কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: অনুপ্রবেশকারী লেখক

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


অনুপ্রবেশকারী লেখক


শুধু এক ফোঁটা কালি দিয়ে মিশরীয় জাদুকর কোনো দৈবাৎ আগমনকারীর কাছে অতীতের সুদূর প্রসারী কল্পদৃশ্য আয়নায় দেখানোর দায়ভার নিয়েছিলেন। পাঠক, আপনার জন্য আমি এটাই করার দায়ভার নিচ্ছি। আমার কলমের শেষে কালির এই ফোঁটা দিয়ে আপনাকে দেখাবো হেস্লোপ গ্রামের ঘরামি ও নির্মাণকারী জনাথন বার্জের প্রশস্থ কারখানা, যেমনটা ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দে ১৮ই জুনে আবির্ভূত হয়।

জর্জ এলিয়ট অ্যাডাম বীড (১৮৫৯)

মারগারেটের কাছে — আমি আশা করি এতে সে পাঠকের বিরূদ্ধে যাবে না — কিংজ ক্রস স্টেশন সব সময় অসীমকে বোঝাতো। এই পরিস্থিতিই — সেন্ট প্যানক্র্যাসের সহজসাধ্য চমৎকারিত্বের পেছনে একটু প্রত্যাহ্যারকৃত — জীবনের বস্তুবাদের সম্পর্কে মন্তব্যের ইঙ্গিত দিয়েছিলো। রঙহীন, মোটামুটি মানের ঐ বিশাল দুই খিলানের মাঝে ঝুলে ছিলো বিশ্রী একটা ঘড়ি। সে দুটো শাশ্বত দূঃসাহসিকতার জন্য ছিলো উপযুক্ত ফটক যা সমৃদ্ধ হতে পারতো, কিন্তু সমৃদ্ধির সাধারণ ভাষায় তা নিশ্চয়ই প্রকাশ করা যায় না। একে হাস্যকর ভাবলে মনে রাখবেন যে এটা মারগারেট নয় যে আপনাকে এ সম্পর্কে বলছে; আর ত্বরা করে আরো বলছি যে ট্রেনের জন্য সেগুলোর অনেক সময় ছিলো; আরো বলছি যে মিসেস মান্ট ইঞ্জিনের মুখোমুখি, কিন্তু খুব কাছে নয় এমন জায়গায় আরামদায়ক একটা আসন পেয়েছিলো; আর মারগারেট উইক্যাম প্লেসে ফেরার পথে নিচের টেলিগ্রামটার মুখোমুখি হয়েছিলো:

            তোমার পালা এবার। কখনো যদি না লিখতাম। কাউকে বলো না। –হেলেন।

কিন্তু আন্ট জুলি চলে গেছে — ফিরে না আসার মতো করে চলে গেছে, আর জগতের কোনো শক্তিই তাকে থামাতে পারে নি।

ই. এম. ফর্সটার হাওয়ার্ডজ এন্ড (১৯১০)

গল্প বলার সরলতম উপায় থাকে গল্প-বলিয়ের কণ্ঠে যা লোকগল্পের বেনামী কণ্ঠ হতে পারে (“একদা ছিলো সুন্দরী এক রাজকন্যা”) অথবা মহাকাব্যের কবির কণ্ঠে (যেমন, ভার্জিলের “অস্ত্র ও মানুষের গান গাই আমি”) অথবা হেনরি ফিল্ডিং থেকে জর্জ এলিয়ট অবধি ধ্রুপদী কথাসাহিত্যের আস্থাশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ, বাগাড়ম্বরপূর্ণ লেখকের কণ্ঠে।

অ্যাডাম বীড  এর শুরুতে কালির ফোঁটা যা আয়না ও মাধ্যম উভয়ই — তার পরিপাটি আলঙ্কারিক কৌশল দিয়ে জর্জ এলিয়ট লেখার কাজটাকে বলার ধরনে রূপান্তরিত করেন, ঋজু অথচ পাঠকের প্রতি অন্তরঙ্গ সম্ভাষণ যা আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানায় উপন্যাসের “দ্বারপ্রান্তের উপর”, আর আক্ষরিকভাবে জনাথন বার্জের কারখানার উপর। সূক্ষ্মভাবে বিশেষ এ ব্যঞ্জনা দিয়ে তিনি তাঁর নিজের সৎ ঐতিহাসিক ঢঙের সাথে জাদু ও কুসংস্কারের ইতস্তত প্রকাশের তুলনা টেনেছেন। মিশরীয় জাদুকরের কৌশল সম্পর্কে তথ্যের অন্য কোনো কথন কর্ম নেই, কিন্তু এমনিতে মজা যে নেই তা নয়। হাজার হলেও আমরা কথাসাহিত্য যে পড়ি তা শুধু গল্পের জন্য নয়, জগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ও বোঝাপড়াকে বৃদ্ধি করার জন্যও পড়ি; আর এ ধরনের বিশ্বকোষীয় জ্ঞান ও প্রবাদমূলক প্রজ্ঞাকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য লেখকের কথন রীতি বিশেষভাবে মানিয়েছে।



শতাব্দীর শেষ নাগাদ অনুপ্রবেশকারী লেখকের কণ্ঠ অবশ্য সুনজরে আসে নি, অংশত এ কারণে যে কথনের কাজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে এটা বাস্তববাদী ভ্রম থেকে সরে আসে এবং পরিবেশিত অভিজ্ঞতার আবেগের প্রাবল্য কমিয়ে আনে। এটা এক ধরনের কর্তৃত্বকে, ঈশ্বর তুল্য সর্বদর্শীতাকেও দাবি করে বসে, যাকে আমাদের সংশয়বাদী ও আপেক্ষিতাবাদী যুগ কারো কাছে অনুমোদন করতে নারাজ। চরিত্রগুলোর চেতনার মধ্য দিয়ে কাজ তুলে ধরে কিংবা তাদের নিজেদের উপর কথনের দায়িত্বটা হস্তান্তর করে লেখকের কণ্ঠকে দমন করার বা বিতাড়িত করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় আধুনিক কথাসাহিত্যে। অনুপ্রবেশকারী লেখকের কণ্ঠ যখন আধুনিক কথাসাহিত্যে প্রয়োগ করা হয়, তখন সেটা সাধারণত হয় এক ধরনের ব্যঙ্গাত্মক আত্ম-চেতনা দিয়ে, যেমনটা হাওয়ার্ডজ এন্ড  এর অনুচ্ছেদে পরিলক্ষিত হয়। এটা দিয়ে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের সমাপ্তি ঘটে যেখানে ব্লুমবেরিট মারগারেট শ্লেজেল, তার বোন হেলেন যে শিল্প-কারখানার নব্য-ধনী ক্যাপ্টেন হেনরি উইলকক্সের প্রেমে পড়েছে, তা শুনে তার চাচীকে (মিসেস মান্ট) ব্যাপারটা দেখতে দ্রুত পাঠিয়ে দেয়।

হাওয়ার্ডজ এন্ড  ইংল্যান্ডের উপন্যাসের এক অবস্থা, এবং আধ্যাত্মিকভাবে

অনুপ্রেরণামূলক, প্রয়োজনীয়ভাবে কৃষিভিত্তিক অতীত এবং শিল্প ও বাণিজ্য দ্বারা অধিকৃত সমস্যাজনক ভবিষ্যৎ নিয়ে অখণ্ড বিচারে দেশাত্ববোধ, যা চরিত্রগুলো ও তাদের মধ্যকার সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করার মতো তাৎপর্য্য এনে দেয়। ১৯ নং অধ্যায়ে এ বিষয়টি স্বাপ্নিক চূড়ায় পৌঁছে গেছে, পুর্বেক পাহাড়ের সুবিধাজনক উঁচু অবস্থান থেকে যেখানে লেখক প্রশ্ন তোলেন, যারা দেশের জন্য সম্পদ ও ক্ষমতা সৃষ্টি করে গেছেন তারা ইংল্যান্ডেরই আছেন কিনা কিংবা “যারা দেশকে কোনো না কোনোভাবে দেখেছেন, সঙ্গে সঙ্গে রূপালী সমুদ্রে আত্মা বহনকারী জাহাজে যাত্রাকারী রত্নের মতো পড়ে থাকা গোটা দ্বীপটাকে দেখেছেন যে জাহাজের সাথে চমৎকার পৃথিবীর বহর শাশ্বতে চলে যাচ্ছে তারা…” ইংল্যান্ডের আছে কিনা।

লেখক ও মারগারেট উভয়ই পরিস্কারভাবে স্বাপ্নিক সাহচর্যের অধিকারে। মারগারেট কিংজ ক্রস স্টেশনের যে অসীমের সাথে মিল খুঁজে পায় সে অসীম যে শাশ্বতের দিকে ইংল্যান্ডের জাহাজটি যাত্রা করছে সেই অসীমের অনুরূপ, অন্যদিকে কিংজ ক্রস যখন বস্তুবাদ ও সমৃদ্ধির বিষয়ে যে বিরূপ মন্তব্য করে তা উইলকক্সদের জগতের অধিকারে। লেখক ও নায়িকার মধ্যকার ভাবাবেগের সংহতি স্পষ্টভাবে প্রকরণে ফুটে উঠেছে: শুধু অতীত কালে রদবদল (“মন্তব্যের ইঙ্গিত দিয়েছিলো ”, “ছিলো উপযুক্ত ফটক”) মারগারেটের চিন্তাকে ব্যাকরণগত দিক দিয়ে লেখকের কণ্ঠ থেকে পৃথক করে তোলে। ফর্সটার প্রকাশ্যে — কেউ কেউ বলতে পারেন অতিমাত্রায়– তাঁর নায়িকার প্রতি প্রতিরক্ষামূলক।

“মারগারেটের কাছে — আমি আশা করি এতে সে পাঠকের বিরূদ্ধে যাবে না…” “একে হাস্যকর ভাবলে মনে রাখবেন যে এটা মারগারেট নয় যে আপনাকে এ সম্পর্কে বলছে,” এ চালগুলো ঝুঁকিপূর্ণ যা এমন একটা প্রভাব সৃষ্টির কাছাকাছি চলে আসে এরভিং গফম্যান যাকে বলেছেন “ছক ভেঙ্গে ফেলা” — যখন কোনো নিয়ম বা রীতি নির্দিষ্ট ধরনের অভিজ্ঞতাকে শাসন করে, তখন সেটার লঙ্ঘন হয়। বাস্তববাদী ভ্রমকে দমিয়ে রাখতে বা প্রত্যাহার করতে আমাদের সাধারণত যা যা প্রয়োজন হয় এ বাক্যংশগুলো তা তুলে ধরে — তুলে ধরে আমরা যে বানানো চরিত্র ও কর্মের সম্বন্ধে পড়ছি সে জ্ঞানকে।

এটা তো উত্তরাধুনিক লেখকদের খুবই প্রিয় একটা কৌশল, যাঁরা কথাসাহিত্য নির্মাণে খুঁটিনাটি উন্মোচিত করে প্রথাগত বাস্তববাদে সরল বিশ্বাসকে পরিত্যজ্য ঘোষণা করেন। উদাহরণস্বরূপ, জোসেফ হেলারের গুড অ্যাজ গোল্ড  (১৯৮০)  এর মাঝখানে লেখকের এই চমকিত অনুপ্রবেশ তুলনা করুন:

গোল্ড আবারও অন্য একজন — স্পটি উইনরকের — সাথে দূপুরের খাবার তৈরি করতে নিজেকে দেখতে পেলো, আর ভাবনা জাগলো যে খেয়ে দেয়ে ও  কথা বলে সে  ভয়ঙ্করভাবে অঢেল সময় ব্যয় করছে এ বইয়ে । তার অন্য তেমন কিছু করার নেই। অ্যান্ড্রিয়ার সাথে তাকে বিছানায় অনেক রাখি, আর তার স্ত্রী ও বাচ্চাদের সুবিধাজনকভাবে ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখি…। নিশ্চয়ই সে শীঘ্রই চার বাচ্চার এক স্কুল শিক্ষকের সাক্ষাৎ পাবে যার প্রেমে সে পাগল হবে, আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রথম ইহুদি পররাষ্ট্র সচিব হওয়ার প্রলুব্ধকর প্রতিশ্রুতি প্রদান করবো, যে প্রতিশ্রুতি আমি রাখতে চাই না।



এর মতো পুরোপুরিভাবে ফর্সটার তাঁর গল্পে সৃষ্ট জীবন ভ্রমকে পুরোপুরি দুর্বল করে তোলেন নি, তবে বাস্তব মানুষদের মতো করে উল্লেখ করে চরিত্রগুলো ও তাদের সৌভাগ্যে সহানুভূতিশীল আগ্রহের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কাজেই মারগারেটের অভিজ্ঞতা ও এর কথনের মধ্যেকার ব্যবধানের দিকে মনোযোগ টেনে তিনি কী অর্জন করার চেষ্টা করছেন? আমার মতে নিজের আলঙ্কারিক ক্রিয়ার ক্রীড়াপূর্ণ আত্ম-নিন্দার উল্লেখ ঘটিয়ে যেন ইতিহাস ও অধিবিদ্যা  (যেমন, পুর্বেক পাহাড় থেকে ইংল্যান্ডকে দেখা) সম্পর্কে সেইসব বাগাড়ম্বরপূর্ণ ব্যাখ্যায় আসক্ত করতে তিনি অনুমতি লাভ করেছেন। এ ব্যাপারগুলো উপন্যাসে আগাগোড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্য সাধনে এটাকে তিনি প্রয়োজনীয় হিসেবে দেখেছেন। সম্ভাব্য পাঠকের সাড়া “বাদ দাও” কে নিরস্ত্র করতে ও ঠেকিয়ে রাখতে নম্র হাস্যরস কার্যকরী একটি উপায়, লেখকের এ ধরনের সরলীকরণ যেটাকে ডেকে আনে। ফর্সটার মজাও করেছেন কথনের গতিবেগের মাঝখান থেকে, এরকম অনুচ্ছেদগুলোতে যা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং “ত্বরা” করে আমাদের কাছে গল্প নিয়ে ফিরে আসেন, আর উৎকণ্ঠার মোহনীয় প্রভাব দিয়ে অধ্যায়টি শেষ করেন।

কিন্তু উৎকণ্ঠা ভিন্ন এক বিষয়।


আগের পর্ব                                                                                                                                   পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*