তুষার রোদন

গল্প




তুষার রোদন

-শাহীনুর ইসলাম


সাফায়া কাঁদতেই পারত। হেমন্তের শেষ রাতটিতে অন্তত। কারণ সব প্রকার কান্নার জন্যই তার নির্জন পথের গাড়িটা যুৎসই ছিল। তা সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না হোক কিংবা ডুকরে অথবা গুমরে কান্নাই হোক। কিন্তু সে কাঁদতে পারছে না। তবে তার অন্তরটা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। তবু আমার কাছে একে কান্না মনে হচ্ছে না। চোখে অশ্রুই যদি না দেখি, তবে সেটা কান্না হয় নাকি?

কিন্তু সে তো জানে কী কাঁদন সে কাঁদছে অন্তরে অন্তরে। কান্নার এ রূপ সে আগে প্রত্যক্ষ করেনি কখনো কিংবা তার অভিজ্ঞতায়ও আসেনি। তবে শুনেছে। কিন্তু তা কথার কথা বলে উড়িয়ে দিয়েছে।

দু’বছর আগে সে নিজের জন্মস্থান কুইবেক সিটি ত্যাগ করে অটোয়ায় আসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে। পাশাপাশি গ্যাস স্টেশনে খণ্ডকালীন কাজ করে। শেষের দিকে দলনেতাও হয়। বয়স ছিল তখন বাইশ ছুঁই ছুঁই।

এরও আগে সে ল্যান্ডস্কেপিংয়ের কাজ করেছিল বছর খানেক। এরপর ছয় মাস সেলস এ্যাসোসিয়েট হিসেবে একটা শপিং মলে। মাঝখানে দু’বছর কোনো কাজ করেনি, কোনো সম্পর্কেও জড়ায়নি। সে সময়টায় সে আপন মনে ছবি আঁকত। ছবি আঁকা তার ভাল লাগার সেরা একটি কাজ ছিল। মানুষের মুখের ও আঙ্গুলের স্কেচিং, শরতের বর্ণবাহারে অঙ্কিত ম্যাপল, পাইন, পপলার, সিডার পাতা, টুকরো টুকরো মেঘসহ পরিচ্ছন্ন নীলাকাশ, ঘোড়সরওয়ারসহ ঘোড়া ইত্যাদি আঁকত।

চৌদ্দ বছর বয়সে সুঠাম, বলিষ্ঠ ও সুদর্শন এক সহপাঠি তরুণ প্রথমে তার মন কেড়ে নেয়। নাম ফ্রাঙ্ক। সেই বয়স থেকে তার প্রতি সাফায়া কামনাজাত ভালবাসা অনুভব করে। কিন্তু ফ্রাঙ্ক তার উপর সব প্রকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল বুঝতে পেরে এক বছরের মাথায় সে তাকে ছেড়ে দেয়। তখন সে এটাও টের পায় যে, ফ্রাঙ্ক ড্রাগাসক্ত। এই মাতাল এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাকে হুমকি দেয়। সাফায়া সেটা থানা-পুলিশকে জানায়ও। ফলে ঝুঁকিটা কমে যায়। এরপর কয়েক মাস কিংবা বড় জোড় এক বছর করে একই ধরণের ভালবাসায় চার-পাঁচ জনকে বদল করতে বাধ্য হয় সে। তাদের মধ্যে কেউ চেয়েছিল তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে খর্ব করতে, কেউ চেয়েছিল আবেগের ইচ্ছেমতো ক্রীড়নক করে তুলতে। তবে সেসব তার কামনার তৃপ্তিতে তেমন কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মাঝে মাঝে মনের মধ্যে তবু এক ধরনের অপূর্ণতা কাজ করত। তবে তা তখনো আকার ধারণ করেনি।

গ্যাস স্টেশনে মুনির নামে নতুন একজন যোগদান করলে তার সাথে কয়েক মাস মেশার পর ধীরে ধীরে সে মনের সেই অচিন গন্ধপুরীর নাগাল পায়। মনের মানুষের অনেকটাই মিল খুঁজে পায় তার মধ্যে। তাই এতদিন যেখানে কামনাজাত ভালবাসা রাজত্ব করছিল, সেখানে তখন ভালবাসাজাত কামনা প্রভূত্ব করছিল।

মুনিরকে একটু ভাল লাগে তার। কিন্তু মুনিরের কেমন লাগে তাকে, সেটা সে ঠিক জানে না। কিছুদিন পর মুনির দু’সপ্তাহের ছুটিতে চলে যায়। এ সময়টায় সে সাফায়ার কোনো খবর নেয় না। সাফায়াও কোনো খবর পায় না। অবশ্য খবর চালাচালি করার জন্য যতটুকু ভাব বিনিময়ের প্রয়োজন, ততটুকু ভাব ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে হয়নি।

মুনির যখন ছুটি শেষে আবার কাজে যোগদান করে, তখন সাফায়া এক রকম বলেই ফেলে,

-এ দু’সপ্তাহে তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছ।

-ভুলিনি।

-কোথায় ছিলে এতদিন? কোনো খবর নাই।

-তোমার মনেই ছিলাম। টের পাওনি?

কোনোকিছু না ভেবেই মুনির তখন চটপট উত্তর করে, যেন কথাটা তার জিহ্বার ডগায় প্রস্তুত হয়ে ছিল। আর সাফায়া মুচকি হেসে কথাটাকে যেন লুফে নেয়। নিজে নিজে একটা রাস্তা নির্মাণ করে চলে। যে রাস্তায় সে মুনিরকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়।

সাফায়া জানত ভালবাসাজাত কামনায় ডুবিয়ে এবং ডুবায়ে ষোল কলা আনন্দ আহরণ করা যায়, যেটার সম্ভাবনা সে মুনিরের মধ্যে খুঁজে পায়। কিন্তু কামনাজাত ভালবাসায় আনন্দ সেভাবে আহরণ করা যায় না, যেটা তার জীবনে অতীতে ঘটে গেছে। প্রথমটিতে হৃদয় পুরোপুরি জড়িত থাকে, দ্বিতীয়টিতে তার ঘাটতি থাকে। হৃদয় পুরোপুরি জড়িত থাকে বলে দেহের সব স্নায়ু-কোষ, রক্তবিন্দু এবং মনের সকল চিন্তা-ভাবনা তাকে ঘিরে ঘণীভূত হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে চায় তার ভূমিতে। তবে দ্বিতীয়টি হয়ত সহজলভ্য, কিন্তু প্রথমটি দুর্লভ; আবার এর বিপদ এবং ঝুঁকিও আছে। তা হল সঙ্গী যদি প্রতারণা করে, যদি প্রত্যাখান করে, তবে ডুবিয়ে ডুবিয়ে আনন্দ ডুবিয়ে ভাসিয়ে যন্ত্রণায় ভোগায়। প্রতারণা করে যদি চলে যায়, তাহলে জীবনেই মরণ থাকে অথবা মরণেই মুক্তি থাকে। কামনাজাত ভালবাসার আরেকটা ধর্ম আছে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। স্থির না, যেমনটা এতদিন সাফায়ার হয়েছিল। কিন্তু ভালবাসাজাত কামনা এক পাত্রেই স্থির থাকতে চায়। নির্ভরতায় সুখ খুঁজে পায়।

এরপর ঘটনাটা ঘটার আগের দিন মুনির ঠিক সময়েই কর্মস্থলে এসে পৌঁছে। কাজের পোশাক পরে সেও তার শিফট শুরু করে। দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়। এরপর নীরবতায় কাটে কিছুক্ষণ। থেকে থেকে দু’একজন কাস্টোমার আসে। তাদেরকে সেবা দিয়ে ফাঁকা সময়টা আবার নীরবতায় কেটে কাটে। এক সময় কথা শুরু করার ওজর হিসেবে সাফায়া তার আইফোনটা বের করে। সেখান থেকে কিছু মজাদার ভিডিও দেখায় মুনিরকে। মুনির তাতে মজা পায়। দুজনে তখন বেশ কাছাকাছি আসে এবং ভিডিও দেখার সময় হেসে ওঠে। আবার কাস্টোমার এলে তাদের দিকে মনোযোগ দেয়। তবু অন্যান্য বারের মতো আসল কথাটা বলার আর সুযোগ হয়ে ওঠে না সাফায়ার। এদিকে হাতে সময়ও বেশি ছিল না সেদিন। আর কিছুক্ষণ পর তাকে অফিস কক্ষে ঢুকতে হবে। সেখানে ঘন্টাখানেক হিসাব মিলাতে হবে। তার আগে সে মুনিরকে বলে কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে বাইরে যায়। গাড়িতে বসে নেক্সট সিগারেট ধরায়। এটা-সেটা ভাবে। বিরতি শেষে ফিরে এসে অফিস কক্ষে ঢোকে।

সাফায়া অফিসের হিসাবের কাজ শেষ করে ক্যাশ কাউন্টারে ফিরে আসে। মুনিরকে বলে সে চলে যাবে আটটা নাগাদ। এর মধ্যে বিরতি চাইলে সে নিতে পারে। মুনির পনের মিনিটের বিরতি নিয়ে বাইরে যায়। এর মধ্যে সাফায়া মনস্থির করে এবার সে বলেই ফেলবে কথাটা। মুনির ফিরে আসে বিরতি শেষে। সাফায়া তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে। মুনির সে ভাষা বুঝেও যায়, কিন্তু সাড়া দেয় না। সাফায়া তখন নিজ থেকেই বলে,

-মুনির, আজকে তো আমার শিফট এখানেই শেষ। কালকে তো তোমার কাজ নেই?

-না, নেই।

-তবে আমার আছে সন্ধ্যাবেলায়। আচ্ছা, কাল সকালে কি তুমি ফ্রি আছ?

-হ্যাঁ, বেশ আছি।

-কালকে কি কোথাও ঘুরতে যাবে আমার সাথে?

-যেতে পারি যদি তুমি আমাকে গ্যাটিনো পার্কে নিয়ে যাও। আমার খুব ইচ্ছে ওখানটায় যাওয়ার। ওখানে যেতে হলে গাড়িতে যেতে হয়। আর তুমি তো জানো আমি বাসে চলাফেরা করি। হেমন্তের সব রঙ নাকি ওখানেই দেখতে পাওয়া যায়। যদিও হেমন্তের আর মাত্র কয়েক দিন আছে, তবু রঙের শেষ বাহার নিশ্চয়ই আরো কয়েক দিন থাকবে।

তখন আটটা বাজে। হিসাব মতে সাফায়ার কাজের সময় শেষ হয়। কিন্তু সে আরেকটু সময় ইচ্ছে করেই থাকে। রঙের কথা উঠতেই সে চট করে তার আইফোনে গিয়ে আবার ফেসবুকে ঢুকে নিজের আঁকা দু’বছর আগেকার হেমন্তের রঙে ভরপুর ছবিগুলো এক এক করে দেখায় মুনিরকে। মুনির এক একটা ছবি দেখে আর তার প্রশংসা করে। রঙ, বুনন, আকার, আয়তন, কম্পোজিশন ও দৃষ্টিনান্দনিকতায় ছবিগুলো অপূর্ব লাগে মুনিরের কাছে। ছবি দেখা শেষ হলে সে সাফায়াকে প্রশ্ন করে,

-এখন আর আঁকো না?

-না, এখন তো সময় পাই না।

সাফায়ার শিল্পী মন তার কাছে বোধ হয় কিছুটা হলেও ভাল লেগে যায়। অনুপ্রেরণার বাক্য ছুঁড়ে দিয়ে তাই সে বলে,

-এটা ছেড়ো না কিন্তু। সবাই ছবি আঁকতে পারে না। গত মাসে তোমার আঁকা যে আত্মপ্রতিকৃতিটা দেখিয়েছিলে সেটা এখনো আমার মনে আঁকা আছে। তোমার সামনে এখনো অনেক সময় আছে। এখন আঁকতে সময় না পাও, তো পরে এঁকো। কিন্তু কখনো ছেড়ো না। এগুলো তোমার আত্মার খোরাক যোগাবে। এক সময় এগুলোই থাকবে। আর কিছুই থাকবে না।

সাফায়া কথাগুলো শুনে মনের ভেতর উচ্ছ্বসিত বোধ করে। মনে মনে ভাবে, মুনির আসলে তারই প্রশংসা করেছে, ছবির নয়। উত্তরে শুধু ‘হম’ বলে সে থেমে যায়।

তখন সময় আটটা বেজে বিশ মিনিট। সে চেয়েছে মুনির এর চেয়েও বেশি কিছু বুঝুক। বুঝুক এই যে বাড়তি সময়টা সে সেখানে আছে ঘন্টা প্রতি টাকা ছাড়াই সেটা আসলে কোন উদ্দেশ্যে। কিন্তু মুনিরের কাছ থেকে এর বেশি কিছু ফেরত আসে না। তাই অযথা দেরি না করে সাফায়া কাজের পোশাক বদল করতে চলে যায়। তবুও অন্তত আরেকটা দিন দেখে সে নিশ্চিত হতে চেয়েছে মুনিরের ভেতরকার অনুভূতি কী তার সম্পর্কে। পোশাক বদল শেষে চলে যাওয়ার সময় মুনিরকে বলে,

-কাল তোমাকে কোথায় পিক আপ করতে হবে?

একটু ভেবে মুনির উত্তর দেয়,

-ডাউন টাউনে। ব্যাঙ্ক স্ট্রীট এবং আলবার্ট স্ট্রীটের কোণায় এলে আমার জন্য ভাল হয়।

-ঠিক আছে। তোমার শিফটটা ভাল যাক। বাই। কাল দেখা হবে।

বিদায় জানিয়ে সাফায়া গাড়ি চালিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। চারিদিকে তখন অন্ধকার হয়ে যায়। আলো বলতে ছিল গাড়ির লাইট এবং রাস্তার দুপাশে ল্যাম্পপোস্টের লাইটগুলো। এমন আবহে মুনিরকে নিয়ে ভাবনাটি তার মনে আরো আসন গেড়ে বসে। যেদিন থেকে সে তার হৃদয়ের চরিত্র বদল করেছে সেদিন থেকেই সে অপূর্ণতায় ভুগতে শুরু করেছে, বিশেষ করে যখন থেকে সে হৃদয় কাঙ্খিত আশ্রয় খুঁজে পায়নি। ব্যতিক্রমী হৃদয়ের কষ্টটাও ব্যতিক্রম। শিল্পী মনে যে কোনো আঘাত অনুরণিত হয় একটু বেশিই।

পরের দিন, অর্থাৎ ঘটনার দিন সকালে উঠে গরম পানি মিশিয়ে বাথটবে গোসল সারে সাফায়া। হালকা মেক-আপ করে। নিজেকে যথাসম্ভব মার্জিত সুন্দর করে তোলে। সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ বাসা থেকে বের হয়ে। ব্যাংক স্ট্রীটে দশটার কাছাকাছি পৌঁছালে সে মুনিরকে দেখতে পায়। তাকে গাড়িতে তুলে গ্যাটিনো পার্কে রওয়ানা দেয়। যেতে যেতে পার্ক নিয়ে মুনিরের উচ্ছ্বাসজারিত প্রশ্নের উত্তর দেয় সাফায়া। আলাপ করতে করতে ঘন্টাখানেক পর তারা পার্কে পৌঁছে যায়।

কী অদ্ভূত রঙের মেলা বসেছে সেখানে! হলুদ, কমলা ও লালের নানা বর্ণমাত্রা। ততদিনে বেশিরভাগ পাতাই ঝরে গেছে। কিছু পাতা তখনো বহাল তবিয়তে নিজেদের নানা রঙ জাহির করে বেড়াচ্ছে। গাড়ি থেকে বের হয়ে তারা কিছুক্ষণ পায়চারি করে ঝরা হলুদ, বাদামি পাতাগুলোকে পদদলিত করে। অদূরে জলাশয়ের পানি শ্যাওলা রঙে রঞ্জিত হয়ে ছিল। এর কাছেই একটা বেঞ্চে বসে কিছু পাতা ঝেরে ফেলে। কিন্তু ঠাণ্ডার জন্য বেশিক্ষণ বসা হয় না। দুজনই তখন গাড়িতে বসে ঘুরে ঘুরে বিশাল এই পার্কটির রূপসজ্জা উপভোগ করতে থাকে। পাতার এই বর্ণবাহার দেখতে দেখতে মুনির সাফায়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলে,

-তুমি সত্যি আমার জীবনের এই সময়টাকে অধিক জীবন্ত করে তুললে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, সাফায়া। অন্তত এ জন্য তোমাকে আমি কখনো ভুলব না।

মুনিরের উচ্ছ্বাস এবং ভাল লাগার এই মুহূর্তটি এবং তার প্রকাশভঙ্গি সাফায়ার মনে বিশেষ এক সুযোগের সন্ধান দেয়। সেই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য সাফায়া গাড়িটা থামিয়ে রাখে পার্কের মধ্যবর্তী এক রাস্তার পাশে। থামিয়ে পাশ ফিরে তাকায়। মনের গহীন থেকে সবটুকু রঙ নিংড়ে এনে সে তার দু’চোখে প্রদর্শন করে। স্থির লক্ষ্যবস্তু মুনিরের চোখকে তার চোখে আটকাতে চায় এবং বলে,

-তোমাকে স্বাগতম, মুনির। আমি তোমার সারা জীবনটাকেই জীবন্ত করে রাখতে চাই।

মুনিরের ভাব দেখে মনে হয় সে যেন কিসের গন্ধ পায়। এই বর্ণিল পরিবেশে সাফায়ার উচ্চারণটা যদিও একেবারে যুৎসই ছিল, তবু মনে হয় কিছু একটা তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই হয়তো সাফায়ার ইঙ্গিতের রোমান্টিক কোনো উত্তর দেয় না সে। প্রত্যাশিত উত্তর না পেয়ে সাফায়া তার চোখের দৃষ্টি অন্যত্র ফিরিয়ে নেয়।

ঘন্টাখানেক কেটে যায়। সাফায়া যেন কূল-কিনারা পায় না। অথৈ জলে হাবুডুবু খেতে খেতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এবার তার চাই পারে ঠাঁই। সে সব বুঝতে পারে। তাই মুখ ঘুরিয়ে সরাসরি কিছু প্রশ্নের ফয়সালা করতে ভূমিকা ছাড়াই মুনিরকে বলে,

-আচ্ছা, আমার উপর কি তোমার বিশ্বাস নেই?

-হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? বিশ্বাস না করলে তোমার সাথে এখানে আসতাম?

-এখানে আসতে একটা ছেলের জন্য বিশ্বাস লাগে না। একটা মেয়ের সঙ্গই যথেষ্ট।

-তার মানে একটা মেয়ে পেলেই আসতাম? শোনো, সাফায়া আমি সবার সাথে মিশি না। তোমার ও ধারণা ভুল। তোমার সাথে আসতে চেয়েছি কেন শুনতে চাও?

সাফায়া কিছু না বলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মুনির আবার যোগ করে,

-তোমার সাথে আমার কিছু মিল আছে। সেটা হল তুমি ছবি আঁকো, যেটা আমার খুব ভাল লাগে। আর আমি ছবি তুলি। তুমি দৃশ্য, ধারণা তৈরি করো। আর আমি সাধারণত সেসব তোলার জন্য অপেক্ষা করি। তুমি যোগ করো, আর আমি বাদ দেই। দুটোই শিল্পের প্রয়োজনে। মাধ্যম ভিন্ন তাই উপায় ভিন্ন। কিন্তু চিন্তাসত্ত্বা তো একই রকম।

-দেখো, তোমাকে আমি শিল্পের আলোচনা করতে বলিনি। আমি প্রশ্ন করেছি তুমি আমাকে বিশ্বাস করো কি না? আমার বিশ্বাস এতদিনে তুমি তা বুঝতে পেরেছ আমি কিসের কথা বলছি।

মুনিরের এবার এড়ানোর আর কোনো সুযোগ থাকে না। স্বদেশ ছেড়ে এই প্রবাসে সেও অনুভব করে তার একাকিত্ব প্রতিদিন। ভিন্ন সংস্কৃতিতে একটা সত্ত্বার মিল সে সাফায়ার মধ্যেই খুঁজে পায়। কিন্তু এক সাথে থাকার জন্য যে গভীর ঐক্য বা মিল দরকার, যে উপাদানগুলো একত্র বাসের আনন্দ ও স্বস্তি যোগাতে পারে, সেটা বোধ হয় সে খুঁজে পায় না সাফায়ার মধ্যে। তা এই অল্প সময়ে সম্ভবও  না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়ের বিনিময়। তাও যে হবে তারও নিশ্চয়তা খুঁজে পায় না সে। এই ভাবনা মনে হয় তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে রাখে। তার চেয়ে মাঝে মধ্যে এভাবে দেখা হল, কথা হল, ভাব বিনিময় হল, অনুভূতি শেয়ার করা গেল—এটাই সে সত্যিকার অর্থে হয়ত চায়। সাফায়ার মনের অবস্থা দেখে মুনিরের মনে হয় সে খুবই সিরিয়াস। এমন অবস্থায় নীরব থাকলে চলে না। মুনির উত্তরে বলে,

-বিশ্বাস করি, অবশ্যই করি তুমি যেমন করো।

-কী হিসেবে বিশ্বাস করো?

-বন্ধুর মতো, একই চেতনার, একই চিন্তার তীর্থচারী হিসেবে।

-এর চেয়ে বেশি কিছু নয়?

-আপাতত নয়।

-কেন?

-ঈগল পাখি দেখেছ কখনো?

-দেখেছি বই পুস্তকের ছবিতে, ফিল্মে।

-বিশ্বাস হচ্ছে ঈগলের মতো। সব প্রাণির চেয়ে উপরে, সবচেয়ে বড় গাছের মগডালে বসবাস করে সে। যুক্তিও সেখানে হার মানে। বিশ্বাস নিজেই যুক্তিকে খুঁজে নেয়। একবার বাসা বাঁধলে সে বিশ্বাস যতই অমূলক হোক না কেন, তাকে নামানো যায় না নিতান্তই বড় কোনো ঝড়-ঝাপ্টা ছাড়া।

-আমি তো এখন ঝড়-ই। আর তুমি না নিজেকে শিল্পী ভাবো? শিল্পীদের এমন অমূলক বিশ্বাস থাকবে কেন?

-সবারই তা থাকে। কারো মোটা দাগে, কারো চিকন দাগে। খুঁজলে তোমার মধ্যেও পাওয়া যাবে।

এসব তর্ক সাফায়ার কাছে আর ভাল লাগছিল না। তার শিল্পী মন পূর্বাভাষ পায় প্রত্যাখ্যানের অপমান ও প্রত্যাশার অপমৃত্যুর। কিন্তু হৃদয়ের ফাঁদ এমনই যে, সব অপমান, গঞ্জণা সত্ত্বেও সে ফিরে ফিরে আসে। হায়রে! আগেই তো সে ভাল ছিল। কামনার নদীতেই মিলে যেত অনেক কিছুই। পূর্ণতার সাগরে ডুব দিতে গিয়ে সে যে অপূর্ণতার সাগরেই যেন হাবুডুবু খেতে শুরু করে। স্থির হতে গিয়ে যেন আরো বেশি অস্থির হওয়ার পূর্বাভাষ পায়। প্রচণ্ড বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয় সে মনে মনে।

এখন যেতে হবে— বলে হঠাৎ করেই গাড়ি ছেড়ে দেয় সাফায়া। সারাটা পথ আর কোনো কথা বলে না মুনিরের সাথে। নিঃশব্দে নীরবে মুনিরকে শুধু তার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়। এরপর কাজের উদ্দেশ্যে হাতে স্টিয়ারিং, চোখে চিক চিক করা জল ও মনে বিষাদ নিয়ে যাত্রা করে।

যেতে যেতে সে দেখে রাস্তার দুপাশে ম্যাপলসহ অন্যান্য গাছের সারি সবেমাত্র সব পাতা ঝরিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সব ঝরা পাতা এখানে-সেখানে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। সেগুলোর মধ্যে বেশকিছু পাতা রাস্তা বরাবর তারকাঁটার জালে মাথা উঁচিয়ে রেখেছে একটুখানি আশ্রয়ের জন্য। আর এ কাজটি করে হেমন্তের পাগলা হাওয়া। কী যে পাগলা নাচন নাচিয়েছে, ঘূর্ণিপাকে ঘুরিয়েছে পাতাগুলোকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য! এর সব কাহিনি এতদিন তার জ্ঞানে ছিল, অভিজ্ঞতায় ছিল, ছিল না শুধু তার বোধে ও অনুভবে। গাড়ি চালাতে চালাতে তার বোধে ও অনুভবে তখন সব কিছু সিসি ক্যামেরার মতো ধরা পড়ে অত্যন্ত গোপনে।

এ সময় তার মনটাও আশ্রয় খুঁজে ফেরে হেমন্তের ঝরা পাতাগুলির মতো। একে একে মনে পড়ে বিগত কয়েক মাসের নিঃসঙ্গতাজাত ফাঁপর থেকে মুক্তির জন্য নিবেদিত সকল আকুতির নীরব প্রত্যাখ্যান। কিন্তু যতই রঙিন হোক, ঝরা পাতা ঝরাই থাকে। তার আশ্রয় যে ধুলোয়। পায়ের তলায়। এক সময় ক্ষয়িত হয়ে মাটির বুকে।

বিষন্ন মনে সাফায়া স্টেশনে পৌঁছে যায়।

***

কর্মস্থলে পৌঁছে সাফায়া দেখতে পায় তার সহকর্মী বেইলিকে। বেইলি তার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। এখন অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার। তার সাথে অনেকটাই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সাফায়ার। কুশল বিনিময় হিসেবে বেইলি জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছিস রে তুই?

-‘ভাল। তুমি?’, ম্লান হেসে সাফায়া উত্তর দেয়।

তখন কয়েকজন কাস্টোমার এক সাথে এসে ভিড় করে। ফলে তাদের মধ্যে কথোপকথন ঐ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। সাফায়া কাজের পোশাক পরে কাজে নেমে পড়ে। আধা ঘন্টা পর কাস্টোমারদের ভিড় একেবারে কমে যায়। পনের মিনিট পর পর দু’একজন আসে। এই ফাঁকা সময়টায় তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলে। সাফায়াকে সেদিন একটু অন্য রকম দেখতে পেয়ে বেইলি উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-সত্যি ভাল তো?

সাফায়া আর লুকাতে পারে না। কারো সাথে শেয়ার করতে চায় তার মনের যন্ত্রণা। আর বেইলি যখন তাকে নিজেই জিজ্ঞেস করে, তখন তাকে কিছু বলা যায় মনে হয় সাফায়ার। হাজার হলেও তাকে তো দুই বছর ধরে চেনে। অনেক কিছু নিয়েই কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথাবার্তা হয়েছে। তাই ভাল কি মন্দ ছিল তার উত্তর না দিয়ে সে পাল্টা প্রশ্ন করে,

-আচ্ছা, মানুষকে আমরা নিজের ঘরে দাওয়াত করে খাওয়াই কেন?

-সবাইকে তো খাওয়াই না। যাদের একান্ত আপন মনে করি তাদেরকেই ঘরে এনে খাওয়াই। কেন কোনো পার্টি ছিল নাকি?

-না, পার্টি নয়।

-তবে…?

-সেই নিমন্ত্রিত ব্যক্তির দ্বারা যদি ঘরের কোনো জিনিস খোঁয়া যায়?

-সেটা তো বিশ্বাসের ব্যাপার। তাকে বিশ্বাস করলেই না ঘরে আনার প্রশ্ন আসে।

-ধরো বিশ্বাস করেই আনা হল।

-তখন যদি কিছু খোঁয়া যায়, তাহলে তো কিছু করার নেই। তাই বলে যাকে বিশ্বাস করি তাকে ঘরে আনা যাবে না এরও কোনো মানে নেই। এটা নির্ভর করে তুই কীভাবে চিন্তা করছিস, কাকে নিয়ে চিন্তা করছিস তার উপর।

-তার মানে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিটির দ্বারা যদি ঘরের কোনো ক্ষতি হয়, তাতে যার-পর-নাই আহত হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

-হ্যাঁ, একদম ঠিক। সমস্যা হল আমরা ওভাবে ভাবতে পারি না। যদিও জানি পানিতে জীবন বাঁচে সেই পানিই আবার কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বলে তো আর আমরা পানি পান করা বন্ধ করি না। যে বিদ্যুৎ ছাড়া সভ্যতা অচল, একটু অসাবধান হলেই সেই বিদ্যুৎই আবার জীবনের অন্ধকার ডেকে আনে। সব জিনিসেরই নেতিবাচক দিক থাকে, বিশেষ করে যা খুব বেশি পজিটিভ তা-ই এক সময় খুব বেশি নেগেটিভ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। একে আমরা অস্বীকার করব কী করে?

-তার মানে নিজের অগোচরেই ক্ষতি করার অধিকার দিয়ে থাকি আমরা নিজেরাই?

-হম, কিন্তু এমন ধরনের কথা বলছিস কেন তুই আজকে? আসলে কী হয়েছে খুলে বল। তাহলে আমি পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারব। অবশ্য যদি বলা যায়..

হঠাৎ দু’তিনজন কাস্টোমার আসে গ্যাসের দাম মেটাতে। তাদের কথায় ছেদ ঘটে। কাস্টোমারদের বিদায় দিয়ে সাফায়া তখন ভূমিকাবিহীন শুরু করে,

-কাউকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতে নেই।

-হা-হা-হা! হৃদয় ছাড়া ভালবাসা হয় নাকি জানতাম না তো।

-হয় হয়। ওটাকে বলতে পারো কামনাজাত ভালবাসা।

-কিন্তু আমি যদ্দূর জানি তোর আগেও কয়েকটা ব্রেক আপ হয়েছে। তুই তো বলেছিলি তখন তোর তেমন কিছু মনে হয়নি। তা এখন কী এমন হল?

 -ঐ যে একটু আগে বললাম না…হৃদয় দিয়ে ভালবাসতে নেই। চরম পজিটিভ জিনিস চরম নেগেটিভে পরিণত হয়। তুমিই তো বললে। আমারও তা-ই মনে হয়। কাউকে ভালবেসে হৃদয়ে স্থান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাকে এক ধরনের অনাকাঙ্খিত অধিকার প্রদান করে থাকি সেই হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করার। অনেকটা যেন বুকে বসিয়ে দাঁড়ি ছেড়ানোর মতো।

-হম, এজন্যই আবারও বলি কাউকে সেই রকম অবস্থানে বসানোর আগে এই ভেবে প্রস্তুত থাকা ভাল যে, জলাশয়ের পানি যেমন হরিণীর তৃষ্ণা মেটায়, সেই পানিতেই কিন্তু প্রাণ-হননকারী কুমির ওঁৎ পেতে থাকে। যে পানি প্রাণ বাঁচায় সেই পানিই আবার প্রাণ হরণ করে।

-কিন্তু পানি পান করার সময় যেমন হরিণীর অন্য কিছু মনে থাকে না, আমাদেরও তো অন্য কিছু ভাবার সময় থাকে না। ভাবলেও সেটা তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না।

-তাহলে তো কুমিরের পেটেই যেতে হবে।

সাফায়া আর কথা বাড়ায় না। যুক্তিতে সে বোঝে, কিন্তু তার আবেগী অবুঝ মনটা কিছুতেই বুঝতে চায় না। দু’বছর ধরে স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে তার শিল্পী মনটা দুর্বলতর হয়ে পড়েছিল। শিল্পীর আশ্রয় কি শুধুই শিল্প? প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য তারই সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ শিল্পীর মন থাকে তুষারের মতো নরম, সামান্য আঘাতেই সে মিইয়ে যায়। প্রিয় মানুষটাকে না পেলে সাধারণ হৃদয় বরফ কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু শিল্পী হৃদয় চিরদিনই তুষার-নরম থাকে। আর সেটাই তাকে আজীবন ভোগায়। গলতেও দেয় না, কঠিনও হতে দেয় না।

বেইলি অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তবে সাফায়ার বিষন্নতা তাকেও স্পর্শ করে। উপলব্ধি করে কোনো ব্রেক আপ হবে এবং তা বিপরীত পক্ষ থেকেই। সান্ত্বনা হিসেবে সে আবার যুক্তিকেই হাজির করে বলে,

-সাফায়া, আমরা বাস্তবতার সাথে অনেক সময়ই মিল রেখে চলি না। এই জন্য আমাদের অনেক ভুগতে হয়। এই যে আমাদের এত সুন্দর সুন্দর দেহ আত্মার সাথে যার নিবিড়, অচ্ছেদ্য সম্পর্ক এবং যাদের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিক্রিয়ার ফলে আমরা মানুষকে চিনি, কথা বলি, ছুঁয়ে যাই, সম্পর্ক করি, নানান ডাকে সাড়া দেই, জগতের যাবতীয় কাজ কর্ম করি। সেই দেহকে ছেড়ে আত্মাও একদিন চলে যায় যেদিন দেহকে আত্মা অস্বীকার করে। আর সেখানে তো কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছর ধরে চেনা-জানা কিংবা খুব করে ভালবাসা একজন মানুষ!

বেইলির যুক্তি সাফায়া বাস্তব বিবেচনা করলেও পাল্টা যুক্তি দেয় সে,

-কিন্তু তখন তো আর চেতনা বলে কিছু থাকে না। তাই সে চলে যাওয়ায় কষ্ট, যন্ত্রণা কিছুই আর অনুভব হয় না তখন নিজের কাছে।

রাত আটটা বাজে। মুনিরের এ সময় টেক্সট বা ফোন করার কথা ছিল। তাই বেইলির সাথে এতক্ষণ কথা চালিয়ে গেলেও সে ঘন ঘন সময়ের দিকে তাকাচ্ছিল। আটটা থেকে এক সময় নয়টা বেজে যায়। কিন্তু মুনির কোনো খবর পাঠায় না—না টেক্সট করে না ফোন করে।

বেইলির শিফট শেষ হলে সে সাফায়াকে বিদায় জানিয়ে এবং মন খারাপ করে না থাকতে বলে চলে যায়। এতক্ষণ বেইলি ছিল কাজে তেমন ভুল হয়নি সাফায়ার। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর সাফায়া অন্যমনস্ক হয়ে থাকে পুরো সময়টাই এবং এর প্রভাব পড়ে তার কাজে। বেশ কিছু হিসেবে ভুল করে বসে সে। রাত এগারটায় শিফট বদলের হিসেবে সেটা ধরা পড়ে।

শিল্পী মন ক্রান্তিদর্শী ও আচ্ছন্ন ধরণের হয়ে থাকে। তাই একটা ভাবনাই তার মনে বাজছিল তখন। মুনির তাহলে এড়াতে চায় তাকে। গ্যাটিনো পার্ক থেকে ফেরার সময় সে বলেছিল সিদ্ধান্তটা জানিয়ে কল করবে, নয়ত টেক্সট পাঠাবে। সেটা তো দূরে থাক সৌজন্যবশত একটা মেসেজও দিল না। প্রত্যাখানের এ সুর তার মনের বেহালায় বাজে করুণ হয়ে, বাজতেও থাকবে হয়ত আজীবন। তবু তার ভেতরকার ইগোটা মাথা চাড়া দিয়ে এবার। আর কোনো আকুতি নয়, নয় কোনো নিবেদন।

আর কয়েক দিন পর পঞ্জিকার হিসেবে শীতের তুষার রোদন শুরু হওয়ার কথা। তার আগাম সূচনা হয় সাফায়ার মনে। ভালবাসার কান্না অশ্রু হয়ে বেরোয়, কিন্তু প্রত্যাখান কিংবা অপমান মিশ্রিত হৃদয়জাত ভালবাসার কান্নায় অশ্রুটুকু বুকেই আটকে থাকে। অশ্রু হয়ে বেরোনোর সুযোগটুকু থাকে না। ঠিক যেমন তুষারপাত হওয়ার পর অনেকদিন তা বরফ হয়ে পৃথিবীর বুকে চেয়ে থাকে সূর্যের উষ্ণতার জন্য।

কাজ শেষে নির্জন পথে বাসা যেতে যেতে উপলব্ধি করে শীতপ্রধান অঞ্চলের অশ্রুবিহীন, শুকনো তুষার রোদন। সবাই বলে শীতের তুষারপাতের কথা, কিন্তু সে যে আকাশেরই শুকনো অশ্রুপাত তা কান পেতে না শুনলে বোঝা যায় না, যেমনটা সে আগে কখনো বোঝেনি।

সাফায়া তার হৃদয় ভেঙ্গে আরো উপলব্ধি করে কামনাজাত ভালবাসা মেটানো যত সহজ ভালবাসাজাত কামনা মেটানো তত কঠিন। হয়ত দুর্লভ। নির্জন পথে গাড়ির আওয়াজ ঠেলে-ঠুলে বেইলির অনেক কথার মধ্যে শুধু একটা কথাই কানে বাজে তার, ‘আগুনে পোড়া হাত ঠাণ্ডা পানি ভেবে আবার গরম পানিতেই চুবিয়েছিস তুই, সাফায়া!’


*তুষার রোদন*




Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*