাথে দেখা করা চমৎকার ব্যাপার হতো না। চিমনির পাত্রগুলো থেকে ধোঁয়া নিচে নামছিলো, পূর্ণবয়স্ক তুষারফলকের মতো বড় ঝুলের টুকরোগুলো নরম কালো গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মতো পড়ছিলো — কেউ ভাবতে পারে, সূর্যের মৃত্যুর জন্য শোকাভিভূত। কুকুরগুলো পাঁকে আলাদা করে চেনা যায় না। ঘোড়াগুলি কদাচিৎ ভাল; তাদের ঠুলিতেই ছুটে গেলো। পথযাত্রীরা বদমেজাজের সংক্রমণে একে অপরের ছাতায় গুঁতাগুঁতি করছিলো, আর রাস্তার কোণায় কোণায় তাদের পা ধরে রাখতে পারছিলো না, যেখানে হাজারে হাজারে অন্যান্য পথযাত্রী পিছলে যাচ্ছিলো ও দিন শুরু হওয়ার (যদি বা কখনো দিন শুরু হয়) পর থেকে পিচ্ছিল কাদার আস্তরণের উপর আস্তরণের নতুন ভাণ্ডার জমা হচ্ছিলো, রাস্তার পাকা অংশের দিকে নাছোড়বান্দার মতো সেইসব জায়গায় লেগেছিলো, আর চক্রবৃদ্ধি সুদের হারে জমছিলো।

চার্লস ডিকেন্স ব্লীক হাউস (১৮১৩)

সমুদ্রের অদ্ভূত ঝড় ব্যতীত আঠার শতকের শেষের দিক পর্যন্ত গদ্য কথাসাহিত্যে আবহাওয়ার বিষয়ে মনোযোগ খুব কমই দেয়া হতো। ঊনিশ শতকে ঔপন্যাসিকেরা এ ব্যাপারে সব সময় কথা বলছে বলে মনে হয়। এটা হয়েছে অংশত রোমান্টিক কবিতা ও চিত্রশিল্প দ্বারা সংঘটিত প্রকৃতির উঁচু মাত্রায় প্রশংসার পরিণতির দরুন, আর অংশত হয়েছে ব্যক্তি সত্ত্বায়, বহির্জগত সমন্ধে আমাদের বোধগুলোকে প্রভাবিত করে ও প্রভাবিত হয়– অনুভূতির এমন পর্যায়ে ক্রমবর্ধমান সাহিত্য রসমণ্ডিত আগ্রহের পরিণতির দরুন। কোলেরিজ যেমনটা তাঁর “ডিজেকশন” কবিতায় লিপিবদ্ধ করেন:

ও রমনী! তুমি যা দাও তা-ই লই মোরা আপন মনে

আর প্রকৃতি করে বাস কেবল মোদের জীবনে।

আমাদের সবাই জানে যে আবহাওয়া আমাদের ভাবকে প্রভাবিত করে। ভাবকে সঞ্চারিত করতে যে আবহাওয়াই যুৎসই হোক না কেন, তা আবিষ্কার করতে সমর্থ্য হওয়ার সুখী অবস্থায় থাকেন ঔপন্যাসিক।

কাজেই জন রাস্কিন যে প্রভাবকে বলেছিলেন প্যাথেটিক ফ্যালাসি, প্রাকৃতিক জগতের প্রপঞ্চে মানুষের আবেগের প্রক্ষেপণ, আবহাওয়া সেই প্রভাবের ঘন ঘন সঞ্চারক। “উদ্দাম সব অনুভূতি…বাইরের বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণার মধ্যে এক ধরনের মিথ্যার সৃষ্টি করে, আমি যাকে সাধারণত প্যাথেটিক ফ্যালাসি বলে চিত্রিত করি,” তিনি লেখেন। নামে যেমনটা ইঙ্গিত আছে, তেমনই রাস্কিন ভেবেছিলেন এটা খারাপ বিষয়, আধুনিক (ধ্রুপদীর তুলনায়) শিল্প-সাহিত্যের অবক্ষয়ের উপসর্গ, আর প্রকৃতপক্ষেই প্রায়শই বেশি বেশি জটিল, শিল্পসম্মত, আত্মপ্রশ্রয়ী লেখার উপলক্ষ। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা ও বিবেচনার সাথে ব্যবহৃত হয়ে তা চলন্ত ও শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে সক্ষম আলঙ্কারিক কৌশল যা ব্যতীত কথাসাহিত্য  অনেকটা নিঃস্ব হতো।

রোমান্টিক কল্পনার অগাস্টান সন্দেহ বজায় রাখেন জেইন অস্টিন, আর সেন্স এন্ড সেন্সিবিলিটি  তে ম্যারিয়েনের চরিত্র চিত্রায়নে তা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেন। “মৃত পাতার জন্য তোমার আবেগের প্রাবল্য সবার মধ্যে নেই,” তার বোন এলিনর শুষ্ক কণ্ঠে মন্তব্য করে ম্যারিয়েনের শরৎকালীন উৎসাহ-অনুভূতির আতিশয্যের পর, “হাঁটতে হাঁটতে সেগুলোকে আমার চারপাশে বাতাসে উড়তে দেখে আমার কী আনন্দই না লেগেছে। কী অনুভূতিই না আছে সেগুলোর, ঋতু, বাতাস সকলই অনুপ্রাণিত!” জেইন অস্টিনের উপন্যাসে আবহাওয়া সাধারণত এমন কিছু হয় যা চরিত্রগুলোর অন্তর্জীবনের রূপকগত সূচী হওয়ার চেয়ে বরং তাদের সমাজ জীবনের উপর গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবসম্মত প্রভাব ফেলে। এমা র ১৫ এবং ১৬ নং অধ্যায়ে তুষার এ প্রভাবের প্রতিনিধিত্ব বহন করে। প্রথম বার উল্লেখ করা হয় ওয়েসটন সাহেবের বড়দিনের আগের ডিনার পার্টির মধ্যখানে, যখন জন নাইটলি সাহেব যিনি কখনোই এতে প্রথম দিকে যোগদান করতে চান নি, তিনি ড্রয়িং রূমে এসে মন্দভাবে লুকানো শাডেনফ্রোড (অন্যের দূর্ভাগ্যে আনন্দ লাভ) এর সাথে ঘোষণা করেন যে “সবলে তাড়িত বাতাসে কঠোর তুষারপাত হচ্ছে”, এমার সদা রুগ্ন বাবা উডহাউস সাহেবের হৃদয়ে আতঙ্ক আঘাত হানছে। এরপর এক আলোচনা হয় যেখানে প্রাসঙ্গিক যতটা না তার চেয়ে বেশি নিজেকে প্রকাশ করার মতো সবার কিছু না কিছু বলার থাকে, যে পর্যন্ত না জর্জ নাইটলি সাহেব আবহাওয়া সম্পর্কে নিজের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে ফিরে এসে একেবারে যৌক্তিক ও আশ্বস্তকর প্রতিবেদন পেশ করেন। উডহাউস সাহেব– তথাপি বাকি সন্ধ্যাটা অস্থির থাকবে– এই বলে শেষ মন্তব্য করে তিনি ও এমা গাড়ি ডাকবে বলে ঠিক করেন। এমার গাড়িতে সাথে না যাওয়ার জন্য এই আকস্মিক প্রস্থানের সুবিধাটি এলটন সাহেব গ্রহণ করেন, আর প্রেমের এমন এক ঘোষণা দেন যা এমার কাছে অপ্রত্যাশিত ও গভীরভাবে বিব্রতকরও বটে, কেননা এমা এক মায়াভ্রমে থাকে যে, এলটন সাহেব এমার অনুরাগভাজন হ্যারিয়েটের সাথে প্রেমভাবে লিপ্ত আছে। সৌভাগ্যক্রমে পরবর্তী কয়েক দিনের আবহাওয়া অন্য দুই পার্টির যে কোনোটার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এড়ানোর জন্য তাকে স্বাগত ওজর প্রদান করে:

তার কাছে আবহাওয়া সবচেয়ে অনুকূল ছিলো…। ভূমি তুষারাবৃত, আর ব্যায়ামের জন্য অন্য সব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবন্ধুসুলভ তুহিন ও গলনের মধ্যে পরিবেশটি ওঠা-নামা করতো, প্রতিটি সকাল বৃষ্টি বা তুষারের মধ্যে শুরু  হতো, আর প্রতিটি সন্ধ্যা শুরু হতো ঠাণ্ডায় হিম হতে, অনেক দিন সে খুবই সম্মানজনক বন্দী ছিলো।

আবহাওয়াকে বর্ণনা করা হয়, কারণ তা গল্পের সাথে প্রাসঙ্গিক, কিন্তু বর্ণনাটি একেবারে সাহিত্য রসমণ্ডিত।

জেইন অস্টিনও অবশ্য উপলক্ষ অনুযায়ী প্যাথেটিক ফ্যালাসির বিচক্ষণ প্রয়োগ ঘটান। জেইন ফেয়ারফ্যাক্সের ব্যাপারে নিজের আচরণের জন্য বিব্রতকর সব ইঙ্গিতসহ এমা যখন সত্যটা আবিষ্কার করে ফেলে, যখন সে আনন্দের সাথে উপলব্ধি করে যে সে নাইটলি সাহেবকে ভালবাসে, তবে বিশ্বাস করার মতো কারণ রয়েছে যে নাইটলি সাহেব হ্যারিয়েটকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন — যখন তার সৌভাগ্যে ভাটা পড়ে, তখন এর উপর তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন, “বিষন্নতার আবহাওয়া যা যা পারলো তা-ই এর সাথে যোগ করলো।” রাস্কিন দেখিয়ে দেন যে আবহাওয়া এমন কোনো উদ্দেশ্যের জন্য অসমর্থ্য। কিন্তু গ্রীষ্মকালের ঝড় নায়িকার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুভূতির যথার্থ সাদৃশ্যগত তুলনা, কেননা হাইবেরির ছোট ও বন্দী সমাজে তার অত্যন্ত স্থির ও লক্ষণীয় অবস্থান নাইটলির সাথে হ্যারিয়েটের বিয়ে হিসেবে এমন “নিষ্ঠুর দৃশ্যাবলী” কে “আরো বেশি দৃশ্যমান” করে তুলেছে শুধু। অবশ্য অযৌক্তিক হওয়ায় এটা অনির্ভরযোগ্য সংকেত: পরের দিন, সূর্য আবার বেরিয়ে আসে এবং জর্জ নাইটলি এমাকে প্রস্তাব করতে হাজির হন।

জেইন অস্টিন যেখানে আমাদের ছাড়িয়ে প্যাথেটিক ফ্যালাসি এত সন্তর্পণে প্রয়োগ করেন যে আমরা তা কদাচিৎ খেয়াল করি, সেখানে তা দিয়ে ডিকেন্স আমাদের মাথার উপর এসে আঘাত করেন ব্ল্যাক হাউস এর বিখ্যাত সূচনা অনুচ্ছেদে। “নভেম্বর মাসের শান্ত-স্নিগ্ধ আবহাওয়া।” আবহাওয়াকে “শান্ত-স্নিগ্ধ” হিসেবে ব্যক্তিত্ব আরোপ সাদামাটা কথ্যরীতি, কিন্তু এখানে তা স্বর্গীয় অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত বহন করে, কেননা এতে ওল্ড টেস্টামেন্টের ঘনিষ্ঠ উল্লেখ রয়েছে। “মনে হয় যেন পৃথিবীর মুখ থেকে জলগুলো শুধু নতুন করে অবসর নিয়েছিলো,” এটি জেনেসিসের সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনা ও মহাপ্লাবনের গল্পের প্রতিধ্বনি। মেগালোসোরাস ও শৃঙ্খলা রীতির রেফারেন্সে আরো আধুনিক, ডারউইন-উত্তর মহাবিশ্বতত্ত্ব দিয়ে বাইবেলের এসব উল্লেখকে ভিক্টোরিয়ান রীতিতে মেশানো হয়। সার্বিক প্রভাবটা হয় পরিচিতিরহিতকরণের চমৎকার কাজ।

ঊনবিংশ শতাব্দীর লন্ডনের রাস্তাঘাটের খারাপ আবহাওয়ায় এক পর্যায়ে এটি বাস্তববাদী চিত্র, একেবারে সাদামাটাভাবে ও সাহিত্য রসমণ্ডিতরূপে বর্ণিত বিশিষ্ট বিবরণের মন্তাজ: চিমনির পাত্রগুলো থেকে ধোঁয়া নিচে নামছিলো… কুকুরগুলো পাঁকে আলাদা করে চেনা যায় না। ঘোড়াগুলি …  তাদের ঠুলিতেই ছুটে গেলো। … ছাতায় গুঁতাগুঁতি করছিলো। কিন্তু ডিকেন্সের রূপকগত কল্পনা আদিম জলাভূমিতে ফিরে গিয়ে কিংবা পৃথিবীতে সকল প্রাণের অন্তিম বিলোপের আগাম ঘোষণা দিয়ে এ সাদামাটা দৃশ্যকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গর্বিত রাজধানীর মহাপ্রলয়তুল্য দৃশ্যকল্পে রূপান্তর করে। রূপকগত দ্বিরুক্তিটি যে ঝুলকালির টুকরো থেকে শোকের তুষার টুকরো, তা থেকে সূর্যের মৃত্যুর দিকে ডিগবাজি খায়, তা বিশেষভাবে মনোমুগ্ধকর।

পরে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর (হর্নবিল পাহাড়ের উপরে মেগালোসোরাসের চলাফেরার দৃশ্যকল্পটি কিং কং যে এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং বেয়ে ওঠে তার কথা বলে দেয়, বলে দেয় এইচ. জী. ওয়েলসের দ্য টাইম ম্যাশিন  এর ভীতিকর পরিসমাপ্তি, “সূর্যের মৃত্যু”র কথা।) এক ধরনের দৃশ্যপটের সাক্ষাৎ পাই আমরা, আর সাক্ষাৎ পাই মার্টিন অ্যামিজের মতো ধ্বংসযজ্ঞের উত্তরাধুনিকতাবাদী ভবিষ্যৎ বক্তার। যে সমাজ ধারণা, লোভ-লালসা ও দুর্নীতি দ্বারা সমাজকেই প্রকৃতি রহিত করেছে, সে ধারণার নিন্দা জানিয়ে এটি শুরু হয়। আর ডিকেন্স বিতর্কিত অবস্থানের উপর নানামুখী প্লটে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে উদ্যত হয়েছেন। বুদ্ধিদীপ্ত রসে লন্ডন শহরে চক্রবৃদ্ধির হারে সুদ জমা হয়, যা অর্থকে নোংরা হিসেবে বাইবেলের নিন্দার কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। প্যাসেজের (“দশটার সংবাদ” থেকে শিরোনামের মতো সংক্ষিপ্ত ও যথাযথ বিবৃতিগুলোতে) শুরুতে বর্ণিত চ্যান্সেরি কোর্টে সভাপতিত্বকারী লর্ড চ্যান্সেলর আবহাওয়ার উপরও সভাপতিত্ব করেন বলে মনে হয়, আর সমীকরণটি কয়েকটা অনুচ্ছেদ পরেই মিলে যায়: “হাতড়ে বেড়ানো ও হতবুদ্ধিকর অবস্থার সাথে মিশে যেতে সেখানটায় কুয়াশা কখনো এত ঘন হয়ে আসতে পারে না, সেখানটায় কাদা ও পাঁক কখনো এত গভীর হয়ে আসতে পারে না, যা পুরানো পাপীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রামক এই চ্যান্সেরির উচ্চ আদালত স্বর্গ ও মর্ত্যরে দৃশ্যে আজকে ধারণ করে।”


আগের পর্ব                                                                                                                     পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*