কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ: জাদু বাস্তববাদ

অনুবাদ




কথাসাহিত্যের শিল্পরূপ

মূল: ড্যাভিড লজ

অনুবাদ: শাহীনুর ইসলাম


জাদু বাস্তববাদ


আর বিশ্রাম ও ঘুম বাদ দিয়ে, সময়কে ছাড়িয়ে গিয়ে, তাদের নিস্পাপতাকে শক্তি দিয়ে ভরিয়ে তুলে এবং তাদের নাচের পদক্ষেপ গতিশীল করে, তখন হঠাৎ করে তারা সবাই তিনটা কি চারটা গান আবার গাচ্ছিলো। সবাই হাসছিলো, আর এলুয়ার্ড এক মেয়ের দিকে হেলান দিয়ে তাকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে বললো,

যে মানুষকে সুখে পেয়ে বসেছে সে কখনো হাসি থামায় না।

আর মেয়েটা হাসলো ও মাটিতে একটু শক্ত করে পা ফেললো এবং অন্যদেরকে তার সাথে টেনে নিয়ে শান থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠলো, আর শীঘ্রই তাদের কেউই মাটি স্পর্শ করে নি, মাটি স্পর্শ না করেই তারা দু’পদক্ষেপ মতো জায়গা রেখে এক পদক্ষেপ সামনে নিচ্ছিলো, হ্যাঁ, তারা ওয়েনসেসলাওস স্কয়ারের উপরে উঠছিলো, দৈত্যাকার মাল্যের প্রতিমূর্তি, তাদের রিংটি উড়ছিলো, আর তাদের পিছন পিছন আমি মাটিতে ছুটলাম, তাদের দিকে তাকিয়েই থাকলাম, আর প্রথমে একটা পা তুলে, তারপর অন্যটা তুলে তারা ভেসে চললো, আর নীচে– কবিদের দিয়ে ভরপুর ক্যাফেসহ প্রাগ এবং বিশ্বাসঘাতকদের দিয়ে ভরপুর এর জেলগুলো, আর শবচুল্লীতে তারা তো এক সমাজতান্ত্রিক প্রতিনিধি ও এক পরাবাস্তববাদীকে শেষ করে দিচ্ছিলো, আর ধোঁয়াটা শুভ লক্ষণের ন্যায় আকাশে উঠলো, আর আমি শুনলাম এলুয়ার্ড ধাতব কণ্ঠস্বরে গম্ভীরভাবে বলছিলো,

প্রেম কাজ করে ক্লান্তিহীনভাবে,

আর শহরটির উপরে ওঠা দেহমাল্যের মধ্য দিয়ে সেই কণ্ঠস্বরের পিছন পিছন আমি ছুটে চললাম, আর হৃদয়ে যন্ত্রণা নিয়ে উপলব্ধি করলাম যে, তারা পাখির মতো উড়ছিলো এবং আমি পাথরের ন্যায় পড়ে যাচ্ছিলাম, আরো উপলব্ধি করলাম যে, তাদের ডানা ছিলো এবং আমার কোনো ডানা থাকবে না।

মিলান কুণ্ডেরা দ্য বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং (১৯৭৮)

অন্যভাবে যা বাস্তববাদী কথন বোঝায়, তার মধ্যে বিস্ময়কর ও অসম্ভব ঘটনা যখন ঘটে, তখন তাকে বলে জাদু  বাস্তববাদ, যা সমসাময়িক ল্যাটিন-আমেরিকান কথাসাহিত্যের সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত একটি প্রভাব (যেমন– কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক, গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেজের কাজ) কিন্তু অন্যান্য মহাদেশ থেকেও এমন উপন্যাস মেলে, যেমন– গুন্টার গ্রাস, সালমান রুশদি এবং মিলেন কুন্ডেরার উপন্যাস। এসব লেখক মহান ঐতিহাসিক আন্দোলন এবং ব্যক্তিগত উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে  বেঁচে আছেন, যা তাঁরা মনে করেন না যে, অব্যাহত বাস্তবতার ডিসকোর্সে পর্যাপ্তভাবে চিত্রায়িত করা যায়। হয়তো ব্রিটেনের আপেক্ষিকভাবে যন্ত্রণাহীন আধুনিক ইতিহাস এর লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রথাগত বাস্তববাদ নিষ্ঠার সাথে চালিয়ে যেতে। জাদু বৈচিত্র্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হওয়ার চেয়ে বরং বাইরে থেকে আমাদের কথাসাহিত্যে আমদানী করা হয়েছে, যদিও গুটি কয়েক ইংরেজ ঔপন্যাসিক, বিশেষ করে লিঙ্গ বিষয়ে দৃঢ় মতের নারী ঔপন্যাসিক, যেমন– ফে ওয়েলডন, এঞ্জেলা কার্টার এবং জনেট উইনটারসন একে উৎসাহজনকভাবে গ্রহণ করেছেন।

মাধ্যাকর্ষণকে অগ্রাহ্য করা যেহেতু সর্বদা অসম্ভব বিষয়ে মানব স্বপ্ন হয়েছে, সেহেতু এটা হয়তো অবাক করার মতো কিছু নয় যে উড্ডয়ন, বাতাসে সন্তরণ ও মুক্ত পতনের  চিত্রকল্প এ ধরনের কথাসাহিত্যে প্রায়ই দেখা যায়। মার্কেজের ওয়ান হানড্রেড ডেইজ অব সলিটিউড  এ এক চরিত্র ধোয়া কাপড়-চোপড় শুকাতে দেয়ার সময় আকাশে আরোহণ করে। সালমান রুশদির দ্য স্যাটানিক ভার্সেজ  এর শুরুতে দুটি প্রধান চরিত্র এক বিস্ফোরিত বড় বিমান থেকে পড়ে যায় এবং তুষারাবৃত ইংরেজ বেলাভূমিতে অক্ষত অবস্থায় অবতরণ করতে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে এবং প্রতিদ্বন্দীতামূলক গান গায়। অ্যাঞ্জেলা কার্টারের নাইটস অ্যাট দ্য সার্কাস  এর নায়িকা ট্রাপিজ শিল্পী, যার নাম ফেভারস; তার জমকালো পালকগুচ্ছ শুধু মঞ্চের পোশাক নয়, তার উড়তে পারার ডানাও বটে। জনেট উইনটারসনের সেক্সিং দ্য চেরি  তে ভাসমান অধিবাসীদের ভাসমান নগরী থাকে — “গুটিকয়েক সরল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া গেলো যে যেসব লোক মাধ্যাকর্ষণকে পরিত্যাগ করেছে, মাধ্যাকর্ষণ তাদের পরিত্যাগ করেছে।” আর দ্য বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং এর এ প্যাসেজে লেখক দাবি করেন যে একদল নর্তক-নর্তকীকে বাতাসে উড়ে ভেসে যেতে তিনি দেখেছেন।

অনেক তরুণ চেক যারা ১৯৪৮ সালের সাম্যবাদী অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলো, তাঁদের মধ্যে মিলেন কুন্ডেরা একজন ছিলেন যিনি আশাবাদী ছিলেন যে এতে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের চমৎকার এক নতুন বিশ্বের সূচনা হবে। শীঘ্রই তার মোহভঙ্গ হলো, “কিছু একটা বললেন যা না বললেই অনেক ভাল হতো,” আর দল থেকে বহিস্কৃত করা হলো। তাঁর পরবর্তী অভিজ্ঞতাগুলোই তাঁর চমৎকার প্রথম উপন্যাস, দ্য জৌক (১৯৬৭) এর ভিত্তি নির্মাণ করে। দ্য বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং (১৯৭৮) এ তিনি যুদ্ধ পরবর্তী চেক ইতিহাসের গণমানুষের বক্রাঘাত ও ব্যক্তিগত ট্রাজেডি নিয়ে আরো আলগা, আরো খণ্ডিত কথনে কাজ করেন যা প্রামানিক দলিল, আত্মজীবনী ও অবাধ কল্পনার মধ্যে মুক্তভাবে চলাফেরা করে।

কথকের মানব সঙ্ঘ এবং দল থেকে বহিস্কৃত হওয়ার বোধ, “নির্ব্যক্তি” হওয়ার বোধ প্রতীকায়িত হয় নৃত্যরত ছাত্র-ছাত্রীদের রিং থেকে তার বাদ যাওয়ার মাধ্যমে, যা দল অনুমোদিত বার্ষিকী রুটিনমাফিক উদযাপন করে। সে সেই বিশেষ একটা দিনকে স্মরণ করে যখন ১৯৫০ সালে “প্রাগের রাস্তাঘাট আবার রিংয়ে নৃত্যরত তরুণদের দিয়ে জনাকীর্ণ হয়। এক রিং থেকে অন্য রিংয়ে ঘুরলাম, সেগুলোর যত কাছাকাছি পারলাম গিয়ে দাঁড়ালাম, কিন্তু আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো।” আগের দিন একজন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ ও একজন পরাবাস্তববাদী শিল্পীকে “রাষ্ট্রের শত্রু” হিসেবে ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো। পরাবাস্তববাদী জ্যাভিস ক্যাল্যান্ড্রা ছিলেন পল এলুয়ার্ডের বন্ধু, সে সময়ে পশ্চিমা বিশ্বে সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত সাম্যবাদী কবি, যিনি তাকে বাঁচিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু এলুয়ার্ড হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানায়: সে ছিলো “সব সমাজতান্ত্রিক দেশ ও বিশ্বের সব সাম্যবাদী দল ঘিরে বিশাল রিংয়ে নাচা নিয়ে এত ব্যস্ত…  ; আনন্দ ও ভ্রাতৃত্বের সুন্দর সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতে এত ব্যস্ত।”

রাস্তাগুলো দিয়ে ঘুরে ঘুরে কুণ্ডেরা হঠাৎ করে দেখতে পান যে এলুয়ার্ড নিজেই তরুণদের একটা রিংয়ে নাচছে। “হ্যাঁ, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাগের টোস্ট। পল এলুয়ার্ড!” আনন্দ ও ভ্রাতৃত্বের উপর এলুয়ার্ড তার অতি উঁচু নৈতিক আদর্শ সম্বলিত কবিতাগুলোর একটি আবৃতি করতে শুরু করে, আর কথন “শুরু হয়”, আক্ষরিক ও রূপকগত– উভয় প্রকারে। নর্তক-নর্তকীদের রিংটা মাটি থেকে উপরে ওঠে এবং আকাশে ভাসতে শুরু করে। এটা তো অসম্ভব ঘটনা। তবুও আমরা আমাদের অবিশ্বাসকে বাতিল করে দেই, কেননা এটি আগের পৃষ্ঠাগুলো জুড়ে গড়ে তোলা আবেগকে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে ও মর্মন্তুদভাবে প্রকাশ করে। রাষ্টের দুজন দাহ করা ভিকটিমের ধোঁয়া যখন আকাশে চড়ে বেড়ায়, তখন একই আকাশে উঠতে উঠতে পাগুলো একসঙ্গে তোলা নর্তক-নর্তকীদের চিত্রকল্পটি কমরেডদের নির্বোধ আত্ম-প্রবঞ্চনা, নিজেদের শুদ্ধতা ও নিস্পাপতা ঘোষণা করতে তাদের যে উদ্বেগ, যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তারা সেবা প্রদান করে তার ত্রাস ও অবিচার না দেখার দৃঢ়প্রতিজ্ঞাকে প্রতীকায়িত করে। কিন্তু এটা সম্মিলিত নাচের আনন্দ অনুভূতি ও নিরাপত্তা থেকে চিরতরে নির্বাসিত লেখকীয় ভূমিকার (persona) ঈর্ষা ও নিঃসঙ্গতাকেও প্রকাশ করে। কুন্ডেরার সবচেয়ে আবেদনময়ী বৈশিষ্ট্যের একটি হলো যে তিনি নিজের জন্য কখনো বীরোচিত শহীদের মর্যাদা দাবি করেন না, আর ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ার সাধারণ মানবিক মূল্যকে কখনো খাটো করে দেখেন না।

আমার জানা নেই মূল চেক ভাষায় এ প্যাসেজটি পড়তে কেমন, কিন্তু অনুবাদেও উল্লেখযোগ্যভাবে কাজ করছে, হয়তো কারণ এই যে এটাকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে মানস চক্ষে দেখা যায়। কুন্ডেরা প্রাগে কিছু সময় ছায়াছবি সম্পর্কে পড়িয়েছিলেন, আর কথক যখন দৌড়াতে থাকে, তখন এরিয়াল দৃশ্য ও কথকের উপরের দিকে সুদীর্ঘ চাহনির মধ্যে যেভাবে এর প্রেক্ষিত বদল হয়, সেই কম্পোজিশনের সিনেম্যাটিক বোধ এ বর্ণনায় প্রদর্শিত হয়। নর্তক-নর্তকীদের ভাসমান রিংটা নিজেই ছবির “স্পেশাল ইফেক্টস” এর মতো। ব্যাকরণগতভাবে উদ্ধৃত অংশটিতে প্রধানত ব্যাপক সুদীর্ঘ একটি বাক্য থাকে; এর উপবাক্যগুলো “শটস” এর সমতুল্য যা সরল অব্যয় আর, এবং, দিয়ে একসঙ্গে প্রবহমান পরম্মপরার গাঁথা যা কথকের নিজের বক্রাঘাত বোধকে নতুবা তার ক্ষতি বোধকে প্রাধিকার প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়। এগুলো একক সূতায় গাঁথা।


আগের পর্ব                                                                                                                             পরের পর্ব




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*